বাজেট: ২০১৯-২০, অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে -সিপিডি
মধ্যবিত্ত
বা নিম্নবিত্ত মানুষ নয়, অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগীরাই প্রস্তাবিত
বাজেটে সুবিধা পাবে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর
পলিসি ডায়ালগ। গতকাল বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি বলেছে,
প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্ত ও বিকাশমান মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষ
খুব বেশি উপকৃত হবে না। ফলে সমাজে বৈষম্য আরো বাড়বে। নির্বাচনের আগে দেয়া
সরকারের প্রতিশ্রুতিও বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করে সিপিডি। রাজধানীর
একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয়
ভট্টাচার্য বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী
ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার
প্রতিফলন এ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া তা পূরণের স্পষ্ট কোনো রূপরেখা
বা কর্মসূচি বাজেটে রাখা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এ সময় সংলাপ পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলে, দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু গরীব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সক্ষমতা বাড়ছে না।
বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটা আরো প্রকট হচ্ছে। যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, এই বাজেট এবারও তাদের পক্ষেই গেছে। কারণ পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা অর্থনৈতিক কৌশল প্রয়োজন, তা বাজেটে নেই, অথচ তা ইশতেহারে ছিল। এটাই পরিতাপের বিষয়।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ এই মুহূর্তে সরকারের আছে, সেই ‘চাপের স্বীকৃতি’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই।
যেহেতু সমস্যাটারই স্বীকৃতি নাই, সেহেতু উনারা কোনো অভিনব কৌশল খোঁজেননি। মুদ্রানীতির ভেতরে, বাণিজ্যনীতির ভেতরে অথবা ভর্তুকি বিতরণের ক্ষেত্রে- কোনো ক্ষেত্রেই সেই ধরনের অভিনবত্ব নাই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশহারে কী কী ছিল, বাজেটে তার কোন বিষয়ে কী আছে- সেই আলোচনা তুলে ধরা হয় সিপিডির পর্যালোচনায়। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার প্রতিফলন এ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীতে পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, তা পূরণের স্পষ্ট কোনো রূপরেখা বা কর্মসূচি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটে রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়।তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ধরে ধরে এ বাজেট তৈরি করেছে বলে সিপিডি মনে করতে পারছে না। গৎ বাঁধা কিছু ভালো কথা থাকে, সেই কথাগুলো আছে। সেই কথাগুলো যখন আছে, সেগুলোর আবার কর্মসূচি নেই। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী তিন কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন খাতে কত দিনে কতজন করে কাজ পাবে- তার কোনো প্রাক্কলন বাজেটে নেই।
বাজেটে বলা হয়েছে করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করা হবে। কিন্তু কত বছরে, কীভাবে তা হবে এবং তার মাধ্যমে কত টাকা রাজস্ব আসবে- সে বিষয়ে কোনো রূপরেখাও বাজেটে নেই। তিনি বলেন, বাতাসের ভেতরে কিছু আশ্বাসের বাণী হয়ত গেছে। আমরা মনে করি না সে রকম বাস্তবভাবে সেগুলো এসেছে। বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাৎ পাওয়ার কথা বলা হয় সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায়। ফলে বাজেট নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয়।
তথ্যের ‘সামঞ্জস্যহীনতার’ উদাহরণ দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ট্যাক্সের যে উৎসে কর কাটা হবে, সেটার স্ল্যাবগুলো কী হবে, সেটা বক্তৃতার ভেতরে আছে ২৫ লাখ টাকা। আর এনবিআর হিসাব দিয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এখানে সমস্যা রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের ভূমিকার ক্ষেত্রে নতুন কিছু পাচ্ছি না। বৈদেশি আয়-ব্যয়ে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, বাজেটে সেই বিষয়ে কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করছি না। আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যাংক খাতের সুশাসন, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ নিয়ে এবারের বাজেটে কী পরিকল্পনা থাকছে, তা ছিল সবার আগ্রহের বিষয়।
মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতকে একটা আলোচ্য বিষয় বানিয়ে দিল! সেটার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আলোচনায় সময়ক্ষেপনের ভেতরে চলে গেল আর কি। পুরো জিনিস ব্যাংক কমিশনের ?বিষয়। কোনো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতিতে আসল না। সামষ্টিক বাজেট কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী এবার অনেক লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তবমুখী হয়েছেন। ফলে আগের দু-একটি বছরের তুলনায় রাজস্ব ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা কম। তিনি কর-বহির্ভূত আয় বাড়ানোর উদ্যোগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে উন্নয়ন ব্যয় ৭ শতাংশ রাখা, শত শত নতুন প্রকল্প না নেয়াসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানান। পুঁজিবাজারে নেয়া পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন নেই বলে উল্লেখ করেন। তবে সুশাসন ছাড়া পুঁজিবাজারের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ভ্যাট আইনে জরুরি সেবা ও পণ্যে ছাড় দেয়ার বিষয়টিও ঠিকই আছে বলে উল্লেখ করেন।
সারচার্জের ক্ষেত্রে সম্পদশালীদের যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে মেলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার নিচে হলে সারচার্জ দিতে হত না। অর্থমন্ত্রী এখন সেই সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করার কথা বলেছেন। ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয়।
তিনি বলেন, অঘোষিত আয় ও বেআইনি আয়কে আলাদা করার সময় এসেছে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দেবপ্রিয় বলেন, এটা স্বচ্ছ যে, বাজেট উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুযোগ দিচ্ছে। অল্প আয়ের মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে একধরনের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এটা থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ব্যয় মোট জিডিপি অনুপাতে বৃদ্ধি না পাওয়ার বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারে না ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারে না, তাদের জন্য আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? গণপরিবহন সংকটে যারা, তাদের জন্য গণপরিবহন তৈরি হচ্ছে কি না, তাদের শিশুরা সে রকম মানে উচ্চ শিক্ষা পাচ্ছে কি না, এটিই বড় বিষয়।
দেবপ্রিয় বলেন, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া নির্ভর করছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য আমরা কী করতে পারব, তার ওপর। বিকাশমান মধ্যবিত্তই হলো চালিকাশক্তি। চিন্তা-চেতনা, উপার্জন, বুদ্ধিমত্তা, সব ক্ষেত্রে এটি হলো চালিকা শক্তি। সেই চালিকা শক্তিকে যদি বাদ দেয়া হয়, তাহলে তা ইশতেহারের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
যে সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, সে সমাজ আজ হোক কাল হোক টেকে না, এগোতে পারে না বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, তাতে ৭, ৮, ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কষ্টকর হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করা ও তিন কোটি কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে বায়বীয় শব্দটি ব্যবহার করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আপনারা বলছেন যে করদাতার সংখ্যা ১ কোটি হবে, বলা হয়েছে শিগগিরই হবে। শিগগিরই কবে? কালকে? তিন বছর পর? ৫ বছর পর? কবে। এটা যতক্ষণ না বলা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আশ্বস্ত হই না। সাধারণ নাগরিক খুশি হতে পারে।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং সরকারি বিনিয়োগের দিক থেকে আমরা মোটামুটিভাবে ভালো অবস্থানে আছি। তবে সাধারণভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল জায়গায় আছি। এর মূল কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। একইভাবে সঞ্চয় হারের ক্ষেত্রেও আমরা দুর্বল জায়গায় আছি।
সিপিডির বিশেষ এই ফেলো বলেন, অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। এর অন্যতম লক্ষণ হলো কৃষিখাতের অবদান কমছে এবং শিল্পখাতের অবদান বাড়ছে।
তিনি বলেন, জিডিপির অংশ হিসেবে দেখলে দেখা যাবে আমদানি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে তা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিচে। এটাকে আমরা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য হিসেবে দেখতে চাচ্ছি।
গড় আয়ুর তথ্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বচ্ছল যারা আছে তাদের গড় আয়ু ৭২-৭৩ বছরের বেশি। আর গরিব মানুষরা কিন্তু বাঁচে ৭০ বছরের নিচে। ওই দুটিকে গড় করে গড় আয়ু করা হয়েছে।
