সকল প্রশংসা নতুন সম্রাটের
সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য! ৯৩ শতাংশ। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ। দারুণ, একদম আক্ষরিকভাবে। মিসরের সাধারণ নির্বাচনে এই পরিমাণ ভোট পেয়ে সাবেক ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি আধুনিক আরবের অন্য অবিনাশী দানবদের সঙ্গে একই কাতারে উঠে এলেন: নাসের, সাদাত, মুবারক, হাফেজ আল আসাদ প্রমুখ। ব্যাপারটা এমন হলো যে সিসি আরবের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে অদম্য, সাদ্দাম হোসেনের চেয়ে মাত্র ৭ শতাংশ ভোট কম পেয়েছেন। সাদ্দাম হোসেন ২০০২ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গণভোটে ১০০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সব প্রশংসা মিসরের সম্রাটের, তিনি যদি বাগদাদের নিষ্ঠুর শাসকের সমকক্ষ নাও হন। কিন্তু পরিসংখ্যান কে অস্বীকার করবেন? কেন মাত্র ৯৩ বছর আগে ব্রিটিশদের আয়োজিত গণভোটে (অবশ্যই জাল ভোট) ফয়সাল ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ইরাকের রাজা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন? তার পর থেকে জনতার সমর্থন পাওয়া আরব নেতাদের জন্য ডালভাতে পরিণত হয়। মুবারক ২১ বছর আগে ৯৬ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সরকারি খাতে সংস্কারের জন্য সাদাত ৯৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পান। সাদ্দাম ২০০২ সালে ১০০ শতাংশ ভোট পাওয়ার আগে ১৯৯৩ সালে ৯৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, আর হাফেজ আল আসাদ ১৯৯৯ সালে ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ ভোট পান। মিসরীয় কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে এই নির্বাচনে ৪৬ ভাগের কমসংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছেন। যদিও এই মহান ব্যক্তি ভেবেছিলেন ৮০ শতাংশ ভোটার ভোট দেবেন—তার পরও এতে কিছু যায়-আসে না। সিসি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ৮০ মিলিয়ন ভোটার ভোট দেবেন। সিসির প্রতিদ্বন্দ্বী হামদিন সাবাহি সত্যিকার অর্থেই একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত ব্যক্তি।
তিনি মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, এটা আসলেই হাস্যকর। সাবাহি প্রকৃত অর্থেই একজন সাহসী ব্যক্তি, তিনি মুবারকের গুন্ডাদের হাতে মার খেয়েছিলেন। তাঁকে জেলেও পোরা হয়েছিল। এটা এক অর্থে সম্মানেরই বিষয়। কিন্তু তিনি কেন ভোটে দাঁড়ালেন, সেটাই ভেবে পাই না। মোহাম্মদ মুরসির ভাগ্যে কী আছে? তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ২০১২ সালের নির্বাচনে তিনি ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে অনেক বছর কারাভোগ করতে হতে পারে, এমনকি তাঁকে ফাঁসিতেও ঝোলানো হতে পারে। ব্রাদারহুড যদি সব ‘সন্ত্রাসের’ উৎস হয়, তাহলে পশ্চিমারা তাঁর মৃত্যুতে অঝোরধারায় অশ্রু বর্ষণ করবে, যা বাস্তবে কুম্ভীরাশ্রুকেও ছাড়িয়ে যাবে। বিরোধী পক্ষকে দমন করতে নাসেরের কোনো সংশয় ছিল না। আর আজ তাঁর চেয়ে কম ভোট পাওয়া একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমা দাবি করতে পারেন? কিন্তু ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেলে কী ঘটবে? সৌদি বাদশা ফোন করে সিসিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। হ্যাঁ, সৌদি আরব সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের এক মূর্ত প্রতীকই বটে। সিসি আবার আবদুল্লাহকে ‘আরবের রাজা’ বলে সম্বোধন করেছেন, একজন মিসরীয়র পক্ষে সৌদি রাজাকে এভাবে প্রশংসা করা সত্যিই অভূতপূর্ব। কিন্তু সৌদি আরবের ডলারে মিসর (ও তাঁর নতুন রাষ্ট্রপতি) যখন ভেসে যাবে, তখন আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তারপর নিশ্চয়ই আরব উপসাগরের অন্য রাজা-বাদশারা সৌদি বাদশার পেছনে দাঁড়িয়ে গাঁইগুঁই করতে থাকবেন। তবে এ কাতারে অবশ্যই কাতার থাকবে না, কারণ এই দেশটি এখনো কারাবন্দী মুরসির পক্ষে। সিসির সবচেয়ে বড় পশ্চিমা গুণগ্রাহী টনি ব্লেয়ারও তাঁর মন ভোলানো কথা নিয়ে পেছনে পড়ে থাকবেন না। আর ওবামাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবেন না।
যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানের গত প্রতারণামূলক নির্বাচনে জয়ী হামিদ কারজাইকে অভিনন্দন জানাতে পারেন, তাঁর পক্ষে সিসির ক্ষমতায় আরোহণে মুখে হাসি নিয়ে মিসরের গণতন্ত্রে উত্তরণপর্বকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া তো কোনো ব্যাপারই না। সিসি ইতিমধ্যে বলেছেন, মিসরীয়দের আরও ২০ বছর গণতন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ফলে এই ‘উত্তরণ’প্রক্রিয়া চোখে পড়ে না। তার পরও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এসব আজগুবি আশ্বাসবাণীর কমতি নেই। যেসব তরুণ ও উদারনীতিক ২০১১ সালের বিপ্লবে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই নির্বাচনে ভোট দেননি। যে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দেননি, তাঁরা এঁদেরই অংশ। কিন্তু তাঁদের পরিচয় কেউ ঘেঁটে দেখবেন না। এই মানুষেরা ২০১৩ সালে সিসির ক্যু-তেও সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু সিসির অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটা ভেবে দেখেননি। জনপ্রিয়তা আসলেই একটি পরিবর্তনশীল ব্যাপার। কায়রোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নিষ্প্রভ ময়দান তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয়ে সিসি–সমর্থকেরা তাঁর বিজয় উদ্যাপন করেছেন। এই সিসি তাঁর পূর্বসূিরকে সামরিক উভ্যুত্থান করে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়েছেন। অথচ সিসির নীতি খুবই আবছা: কঠোরতা ও দেশপ্রেম। বিক্ষোভকারীদের বলা হয়েছে, আপনারা পরিবারবর্গকে নিয়ে আসুন। কাজ, পরিবার, পিতৃভূমি—বর্গগুলো কি পরিচিত মনে হয় না? ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন রবার্ট ফিস্ক: ইংল্যান্ডের দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা।
No comments