শাবানের মধ্যরজনী ‘শবে বরাত’

হিজরি সনের শাবান চান্দ্রমাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ ‘শাবানের মধ্যবর্তী রজনী’কে উপমহাদেশে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য শাবান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতময় মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) অধিক হারে এ সময় দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাজিল করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন!’ (মুসনাদে আহমাদ) নবী করিম (সা.) শাবান মাসে বেশি নফল রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের রোজা পালন করতে বলতেন। হজরত উসামা বিন জায়েদ (রা.) বলেন, ‘একদা নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তো আপনাকে শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোজা রাখতে দেখি না।’ ... উত্তরে তিনি বললেন, ‘শাবান মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। অনেক মানুষ এ মাসের ফজিলত সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অথচ বান্দার আমলগুলো এ মাসে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হয়। এ জন্য আমি চাই যে আমার আমলগুলো আল্লাহর দরবারে এমতাবস্থায় পেশ করা হোক যে আমি রোজাদার।’ (বায়হাকি) ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে শাবানের মধ্যরজনীটি অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য তাঁর রহমতের দরজা এ রাতে খুলে দেন। রাত জেগে নফল ইবাদত করে নিজের গুনাহখাতা মাফ ও অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন এবং অসংখ্য অনুতপ্ত বান্দাকে পাপমুক্ত করে দেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তাআলা রহমতের ভান্ডার নিয়ে তাঁর সব সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হন এবং মুশরিক অথবা হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’
(তাবারানি) হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। কেননা, প্রতি রাতে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, “কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব।” সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ আহ্বান অব্যাহত থাকে।’ (ইবনে মাজা) মাহে রমজানের প্রস্তুতির লক্ষ্যে শাবান মাসের অন্যতম ঐচ্ছিক ইবাদত রোজা পালন হিসেবে ‘নিস্ফে শাবান’ তথা শবে বরাতের আগে সোম ও বৃহস্পতিবার মিলিয়ে কমপক্ষে দুটি নফল রোজা পালন করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ‘আইয়ামে বিজের’ তিনটি নফল রোজা পালনের জন্য নবী করিম (সা.) অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, ‘যখন তুমি মাসে তিনটি রোজা রাখতে চাও, তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখো।’ (তিরমিজি) হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) আমাদের ‘আইয়ামে বিজের’ রোজা রাখার হুকুম দিতেন, আর আইয়ামে বিজের দিনগুলো হচ্ছে চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ।’ (আবু দাউদ) রাসুলুল্লাহ (সা.) গৃহে অবস্থানকালে বা ভ্রমণরত অবস্থায় কখনো আইয়ামে বিজের রোজা ছাড়তেন না।’ (নাসাঈ) এ অবস্থায় কেউ যদি ‘নিস্ফে শাবান’ বা শবে বরাত পালন উপলক্ষে শাবান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের তিনটি ঐচ্ছিক রোজা রাখেন, তাহলে এর সুবাদে ‘আইয়ামে বিজের’ নফল রোজা পালনের সওয়াব অর্জন করতে পারেন। শবে বরাতের আরেকটি নেক আমল মরহুম পিতা-মাতা,
আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত এবং ইসালে সওয়াব বা মৃতের জন্য সওয়াব পৌঁছে দেওয়া। একদা মধ্য শাবানের রজনীতে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাসুলে করিম (সা.) নীরবে জান্নাতুল বাকির সমাধিস্থলে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করছিলেন। (বায়হাকি) নবী করিম (সা.) কবর জিয়ারতে গিয়ে মানুষকে এ দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমরা! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! আমরাও ইনশা আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব! আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি!’ (মুসলিম) নিস্ফে শাবানের রাতে অধিক নফল নামাজ আদায় গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। যুগ যুগ ধরে শবে বরাতে মুসলিম সম্প্রদায় যথাসাধ্য রাত জেগে বাসায় ও মসজিদে ঐচ্ছিক ইবাদত তথা নফল নামাজ, তাহাজ্জত, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, মিলাদ মাহফিল, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়া-দরুদে মশগুল থাকেন এবং পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কল্যাণ, দেশ-জাতি তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আল্লাহর রহমত কামনায় এবং সবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করেন। শবে বরাতে অযথা আতশবাজিতে অনর্থক অপব্যয় না করে সমুদয় অর্থ জনকল্যাণকর কাজে বা গরিব-মিসকিনের মধ্যে দান-সাদকা করে দেওয়া পুণ্যময় কাজ। এ রজনীতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফুটানো, আড্ডাবজি বা মেলা বসানো প্রভৃতি শরিয়ত গর্হিত কাজ। পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্যকর্তব্য। শরিয়তবিবর্জিত ও অর্থের অপচয় রোধ করে সাধ্যমতো নফল ইবাদত বন্দেগিরত ধর্মপ্রাণ মানুষের আল্লাহর ধ্যানে যেন বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.