আমাদের দুর্দিনের বন্ধু
১৯৭১ সালে শত্রুকবলিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় জাপানে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন জাপানি নাগরিক আমাদের সমর্থনে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও জাপান বাংলা ভাষার শিক্ষক অধ্যাপক ৎসুইয়োশি নারা ছিলেন সেই দলের অগ্রগামী এক সদস্য। সেই সময়ে যে স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশি জাপানে অধ্যয়নরত ছিলেন, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে প্রবাসে জনমত গড়ে তোলায় তাঁরা এগিয়ে এলে অধ্যাপক নারাকে তারা অনুরোধ করেছিলেন তাঁদের সেই দূর প্রবাসের সংগ্রামে সঙ্গে থেকে নেতৃত্ব দিতে। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর যে যোগসূত্র জাপানি এই অধ্যাপকের গড়ে উঠেছিল, তা ছিন্ন হয় মাত্র গত সোমবার, ২০ জানুয়ারি, তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে।
বেশ কিছুদিন ধরে ফুসফুসের ক্যানসারে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট জাপানি সুহূদ। অধ্যাপক নারার জন্ম জাপানের আকিতা জেলায় ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে। আকিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হন এবং সেখানে ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর পর্বের লেখাপড়া শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যান পিএইচডি গবেষণার কাজে। বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সুকুমার সেনের অধীনে ইন্দো-আর্য ভাষার ওপর সেখানে তিনি গবেষণা করেন এবং ১৯৬৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। জাপানে ফিরে এসে টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া-আফ্রিকার ভাষা ও সংস্কৃতি গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৩০ বছর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার শেষে ১৯৯৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তবে এর পরও অধ্যাপক নারা ২০০৩ সাল পর্যন্ত সেইশন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ভাষাতত্ত্বের শিক্ষকতার পাশাপাশি টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাও তিনি শিখিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে অধ্যাপক নারার যোগসূত্রের সূচনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো থেকে, যা অক্ষুণ্ন ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত। ১৯৭৪ সালে জাপান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে তিনি গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষা শেখাতে। সেই সময়ে প্রায় বছর খানেক বাংলাদেশে অবস্থান সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করা দেশটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঢাকায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ লাভকে তিনি বরাবর তাঁর জীবনের প্রধান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করতেন, যে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণা তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে করেছেন। ফলে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা তাঁকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল। কতটা মর্মাহত তিনি হয়েছিলেন তার বর্ণনা আমরা পাই আরেক বঙ্গপ্রেমিক জাপানি নাগরিক, রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগের কাজুহিরো ওয়াতানাবের স্মৃতিচারণায়। কাজুহিরো ওয়াতানাবে তখন ছিলেন টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নারার বাংলা ক্লাসে যোগ দেওয়া ছাত্র। বাংলা তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ভাষাগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে গ্রীষ্মের ছুটিতে বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করা হতো।
১৫ আগস্ট সকালে ক্লাসে গিয়ে তিনি দেখেন বেদনাহত, বিষণ্ন চেহারায় বসে আছেন অধ্যাপক নারা। ছাত্রদের তিনি বলেছিলেন সেদিন কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সেই ঘটনার কথা। জাপানে বাংলাদেশিদের বরাবরের সুহূদ ছিলেন অধ্যাপক নারা। প্রবাসীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে কখনো তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। সেই সঙ্গে কোনো রকম স্খলন চোখে পড়লে এর সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হননি। বাংলাদেশ বরাবর তাঁকে কাছে টেনেছে এবং সেই টান অনুভব করে অনেকবার তিনি বাংলাদেশ সফরে গেছেন। তাঁর সর্বশেষ বাংলাদেশ ভ্রমণ ছিল ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন বিদেশি বন্ধু হিসেবে মৈত্রী সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করতে। আমাদের সৌভাগ্য যে সঠিক সময়ে আমরা তাঁকে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কৃত করতে পেরেছিলাম। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাপান সরকারও সেই একই বছর তাঁকে অর্ডার অব সেক্রেড ট্রেজার পদকে ভূষিত করে।
টোকিও, ২৫ জানুয়ারি ২০১৪
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
টোকিও, ২৫ জানুয়ারি ২০১৪
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments