যে নির্বাচন কমিশনারকে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা সত্যিই ভয় পেতেন
১৯৯০
সালের ডিসেম্বর মাস। দিল্লিতে সেদিন ভীষণ ঠাণ্ডা। রাত প্রায় একটার সময়ে
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী সুব্রহ্মনিয়াম স্বামীর সাদা অ্যাম্বাসেডর
গাড়িটা দিল্লির পান্ডারা রোডের একটা সরকারি বাড়ির গাড়িবারান্দায়
দাঁড়াল।
ওই বাড়িতে তখন থাকতেন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য টি এন শেষন।
হন্তদন্ত হয়ে মি. শেষনের বাড়িতে ঢুকলেন মন্ত্রী।
মি. স্বামী যখন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সেই সময়ে সেখানে ছাত্র ছিলেন মি. শেষন, যদিও শিক্ষকের বয়স ছাত্রের থেকে কিছুটা ছোটই ছিল।
তবে মাঝে মাঝেই দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে শিক্ষক হাজির হতেন ছাত্রের ফ্ল্যাটে।
সেই রাতে কিন্তু মন্ত্রী সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী অত রাতে টি এন শেষনের সরকারী আবাসে খেতে যান নি।
প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের দূত হয়ে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে গিয়েছিলেন তিনি।
প্রাক্তন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে রাজি আছেন আপনি?"
খুব একটা উৎসাহ দেখান নি মি. শেষন। আগের দিন আরেক শীর্ষ আমলা বিনোদ পান্ডেও তাঁর কাছে এই একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
"বিনোদ, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই নির্বাচন সদনে কে যাবে!" জবাব দিয়েছিলেন মি. শেষন।
কিন্তু সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী ছাড়ার পাত্র নন। দুঘণ্টা ধরে তিনি মি. শেষনকে বোঝাতে লাগলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদটা নেওয়ার জন্য।
শেষমেশ মি শেষন বলেন যে কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবেন তিনি।টি এন শেষনের জীবনী 'শেষন- অ্যান ইন্টিমেট স্টোরি'-র লেখক সিনিয়ার সাংবাদিক কে গোবিন্দন কুট্টি বলছেন, "মি. স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পরেই অত রাতে রাজীব গান্ধীকে ফোন করেন মি. শেষন। তখনই একবার দেখা করতে চান তিনি।"
"প্রথমে তো পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা খুব দ্রুতই পেরিয়ে গেল। চকোলেট দুজনেরই খুব পছন্দের জিনিস ছিল। চকোলেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পরে রাজীব গান্ধী মি. শেষনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ গ্রহণের জন্য সম্মতি দিতে বলেন ।"
মি. শেষন রাজীব গান্ধীর এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হন নি।
দরজার দিকে অতিথিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, "দাড়িওয়ালা কিছুদিন পরে সেই দিনটাকে দোষ দেবে, যেদিন তিনি আপনাকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।।"
দাড়িওয়ালা বলতে মি. গান্ধী সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরকে বুঝিয়েছিলেন।
রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই তার সঙ্গে টি এন শেষনের একটু সুসম্পর্ক ছিল।
বন এবং পরিবেশ দপ্তরের সচিব হিসাবে মি. শেষনের কাজে খুশি হয়ে মি. গান্ধী তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন।
তখন থেকেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা। সেই সূত্রেই ভোর রাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে পরামর্শ করতে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন মি. শেষন।
দেব-দেবীর ছবি বার করে দিয়েছিলেন দপ্তর থেকে
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাবে সায় দেওয়ার পরে তিনি যখন নির্বাচন সদনে কাজে যোগ দিলেন, সেই সময়ে তার পূর্বসূরি মি. পেরি শাস্ত্রী নিজের ঘরে অনেক দেব-দেবীর ছবি রেখেছিলেন।
মি. শেষন কাজে যোগ দিয়ে প্রথম দিনই সেই সব ছবি, মূর্তি - সব সরিয়ে ফেলার আদেশ দেন। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন।
কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই কাজের ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রমাণ পাওয়া শুরু হয়।একটা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, "নির্বাচন কমিশন যে কতটা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারত, তার একটা আন্দাজ দিতে পারি। আমারই এক পূর্বসূরি ৩০ টাকা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। একটা বই কেনার জন্য ওই টাকার প্রয়োজন ছিল।"
"সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের লেজুড় বলে মনে করা হত।"
তিনি বলেছিলেন, "আমার মনে আছে, যখন ক্যাবিনেট সচিব ছিল, সেই সময়ে একবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিন যে কোন কোন দিন নির্বাচন করাতে চায় সরকার।"
"আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, এটা আমরা বলতে পারি না। নির্বাচন কমিশনকে শুধুমাত্র এটুকুই আমরা বলতে পারি যে সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত," ওই সাক্ষাতকারেই জানিয়েছিলেন তিনি।
একটা সময়ে ছিল, যখন আইন মন্ত্রীদের ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে হত নির্বাচন কমিশনারদের, যে কখন ভেতর থেকে ডাক আসবে।
"আমি ঠিক করেছিলাম,আমি নিজে কখনও মন্ত্রীর দপ্তরে যাব না। আমাদের দপ্তরে আগে চিঠি আসত নির্বাচন কমিশন, ভারত সরকার - এই ভাবে।"
টি এন শেষন বলেছিলেন, "আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ভারত সরকারের অংশ নই।"
রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরেই সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই তিনি লোকসভা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
শীর্ষ আমলাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁর আমলে
১৯৯২ সালের গোঁড়ার দিক থেকেই ভুল করলেই সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন তিনি। এদের মধ্যে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন নানা রাজ্যের মুখ্য সচিবরাও।
একবার নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব কে ধর্মরাজনকে ত্রিপুরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
তিনি আগরতলা না গিয়ে দপ্তরের অন্য কোনও কাজে থাইল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন।
মি. শেষন দ্রুত আদেশ জারি করেন, "মি ধর্মরাজনদের মতো অফিসারদের বোধহয় ভুল ধারণা রয়েছে যে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দায়িত্বটা একটা বোঝা। পালন করলেও হয়, না করলেও হয়। তিনি যদি মনে করে থাকেন ভোটের কাজের থেকে বিদেশে যাওয়া বেশি জরুরী, এই ভুল ধারণাটা ভেঙ্গে দেওয়ার দরকার আছে।"
"এর জন্য মি. ধর্মরাজনকে কড়া শাস্তি দেওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই রাস্তায় না হেঁটে তার চাকরিজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি - কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে এই গুরুতর বিষয়টির উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।
কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট একজন সরকারি চাকুরের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা দিয়ে তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে।একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করে দিতেন তিনি
মি. শেষনের একের পর এক নির্দেশের ফলে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু তখনও আরও অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল।
১৯৯৩ সালের ২রা অগাস্ট টি এন শেষন একটা ১৭ পাতার নির্দেশ জারি করে। লেখা হয়, যতদিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরকার মান্যতা দিচ্ছে, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না।
"ভারত সরকারের নিজেই এমন কিছু প্রথা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশন তার নিজের সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে অসমর্থ হচ্ছে।"
"তাই নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কমিশনের অধীনে যত নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই সব ভোট প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।
এই নির্দেশের যে প্রবল বিরোধিতা হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার একটি আসনের নির্বাচন হতে দেন নি মি. শেষন, যার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সময়কাল শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে টি এন শেষনকে তিনি 'পাগলা কুকুর' বলে ফেলেন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, "আমরা এতদিন কারখানায় লক আউট জানতাম। মি. শেষনের আমলে তো গণতন্ত্রই লক আউট হয়ে গেল।"
শেষনকে শায়েস্তা করার উপায় বার করল সরকার
টি এন শেষনের একের পর এক নির্দেশে রাজনীতির মহলে শোরগোল আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবারে সরকার ভাবতে লাগল কীভাবে তাকে জব্দ করা যায়।
নির্বাচন কমিশনে আরও দুজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করে দিল সরকার।
মি. শেষন সেদিন দিল্লির বাইরে ছিলেন।
যে দুজনকে নিয়োগ করা হল নির্বাচন কমিশনার হিসাবে, তাদের মধ্যে একজন, এম এস গিল তখন কৃষি মন্ত্রকের সচিব ছিলেন। তাকে গোয়ালিয়র থেকে বিশেষ বিমানে করে উড়িয়ে নিয়ে এসে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
মি. গিল যোগ দেওয়ার আগেই আরেকজন কমিশনার মি. কৃষ্ণমূর্তি কাজে যোগ দিয়ে দিয়েছিলেন।
মি. শেষন যখন দিল্লিতে ফিরলেন, তারপরে অন্য দুজন কমিশনারের সঙ্গে প্রথম বৈঠকটা ছিল বেশ গম্ভীর।
মি. গিল পরে জানিয়েছিলেন যে তিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে মোটামুটি সহযোগিতাই করতেন, তাই তার সঙ্গে সম্পর্কটা মন্দ ছিল না। কিন্তু মি. কৃষ্ণমূর্তি কাজে যোগ দিয়েই রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে তাকে বসার জায়গা দেওয়া হচ্ছে না!দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করার বদলা মি. শেষন নিয়েছিলেন একবার যখন তিনি বিদেশ ভ্রমণে যান, সেই সময়ে।
অন্য দুজন নির্বাচন কমিশনার থাকা সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একজন উপ নির্বাচন কমিশনারকে।
মি. গিল বলেছিলেন, "আমাদের দুজনকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেছন। কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে একজন আমলাকে নির্বাচন কমিশন চালানোর দায়িত্ব দিয়ে দিলেন তিনি। এই বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। আদালতই আদেশ দেয় যে মি. শেষনের অনুপস্থিতিতে আমরা দুজন নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম চালাবো।"
কার সঙ্গে লড়াই করেন নি মি. শেষন?
