প্রণব মুখার্জির মিশন! by সৈয়দ আবদাল আহমদ
বাংলাদেশ
ঘুরে গেলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তার পাঁচ দিনের এই
সফর ছিল খুবই আলোচিত। সরকারি মহল এ সফরকে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে, মনেই হয়নি
প্রণব মুখার্জি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি। সফরকালে তার সম্মানে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা গণভবনে মধ্যাহ্নভোজ ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে নৈশভোজের
আয়োজন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে বিশেষ সমাবর্তন আয়োজন করে
প্রণব মুখার্জিকে সম্মানসূচক ‘ডি লিট’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়। অতীতে বহুবার
বাংলাদেশে এলেও এবারই প্রথম তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সফর করেন। ‘ডি লিট’
ডিগ্রি গ্রহণ ছাড়াও তিনি সেখানকার প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থানও পরিদর্শন
করেন। বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে
তিনি প্রধান অতিথি হয়ে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিনই প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে আসেন। দিল্লি
ফেরার আগে তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যান এবং শেখ
মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পরিদর্শন বইতে লেখেন- ‘সর্বকালের সাহসী
নেতাকে স্যালুট জানাই।’ ২০১৩ সালে প্রণব মুখার্জি ভারতের প্রথম বাঙালি
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশেই প্রথম সফর করেছিলেন। তখন তাকে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডি লিট’ ডিগ্রি দিয়েছিল। অবসরের পরও তার প্রথম সফর
বাংলাদেশে। তবে এবারের এই সফর নানা জল্পনা ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। সফরের
প্রথম দিন ভারতীয় হাইকমিশনে তোলা একটি ছবি রীতিমতো বিতর্কের সৃষ্টি করে।
বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছবি হইচই ফেলে দেয়। ছবিতে দেখা যায়,
প্রণব মুখার্জি সামনে চেয়ারে বসে আছেন আর বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র
রাজনীতিবিদ পেছনে দাঁড়ানো। এর মধ্যে রয়েছেনÑ সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম
এরশাদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল
আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল
হাসান মাহমুদ আলী। ভারতীয় হাইকমিশনের দেয়া নৈশভোজ শেষে ছবিটি তোলা হয়।
এই
ছবি হাইকমিশনের ফেসবুক ও টুইটার পেজে আপলোড করা হলে সৃষ্টি হয় বিতর্ক।
ছবিটির অর্থ অনেকের কাছে এমন দাঁড়ায়- এ যেন মোড়লিপনারই চরম নিদর্শনমূলক
একটি ছবি। ছবিটি নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরে
অবশ্য ভারতীয় হাইকমিশন ওই পেজ থেকে তা সরিয়ে ফেলে। এ নিয়ে হাইকমিশন একটি
ব্যাখ্যাও দেয়। প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ করতে ভারতীয় হাইকমিশনে ওইদিন
নাকি ১৭-১৮টি গ্রুপ গিয়েছিল। তাদের আগ্রহেই তিনি ছবি তোলেন। সে যাই হোক,
প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে কৌতূহলের বিষয় ছবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; কৌতূহলের
আরো কারণ আছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার
হয়ে নিহত হয়েছেন, প্রণব মুখার্জি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া ভাষণে
তাদের নাম উল্লেখ করলেও রহস্যজনক কারণে জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারণ করেননি।
এ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। তবে কৌতূহলের প্রধান বিষয় ছিলÑ ‘ভোট নিয়ে
হাসিনা-প্রণব আলোচনা’। কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ
করেছে। ঢাকার মানবজমিন পত্রিকা আনন্দবাজারকে উদ্ধৃত করে লিখেছে ১৫
জানুয়ারি গণভবনে মধ্যাহ্নভোজের পর মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে
হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের ‘ট্র্যাক-টু’ কূটনীতির সূত্রপাত হয়েছে।
হাসিনার সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভোটের
ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন প্রণব মুখার্জি। এ আলোচনা বেশ কিছু
সময় চলে এবং নির্বাচন ও চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে
পরামর্শ দিয়েছেন প্রণব বাবু। আনন্দবাজারের সাংবাদিক অগ্নি রায় প্রণব
মুখার্জির সফর নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছেন। একটি প্রতিবেদনে তিনি
লিখেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসর নেয়ার পর প্রথম সফরে ঢাকায় পৌঁছে
প্রণব মুখার্জি জানিয়েছিলেন- ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’ এই হলো তার সফরের
উদ্দেশ্য। রথ দেখা অর্থাৎ বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশ
নেয়াকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু ‘কলা বেচার’ ব্যাখ্যা তিনি স্পষ্ট করেননি। অনেকের
ধারণা, ভোট নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার মধ্যেই ‘কলা বেচা’র বিষয়টি জড়িত
থাকতে পারে। প্রণব মুখার্জির এই সফরের কথা প্রথম ঘোষিত হওয়ার পর, মাসখানেক
আগে নয়া দিগন্তের এই পাতায় নির্বাচন নিয়ে মানুষের শঙ্কার কথা লিখেছিলাম।
পাঠকদের হয়তো মনে আছে, সেই লেখায় ছিল- ‘প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে বেড়াতে
আসতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে আমাদের ভয়ও
আছে।’ সেই ভয় হচ্ছে নির্বাচন হাইজ্যাকের শঙ্কা। প্রণব মুখার্জি নিজেই তার
‘কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২’ বইতে লিখেছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার
ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল। তিনি কোনো রাখঢাক না করেই বলেন, বিএনপির প্রথম
আমলে (১৯৯১-৯৬) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শক্ত আন্দোলন করতে তিনি শেখ
হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমরা জানি, শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
আন্দোলনে ‘শক্ত’ অবস্থানে ছিলেন এবং সংসদ থেকে তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল এ
জন্য পদত্যাগও করেছিল। পদত্যাগপত্র সংসদে গ্রহণ করা না হলেও তিনি আর সংসদে
যাননি। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
আদায় করে, নির্বাচনের মাত্র এক-দেড় মাসের মাথায় ওই সরকারকে ক্ষমতায় বসানো
হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার
ব্যাপারে নিজের ভূমিকার কথা লিখেছেন প্রণব মুখার্জি।
ওয়ান-ইলেভেনের সময়
আওয়ামী লীগের বড় নেতারা যখন জেলবন্দী শেখ হাসিনাকে পরিত্যাগ করে সংবাদ
সম্মেলন করেছিলেন, এ অবস্থায় ওই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট প্রণব মুখার্জিই নিরসন
করে দেন। তিনি তাদের ডেকে ভর্ৎসনা করেন এবং শেখ হাসিনাকে ছেড়ে না যাওয়ার
পরামর্শ দেন। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের হাই-প্রোফাইল ভারত সফরের কথা কে না
জানে? তাকে ভারতের পক্ষ থেকে রাজকীয় ছয়টি ঘোড়া উপঢৌকন দেয়া হয়েছিল। শুধু
তাই নয়, প্রণব মুখার্জি নিজেই লিখেছেন, জেনারেল মইনকে তার পদে শেখ হাসিনা
বহাল রাখবেন বলে তিনি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। বিনিময়ে দেশবাসী প্রত্যক্ষ
করেছে আন্দোলনের ফসল মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে
দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনের সময় প্রণব মুখার্জি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। তখন ভারতের
পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় ২৬ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে এসে আওয়ামী লীগের
পক্ষে যে ভূমিকা রাখেন, সেটা কারো নজর এড়ায়নি। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয়
নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশের এমন নগ্ন হস্তক্ষেপে সেদিন সবাই ক্ষুব্ধ হলেও
করার কিছুই ছিল না। শুধু অসহায় চোখে ‘নির্বাচন হাইজ্যাক’ হওয়ার দৃশ্য দেখতে
হয়েছে। এই সেই সুজাতা সিং ষড়যন্ত্রের বীজ যার অস্থিমজ্জায়, তারই বাবা
ষড়যন্ত্র করে লেন্দুপ দর্জিকে দিয়ে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন।
আজ তাই প্রণব মুখার্জি কিংবা সুজাতা সিংরয়র প্রসঙ্গ উঠলে আমাদের ভয় হয়। ২৩
জানুয়ারি সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকদের প্রতি
সংহতি জানাতে এসে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী
বলেছেন, ‘সময় এখন ভালো নয়। সঠিকভাবে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে
না।’ এটা শুধু তার কথাই নয়, দেশের সবাই তা মনে করে। এমনকি শেখ হাসিনাও সেটা
জানেন। ভয় সেখানেই। আমরা জানি না, হাসিনা-প্রণব ভোটের আলোচনায় সঠিকভাবে
নির্বাচন যাতে না হয়, সে ব্যাপারে কোনো কথা হয়েছে কি না। আনন্দবাজার
লিখেছে, প্রণব মুখার্জি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে পরামর্শ
দিয়েছেন। সেই পরামর্শ যদি হয় আবার নির্বাচন ‘ম্যানেজ’ করা, বেঠিক
