বুড়ো গরু নিয়ে বিপাকে ভারত
দুধ
দেওয়ার ক্ষমতা হারানো বয়স্ক গাভি নিয়ে ভারতের দুগ্ধশিল্পে নতুন সংকট তৈরি
হয়েছে। এত দিন কৃষক বা গরুর খামারিরা এসব গাভি বিক্রি করে দিতেন মাংস
ব্যবসায়ীদের কাছে। গরু বিক্রির টাকা দিয়ে আবার তাঁরা নতুন গাভি কিনতেন।
কিন্তু গরু জবাই করা নিয়ে দেশটিতে রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে খামারিরা তাঁদের
পালিত পশু বিক্রি করতে পারছেন না। এতে দেশটির ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি রুপির
দুগ্ধশিল্পে খামারি ও কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের সনাতন
ধর্মাবলম্বীরা গরুকে পবিত্র প্রাণী মনে করে। তাঁদের অনেকের মতে, গরু হত্যা
বা জবাই করা একটি গর্হিত কাজ। ২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায়
আসার পর গরু হত্যা বন্ধ নিয়ে কাজ করা কট্টরবাদী সংগঠনগুলো অনেক বেশি
সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে গরু ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর
অত্যাচার-নির্যাতনও আগের চেয়ে বেড়ে যায়। গত বছরের মে মাসে গরু হত্যা বন্ধে
সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও পরিস্থিতির
খুব একটা উন্নতি হয়নি। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই ঘোষণা
দিয়ে বা অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের সরাসরি প্রভাব
গিয়ে পড়েছে দেশটির গরুর খামারি, মাংস ও চামড়া ব্যবসায়ীদের ওপর। কৃষক ও গরুর
খামারিরা তাঁদের পশু বিক্রি করতে না পেরে আর্থিক লোকসানে পড়ছেন। ফলে ২০২০
সালের মধ্যে ভারতে দুধের সরবরাহ ও উৎপাদন দ্বিগুণ বাড়ানোর সরকারি পরিকল্পনা
হুমকির মুখে পড়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের গান্ধী রিসার্চ ফাউন্ডেশনের
হিসাবে, গরু জবাই বন্ধ থাকার প্রভাবে বছরে ভারতের খামারিদের আর্থিক ক্ষতির
পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি রুপি। দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া গাভি জবাই করতে না
পারায় বছরে ভারতে দুই কোটি বয়স্ক গরু যোগ হচ্ছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের
পুরানমাসি ভার্মা নামের এক গরুর খামারি এমন পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, বাজারে
এখন গাভির কোনো চাহিদা নেই, এতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। ডেইরি ইন্ডিয়া নামের
একটি প্রকাশনা সংস্থার হিসাবে, ভারতে গত দুই দশকে প্রতিবছর দুগ্ধজাত
পণ্যের চাহিদা বাড়ছে গড়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে।
এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি
জড়িত সাত কোটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার। দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদনকারী বড়
প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই দুধ কিনে থাকে। ফ্রান্সের
বহুজাতিক খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ডানোন ইতিমধ্যেই ভারতের দিল্লির কাছে
একটি দুগ্ধজাত কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে
যাওয়ার বিষয়ে এখন কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারতের দুগ্ধপণ্য বিক্রির
প্রতিষ্ঠান কোয়ালিটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাগর খান্নার মতে, মানুষের আয়
বাড়লে দুগ্ধজাত পণ্য ক্রয়ে বেশি খরচ করে। এ কারণে বেশির ভাগ দুগ্ধজাত
পণ্যের বিক্রিতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ইন্ডিয়াস্পেন্ড নামের একটি
অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমের হিসাবে, ২০১৭ সালে গরু রক্ষাকারীদের আক্রমণের
শিকার হয়ে ভারতে ১১ জন মানুষ মারা গেছেন। গাভি নিয়ে অতিরিক্ত রক্ষণশীলতার
কারণে ভারতের খামারিরা বাধ্য হয়ে মহিষ পালনের দিকে ঝুঁকছেন। তবে একটি সংকর
জাতের গাভির তুলনায় মহিষের দুধ দেওয়ার ক্ষমতা কম। ভারতের মৎস্য ও
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশটিতে একটি মহিষ দিনে গড়ে দুধ দেয় সোয়া
পাঁচ কেজি। আর সংকর জাতের গাভি দিনে গড়ে সাড়ে সাত কেজি দুধ দেয়। ভারতের গো
রক্ষা দল নামের একটি সংগঠনের হিসাবে, বয়স্ক ও কর্মক্ষমতা হারানো গরুর জন্য
ভারতজুড়ে ২০১১ সাল থেকে পাঁচ হাজারের বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব
আশ্রয়কেন্দ্রে গরুর বিনা মূল্যে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। কিন্তু
তারপরও কর্মক্ষমতা হারানো গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গরুর দুধ
উৎপাদনকারী দেশ হলো ভারত। দেশটিতে বছরে ১৬ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টন দুধ
উৎপাদিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে উৎপাদন হয় ১৫ কোটি ৬৮ লাখ
মেট্রিক টন দুধ। তৃতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন হয় প্রায় ১০ কোটি
মেট্রিক টন দুধ। দুধ উৎপাদনে শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে
চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ও ইউক্রেন।
তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ
তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ
No comments