বিরোধী দলবিহীন সংসদ
বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে এবং ২৯ জানুয়ারি যার অভিষেক হতে চলেছে, তাতে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। জেনারেল এরশাদ বা রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে গেজেট প্রকাশ করে বিরোধী দলের আসনে অভিষিক্ত করার পরেও একে সরকারি-বিরোধী দল বা বিরোধী-সরকারি দল বলেই আমরা জানব। কবি হলে জাতীয় পার্টির অবস্থানকে আমরা ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ বলে বর্ণনা করতে পারতাম। সংসদীয় ব্যবস্থার ইতিহাসে বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কোনো ইতিহাস না থাকলেও আমরা এখন এক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তার আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। তার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে আমরা কতটুকু জ্ঞাত এবং চিন্তিত?
১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম সংসদে সব দলের সম্মতিতে সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং একটি গণভোটের মধ্যে যাতে নাগরিকদের সম্মতি নেওয়া হয়েছিল, তার মর্মবাণীই কি এখন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে? এই বিষয়টি আরও বেশি করে বিবেচনার দাবি করে এই কারণে যে আজকে বিকাশমান এই অবস্থায় তৎকালীন স্বৈরশাসকের ছায়া নয়, তাঁর এবং তাঁর দলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সংসদ, যাতে অধিকাংশ নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ছিল না, তার গঠনই এখন সংসদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে এসে কী ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা করতে চলেছে, তার প্রতিক্রিয়া কী, সেটা গভীরভাবে ভাবা দরকার। এই নতুন পরিস্থিতিতে যাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের অনেকে এই কথা বলার চেষ্টা করছেন যে যেহেতু গত পাঁচ বছরে সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপি কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করেনি, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল থাকা না-থাকায় আদৌ কিছু যায়-আসে না। তাঁদের এই কথার পেছনে তাঁরা যে তথ্যগুলো হাজির করেন, সেটা অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বিএনপি ৭৪ শতাংশ অধিবেশন বর্জন করেছে এবং কার্যত কোনো ধরনের বিতর্কে অংশ নেয়নি।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ৪১৮টি বৈঠকের মাত্র ১০টিতে উপস্থিত ছিলেন। এটি দল হিসেবে বিএনপির এবং সাংসদ হিসেবে খালেদা জিয়ার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বললে সামান্যই বলা হবে। যাঁরা এখন সংসদে বিরোধী দলের না থাকাকে বড় কিছু নয় মনে করছেন, তাঁরা এখানেই আলোচনাটি শেষ করতে চাইবেন। কিন্তু এই তথ্য আমরা কি অতীতে, ১৯৯১ সালে থেকে যত সংসদ বহাল থেকেছে, তার থেকে আলাদা করে বিবেচনা করব? প্রথমেই যেটা স্মরণ করা দরকার তা হলো ১৯৯৬ সাল থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সংসদে বিরোধী দলের আকার ছোট হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে সংসদে বিরোধী দলের আসন ছিল ১৩৯টি, ১৯৯৬ সালে তা হয় ১২০টি, ২০০১ সালে ৭৮টি এবং ২০০৮ সালে ৩৪টি। যদিও এসব আসনসংখ্যা সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না কিন্তু বিরাজমান নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে অনিবার্য বলেই ধরে নিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এও মনে রাখা দরকার, ১৯৯১-৯৬ সালে বিরোধী দল অনুপস্থিত থেকেছে ৩৪ শতাংশ অধিবেশন, ১৯৯৬-২০০১ সালে এই অনুপস্থিতির হার ছিল ৪৩ শতাংশ এবং ২০০১-০৬ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯১-৯৬ সালে ৪০০ বৈঠকের ১৩৫টিতে যোগ দেন, ১৯৯৬-২০০১ সালে খালেদা জিয়া যোগ দেন ৩৮২ বৈঠকের ২৮টিতে, ২০০১-২০০৬ সালে শেখ হাসিনা যোগ দেন ৩৭৩ বৈঠকের ৪৫টিতে। এই তথ্যগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় বাংলাদেশের দুই প্রধান দল, যারা পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের আসনে বসেছে, তারা সরকার চালাতে যতটা উৎসাহী হয়েছে, বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালনে ততটাই অনুৎসাহী হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সংসদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে কমেছে। খুব সোজা ভাষায় বললে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল হিসেবে সব দলই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই প্রবণতার সঙ্গে ক্রমহ্রাসমাণ বিরোধী দলের আসনের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না এবং সরকারি দলের আকার বিরোধী দলের প্রতি তাদের আচরণকে প্রভাবিত করেছে কি না, সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির গবেষকেরা খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বলে চোখে পড়েনি। এই যোগসূত্র খোঁজার বদলে, তার কারণ অনুসন্ধানের বদলে আমরা কি এই শিক্ষা নেব যে বিরোধী দলেরই দরকার নেই? আমরা কি তাহলে ধরে নিচ্ছি যে আজকে যারা ক্ষমতাসীন, তাদের আর কখনোই বিরোধীদের আসনে বসতে হবে না? এই রকম ধারণার ইঙ্গিতই দেশে একদলীয় ব্যবস্থার আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসছে। বিরোধী দলের দরকার নেই এই কথা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার পরামর্শের মতোই শোনায়। মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার সমাধান যত সহজ শোনায় তার পরিণতি ততটাই ভয়াবহ। বরং আমাদের এখন বিবেচনা করা উচিত যে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল কেন তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় এবং এই বৃত্তচক্র ভাঙার পথ কী হতে পারে? সমাধান এটা হতে পারে না যে বিরোধী দলের ধারণাকেই সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দিতে হবে। ২০০১ সালে বিএনপি যদি এই যুক্তি হাজির করত, তা যেমন অগ্রহণযোগ্য হতো, আজকে যাঁরা এই কথাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন, তাঁদের বক্তব্যও ততটাই অগ্রহণীয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের প্রয়োজন কেন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে সংসদীয় ব্যবস্থার এবং
সুস্থ রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এবং সংসদ এবং রাজনীতিতে দলের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে।
আগামীকাল: কেন বিরোধী দল জরুরি
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
সুস্থ রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এবং সংসদ এবং রাজনীতিতে দলের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে।
আগামীকাল: কেন বিরোধী দল জরুরি
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
No comments