বিজয় মেনেছি, আকাঙ্ক্ষা ছাড়িনি by পবিত্র সরকার

গত ১৬ মে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র বদলে গেল। ভারতীয় সংসদের এবারের নির্বাচনে ‘হিন্দুত্ববাদী’ দল বিজেপি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা দখল করল। বিজেপি একাই পেয়েছে ২৮৫টি আসন, যেখানে ২৭২টি পেলেই নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়। এনডিএ, অর্থাৎ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স নামক বিজেপি জোট পেয়েছে মোট ৩৩৫টি আসন। কংগ্রেস মাত্র ৪৪টি আর তার জোট ইউপিএ বা ইউনাইটেড পিপলস অ্যালায়েন্স ৬২টি, অন্যরা সব মিলিয়ে ১৪৬টি। তার মধ্যে পশ্চিমবাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল একাই পেয়েছে ৩৪টি, আর এতদিনের শক্তিশালী বামফ্রন্ট প্রায় ২৯ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র দুটি আসন পেয়েছে। বলাবাহুল্য দাঙ্গাকলংকিত গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভাবিত ব্যক্তিগত সাফল্য এটি। ফলে আগামী পাঁচ বছরের জন্য তিনিই হলেন পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী। চায়ের দোকানের চা বিক্রি করা বালকের জীবন থেকে উঠে আসা ভারতের এই নতুন প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা বর্তাল যে, এর আগেকার খুব কম প্রধানমন্ত্রীরই সে ক্ষমতা ছিল- পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর কথা বাদ দিলে। তার বা তার সরকারের সিদ্ধান্তে বাধা বা বিঘ্ন ঘটাতে পারে বিরোধী পক্ষ, এমন কোনো দুশ্চিন্তা তার রইল না। চায়ের দোকানের সেই বালক, পরে গুজরাটের দাঙ্গার পটভূমিতে সারা পৃথিবীতে এক বিরূপ ভাবমূর্তির অধিকারী সেই মানুষটি এখন শুধু শক্তির বিচারে ভারতভাগ্যবিধাতা নন, তিনি এ উপমহাদেশেরও সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

না, হঠাৎ বদল হল তা বলব না, নিশ্চয়ই বেশ কিছুদিন ধরে তলে তলে ভারতে এ পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল, আমাদের মতো কিছু মানুষ বুঝেও তা বুঝতে চায়নি। আমরা নরেন্দ্র মোদির সভায় বিশাল জনসমাগম দেখেছি, তার গলার পর্দা ওঠা-নামার সঙ্গে হাতের বীরত্বপূর্ণ বিক্ষেপের অতি-অতিনাটকীয় বক্তৃতায় মানুষকে উত্তাল হাততালি দিতে দেখেছি, কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি যে, এই মানুষটি তার প্রার্থীদের সদলবলে জিতিয়ে এনে ভারতের মসনদ এমন অবলীলাক্রমে দখল করবেন। কংগ্রেসের দুর্গ ছিল কয়েকটি রাজ্য, কিংবা কয়েকটি রাজ্য বিজেপিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল- আসাম, মহারাষ্ট্র, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র, বিহার বা তামিলনাড়ু- এগুলোর অনেকটিতেই ধস নেমেছে। বর্তমান লেখক রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী বা ভবিষ্যৎ দৃষ্টিতে একেবারেই আনাড়ি, তাই বোকার মতো সেও ভেবেছিল হয়তো এবারও কংগ্রেস কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে। উত্তরপ্রদেশে মজফ্ফরনগরে দাঙ্গার পর ভারতের বিপুলসংখ্যক মুসলমান কি বিজেপিকে বিশ্বাস করবেন? ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদের ইতিহাস, ২০০২-এ গুজরাটের ইতিহাস কি তাদের কাছে অলীক হয়ে যাবে? কিন্তু আমাদের কোনো হিসাব মেলেনি। সম্ভবত আত্মরক্ষার আরও জরুরি তাগিদ থেকে মোদিকে মুসলমানরাও প্রচুর ভোট দিয়েছেন।
কিন্তু যাদের সংবাদ মাধ্যম বলা হয়, তারা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, এবারে একটা এস্পার কী ওস্পার হবে। ভোটের আগে যেসব জনমত-সমীক্ষা হয় তার সবটাতেই নরেন্দ্র মোদির জয় চিহ্নিত হয়েছে, ক্রমশ তা আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে এবং শেষকালে দুরাগত সুনামি প্রবল উচ্ছ্বাসে ভারতে এসে আছড়ে পড়ে এ দেশকে প্লাবিত করেছে। আমরা নির্বোধের মতো শেষ পর্যন্ত ভেবেছি যে, না খুব বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিছু হবে না। বাংলাদেশে গেলে বাংলাদেশের বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করেছেন কী হতে চলেছে, তখন তাদের ওই বোকার মতোই আশ্বাস দিয়েছি, চিন্তা করবেন না। কিন্তু আমাদের মতো লোকেরা ভাবেনি ইতিহাসের কাছে আমাদের এমন থাপ্পড় খেতে হবে।
২.