বাজেট বাস্তবায়নে মূল্যনীতি এবং ভর্তুকির মধ্যে সামঞ্জস্যের আহ্বান জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ভর্তুকির কারণে গ্যাস ও বিদ্যুতের খুচরা মূল্য নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। না হলে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ পড়বে।
বাজেট সঙ্গতিপূর্ণ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ প্রতিনিয়ত কমছে, ভর্তুকির অনেক অর্থ অব্যবহৃত থাকায় কৃষকের প্রকৃত সুবিধাভোগ হচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এ সময় সংলাপ পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলে, দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু গরীব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সক্ষমতা বাড়ছে না।
বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটা আরো প্রকট হচ্ছে। যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, এই বাজেট এবারও তাদের পক্ষেই গেছে। কারণ পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা অর্থনৈতিক কৌশল প্রয়োজন, তা বাজেটে নেই, অথচ তা ইশতেহারে ছিল। এটাই পরিতাপের বিষয়।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ এই মুহূর্তে সরকারের আছে, সেই ‘চাপের স্বীকৃতি’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই।
যেহেতু সমস্যাটারই স্বীকৃতি নাই, সেহেতু উনারা কোনো অভিনব কৌশল খোঁজেননি। মুদ্রানীতির ভেতরে, বাণিজ্যনীতির ভেতরে অথবা ভর্তুকি বিতরণের ক্ষেত্রে- কোনো ক্ষেত্রেই সেই ধরনের অভিনবত্ব নাই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশহারে কী কী ছিল, বাজেটে তার কোন বিষয়ে কী আছে- সেই আলোচনা তুলে ধরা হয় সিপিডির পর্যালোচনায়। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার প্রতিফলন এ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীতে পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, তা পূরণের স্পষ্ট কোনো রূপরেখা বা কর্মসূচি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটে রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়।তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ধরে ধরে এ বাজেট তৈরি করেছে বলে সিপিডি মনে করতে পারছে না। গৎ বাঁধা কিছু ভালো কথা থাকে, সেই কথাগুলো আছে। সেই কথাগুলো যখন আছে, সেগুলোর আবার কর্মসূচি নেই। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী তিন কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন খাতে কত দিনে কতজন করে কাজ পাবে- তার কোনো প্রাক্কলন বাজেটে নেই।
বাজেটে বলা হয়েছে করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করা হবে। কিন্তু কত বছরে, কীভাবে তা হবে এবং তার মাধ্যমে কত টাকা রাজস্ব আসবে- সে বিষয়ে কোনো রূপরেখাও বাজেটে নেই। তিনি বলেন, বাতাসের ভেতরে কিছু আশ্বাসের বাণী হয়ত গেছে। আমরা মনে করি না সে রকম বাস্তবভাবে সেগুলো এসেছে। বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাৎ পাওয়ার কথা বলা হয় সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায়। ফলে বাজেট নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয়।
তথ্যের ‘সামঞ্জস্যহীনতার’ উদাহরণ দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ট্যাক্সের যে উৎসে কর কাটা হবে, সেটার স্ল্যাবগুলো কী হবে, সেটা বক্তৃতার ভেতরে আছে ২৫ লাখ টাকা। আর এনবিআর হিসাব দিয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এখানে সমস্যা রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের ভূমিকার ক্ষেত্রে নতুন কিছু পাচ্ছি না। বৈদেশি আয়-ব্যয়ে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, বাজেটে সেই বিষয়ে কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করছি না। আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যাংক খাতের সুশাসন, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ নিয়ে এবারের বাজেটে কী পরিকল্পনা থাকছে, তা ছিল সবার আগ্রহের বিষয়।
মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতকে একটা আলোচ্য বিষয় বানিয়ে দিল! সেটার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আলোচনায় সময়ক্ষেপনের ভেতরে চলে গেল আর কি। পুরো জিনিস ব্যাংক কমিশনের ?বিষয়। কোনো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতিতে আসল না। সামষ্টিক বাজেট কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী এবার অনেক লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তবমুখী হয়েছেন। ফলে আগের দু-একটি বছরের তুলনায় রাজস্ব ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা কম। তিনি কর-বহির্ভূত আয় বাড়ানোর উদ্যোগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে উন্নয়ন ব্যয় ৭ শতাংশ রাখা, শত শত নতুন প্রকল্প না নেয়াসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানান। পুঁজিবাজারে নেয়া পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন নেই বলে উল্লেখ করেন। তবে সুশাসন ছাড়া পুঁজিবাজারের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ভ্যাট আইনে জরুরি সেবা ও পণ্যে ছাড় দেয়ার বিষয়টিও ঠিকই আছে বলে উল্লেখ করেন।
