বিবাহে ইচ্ছুকদের জেন্ডার শিক্ষা by উম্মে মুসলিমা
ভোজ্যতেলের
একটা বিজ্ঞাপনে পাত্রী জানতে চান, পাত্র কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস
করেছেন। পাত্র বেশ ভাব নিয়ে ‘মামৈনসিংহ ক্যাডেট’ বললে পাত্রী বলেন
‘ময়মনসিংহ তো মেয়েদের ক্যাডেট’। ধরা পড়ে যায় পাত্রের প্রতারণা। তো
হাড়েমজ্জায় পিতৃতন্ত্র নিয়ে উদিত হওয়া পাত্র বা প্রেমিকের জেন্ডার শিক্ষার
পরীক্ষা নিয়ে তবেই প্রেম বা বিয়েতে নারীর এগিয়ে আসা উচিত। প্রেমের দেবতা
কিউপিড অন্ধ। অত ভেবেচিন্তে প্রেম হয় না। কিন্তু এখন সেই ‘এক প্রেম এক
বিয়ে’-এর দিন অস্তগামী। প্রেম ভাঙছে, বিয়েও ভাঙছে। এমনকি তরুণ-তরুণীরা
ভাঙাগড়াকে এখন অনেক সহজভাবে নিচ্ছে। তালাক ও পুনর্বিবাহের সংখ্যাও আগের
চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে জরিপ চালিয়ে
দেখা গেছে, আমাদের দেশে শতকরা ৮৫ ভাগ বিয়ে এখনো পরিবারের পছন্দমতো হয়। বাকি
১৫ ভাগ পাত্র-পাত্রীর নিজের পছন্দে। একটা ছোট্ট ফুটো রেখে বাল্যবিবাহ
নিরোধ আইন হলেও নারী শিক্ষার প্রতি সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ
স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাল্যবিবাহ রোধে ভেতরে-ভেতরে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। নারী
শিক্ষিত বা আলোকপ্রাপ্ত হয়ে উঠলে কোনো ফুটোফাটায় কাজ হবে না। তারপরও
পারিবারিক জীবনে নারীর অশান্তি কেন লেগেই আছে? নারী এখন রোজগেরেও হচ্ছেন
দিন দিন। কিন্তু ক্ষমতায়নে প্রত্যাশিত সুফল আসছে না। কেন? কারণ,
শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর পদচারণ বৃদ্ধি পেলেও তাঁর
পাশে থাকা পুরুষ বা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা তাঁদের আগের
জায়গাতেই রয়ে গেছেন। কেবল রোজগেরে হলেই ক্ষমতায়ন হবে, তার কোনো মানে নেই।
যেখানে উপার্জনক্ষম নারীরাও নিজের পছন্দে বিয়ে করতে দ্বিধা করেন, সেখানে
ক্ষমতায়ন দূর অস্ত। পোশাকশিল্প কারখানায় নারীরা যেদিন মাইনে তোলেন, সেদিন
তাঁদের স্বামী-ভাই-বাবা-শ্বশুরেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন টাকাগুলো
হাতানোর জন্য। এ চিত্র বড় বড় চাকুরে নারীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ক্ষমতাধরদের
চাপিয়ে দেওয়া শ্রমবিভাজন সময়ের উন্নয়নে সমতার যুক্তিপূর্ণ দাবিদার। কিন্তু
পিতৃতন্ত্রের সুবর্ণ সুবিধা হারাতে এখনো সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নারাজ। কেউ কেউ
পুরুষতান্ত্রিক অধিকারকে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলতেও দ্বিধা করেন না। শুধু গুটিকয়েক
সমতানুরাগী পুরুষ এর ব্যতিক্রম। পাশ্চাত্যে এত তালাক কেন?