থাপ্পড় না হয় খেলাম, কিন্তু আমরা তো আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে বসে সব খুইয়ে বসিনি। আমরা এখন কী আশা করব? কী আশংকা করব? নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের মানুষ বিপুলভাবে জয়ী করেছে, মানুষের এই নির্বাচনকে বুদ্ধিজীবীর উঁচু টিলা থেকে যে চোখেই দেখি না কেন, এ তো অস্বীকার করার জো নেই- আগামী পাঁচ বছরের জন্য এ বাস্তব আমাদের সামনে। কী করবেন মোদি? গুজরাটের দাঙ্গার সময় শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী তাকে যে আকুল হয়ে বলেছিলেন-‘রাজধর্ম পালন করো’- তিনি কি এবার সেই ‘রাজধর্ম পালনের’ একটি দীর্ঘস্থায়ী দৃষ্টান্ত তুলে ধরবেন? এমন আশা কি আমরা করতে পারি? ভারতের সবাই জানে বিজেপি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তার পেছনে ছায়ার মতো আছে সামরিক হিন্দুত্ববাদী এক সংস্থা, যার নাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। তাদের সঙ্গে বিজেপির পার্থক্যের পাঁচিলটা যত মোটা করে দেখানোর চেষ্টা হোক, তাদের যে একই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে তা কারও অজানা নেই। বিজেপি, তারও চেয়ে বড় কথা নতুন প্রধানমন্ত্রী- সেই এজেন্ডাকে কতটা গ্রাহ্য করবেন? ভাই নরেন্দ্র মোদির ওপর সেই আরএসএসের খবরদারি কতটা জারি থাকবে? স্বরাষ্ট্রনীতিতে, বিদেশ নীতিতে, অর্থনীতিতে, প্রজাকল্যাণে, ভারতের দরিদ্র আর বঞ্চিত মানুষের জীবনের পরিবর্তনের প্রকল্পে? এই প্রশ্নগুলোই এখন সবার মনকে তোলপাড় করে চলেছে। তার অগ্রাধিকার কী হবে? ৩৭০ ধারার (ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরের মানুষের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা) অবলুপ্তি, নাকি গ্রামের গরিবদের গৃহনির্মাণ, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা? যে আরএসএসের স্লোগান হল ‘গরবসে কহো হম্ হিন্দু হ্যায়!’, সেই আরআরএস কি মোদিভাইকে আরও চরম হিন্দুত্বের দিকে ঠেলবে? তা হলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তো মুসলমান আরও মুসলমানত্বের দিকে যাবে, মানুষের অবস্থান থেকে দুয়েই ক্রমশ দুই প্রান্তের দিকে সরে যাবে। মাঝখানে যারা কম কম হিন্দু আর কম কম মুসলমান, কিন্তু বেশি করে মানুষ হয়ে পরস্পরের সঙ্গে থাকার কথা ভেবে এসেছে হাজার বছর ধরে, তাদের কী হবে? প্রশ্নের শেষ নেই।
শপথ গ্রহণের দিন মোদি অবশ্যই কিছুটা আশা জাগিয়েছেন। একটা অভিনব কাণ্ড ঘটিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ সার্ক দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের তিনি আমন্ত্রণ করে এমন একটা নাটকীয় সদিচ্ছার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তিনি আগের প্রধানমন্ত্রীদের টেক্কা দিয়েছেন বলা যায়। নওয়াজ শরিফও এসে তার সেই সৌজন্যের চমৎকার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, ফিরে গিয়ে মোদিজির মাকে শাড়ি পাঠিয়েছেন, সঙ্গে আরও উপহার এবং এতে অগভীর হোক, ভঙ্গুর হোক, অস্থায়ী হোক, একটি সদিচ্ছার আবহ যে তৈরি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মন্ত্রী নির্বাচন মোটামুটি ভালোই হয়েছে বলা যায় (এক স্নাতক ডিগ্রির নিচে আটকে যাওয়া স্মৃতি ইরানিকে শিক্ষা বা মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী করায় কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, যে বিতর্ক আমাদের মতে তারা এড়াতে পারতেন)। শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথমেই বাংলাদেশে যাবেন শুভেচ্ছা সফরে, আমি মনে করি মোদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চান, সেটি এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। তিনি নিজেও ভুটানে গেছেন, তারও একটা তাৎপর্য তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশী ছোট হোক, তার যে একটা সমান মর্যাদা আছে এবং আমাদের পরস্পরের স্বার্থ যে একসঙ্গে জড়িত- এ সচেতনতা আমাদের আগেকার অনেক সরকারপ্রধানের ছিল না, তারা অনেক সময় ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিগ ব্রাদার’ (এর বাংলা কি হবে ‘জ্যাঠামশাই’?)- সেই রকম একটু হামবড়া ভাব দেখাতেন, যেটা ভারতের উপকারে আসেনি।
