হুয়ান ইং মেং জিয়া লা- চীনে স্বাগত বাংলাদেশ by আলমগীর স্বপন
টেং শিয়াও জি। চীনের ওরিয়েন্টাল
ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট। মাল্টি
বিলিওনিয়ার। তার সঙ্গে পরিচয় বেইজিং প্রেসিডেন্সিয়াল হোটেলে বাংলাদেশ চীন
ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড কো-অপারেশন ফোরামের মধ্যাহ্ন ভোজসভায়। বাংলাদেশের
সংবাদকর্মী পরিচয় দিতেই তাদের ভাষায় ‘নি হাও’ অর্থাৎ হ্যালো বলে সম্ভাষণ
জানালেন। তার সম্ভাষণে এমন বিনয় ছিল যে, মনে হয়েছে আমার চেয়ে তারই আমাকে
প্রয়োজন বেশি। তাই আমার ঝটপট প্রশ্নের জবাবে অকপটেই বলতে লাগলেন কেন
বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগের টার্গেট? এর প্রমাণও দিলেন কিছুক্ষণ পর। সেখানে
বসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পপার্ক
স্থাপন চুক্তি করলেন বিজিএমইএ’র সঙ্গে। মুন্সীগঞ্জের বাউসিয়ায় ১.২ বিলিয়ন
ডলার বিনিয়োগে তার কোম্পানি ওরিয়েন্টাল নির্মাণ করবে শিল্পপার্ক। যে পার্কে
আড়াইশ’ ফ্যাক্টরি থাকবে। যেখানে কাজ করতে পারবেন ৩ লাখ শ্রমিক। আর এখান
থেকে যে পণ্য উৎপাদন হবে, তা রফতানি করে প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রায় ৩-৪
বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এতক্ষণ চীনা ব্যবসায়ী টেংয়ের সঙ্গে আলাপের যে সারবস্তু তুলে ধরলাম তা শুধু এই বিলিওনিয়ারের বিনিয়োগ ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। চীনা ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এখন বাংলাদেশকে বিনিয়োগের অন্যতম উপযোগী দেশ মনে করে। কম মজুরি, কর্মক্ষম জনশক্তি আর আকর্ষণীয় মুনাফা এক্ষেত্রে তাদের টানছে বলে মনে করেন তরুণ ব্যবসায়ী স্টিভেন ঝ্যাং। ফোরামের ভোজসভায় ঝ্যাং এসেছিলেন তার বাবাকে নিয়ে। বাংলাদেশের সাংবাদিক দেখে এগিয়ে এলেন। জানালেন, বাংলাদেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। এরপর বসে থাকেননি। বাংলাদেশেই ব্যবসা জমিয়েছেন। গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, সি ফুড, পাট ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করছেন বাংলাদেশ থেকে। এরই মধ্যে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি করেছেন। ঝ্যাং জানালেন, তাদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিনিয়োগের পরিস্থিতি যাচাই করতে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০টি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে যাচ্ছে। তার কথা শুনে চীনের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড টেক্সটাইল কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য রোজা ডাডা নিজের উচ্ছ্বাস ঢেকে রাখলেন না। তিনি বাংলাদেশে এক বছর ছিলেন। তার অভিজ্ঞতায় জানালেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর হলে তোমাদের দেশ (বাংলাদেশ) আরও এগিয়ে যাবে, হয়ে উঠবে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি।’
চীনা ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশার এই মানদণ্ডেই বিশ্লেষণ করতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর। সেক্ষেত্রে প্রত্যাশার পারদ যে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বগামী সেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাবটি প্রথমে আলোচনায় চলে আসে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে চীন। চীনা কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগেও রাজি। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের বিনিয়োগ হবে মাত্র ২০ ভাগ। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে জেনেছিলাম, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ও শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এক্ষেত্রে যৌথ ঘোষণা আসতে পারে। তবে এ প্রত্যাশা আর বাস্তব রূপ নেয়নি দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে। এ নিয়ে আমরা সফরেই জানতে চেয়েছিলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে। তারা জানিয়েছেন, যৌথ ঘোষণা হবে সরকার কখনও এমনটা বলেনি। কারণ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস ও জাপানের প্রস্তাবও বিবেচনায় নিতে চায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ আগে দেখা হবে। তাই দুই প্রধানমন্ত্রীর মাঝে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এক্ষেত্রে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তবে চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে গিয়েছিলেন এমন একজন ব্যবসায়ী মনে করিয়ে দিলেন ভিন্ন এক তথ্যও। তিনি বলেন, চীন এরই মধ্যে মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের দ্বিতীয় পছন্দ। তাই চীন তার স্বার্থে হিসাব-নিকাশ করেই এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে। এজন্য গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়ে সহসাই সিদ্ধান্ত আসছে না বলে আশংকা তার। তবে এ নিয়ে ভবিষ্যৎ আলোচনায় যেন বন্দর ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়। কারণ যে দেশই বন্দর নির্মাণ করুক না কেন, নির্দিষ্ট হারে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি যেন চুক্তিতে থাকে- এ কথা বলতে ভুললেন না তিনি।