প্রতিশোধ—ছাত্রলীগ স্টাইল! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

এক বছর আগে, ২০১৩ সালের ১৬ জুন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। সেদিন নায়েব হোসাইন খান নামের এক তরুণ শিক্ষার্থীর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে—এই আশঙ্কায় ওই বছরই ১৭ জুন থেকে এক মাসের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। কর্তৃপক্ষ হয়তো ‘টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার’ আপ্তবাক্যের ওপর আস্থা রেখে ভেবেছিল, সময়ের নিয়মেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাদের ধারণা সত্য হয়নি। বরং সাময়িকভাবে সংঘর্ষ স্থগিত রাখার যে কৌশল তারা নিয়েছিল, তাতেই উপ্ত ছিল দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার বীজ।
এক বছর পর হিংসার বর্ষপূর্তি পালন করল ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপ। সেই ১৬ জুন। একই তারিখে একই কায়দায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে শামীম তালহা নামের এক শিক্ষার্থীর হাতের কবজি কেটে প্রতিশোধ নিয়েছে তারা। উত্তেজিত হয়ে নয়, রাগের মাথায় তাৎক্ষণিক বিচারবুদ্ধি হারিয়েও নয়, সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় দিনক্ষণ নির্ধারণ করেই এই আক্রমণ। প্রতিশোধ নেওয়ার এই নমুনা দেখে মনে হয় যেন ছাত্র নন তাঁরা, বিবদমান কোনো আদিম গোত্রের সদস্য, যারা বছরের পর বছর মনের ভেতর বাঁচিয়ে রাখে প্রতিশোধের আগুন। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নেওয়ার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে হাতের কবজি কেটে। এর মধ্যে কেমন যেন হিন্দি-মসালা ছবির প্রভাব বা প্ররোচনাও আছে। একসময়কার সুপারহিট ছবি শোলের খলনায়ক গব্বর সিংয়ের সেই বিখ্যাত সংলাপটি অনেকেরই মনে থাকতে পারে, একজনের হাত কেটে নেওয়ায় আগের নৃশংস মুহূর্তটিতে ক্রূর হাসিতে মুখ ভরিয়ে গব্বর সিং বলেছিলেন, ‘ইয়ে হাত হামকো দে দে ঠাকুর।’ হায়, জঙ্গলের সেই নৃশংসতারই যেন পুনর্নির্মাণ হচ্ছে আজ আমাদের মেধাবী তরুণদের হাতে।
১৬ জুনের ঘটনার পর এক মাসের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঠিক এক বছর আগে যা করেছিল তারা। এ রকম আকস্মিক বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টার মধ্যে একধরনের ‘আপস’ আছে বলে মনে করি আমরা। যেহেতু হামলাকারীদের তাৎক্ষণিক ধরা যাচ্ছে না, আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বা শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না, সুতরাং কয়েকটা দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা। এই প্রক্রিয়ায় বারবার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হচ্ছে, আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন, শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত হচ্ছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি আর বাঁধা হচ্ছে না। সন্ত্রাসীরা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য।
এখানে বলা প্রাসঙ্গিক, হরতাল-অবরোধ–ধর্মঘট বা অন্য যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির সময়ও চুয়েটের ক্যাম্পাস সচল থাকে। নিয়মিত ক্লাস বা পরীক্ষার রুটিনেও কোনো পরিবর্তন আনা হয় না। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যাম্পাসে হরতাল-অবরোধের সময় যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে যানবাহনের অপ্রতুলতা যেমন একটি বড় সমস্যা, তেমনি নিরাপত্তার ব্যাপারটিও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে অভিভাবকদের জন্য।
আবার কর্তৃপক্ষের এই কালাপাহাড়ি মনোভাবের কারণেই যে শিক্ষার্থীরা অন্তত সেশনজট থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, এটা ছিল স্বস্তির বিষয়। কিন্তু বাইরের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তোয়াক্কা না করে ক্লাস চালু রাখার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়ে চুয়েট প্রশাসন যে কঠোর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, সে তুলনায় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দাপটের কাছে অনেক নড়বড়ে মনে হয়েছে তাদের অবস্থান। ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দল ও সংঘর্ষের কারণে বারবার বন্ধ রাখা হয়েছে এই ক্যাম্পাস। গত বছর ১৬ জুনের ঘটনায় মোট নয়জনকে দায়ী করে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরবর্তীকালে আবার দয়াপরবশ হয়ে সেই শাস্তি কোনো ক্ষেত্রে হ্রাস ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মওকুফ
করে দিয়েছে তারা। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’—আজকাল খুবই সাধারণ ও সর্বক্ষেত্রে উচ্চারিত দাবি। বহুল উচ্চারিত বলে এর আলাদা কোনো তাৎপর্যও নেই আর। কিন্তু আমাদের মতো সমাজে শাস্তিদানের বিষয়টিকে যে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপনেরও প্রয়োজন আছে, এ কথা কি এখনো উপলব্ধি করতে পারছে না চুয়েট কর্তৃপক্ষ?