টি এন শেষন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যতদিন কাজ করেছেন, সেই সময়ে এমন কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না বোধহয়, যার সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে নি!
রাজনৈতিক দলগুলো বা সংবাদমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল 'টাইট নাট শেষন' - তিনি সবাইকে 'টাইট' দিতেন বলে।
এই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল গুলশের আহমেদ বা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব।
মি. শেষনই প্রথমবার বিহারে চার দফায় নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করেন। আর প্রতিটা দফার তারিখ বদলাতে থাকেন।
এম এস গিল, যিনি পরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন, তিনি বলছেন, "মি. শেষনের সব থেকে বড় অবদান এটাই যে তিনি নির্বাচন কমিশনকে 'সেন্টর স্টেজে' নিয়ে এসেছিলেন। তার আগে কেউ তো মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নামই জানত না। আর প্রত্যেকেই নির্বাচন কমিশনকে হেলাফেলা করে চলতো।"
বলা হয়ে থাকে টি এন শেষনই ভারতের নির্বাচন কমিশনকে বলতে গেলে তার সংবিধান স্বীকৃত স্থানে বসিয়ে গেছেন। এখন যে ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটের ব্যাপারে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তা মি. শেষনের আমল থেকেই শুরু হয়।
একদিকে ভোটের প্রতিটা বিষয়ের ওপরে নজরদারী চলতে থাকে, আর ব্যবস্থা হয় শাস্তিরও।
সেই ট্র্যাডিশনই এখনও চলছে।
>>সূত্রঃ বিবিসি
ওই বাড়িতে তখন থাকতেন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য টি এন শেষন।
হন্তদন্ত হয়ে মি. শেষনের বাড়িতে ঢুকলেন মন্ত্রী।
মি. স্বামী যখন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সেই সময়ে সেখানে ছাত্র ছিলেন মি. শেষন, যদিও শিক্ষকের বয়স ছাত্রের থেকে কিছুটা ছোটই ছিল।
তবে মাঝে মাঝেই দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে শিক্ষক হাজির হতেন ছাত্রের ফ্ল্যাটে।
সেই রাতে কিন্তু মন্ত্রী সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী অত রাতে টি এন শেষনের সরকারী আবাসে খেতে যান নি।
প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের দূত হয়ে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে গিয়েছিলেন তিনি।
প্রাক্তন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে রাজি আছেন আপনি?"