সারচার্জের ক্ষেত্রে সম্পদশালীদের যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে মেলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার নিচে হলে সারচার্জ দিতে হত না। অর্থমন্ত্রী এখন সেই সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করার কথা বলেছেন। ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয়।
তিনি বলেন, অঘোষিত আয় ও বেআইনি আয়কে আলাদা করার সময় এসেছে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দেবপ্রিয় বলেন, এটা স্বচ্ছ যে, বাজেট উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুযোগ দিচ্ছে। অল্প আয়ের মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে একধরনের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এটা থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ব্যয় মোট জিডিপি অনুপাতে বৃদ্ধি না পাওয়ার বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারে না ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারে না, তাদের জন্য আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? গণপরিবহন সংকটে যারা, তাদের জন্য গণপরিবহন তৈরি হচ্ছে কি না, তাদের শিশুরা সে রকম মানে উচ্চ শিক্ষা পাচ্ছে কি না, এটিই বড় বিষয়।
দেবপ্রিয় বলেন, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া নির্ভর করছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য আমরা কী করতে পারব, তার ওপর। বিকাশমান মধ্যবিত্তই হলো চালিকাশক্তি। চিন্তা-চেতনা, উপার্জন, বুদ্ধিমত্তা, সব ক্ষেত্রে এটি হলো চালিকা শক্তি। সেই চালিকা শক্তিকে যদি বাদ দেয়া হয়, তাহলে তা ইশতেহারের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
যে সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, সে সমাজ আজ হোক কাল হোক টেকে না, এগোতে পারে না বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, তাতে ৭, ৮, ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কষ্টকর হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করা ও তিন কোটি কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে বায়বীয় শব্দটি ব্যবহার করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আপনারা বলছেন যে করদাতার সংখ্যা ১ কোটি হবে, বলা হয়েছে শিগগিরই হবে। শিগগিরই কবে? কালকে? তিন বছর পর? ৫ বছর পর? কবে। এটা যতক্ষণ না বলা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আশ্বস্ত হই না। সাধারণ নাগরিক খুশি হতে পারে।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং সরকারি বিনিয়োগের দিক থেকে আমরা মোটামুটিভাবে ভালো অবস্থানে আছি। তবে সাধারণভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল জায়গায় আছি। এর মূল কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। একইভাবে সঞ্চয় হারের ক্ষেত্রেও আমরা দুর্বল জায়গায় আছি।
সিপিডির বিশেষ এই ফেলো বলেন, অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। এর অন্যতম লক্ষণ হলো কৃষিখাতের অবদান কমছে এবং শিল্পখাতের অবদান বাড়ছে।
তিনি বলেন, জিডিপির অংশ হিসেবে দেখলে দেখা যাবে আমদানি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে তা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিচে। এটাকে আমরা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য হিসেবে দেখতে চাচ্ছি।
গড় আয়ুর তথ্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বচ্ছল যারা আছে তাদের গড় আয়ু ৭২-৭৩ বছরের বেশি। আর গরিব মানুষরা কিন্তু বাঁচে ৭০ বছরের নিচে। ওই দুটিকে গড় করে গড় আয়ু করা হয়েছে।
বাজেট বাস্তবায়নে মূল্যনীতি এবং ভর্তুকির মধ্যে সামঞ্জস্যের আহ্বান জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ভর্তুকির কারণে গ্যাস ও বিদ্যুতের খুচরা মূল্য নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। না হলে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ পড়বে।
বাজেট সঙ্গতিপূর্ণ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ প্রতিনিয়ত কমছে, ভর্তুকির অনেক অর্থ অব্যবহৃত থাকায় কৃষকের প্রকৃত সুবিধাভোগ হচ্ছে না।
No comments