শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস: রগ কাটা থেকে গোড়ালি by প্রতীক বর্ধন
আবারও রক্ত ঝরল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
না, এবার আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের হামলায় নয়৷ এবার ছাত্রলীগের হামলায়
গোড়ালি খোয়ালেন ছাত্রশিবিরের এক নেতা, পরে আবার তাঁকে গুলিও করা হয়।
শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সিঁড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে৷ সে ভবনের নিচতলায় তখন ইংরেজি
বিভাগের কোনো এক বর্ষের পরীক্ষা চলছিল৷ চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটতে দেখে অনেক
ছাত্রই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন, এমনকি অনেকে স্নায়ুরোগেও ভুগছেন
বলে জানা গেছে৷ সেই ভবনের সামনে পুলিশ থাকলেও তারা এগিয়ে আসেনি৷
ছাত্রশিবির আগে যখন ছাত্রলীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের
নেতা-কর্মীদের হাত-পা কাটত, তখনো পুলিশ কোনো দিন কাউকে বাঁচাতে এগিয়ে
আসেনি।
১৯৮০-এর দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুরূপ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও হামলার মাধ্যমে ইসলামী ছাত্রশিবির জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। এই ভীতিই তাদের আধিপত্য বিস্তারের পথে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে প্রকাশ্য দিবালোকে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জামিল আক্তারকে ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। এ ঘটনার পর থেকে রগ কাটা সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায় ছাত্রশিবির। একই বছর ১৭ জুলাই ভোররাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ঘুমিয়ে, ঠিক তখন বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা হলে হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ুব আলী খান, সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল ও হল সংসদের ভিপি নওমাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়।
১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তাণ্ডবলীলা চালায় শিবিরের ক্যাডাররা। তারা ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপনসহ পঁাচজন ছাত্র নিহত হন। একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বহিরাগত সশস্ত্র শিবির কর্মীরা শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্র মৈত্রীর নেতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের ক্রিকেটার জুবায়েদ চৌধুরীকে হাত-পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।
দুর্ভাগ্যজনক যে গত তিন দশকে এসব হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি। হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো পুলিশের চোখের সামনেই হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি খুবই ভয়াবহ। এতে মানুষের মধ্যে একধরনের অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়। মানুষ ধীরে ধীরে অন্যায়কে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিতে শুরু করে। তখন অপরাধ হওয়াটাই স্বাভাবিকে পরিণত হয়। প্রকাশে্য শিবির নেতার গোড়ালি কেটে ছাত্রলীগ জানান দিল, তাদের রোখার কেউ নেই৷
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বাঙালির গৌরবময় অর্জন ভাষা আন্দোলনেও ছাত্রসমাজ উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, সেদিন ছাত্ররাই প্রথম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ জানান ছাত্ররাই।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্রসংগঠনগুলো একে অপরের সঙ্গে আদর্শিক লড়াইয়ে না নেমে পেশির লড়াইয়ে নেমেছিল, যা এখনো চলছে৷ পুরো আশির দশেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। ফলে এই দায় যেমন জামায়াতে ইসলামীর, তেমনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও কম দায়ী নয়৷ এমনকি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেও সংঘাত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো শিবির ঠেকানোর নীতি গ্রহণ করেছিল। জামায়াত বা শিবির রাজনীতি করবে কি করবে না, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার৷ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, যা এখনো প্রযোজ্য৷ কিন্তু তা না করে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের ঠেকানোর লাইন নিয়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো আত্মঘাতী পথ বেছে নেয়৷ আর শিবির তাদের আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষও হয়েছে, তাতে যেমন প্রগতিশীল ছাত্রকর্মীরা মারা গেছেন, তেমনি ছাত্রশিবিরেরও নেতা–কর্মীরা মারা গেছেন৷ স্বৈরাচার এরশাদের মদদেই শিবির এসব ঘটিয়েছে৷ এরশাদ তঁার স্বৈরশাসন বজায় রাখতে এদের ব্যবহার করেছেন, এদের লেিলয়ে দিয়েছেন প্রগতিশীলদের ওপর৷ বলা বাহুল্য, তারপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই এদের ব্যবহার করেছে৷
প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোকে হটিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে ছাত্রশিবির এই নৃশংসতার পথ বেছে নিয়েছিল৷ ছাত্রসমাজের মধ্যে তাদের রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় তারা এ পথ বেছে নেয়৷ ফলে তাদের হাতে একসময় প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর বহু নেতা-কর্মী মারা পড়েন, অনেকে পঙ্গু হন৷ ১৯৯০ সালের পর প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ধীরে ধীরে প্রভাব হারিয়ে ফেলে৷ তারপর ছাত্রলীগই হয়ে ওঠে ছাত্রশিবিরের প্রধান লক্ষ্য৷ ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ই ছাত্রশিবির ব্রাশফায়ার করে চট্টগ্রামে আটজন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করে৷ এ ছাড়া ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী শিবিরের হাতে মারা পড়েন৷
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ অনেক ক্যাম্পাস থেকেই ছাত্রশিবিরকে বিতাড়িত করে৷ িশবিরও এর প্রতিশোধ নিয়েছে বিভিন্ন সময়৷ অন্যদিকে ছাত্রলীগও নিজেদের মধ্যে অনেক মারামারি-কাটাকাটি করেছে৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা থেকে ফেলে দিয়ে নিজ দলের কর্মীকে মেরে ফেলেছে ছাত্রলীগ৷ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও উপদলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছেন ছাত্রলীগের দুই কর্মী৷ সর্বশেষ চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় ছাত্রলীগের চঁাদাবাজি, দখলবাজি ও টেন্ডারবাজির খবর প্রকাশিত হয়৷
উল্লেখ্য, জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনামলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু গত আড়াই দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আমলে দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যে ছাত্র প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র সংসদকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল, সেটাও কমে আসে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারাও নির্বাসিত প্রায়৷ শুধু শিক্ষাঙ্গনেই নয়, দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ ধারা দেখা যায়।
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস হলে এর ভুক্তভোগী হন সাধারণ ছাত্ররাই। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের কারণে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ ফলে ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হবে৷ এ রকম ঘটনা অতীতেও ঘটেছে৷ কোনো অভিভাবকই চান না, তঁার সন্তান পড়তে গিয়ে সন্ত্রাসের শিকার হোক, দিনের পর দিন ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাক৷ সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনো চান না তঁাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসের কারণে বন্ধ থাকুক৷ তার পরও সন্ত্রাস হচ্ছে৷ দলীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্য কেউ প্রতিপক্ষের হাত–পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে৷ কেউবা গোড়ালি কেটে নিচ্ছে৷
এর প্রতিকারে রাষ্ট্রের অভিভাবকদের কি কিছুই করার নেই?
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক৷
No comments