খুব একটা উৎসাহ দেখান নি মি. শেষন। আগের দিন আরেক শীর্ষ আমলা বিনোদ পান্ডেও তাঁর কাছে এই একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
"বিনোদ, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই নির্বাচন সদনে কে যাবে!" জবাব দিয়েছিলেন মি. শেষন।
কিন্তু সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী ছাড়ার পাত্র নন। দুঘণ্টা ধরে তিনি মি. শেষনকে বোঝাতে লাগলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদটা নেওয়ার জন্য।
শেষমেশ মি শেষন বলেন যে কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবেন তিনি।টি এন শেষনের জীবনী 'শেষন- অ্যান ইন্টিমেট স্টোরি'-র লেখক সিনিয়ার সাংবাদিক কে গোবিন্দন কুট্টি বলছেন, "মি. স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পরেই অত রাতে রাজীব গান্ধীকে ফোন করেন মি. শেষন। তখনই একবার দেখা করতে চান তিনি।"
"প্রথমে তো পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা খুব দ্রুতই পেরিয়ে গেল। চকোলেট দুজনেরই খুব পছন্দের জিনিস ছিল। চকোলেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পরে রাজীব গান্ধী মি. শেষনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ গ্রহণের জন্য সম্মতি দিতে বলেন ।"
মি. শেষন রাজীব গান্ধীর এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হন নি।
দরজার দিকে অতিথিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, "দাড়িওয়ালা কিছুদিন পরে সেই দিনটাকে দোষ দেবে, যেদিন তিনি আপনাকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।।"
দাড়িওয়ালা বলতে মি. গান্ধী সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরকে বুঝিয়েছিলেন।
রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই তার সঙ্গে টি এন শেষনের একটু সুসম্পর্ক ছিল।
বন এবং পরিবেশ দপ্তরের সচিব হিসাবে মি. শেষনের কাজে খুশি হয়ে মি. গান্ধী তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন।
তখন থেকেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা। সেই সূত্রেই ভোর রাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে পরামর্শ করতে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন মি. শেষন।
দেব-দেবীর ছবি বার করে দিয়েছিলেন দপ্তর থেকে
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাবে সায় দেওয়ার পরে তিনি যখন নির্বাচন সদনে কাজে যোগ দিলেন, সেই সময়ে তার পূর্বসূরি মি. পেরি শাস্ত্রী নিজের ঘরে অনেক দেব-দেবীর ছবি রেখেছিলেন।
মি. শেষন কাজে যোগ দিয়ে প্রথম দিনই সেই সব ছবি, মূর্তি - সব সরিয়ে ফেলার আদেশ দেন। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন।
কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই কাজের ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রমাণ পাওয়া শুরু হয়।একটা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, "নির্বাচন কমিশন যে কতটা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারত, তার একটা আন্দাজ দিতে পারি। আমারই এক পূর্বসূরি ৩০ টাকা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। একটা বই কেনার জন্য ওই টাকার প্রয়োজন ছিল।"
"সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের লেজুড় বলে মনে করা হত।"
তিনি বলেছিলেন, "আমার মনে আছে, যখন ক্যাবিনেট সচিব ছিল, সেই সময়ে একবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিন যে কোন কোন দিন নির্বাচন করাতে চায় সরকার।"
"আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, এটা আমরা বলতে পারি না। নির্বাচন কমিশনকে শুধুমাত্র এটুকুই আমরা বলতে পারি যে সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত," ওই সাক্ষাতকারেই জানিয়েছিলেন তিনি।
একটা সময়ে ছিল, যখন আইন মন্ত্রীদের ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে হত নির্বাচন কমিশনারদের, যে কখন ভেতর থেকে ডাক আসবে।
"আমি ঠিক করেছিলাম,আমি নিজে কখনও মন্ত্রীর দপ্তরে যাব না। আমাদের দপ্তরে আগে চিঠি আসত নির্বাচন কমিশন, ভারত সরকার - এই ভাবে।"
টি এন শেষন বলেছিলেন, "আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ভারত সরকারের অংশ নই।"
রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরেই সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই তিনি লোকসভা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
শীর্ষ আমলাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁর আমলে
১৯৯২ সালের গোঁড়ার দিক থেকেই ভুল করলেই সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন তিনি। এদের মধ্যে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন নানা রাজ্যের মুখ্য সচিবরাও।
একবার নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব কে ধর্মরাজনকে ত্রিপুরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
তিনি আগরতলা না গিয়ে দপ্তরের অন্য কোনও কাজে থাইল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন।
মি. শেষন দ্রুত আদেশ জারি করেন, "মি ধর্মরাজনদের মতো অফিসারদের বোধহয় ভুল ধারণা রয়েছে যে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দায়িত্বটা একটা বোঝা। পালন করলেও হয়, না করলেও হয়। তিনি যদি মনে করে থাকেন ভোটের কাজের থেকে বিদেশে যাওয়া বেশি জরুরী, এই ভুল ধারণাটা ভেঙ্গে দেওয়ার দরকার আছে।"