অর্থনীতি নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছে। এ দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কতটা হবে, তার ফলে দেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। এ দেশের কর্পোরেট মহল মোদিজির নির্বাচনে যে উল্লসিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। দূরে আমেরিকা পর্যন্ত বিরূপতা ভুলে গিয়ে খুশির হাসি হাসছে। তাদের বাজার বাড়ানোর জন্য এবার তো তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে, মোদিকে তারা এক্ষুণি আটলান্টিকের ওপর দিয়ে লাল কার্পেট বিছিয়ে ঘরে নেমন্তন্ন করে নিয়ে যেতে চায়। এর পর ভারতে ওয়ালমার্ট গোছের খুচরা দোকানদাররা এসে যাবে না তো? কিছু কিছু কথা তো দুশ্চিন্তাও বাড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভারতের অস্ত্র উৎপাদনে সব বিদেশী বিনিয়োগ হবে। আমি খবরটা দেখে চমকে উঠেছিলাম, ভাবলাম, ভুল দেখছি না তো? তা হলে আবার শুরু হয়ে যাবে সেই হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষের লেনদেন, আগেকার সরকারের কীর্তিকেও তা না ছাপিয়ে যায়। মোদি একটি দুর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছ সরকার ভারতকে উপহার দেবেন বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগ টানতে গেলেই দুর্নীতি খালের কুমিরের মতো ঢুকে পড়বে। কারণ যারা বিনিয়োগ করবে তারা বাইরে উৎকর্ষের প্রতিযোগিতায় নামবে, কিন্তু ভেতরে মন্ত্রী বা আমলাদের ঘুষ জোগানোর প্রতিযোগিতাতেও এই উপমহাদেশে দীর্ঘস্থায়ী নিয়ম মতোই নামবে। স্বচ্ছ ও সৎ প্রশাসনের সেখানেই কবর খোঁড়া হবে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বলেছিলেন, ষাট দিন সময় পেলে দাম-টাম কমিয়ে দেবেন। এখন আর অত নাটকীয় কথাবার্তা বলছেন না, বলছেন পাঁচটা বছর যদি সময় পান, তা হলে ‘অচ্ছে লাগনেওয়ালা’ দিন নিয়ে আসবেন, ‘ফিল গুড’- এর দিন। জানি না আমরা তা দেখে যেতে পারব কি-না। তবে এসেই বিদেশের ব্যাংকে (সুইজারল্যান্ডে বা অন্যত্র) লুকিয়ে রাখা কালো টাকা উদ্ধারের কথা বলে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন। ক’দিন তা নিয়ে আর বেশি কথাবার্তা বলছেন না। বরং একদিন খবর বেরোল, তা নিয়ে নাকি হাজার সমস্যা। আচ্ছা, এ তো বড় হাসির কথা হল! সমস্যা তো থাকবেই। তাতেই যদি এ ‘আয়রনম্যান’ প্রধানমন্ত্রী ঘাবড়ে যান, তাহলে অন্যদের থেকে তিনি আলাদা হলেন কোথায়? তার মতো বিপুল জনসমর্থন নিয়ে এ পর্যন্ত ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী তো আসেননি। তা তার কাছে আমরা একটু বেশি আশা করতে পারি না? অন্যেরা যে সমস্যায় ঘাবড়ে যায়, তিনি কেন তাতে ঘাবড়াবেন? কত লক্ষ হাজার কোটি ডলার বাইরে পড়ে আছে, তার ১০ শতাংশ দেশে আনতে পারলেও ভারতের সব নিরক্ষর শিশুর জন্য পাঠশালা স্কুল বসানো যায়, সবার জন্য হাসপাতাল করা যায়, সবাইকে খাদ্য আর পানীয় জল পৌঁছে দেয়া যায়। মোদিভাই, আপনার মুখে কালো টাকা উদ্ধারের কথাটা একবার যখন শুনেছি, তা আর আপনি আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারবেন না। বলতে পারবেন না, ‘কই? ও কথা তো আমি বলিনি!’
সে যাই হোক, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হোক, পাকিস্তানের মৌলবাদীরা সেখানকার নড়বড়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টায় ব্যর্থ হোক, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা বা ছিটমহলের সম্মানজনক চুক্তি হোক, বাংলাদেশে হিন্দি টেলিমিডিয়ার দৌরাত্ম্য কমুক, সারা উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখ একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখুক। আমি আপনার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না মোদিভাই, কিন্তু দেশের মানুষ আপনাকে অনেক আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে বসিয়েছে, আপনি দেশের মানুষের বিশ্বাস আর আকাক্সক্ষার মর্যাদা রাখুন।
পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক
pabitra37@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.