মোবাইল কেনার সামর্থ্য নাই আমার, আর মোবাইল ফোন দিয়ে আমি কি করবো? বলছেন বাংলাদেশের একজন নারী by মুন্নী আক্তার
বাংলাদেশের অনেক নারীরই মোবাইল ফোন
কেনার সক্ষমতা নেই, অন্যের উপহার দেয়া ইন্টারনেট-বিহীন ফোন ব্যবহার করেন
অনেকেই, আবার এমন নারীও আছেন - যারা এটির তেমন প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন
না।
যেমন সুনামগঞ্জের সোনাপুরের রুনা বেগম, তিনি সম্মান চতুর্থ
বর্ষের ছাত্রী। মাত্র চার বছর হল মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে শুরু করেছেন
তিনি। তবে সেই ফোনে ইন্টারনেট নেই।
তিনি জানান, জীবনের প্রথম ও একমাত্র এই মোবাইল ফোনটি তিনি পেয়েছেন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে।
জরিপে
বলা হচ্ছে মোবাইল ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এর কারণ
হিসেবে শিক্ষা, দারিদ্র্য এবং পশ্চাৎপদতার মতো একাধিক কারণের কথা উল্লেখ
করা হয়েছে।
মিজ রুনার সাথে কথা বলে তার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল।
তার
কথায়, পড়াশুনা করতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হয় বলে সার্বক্ষণিক
খোঁজখবর নেয়ার জন্যই মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধা দেয় নি তার পরিবার।
মিজ
রুনা বলেন, "আমরা যে এলাকায় থাকি সেখান থেকে নদী পার হয়ে সদরে কলেজে
আসতে হয়। যাতায়াতে দূরত্বের একটা সমস্যা আছে। যেজন্য মোবাইল ব্যবহারে
পরিবারের কেউ নিষেধও করে নাই।"
তবে পুরনো হওয়ার কারণে এটিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না তিনি। রয়েছে, ইন্টারনেটের খরচ বহনের বিষয়টিও।
"ইন্টারনেট ব্যবহার করার প্রবলেম হচ্ছে নেটওয়ার্ক প্রবলেম। তারপরে ফোন তো অনেক বছর হইছে। ফোনেও সমস্যা," তিনি বলেন।
মিস রুনা বলেন, "স্টুডেন্ট মানুষ তো আমি। তাই সব সময় ইন্টারনেটের যে খরচ সেটা যোগার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।"
রুনা ছাড়াও বাংলাদেশের আরও অনেক নারী রয়েছেন যাদের কাছে, ইন্টারনেট তো
দূরের কথা মোবাইল ফোন ব্যবহারটাও বেশ সীমাবদ্ধ। এমনই একজন তানিয়া বেগম।
তিনি বলেন, "মোবাইল কেনার সামর্থ্য নাই আমার। আর মোবাইল ফোন দিয়ে আমি কি করবো? আমার বাবা-মা, ভাই বোন সবাই আমার সাথে থাকে।"
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোবাইল ফোন এবং ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের পিছিয়ে থাকার হার ব্যাপক।
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে পুরুষদের তুলনায় নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অনেক নারী বলছেন, তারা যেকোনো মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিংবা পাবলিক পোস্টে কমেন্টের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়েন, নানা মন্তব্যের শিকার হতে হয়। (ফাইল ফটো) |
যুক্তরাজ্য
ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন-জিএসএমএ এক গবেষণায়
বলছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারে নারী-পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য বা
জেন্ডার গ্যাপ ৩৩ ভাগ।
আর মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই হার ৫৮ ভাগ।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, মোবাইল ফোন কেনার সক্ষমতা থাকে না বেশিরভাগ নারীর। এছাড়া অনেকেই এটিকে তেমন প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না।
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে, দরকার হয় সাক্ষরতা এবং ডিজিটাল দক্ষতার।
বাংলাদেশে
শহর অঞ্চল ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার কম হওয়ায় তাদের
মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার কম। তবে শিক্ষিত হওয়ার পরও নিরাপত্তা ও
সুরক্ষার কারণেও ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন,
"শহরাঞ্চলে পুরুষের তুলনায় নারীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এতে ইন্টারনেট
ব্যবহারের হার কম। বাজার অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় বাইরে কাজের
পাশাপাশি সংসারের কাজও তারা করছে। ফলে সময় কম পাচ্ছে।"
"আর গ্রামাঞ্চলে নারীদের হাতে মোবাইল ফোন তেমনিভাবে পৌঁছায়নি। কারণ এর জন্য ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হবে।"
"পরিবারে একটি মোবাইল ফোন থাকলেও সেটি থাকে একজন পুরুষের কাছে। যা ব্যবহার করতে হলে নারীকে অপেক্ষা করতে হয়," - বলেন তিনি ।
ড. সাদেকা হালিম বলেন, "ইন্টারনেট যেটা আধুনিক জায়গা নারীদের জন্য সেখানে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।"
"তার কোন প্রশিক্ষণ আছে কিনা, সে কোন পাঠ গ্রহণ করেছে কিনা সে ইন্টারনেট চালাতে পারছে কিনা - সেটার উপরও নির্ভর করে।"
তিনি
বলেন, "আমরা অভিভাবকরা মনে করি, পুরুষ ছেলের হাতে আমরা খুব তাড়াতাড়ি
মোবাইল ফোন দিতে পারি। কিন্তু সে তুলনায় একজন নারীকে দিতে পারছি না।"
"অভিভাবকরা
মনে করেন যে, নারীদের কেউ অহেতুক জ্বালা-যন্ত্রণা করতে পারে, তারা কারো
সাথে চলে যেতে পারে কিংবা পড়াশুনায় অমনোযোগী হতে পারে।"
"এগুলো
ঠেকাতে সার্বিকভাবে সমাজে সচেতনতা প্রয়োজন। পুরুষের হাতে ফোন থাকবে,
কিন্তু নারীদের হাতে থাকবে না - সেটা হবে না," তিনি বলেন।
তার মতে, "স্কুল-কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।"
মোবাইল
ফোন ও এতে ইন্টারনেট ব্যবহারে এই লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে সরকারের কি কি
প্রচেষ্টা রয়েছে - এমন প্রশ্নে কথা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সারওয়ার জাহানের সাথে।
তিনি
বলেন, "মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য শিপআওয়ার নামে একটি প্রকল্প
রয়েছে। যেখানে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।"
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও এতো বড় বৈষম্যের হার রয়েছে পাকিস্তানে। তারপরেই আছে ভারত।
তবে, চীনে এই হার আশ্চর্যজনকভাবে কম। দেশটিতে মোবাইল ফোন ব্যবহারে জেন্ডার গ্যাপ শূন্যের কোটায়।
আর মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ মাত্র ১%।
জিএসএমএ-এর
প্রতিবেদন বলছে, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীদের অংশগ্রহণ
বাড়িয়ে লিঙ্গ বৈষম্য কমানো গেলে, ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের
দেশগুলোতে ৭০ কোটি ডলার জিডিপি বাড়ানো সম্ভব।
No comments