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রস্তাব নিয়ে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি না হওয়া বাংলাদেশের জন্য কতটা ভালো বা মন্দ হয়েছে সেই হিসাবে না গিয়ে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তিও কম নয়। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে চীনের সহায়তা আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যরাতের কূটনীতিতে মুন্সিয়ানা ছিল। চীনের ঐতিহাসিক গ্রেট হলে দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও লি কেকিয়াংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর বিকালের দিকে আমাদের জানানো হয়েছিল দুটি চুক্তি, একটি সমঝোতা স্মারক ও দুটি লেটার অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের বিষয়টি ছিল না। কিন্তু পরে নৈশভোজে শেখ হাসিনা লি কেকিয়াংয়ের কাছে টানেলের বিষয়টি তুলে ধরেন। আর এতে ইতিবাচক সাড়া পান চীনা প্রধানমন্ত্রীর। পরে স্থানীয় সময় রাত ১২টায় এ নিয়ে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়। টানেল নির্মাণে চীন সহজ শর্তে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেবে আর তা নির্মাণ করবে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা করেন, দ্রুত এই টানেল নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যে চুক্তি হয়েছে সেজন্যও টানেলটি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে চীনা উদ্যোক্তারা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। এছাড়া চীন অর্থ সহায়তা দেবে রাজশাহীতে ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্প, ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা নেটওয়ার্ক প্রকল্প, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর দ্বিতীয় রেল-সড়ক সেতু নির্মাণ ও ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং সিঙ্গেল মুরিং প্রকল্পে। আর পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চীনের অর্থ সহায়তা বাংলাদেশের জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া এর আগে প্রতিবছর চীন বাংলাদেশকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিত। এবার তা দ্বিগুণ হয়েছে। এখন থেকে চীন ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান সহায়তা দেবে।
এ সফরে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের বিষয়টিও। চীন সরকারের উদ্যোগে এ করিডোর বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের তৎপরতার প্রশংসা করেছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম-রামু-কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের গুনধুম সীমান্ত পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেললাইন স্থাপনে চীন ৯২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তাও দেবে। আগামী সেপ্টেম্বরে চার দেশের যৌথ সমীক্ষা গ্র“পের সভা হবে কক্সবাজারে। বাংলাদেশ আশা করে, চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার ও ভারত হয়ে চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন হলে এক ইউরোপের মতো এক এশিয়ার স্বপ্ন অনেকটা এগিয়ে যাবে।
চীন সফরে আলোচনায় ছিল দু’দেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। ২০১২-১৩ সালে চীন বাংলাদেশে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার পণ্য রফতানি করেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের রফতানি মাত্র ৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিশাল ঘাটতি কমাতে পাট ও পাটজাত পণ্যে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্র“তি পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেন। এতে চীনা ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহও দেখা গেছে। তবে এ আগ্রহ ধরে রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন চীনের ব্যবসায়ীরা।
তাই চীন ‘হুয়ান ইং মেং জেয়া লা’ বলে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশকে স্বাগত’ জানালেও সম্পর্কের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। চীনের তিয়েন আন মেন স্কয়ারে বাংলাদেশ-চীনের পতাকা যেভাবে উড়তে দেখেছি, সৌহার্দ্যরে যে বাতাবরণ দেখেছি, কূটনীতি ও অর্থনীতির পাটাতনে তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে। আবেগে নয়। দু’দেশের ভাষায় বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্য আছে সংস্কৃতি-আচরণেও। আকাশ-পাতাল ফারাক আছে উন্নয়নের ধরন-ধারণ এবং এগিয়ে যাওয়ার কৌশলেও। কিন্তু এতসব পার্থক্য ঘুচে যায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনীতির কারণে। তাই চীনের কাছে বাংলাদেশের এই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠার সুযোগ নিতে হবে সরকারকে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের অগ্রগতি।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
alm-swapn@yahoo.com
No comments