একটি ওয়েব
ম্যাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকায় ৪০-৫০ শতাংশ প্রথম বিয়ে এবং ৬০ শতাংশ
দ্বিতীয় বিয়ে তালাকে পর্যবসিত হয়। ওই সব দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর উদ্যোগে
বেশি তালাক হয়। এর প্রধান কারণ জেন্ডার বৈষম্য। এখনো স্ত্রীদের স্বামীর
নামের পদবি ব্যবহার করতে হয়। গৃহস্থালি কাজ এবং সন্তান পালনের বেশির ভাগ
নারীকেই করা লাগে। বউ পেটানোতে কোনো দেশের পুরুষই কম যান না। দীর্ঘদিনের
প্রেমের বিয়েও ভেঙে যায়, যখন স্ত্রী দেখেন স্বামী পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা
প্রয়োগকে তাঁদের জন্মগত অধিকার ভাবেন। আমাদের দেশের মা-বাবারা ‘মানিয়ে নিতে
শেখা’কে মেয়েদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা বলে প্রশিক্ষিত করে ছেড়ে দেন। ফলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, মিডিয়াকর্মী, আইনজীবী ও
স্বনির্ভর নারীরা স্বামীর বাড়ি থেকে কেউ লাশ হয়ে বেরিয়ে আসেন, কেউ
প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জীবন কাটান, কেউ সামাজিকতার ভয়ে বেঁচে থেকেও নিঃশেষ হয়ে
যান। আর যাঁরা নির্ভরশীল, তাঁদের তো ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া বাঁচার
কোনো পথ নেই। যেসব নারী ভালোবেসে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তাঁরা যাচাই করে নিন
সঙ্গী পুরুষটি কতখানি জেন্ডার সচেতন। অথবা যাঁরা সদ্য প্রেমে পড়েছেন,
তাঁরাও প্রেমিকের আচরণ লক্ষ করতে থাকুন। পুরুষতান্ত্রিক আচরণ বুঝতে না
পারার কোনো কারণ নেই। বেশি বেশি কর্তৃত্ব ফলানোর ভাব দেখলেই শুধরে দেওয়ার
পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে যেসব প্রেমিকা নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্না করে টিফিন
বক্সে ভরে প্রেমিককে খাইয়ে প্রশংসা পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে
থাকেন, তাঁদের জন্য উপদেশ বৃথা। কারণ, তাঁরাই জেন্ডার বৈষম্য জিইয়ে রাখতে
সচেষ্ট। সেই প্রেমিক স্বামী হয়ে উঠলে তিনি কোনো দিন তাঁর এ বদ্ধমূল ধারণা
থেকে বেরোতে পারবেন না যে রান্না করা কেবল নারীরই কাজ। যেমন ধরুন, প্রেমিক
বলে বসলেন, ‘এত জোরে বেটাছেলের মতো হাসো কেন? মেয়েদের মতো হাসতে পারো না?’
অথবা নারী নিজেই তাঁর প্রেমিককে বললেন, ‘মেয়েদের মতো ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদো
না তো।’ জেন্ডার ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে নারী-পুরুষ উভয়কেই। যেসব অভিভাবক
তাঁদের পছন্দমতো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চান, তাঁদেরকেও পুরোনো ধ্যানধারণা
থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত ও উপযুক্ত ছেলেমেয়ের নিজেদের পছন্দকে সম্মান
দেখাতে হবে। এখন তো বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ের অনেক মা-বাবাকেই বলতে শোনা যায়,
‘বাছা, নিজে একটা পছন্দ করে রাখলেই তো আর এত ছুটতে হয় না আমাদের।’ যৌতুক
দেওয়া ও নেওয়ার কোনো আলোচনা দুই পক্ষের মধ্যে হবে না। সে ক্ষেত্রে
পাত্র-পাত্রীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যৌতুক নারীকে হেয় করার প্রধান
উপাদান। ভোজ্যতেলের বিজ্ঞাপনের মতো অন্য আরেকটি বিজ্ঞাপনে পাত্রীকে যদি
পাত্রপক্ষ ‘কী কী রাঁধতে পারো মা?’ জিজ্ঞাসা করে, তাহলে মেয়েটিও পাত্রকে
‘আপনি থালাবাসন পরিষ্কার করতে পারেন?’ জিজ্ঞাসা করবেন। যদি পাত্র বিস্ময়ে
বলে ওঠেন, ‘থালাবাসন পরিষ্কার করা তো মেয়েদের কাজ’, তখন পাত্রী সে বিয়েতে
মত না দিলে সেটাই হবে পুরুষকে জেন্ডার সচেতন করার সফল বিজ্ঞাপন।
উম্মে মুসলিমা, কথাসাহিত্যিক।
উম্মে মুসলিমা, কথাসাহিত্যিক।
No comments