"এর জন্য মি. ধর্মরাজনকে কড়া শাস্তি দেওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই রাস্তায় না হেঁটে তার চাকরিজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি - কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে এই গুরুতর বিষয়টির উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।
কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট একজন সরকারি চাকুরের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা দিয়ে তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে।একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করে দিতেন তিনি
মি. শেষনের একের পর এক নির্দেশের ফলে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু তখনও আরও অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল।
১৯৯৩ সালের ২রা অগাস্ট টি এন শেষন একটা ১৭ পাতার নির্দেশ জারি করে। লেখা হয়, যতদিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরকার মান্যতা দিচ্ছে, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না।
"ভারত সরকারের নিজেই এমন কিছু প্রথা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশন তার নিজের সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে অসমর্থ হচ্ছে।"
"তাই নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কমিশনের অধীনে যত নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই সব ভোট প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।
এই নির্দেশের যে প্রবল বিরোধিতা হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার একটি আসনের নির্বাচন হতে দেন নি মি. শেষন, যার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সময়কাল শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে টি এন শেষনকে তিনি 'পাগলা কুকুর' বলে ফেলেন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, "আমরা এতদিন কারখানায় লক আউট জানতাম। মি. শেষনের আমলে তো গণতন্ত্রই লক আউট হয়ে গেল।"
শেষনকে শায়েস্তা করার উপায় বার করল সরকার
টি এন শেষনের একের পর এক নির্দেশে রাজনীতির মহলে শোরগোল আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবারে সরকার ভাবতে লাগল কীভাবে তাকে জব্দ করা যায়।
নির্বাচন কমিশনে আরও দুজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করে দিল সরকার।
মি. শেষন সেদিন দিল্লির বাইরে ছিলেন।
যে দুজনকে নিয়োগ করা হল নির্বাচন কমিশনার হিসাবে, তাদের মধ্যে একজন, এম এস গিল তখন কৃষি মন্ত্রকের সচিব ছিলেন। তাকে গোয়ালিয়র থেকে বিশেষ বিমানে করে উড়িয়ে নিয়ে এসে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
মি. গিল যোগ দেওয়ার আগেই আরেকজন কমিশনার মি. কৃষ্ণমূর্তি কাজে যোগ দিয়ে দিয়েছিলেন।
মি. শেষন যখন দিল্লিতে ফিরলেন, তারপরে অন্য দুজন কমিশনারের সঙ্গে প্রথম বৈঠকটা ছিল বেশ গম্ভীর।
মি. গিল পরে জানিয়েছিলেন যে তিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে মোটামুটি সহযোগিতাই করতেন, তাই তার সঙ্গে সম্পর্কটা মন্দ ছিল না। কিন্তু মি. কৃষ্ণমূর্তি কাজে যোগ দিয়েই রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে তাকে বসার জায়গা দেওয়া হচ্ছে না!দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করার বদলা মি. শেষন নিয়েছিলেন একবার যখন তিনি বিদেশ ভ্রমণে যান, সেই সময়ে।
অন্য দুজন নির্বাচন কমিশনার থাকা সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একজন উপ নির্বাচন কমিশনারকে।
মি. গিল বলেছিলেন, "আমাদের দুজনকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেছন। কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে একজন আমলাকে নির্বাচন কমিশন চালানোর দায়িত্ব দিয়ে দিলেন তিনি। এই বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। আদালতই আদেশ দেয় যে মি. শেষনের অনুপস্থিতিতে আমরা দুজন নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম চালাবো।"
কার সঙ্গে লড়াই করেন নি মি. শেষন?
টি এন শেষন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যতদিন কাজ করেছেন, সেই সময়ে এমন কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না বোধহয়, যার সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে নি!
রাজনৈতিক দলগুলো বা সংবাদমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল 'টাইট নাট শেষন' - তিনি সবাইকে 'টাইট' দিতেন বলে।
এই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল গুলশের আহমেদ বা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব।
মি. শেষনই প্রথমবার বিহারে চার দফায় নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করেন। আর প্রতিটা দফার তারিখ বদলাতে থাকেন।
এম এস গিল, যিনি পরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন, তিনি বলছেন, "মি. শেষনের সব থেকে বড় অবদান এটাই যে তিনি নির্বাচন কমিশনকে 'সেন্টর স্টেজে' নিয়ে এসেছিলেন। তার আগে কেউ তো মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নামই জানত না। আর প্রত্যেকেই নির্বাচন কমিশনকে হেলাফেলা করে চলতো।"
বলা হয়ে থাকে টি এন শেষনই ভারতের নির্বাচন কমিশনকে বলতে গেলে তার সংবিধান স্বীকৃত স্থানে বসিয়ে গেছেন। এখন যে ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটের ব্যাপারে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তা মি. শেষনের আমল থেকেই শুরু হয়।
একদিকে ভোটের প্রতিটা বিষয়ের ওপরে নজরদারী চলতে থাকে, আর ব্যবস্থা হয় শাস্তিরও।
সেই ট্র্যাডিশনই এখনও চলছে।
>>সূত্রঃ বিবিসি
No comments