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ২০১১ সাল থেকে চুয়েটে সভা-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ রাখা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একবার সমাবেশ করায় ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আজীবন হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের কর্মীরা নিয়মিত সভা-সমাবেশ করলেও এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এই পক্ষপাতমূলক আচরণই ছাত্রলীগকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে বলে আমাদের ধারণা। বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব কার্যত নেই। প্রতিপক্ষ নেই, তাই নিজেরাই নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। আর বিপন্ন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন।
এই অন্তঃকোন্দল নিরসনের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্যোগও বিফলে গেছে বলে মনে হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার চট্টগ্রামে এসে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি আগের কমিটি বাতিল করে ২৫ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করেছেন তাঁরা। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর নতুন করে সংঘর্ষে জড়িয়ে ছাত্রলীগের এই ক্যাম্পাসের কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি তাঁদের আস্থা ও আনুগত্যকেই অস্বীকার করেছেন।
অন্যদিকে এই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে চুয়েট কর্তৃপক্ষ। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের এই তুঘলকি আচরণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন। এই সংঘর্ষের জের ধরে ৩১ দিন বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। বারবার এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী তা কার্যকর করা হয়নি।
‘ছাত্রলীগ হলে সাত খুন মাফ’—চুয়েটের এই অলিখিত নিয়ম সম্ভবত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও অনুধাবন করতে পেরেছেন ইতিমধ্যে। ফলে নীতি-আদর্শের প্রতি আনুগত্য না থাকলেও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই যেন ছাত্রলীগের কোনো না-কোনো গ্রুপের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছেন অনেকেই। যেমন ২০১৩ সালে যে ছাত্রটির (নায়েব হোসাইন খান) ওপর হামলা করে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিয়েছিল ছাত্রলীগের একাংশ, তিনি তখন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই হোক বা নিরাপত্তার কারণেই হোক, নায়েব হোসাইন এখন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। তার চেয়েও বড় কথা, এ বছরের ১৬ জুন প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও একজন ছাত্রের (শামীম তালহা) কবজির রগ কেটে দেওয়ার ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন অগ্রভাগে। এভাবেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ হচ্ছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে। কারণ, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যেই থাকছে ভবিষ্যতে আরও সংঘর্ষের আশঙ্কার বীজ।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার আগে যন্ত্রকৌশল বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা চলছিল। দুটি পরীক্ষা সম্পন্নও হয়েছে। নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা হলে আসন্ন ঈদের আগেই শিক্ষাজীবন শেষ হতো তাঁদের। এভাবে প্রলম্বিত হচ্ছে শিক্ষাজীবন। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে এই শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠেছিলেন অভিভাবকদের আশা ও আশ্বাস। কিন্তু রাজনীতির নামে কিছু কিছু ছাত্রের হঠকারিতা আর কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে তাঁদের চোখেমুখে আজ আশঙ্কার ছায়া।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.