লিওনেল মেসি এখন রুপালি পর্দারও রাজপুত্তুর
ক্রমশ রূপকথা ও রুপালি পর্দার রাজপুত্তুর
বনে যাচ্ছেন লিওনেল মেসি। পূর্ণ দৈর্ঘ্য হলিউডের ‘রকি’ স্টাইলের চলচ্চিত্র
আসবে আরও পরে। তবে বিশ্বকাপ চলমান থাকতেই প্রামাণ্য ফিল্ম ‘মেসি’র
প্রিমিয়ার হলো গতকাল। তার প্রতি বিখ্যাত স্পেনিশ পরিচালক অ্যালেক্স দ্য লা
ইগলেসিয়া শ্রদ্ধা জানালেন। এটি যেনতেন বা কাঠখোট্টা ধরনের ডকুফিল্ম নয়।
এতেও রীতিমতো সিনেমাটিক স্টাইল গ্রহণ করা হয়েছে। ছোট বেলার মেসি রোজারিও
রাস্তায় ফুটবলে লাথি মারছে। এই দিয়ে এর শুরু।
মেসির ওপর ফিল্ম তৈরি করেছেন, করছেন এবং আরও অনেকেই করবেন। ইতিমধ্যে আরব পরিচালক সাহিম ওমর খলিফা অনেকগুলো নামীদামি পুরস্কার জুটিয়েছেন। তার মুভির নাম ‘বাগদাদ মেসি’। ২০০৯ সালে নির্মিত এই ছবির বিষয়বস্তু মেসি ও রোনাল্ডোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা। কিন্তু তার পটভূমি বাগদাদের ধূসর মরুভূমি। ১০ বছরের ছোট্ট হামুদি মরুভূমিতে ফুটবল খেলছে। আর অবশিষ্ট বিশ্বের মতোই বার্সেলোনা ও ইউনাইটেড মানচেস্টারের মধ্যে কবে চ্যাম্পিয়ন লিগ খেলা হবে সেজন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছে। মেসি ও রোনাল্ডোর লড়াই দেখাই তাদের আকর্ষণ। কিন্তু তখনই হামুদির টিভি সেট ভেঙে গেল। এরপর কাহিনী এগিয়ে চলে।
এই বাগদাদ মেসির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিল দশ বছরের আরব বালক আলি আল জায়েদওয়াই। গত বছর মে মাসে মেসি দোহা সফরে গেলে আলির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। সেটি ছিল ১৯ মিনিটের শর্ট ফিল্ম। এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল ইরাকে রক্তের নহর বইলেও ফুটবলের প্রতি মানুষের যে দুর্নিবার আকর্ষণ তা থমকে যায়নি। আর তার মহানায়ক মেসি। মেসি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা রাষ্ট্রদূত, সে কারণে সম্প্রতি মেসি শিশুদের সঙ্গে করমর্দনে অনীহা প্রকাশের খবরে হৈচৈ হয়।
মেসি এবং অন্যান্য নির্মীয়মান ছবিতে মোটামুটি চার বছর বয়স থেকে মেসির বেড়ে ওঠা চিত্রিত হয়েছে ও হচ্ছে। মেসির ১১ বছর বয়সে ধরা পড়লো যে তিনি হরমোন ঘাটতির শিকার। এফসি বার্সেলোনা তখনই তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। মেসির ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচার যোগান দিয়েছিল। এই প্রামাণ্য ফিল্মে ইয়োহান ক্রাফ, হাভিয়ার মাসসেরানো, পিক, আন্দ্রেজ ইনিয়েস্তা এবং বার্সেলেনো ম্যানেজার মতো তারকাদের মন্তব্য রয়েছে।
তবে গতকাল যখন মেসি ছবির প্রিমিয়ার হলো তখন ম্যারাডোনার সমালোচনামূলক মন্তব্য বাতাসে ভাসছিল। বলেছেন গ্রুপম্যাচগুলোতে আর্জেন্টিনা খুবই খারাপ খেলেছে। সুইসদের সঙ্গে খেলারও প্রশংসা করেননি ম্যারাডোনা। গতকাল ওলে লিখেছে, ‘খেলোয়াড়দের উচিত ছিল অন্য ধরনের একটি খেলা উপহার দেয়া। আমরা তো শুরুই করলাম না। ৪০ ভাগ পর্যন্ত খেলেছে আর্জেন্টাইন টিম। গোলবারের দশটি শট সবটাই স্পাইসি। আমরা একটি মেসি সর্বস্ব টিমে পরিণত হতে পারি না।’
চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেসব বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন তার মধ্যে মেসির অনেক অজানা কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হবে। আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারা আর মেসির জন্ম একই স্থানে। তার পরিবার ইতালীয় বংশোদ্ভূত। মধ্যবিত্ত।