নির্বাচনের কিংবা ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির, তা হবে জাতির জন্য বড়ই
দুর্ভাগ্যের।
নিজেকেই প্রশ্ন করুন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডি লিট’ ডিগ্রি গ্রহণ করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার ভাষণে প্রশ্ন তোলেন- উপমহাদেশে কেন গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না? তিনি এও বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া যায়। শত বাধার মুখেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ (সমকাল, ১৭ জানুয়ারি)। তার এ কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? উপমহাদেশের গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না কী কারণে? এর জন্য কারা দায়ী? প্রণব মুখার্জি যদি এ বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন, তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। আর সেটা হচ্ছে, ভারতের কারণেই উপমহাদেশে গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না। ভারত নিজে যে গণতন্ত্র ভোগ করেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোকে সেভাবে ভোগ করতে দিচ্ছে না। সুজাতা সিংয়ের উক্তি আমরা ভুলে যাইনি। বাংলাদেশে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র একেক দেশে একেক রকম হয়।’ অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশে ভারতের মতো গণতন্ত্র চান না। ভারতের স্বার্থ বিশেষ করে কংগ্রেসের স্বার্থ হাসিল হয়- এমন গণতন্ত্র চেয়েছেন। সেই ‘গণতন্ত্র’ এখন চলছে। ভারতের সাথে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ সরকারেরই সম্পর্ক মধুর। এই সম্পর্কের বিনিময়ে বাংলাদেশকে অন্য অনেক বিষয়ের সাথে গণতন্ত্রকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে।বস্তুত, ভারত চায় না তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দল ক্ষমতায় থাকুক। তাতে তাদের আবদার পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য জনবিচ্ছিন্ন তাঁবেদার সরকার পছন্দ ভারতের। বাংলাদেশ এখন এর বড় প্রমাণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী কোনো দেশেই ভারত গণমুখী দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। যেমন- তার কার্যত ‘করদরাজ্য’ ভুটানের বর্তমান গণতন্ত্রমনা রাজাকে পছন্দ নয় দিল্লির। এ জন্য ২০১৩ সালে ভুটানের জনগণকে শায়েস্তা করতে জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিয়ে দেশটিকে বিপাকে ফেলেছিল ভারত সরকার। ভুটানের বর্তমান সরকার চাইছে ভারতের পেটের ভেতর থেকে বের হয়ে চীনমুখী হতে। কিন্তু সেটা দিল্লি হতে দিচ্ছে না। ভুটানকে কব্জায় রাখার জন্য ভারতের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। সম্প্রতি চীনের সাথে ভুটানের মালিকানাধীন ডোকলাম নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে দিল্লির এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে নগ্নভাবে। ভুটান সরকার ডোকলাম নিয়ে চীনের সাথে বিরোধে জড়াতে না চাইলেও ভারত গায়ে পড়ে চীনের সাথে বিবাদে জড়িয়েছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ‘নাকে খত দিয়ে’ ভারতকে ডোকলাম ছাড়তে হয়েছে। এক সময় সাংবিধানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র, নেপালেও গণমুখী সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি ভারত। অভিযোগ আছে, জনগণের কাছে অতিপ্রিয় নেপালের রাজা বীরেন্দ্রসহ রাজপরিবারের ১০ জন সদস্যকে ২০০১ সালে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার মদদে হত্যা করা হয়। রাজা বীরেন্দ্র ছিলেন ভারতের আগ্রাসন নীতির বিরোধী এবং গণমুখী। তাই তাকে সরিয়ে পুতুল সরকার সেখানে ক্ষমতায় বসানো হয়।
নিজেকেই প্রশ্ন করুন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডি লিট’ ডিগ্রি গ্রহণ করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার ভাষণে প্রশ্ন তোলেন- উপমহাদেশে কেন গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না? তিনি এও বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া যায়। শত বাধার মুখেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ (সমকাল, ১৭ জানুয়ারি)। তার এ কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? উপমহাদেশের গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না কী কারণে? এর জন্য কারা দায়ী? প্রণব মুখার্জি যদি এ বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন, তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। আর সেটা হচ্ছে, ভারতের কারণেই উপমহাদেশে গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না। ভারত নিজে যে গণতন্ত্র ভোগ করেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোকে সেভাবে ভোগ করতে দিচ্ছে না। সুজাতা সিংয়ের উক্তি আমরা ভুলে যাইনি। বাংলাদেশে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র একেক দেশে একেক রকম হয়।’ অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশে ভারতের মতো গণতন্ত্র চান না। ভারতের স্বার্থ বিশেষ করে কংগ্রেসের স্বার্থ হাসিল হয়- এমন গণতন্ত্র চেয়েছেন। সেই ‘গণতন্ত্র’ এখন চলছে। ভারতের সাথে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ সরকারেরই সম্পর্ক মধুর। এই সম্পর্কের বিনিময়ে বাংলাদেশকে অন্য অনেক বিষয়ের সাথে গণতন্ত্রকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে।বস্তুত, ভারত চায় না তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দল ক্ষমতায় থাকুক। তাতে তাদের আবদার পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য জনবিচ্ছিন্ন তাঁবেদার সরকার পছন্দ ভারতের। বাংলাদেশ এখন এর বড় প্রমাণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী কোনো দেশেই ভারত গণমুখী দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। যেমন- তার কার্যত ‘করদরাজ্য’ ভুটানের বর্তমান গণতন্ত্রমনা রাজাকে পছন্দ নয় দিল্লির। এ জন্য ২০১৩ সালে ভুটানের জনগণকে শায়েস্তা করতে জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিয়ে দেশটিকে বিপাকে ফেলেছিল ভারত সরকার। ভুটানের বর্তমান সরকার চাইছে ভারতের পেটের ভেতর থেকে বের হয়ে চীনমুখী হতে। কিন্তু সেটা দিল্লি হতে দিচ্ছে না। ভুটানকে কব্জায় রাখার জন্য ভারতের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। সম্প্রতি চীনের সাথে ভুটানের মালিকানাধীন ডোকলাম নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে দিল্লির এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে নগ্নভাবে। ভুটান সরকার ডোকলাম নিয়ে চীনের সাথে বিরোধে জড়াতে না চাইলেও ভারত গায়ে পড়ে চীনের সাথে বিবাদে জড়িয়েছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ‘নাকে খত দিয়ে’ ভারতকে ডোকলাম ছাড়তে হয়েছে। এক সময় সাংবিধানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র, নেপালেও গণমুখী সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি ভারত। অভিযোগ আছে, জনগণের কাছে অতিপ্রিয় নেপালের রাজা বীরেন্দ্রসহ রাজপরিবারের ১০ জন সদস্যকে ২০০১ সালে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার মদদে হত্যা করা হয়। রাজা বীরেন্দ্র ছিলেন ভারতের আগ্রাসন নীতির বিরোধী এবং গণমুখী। তাই তাকে সরিয়ে পুতুল সরকার সেখানে ক্ষমতায় বসানো হয়।
এরপর নেপালে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হলে ক্ষেপে যায় ভারত।
উগ্রপন্থীদের দিয়ে নেপালকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়। নেপালে গত বছরের
শেষের দিকে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে ভারতবিরোধী জোট। দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ভারতপন্থী দল যে ক্ষমতায় আসতে পারে না, নেপালের
নির্বাচনে সেটা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা নিয়েও ভারত কম খেলা
দেখায়নি। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদদ দেয়া ছাড়াও দেশটিতে ভারত
সরাসরি সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে শ্রীলঙ্কার
মানুষও দিল্লির ওপর অসন্তুষ্ট। সরাসরি ভারতের দালালি করে এ দেশটিতে কোনো
দলের ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার কিছুটা ভারতঘেঁষা
হলেও তারা ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করছেন। ভারত ও চীনের সাথে দরকষাকষির
অবস্থান বজায় রেখেছে মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকার। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের
রাজনীতিতেও ভারতের হস্তক্ষেপ কোনো অংশে কম নয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের
মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবেশী ভারত আমাদের বিপুল সহযোগিতা
করেছে। ভারতের প্রতি এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ভারতের
কথায় সব সময় আমাদের চলতে হবে। ভারত চায়, তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে
বাংলাদেশ চলুক। সেজন্য বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত খবরদারি করে আসছে।
একাত্তরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে
সাত দফা ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ চুক্তির মূল
লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা পরিচালিত হবে দিল্লি
থেকে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের কোনো সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিডিআর ভেঙে দিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফের
তত্ত্বাবধানে একটি বর্ডার গার্ড (বিজিবি) বাহিনী গঠন করা হবে। পাকিস্তান
থেকে মুক্ত হয়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লিতে স্বল্পকালীন
যাত্রাবিরতিকালে তাকে সাত দফা চুক্তির কথা জানানো হলে তিনি তা মানেননি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী ফিরিয়ে নেয়া দিল্লির কাম্য ছিল
না। কিন্তু মুজিবের পীড়াপীড়িতে ভারত তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
আজো সেই চুক্তির কথা ভারত ভুলে যায়নি। বিডিআর ভেঙে দিয়ে এখন বিজিবি গঠিত
হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি কাদের ইঙ্গিতে পরিচালিত
হচ্ছে, সবার তা জানা। বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের অন্ধসমর্থন রয়েছে। ফলে
সরকার ভারতকে যেকোনো মূল্য দিতে রাজি আছে। ভারত সে মূল্য আদায়ও করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের সড়ক, নৌ, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দরগুলো প্রায় বিনামূল্যে সরকারের
কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের
ব্যাপারে দিল্লি যে অশোভনভাবে হস্তক্ষেপ করেছে, এর নজির সত্যিই বিরল। ৫
জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পর অবৈধ সরকারের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য
ভারতীয় কূটনীতিকেরা বিশ্বব্যাপী দাপাদাপি করেছেন। তখন থেকে বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ বেড়ে যায়। প্রণব মুখার্জি আজ তাই
বড়গলায় বলছেন, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতের মতোই নাকি এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানেন, কথাটা একেবারেই হাস্যকর। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতের মতো
এগিয়ে গেলে তাতে ভারতের লাভ হতো না। বাংলাদেশ এগিয়ে যেত। মানুষ গণতন্ত্রের
সুফল পেত, কিন্তু ভারত বাংলাদেশে তার দেশের মতো গণতন্ত্র হোক তা চায়নি।
তারা চেয়েছেন বাংলাদেশে এমন একটা গণতন্ত্র কায়েম হোক, যাতে তার স্বার্থ
রক্ষা হয়। সেই লক্ষ্যে তার পছন্দের একটা সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে। সেটাই
হয়েছে। ফলে সত্যিকার গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত।
বাংলাদেশে বিরোধী দল বলতে কিছু
নেই। বিরোধী দলকে সরকার সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। অসংখ্য মামলা দিয়ে
হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে কয়েদ করে রেখেছে; বাড়িঘর ছাড়া করে রেখেছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও খুন করছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের মিডিয়া বন্ধ করে
দেয়া হয়েছে। এক কথায়, বাংলাদেশে এখন চলছে ত্রাসের রাজত্ব; কর্তৃত্ববাদী
শাসন চলছে। এর মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই, যাকে প্রণব মুখার্জি
স্বীকৃতি দিতে চেয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে।
সেই তামাশার নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বি¦তায়
প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। ভুয়া নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হয়, সেই
সংসদে বিরোধী দল সরকারের মন্ত্রিসভায়ও আছে। আসলে প্রণব মুখার্জিও কথা
এমনিতেই বলেননি। আসন্ন নির্বাচনটিও ম্যানেজ করে তাদের পছন্দের সরকারকে যাতে
টিকিয়ে রাখা যায়, সেটাই তার লক্ষ্য। তবে ভারতের বর্তমান নেতৃত্ব মনে হয় না
প্রণবের পথে হাঁটবেন। কারণ, বাংলাদেশে অতীতের কংগ্রেস সরকারের অতিমাত্রায়
হস্তক্ষেপের কারণে ভারত যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে; সে খবর মোদি সরকারের
কাছে রয়েছে। আর সেই ক্ষতি হচ্ছে- অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন
বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী। এটা ক্রমাগত চলতে থাকলে বিশ্বের
অন্যতম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের জন্য ভালো দেখায় না। এ নিয়ে ভারতের বর্তমান
নেতৃত্ব আশা করি সজাগ রয়েছেন। তাই বাংলাদেশে মিশন না চালিয়ে কী করে খাদে
পড়া কংগ্রেসকে টেনে তোলা যায়, সে দিকেই প্রণব মুখার্জির মনোনিবেশ করা উচিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
No comments