ফুটবলের ‘মোস্ট গিফটেড’ রাজপুত্তুর লিওনেল মেসি তার ২৭তম জন্মদিনে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে যে ‘গোল’ স্থির করেন সেটা অনবদ্য। একজন মানবিক মেসিকেও ফিল্ম নির্মাতারা বিবেচনায় নিয়েছেন। কারণ বিনয়ী মেসি বলেন, ‘অন্য সবার চেয়ে বেশি গোল করা কিংবা ব্যক্তিগতভাবে গোল করে এগিয়ে থাকার চেয়ে আমি আমার টিমের বিজয়ে গৌরবান্বিত বোধ করি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হওয়ার চেয়ে একজন ভাল মানুষ হওয়ার বিষয়ে আমি বেশি উদ্বেগ অনুভব করি। যখন সব কিছুই হারিয়ে যাবে, তখন আপনার সামনে কি অবশিষ্ট থাকবে? আমি যখন অবসর নেবো, তখন আমি আশা করি, একজন শিষ্টাচারসম্মত মানুষ হিসেবে আমি মানুষের মনে বেঁচে থাকতে চাই।’
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ সম্পর্কে মেসি বলেছেন, আপনাকে অবশ্যই বিশ্বকাপে নৈপুণ্য দেখাতে হবে এবং একটি বিশ্বকাপে যে কোন কিছু ঘটতে পারে।
২৬ বছরে মেসি শব্দের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ম্যাজিক শব্দটি সমার্থক হয়ে উঠেছে। পিতা জর্জ হোরেসিও মেসি ছিলেন একটি ইস্পাত কারখানার শ্রমিক। তবে এখন সে পরিচয় ছাপিয়ে এটাই বড় হয়ে উঠবে যে, মেসি উত্তরাধিকার সূত্রে ফুটবলার হয়েছেন। মেসির পিতা জর্জ রোজারিও স্থানীয় যুব ফুটবল টিমের কোচ ছিলেন। তার মানে এক অখ্যাত ফুটবল কোচের ছেলে বিখ্যাত ফুটবলার হয়েছেন। কেবল পিতাই নন, মেসির পারিবারিক পরিবেশও ফুটবলময়।
আর মা সিলি মারিয়া ছিলেন একজন খ-কালীন পরিচ্ছন্নকর্মী। এর আগে ‘ওলে’ জানিয়েছে, গতবারের বিশ্বকাপের মতো নয়, এবারে মেসির পুরো পরিবারই তার সঙ্গে। বাবা-মা, ছেলে থিয়াগো, বউ আন্তোলিনা ছাড়াও দুই ভাই রডরিগো ও মাতিয়াস রয়েছেন। তবে বরাবরের মতোই তারা লো প্রফাইলে আছেন। এমনকি জন্মদিনের কেক কাটার মতো আলোকচিত্র মিডিয়া আসতে দেননি।
মেসির বউ ও তার পরিবার প্রচার বিমুখ। ২০১০ সালে প্রিটোরিয়ায় ওলের অনুরোধে মেসি তার একটি আলোকচিত্র ধারণ করেছিল। কিন্তু ফ্লাশ দিয়ে নয়। সেই ছবি অবশ্য কোথাও ছাপা হয়নি।
মেসি যখন বার্সা এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটলো তার বার্সায়। ১৬ বছরে ফুটবলের শুরু। ৪৬৬ খেলায় ৩৮১ গোল করে তিনি বিশ্বের নন্দিত ফুটবলালের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে চলেছেন। বড় পত্রিকাগুলো ইদানীং একটি প্রবণতা দেখাচ্ছে। তারা বলছে, মেসি সর্বকালের সেরা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। অনেকেই তাকে পেলে ও ম্যারাডোনার চেয়ে মেধাবী ও শ্রেয়তর মনে করেন।
মেসি ২০০৯ থেকে ২০১২- টানা চারবার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খোলোয়াড়ের বিজয় মুকুটে শোভিত হয়েছেন। উপরন্তু ইউরোপের শীর্ষ গোলদাতার খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছেন টানা ছয় বছর। তার এ সাফল্যের, এই বীরত্বের, এই নান্দনিকতার গল্প ফুরোনোর নয়।
আর্জেন্টিনার ফুটবল বাইবেল ওলে মেসির জন্মদিনে লিখেছে, এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল তারকা মেসি ২৭ বছরে পা রেখেছে।
বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির প্রথম চুক্তি নিজেই একটি ইতিহাস। কারণ বালক মেসির নৈপুণ্যে মুগ্ধ কর্তারা হাতের কাছে কাগজ না পেয়ে পেপার ন্যাপকিনে ঝটপট শর্তাবলী লিখে ফেলেছিলেন। এ সময়টায় ধরা পড়ে যে মেসি সুস্থ নন। অপুষ্টির শিকার। তাঁর চিকিৎসা দরকার। বার্সেলোনার হিরে চিনতে ভুল হয়নি। চুক্তি করার জন্য মেসির পুরো পরিবারকে স্পেনে নিয়ে যায়। তখন মেসির বয়স মাত্র ১৩। ২০০৫-২০০৬ সাল থেকে মেসিকে ফার্স্ট টিম সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা দেয়া শুরু হয়। মেসির রয়েছে দু’টো পাসপোর্ট। আর্জেন্টিনা ও স্পেনের।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মেসি স্পেনেরও নাগরিক। তবে স্পেন যখন তার জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে নাম লেখানোর প্রস্তাব দিলো, মেসি তখন তা ফিরিয়ে দিলেন। মেসি হলেন বিশ্বকাপের ষষ্ঠতম কনিষ্ঠ, যিনি বিশ্বকাপে নেমে গোল করতে পেরেছিলেন। তার গতি ও ক্ষিপ্রতার কারণে লিওনেল ও মেসি ছাড়াও তার কিন্তু আরও একটি ডাক নাম আছে। সেটি হল ফ্লিয়া।
স্পেনিশ ফার্স্ট ডিভিশন লীগে মেসি ১৭ বার অংশ নিয়ে ৬ বার গোল করেন। ২০০৫ সালে মেসি আন্তর্জাতিক ফুটবলে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামেন। আর মাত্র ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় তাকে মাঠ ছাড়তে হয়। কারণ রেফারি তাঁকে লাল কার্ড দেখান।
২০০৮ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে মেসি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। একই বছরের গ্রীষ্মে মেসি আরেক মহান ফুটবলার রোনালদিনহোর কাছ থেকে ১০ নম্বর বার্সা জার্সি লাভ করেন। পরের বছরই মেসি ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার ঘোষিত হন। ইংল্যান্ডের ভিভিয়ান উডওয়ার্ড ছাড়া মেসি হচ্ছেন অপর সেরা তারকা যিনি একটি বছরে ক্লাব ও নিজের দেশের জন্য ২৫টি গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
ইরানের সঙ্গে আর্জেন্টিনার শ্বাসরুদ্ধকর খেলায় ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চেপে মেসিপুত্র ও মেসিপত্নী মাঠে এসেছিলেন। মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। দিয়াগো সেদিন মাঠ ছাড়ার একটু পরেই মেসি তাঁর মনমাতানো গোলটি করেন। লন্ডনের গার্ডিয়ান লিখেছিল, ‘এটা সম্ভব হয়েছে কারণ দিয়াগো মেসির চোখের আড়াল হয়েছিলেন বলেই!’ আর ভেনেজুয়েলার টিভি তেলেসুরে দিয়াগো রসিকতা করে বলেছেন, ‘মেসি এটা পেরেছে কারণ সে মেধাবী বলেই। আমার মাঠ ত্যাগের সঙ্গে মেসি গোলের কোন সম্পর্ক নেই।’
তবে সব কিছুর পরেও মেসি জানেন ‘বিশ্বকাপে যা কিছু ঘটতেই পারে’। যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তারাও বিনিয়োগের দিকে নজর দিচ্ছেন। ১৯৮৬ সালের সেই ঝড় তোলা বিশ্বকাপে, একাই এক শ’ হয়ে সোনার কাপ ছিনিয়ে নেয়ার সময় দিয়াগো ম্যরাডোনার বয়স ছিল ২৫। আর মেসি গত ২৪শে জুন ২৬ অতিক্রম করেছেন।
তদুপরি খবর বেরিয়েছে, হলিউড ফিল্মের চিত্রনাট্য তৈরি হচ্ছে। এপিক পিকচার্স গ্রুপের উদ্যোক্তা। ‘মেসি: দি ইনসাইড স্টোরি অব দ্য বয় হু বিকেম এ লিজেন্ড’- লুকা সাইয়োলির লেখা বই অবলম্বনে চিত্রনাট্য হচ্ছে। এর অর্থায়ন ও প্রযোজনা করবে এপিক। এই সংস্থার প্রধান প্যাটরিক ওয়ার্ল্ড এবং শেকড বেরেনসন এখন চিত্রনাট্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন।
No comments