হিউমার, কমেডি, ভাঁড়ামি! by শায়ের খান
হিউমার
হচ্ছে সূক্ষ্ম রসবোধে হাসানো। লিখে বা বলে। আর কমেডি হচ্ছে সূক্ষ্ম কিছু
দেখিয়ে বা বলে হাসানো। যেমন মঞ্চে বা টিভি-মুভিতে। হিউমার বা কমেডিতে সেন্স
অব হিউমার লাগে, বাংলায় যাকে বলে রসবোধ। যাদের রসবোধ নেই, তারা হিউমার
করলে ভাঁড়ামি হয়ে যাবে। ভাত রাঁধতে গিয়ে জাউ হওয়ার মতো। ভাঁড়ামি হচ্ছে
কমেডির সস্তা রূপ। হিউমার একটা ক্ল্যাসিক বিষয়। ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর
হুগো তাঁর বই কেমন বিক্রি হচ্ছে, তা জানতে প্রকাশককে লিখলেন, ‘?’, মানে
বিক্রি কেমন? হিউমারে প্রকাশকও কম যান না।
উত্তরে লিখলেন, ‘!’, অর্থাৎ
ফাটাফাটি! এখন পর্যন্ত বিশ্বে এটিই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত মজার চিঠি চালাচালি।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সেন্স অব হিউমার ছিল ভয়াবহ। তাঁর একটা ঘটনা। জার্মানিতে
এক জাহাজে চড়েছেন উনি। জাহাজে স্কুলের মেয়েদের একটি বনভোজন দলও যাচ্ছে।
সোনালি চুল, নীল চোখের এক মিষ্টি মেয়ে বারবার মুজতবা আলীর দিকে তাকাচ্ছে।
বিব্রত মুজতবা আলী। এত্তটুকুন মেয়ে টাংকি মারছে? জাহাজ থামার আগে আগে
মেয়েটি এসে মুজতবা আলীর পথ আগলে বলে, ‘আমাকে সত্যি কথা বলে যাবে সুইট
হানি?’ ধক করে উঠল মুজতবা আলীর বুক। বললেন, ‘বলো ছোট্ট মেয়ে, কী জানতে
চাও?’ মেয়ে বলল, ‘তুমি চুলে কী রং লাগাও?’ হেসে মুজতবা বললেন, ‘আমার চুল
ন্যাচারালিই কালো।’ মেয়ে বলে, ‘মিথ্যুক! লুকাচ্ছ। যদি না বলো, আমি মিসকে
বলে দেব যে তুমি আমার সঙ্গে টাংকি মারছিলে।’ কাঁপন ধরে গেল মুজতবার। বুদ্ধি
আঁটলেন। চট করে শার্টের বোতাম খুলে বললেন, ‘দেখো, আমার বুকের চুলও কালো।
বুকের চুল কেউ কালার করে?’ মেয়ে এবার বিশ্বাস করল। অবাক হয়ে তাকিয়ে ‘ইউ আর
সো বিউটিফুল’ বলে দৌড়ে উধাও হয়ে গেল। রসবোধ যাদের ভালো, তারা বুদ্ধিমান হয়।
চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের রসবোধ তীক্ষ্ণ ছিল। লেখক নারায়ণ
গঙ্গোপাধ্যায়ের রসবোধ ছিল প্রশ্নাতীত। শিবরাম চক্রবর্তীর হাস্যরসজ্ঞান ছিল
কিংবদন্তি। আর আমাদের হুমায়ূন আহমেদের রসবোধ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ
নেই। রসবোধের সঙ্গে তীক্ষ্ণ চোখের সম্পর্ক আছে। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন,
টাকওয়ালা মানুষ টাকাওয়ালা হয়। টাক মাথার কোনো ভিক্ষুক সহজে চোখে পড়ে না।
আরে তাই তো? এ পর্যন্ত কোনো ভিক্ষুকের মাথায় তো টাক দেখিনি? এবার আমার
মাথায়ও একটা মজার ভাবনা এল।
আমার মনে হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমের সঙ্গে চোখের
পাওয়ারের একটা সম্পর্ক আছে। এখন পর্যন্ত চশমাওয়ালা কোনো রিকশাওয়ালা
দেখিনি। আপনি দেখেছেন? আমি আমার রসবোধের কথা বলিনি। চিন্তাটা বললাম মাত্র।
হিউমার সেন্স যে শুধু লেখক-সেলিব্রিটিদের মধ্যেই থাকবে, তা না। সাধারণ
মানুষের মধ্যেও অসাধারণ রসবোধ থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সাধারণ মানুষের
মন্তব্যে অসাধারণ হিউমার পাওয়া যায়। খবর বের হলো, ভারতে এক প্লেন থেকে কয়েক
কেজি মানববর্জ্য আকাশ থেকে ফেলায় সাধারণ মানুষ ওগুলোকে ভিন্ন জগতের দামি
বস্তু ভেবে ঘিরে রাখে। পরে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, ওগুলো প্লেনের ফেলা
বর্জ্য। এই খবরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন মন্তব্য করেন, ‘যে দেশে ৭০ শতাংশ
মানুষ খোলা আকাশে টয়লেট করে, সে দেশের প্লেন খোলা আকাশে উড়ে টয়লেট করবে,
সেটাই তো স্বাভাবিক।’ ভারতের আদালত এখন ‘প্লেনের মানববর্জ্য ত্যাগ’ আইন
করার চিন্তাভাবনা করছে। ঢাকাইয়াদের রসবোধ ঐতিহাসিক। এক দাপুটে সিনিয়র
ঢাকাইয়া বিপদে পড়েছেন। তাঁকে বললাম, তাঁর চেয়ে কম কোয়ালিটির লোকজন এগিয়ে
যাচ্ছে। একমুহূর্ত দেরি না করে বললেন, ‘জ্যামে পড়লে মার্সিডিজ থেইকা
ঠ্যালাগাড়ি ভি আগে লউড়ায় (দৌড়ায়)!’ উত্তরটা যেন তৈরিই ছিল। আমাদের দর্শকদের
হিউমার সেন্স বা চিন্তার গভীরতা অনেক উন্নত। তারা হিউমার আর ভাঁড়ামির
পার্থক্যটা ভালোভাবেই বোঝে। নইলে বিশ-পঁচিশ বছর আগের হুমায়ূন আহমেদের
দর্শকপ্রিয়তা এত হতো না। চার্লি চ্যাপলিন দিয়েই কমেডি আর ভাঁড়ামি বোঝা
যাবে।
তার ‘সিটি লাইটস’ মুভিতে নগর মেয়র একটি বিশাল স্ট্যাচু বা মূর্তি
উদ্বোধন করবেন। ত্রিপলে ঢাকা মূর্তিটি। ভবঘুরে চ্যাপলিন রাতে ত্রিপলের নিচে
মূর্তির কোলেই ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ত্রিপল উন্মোচিত হলো, পতাকা উত্তোলন
হলো, বিউগলে জাতীয় সংগীত বেজে উঠল, সৈন্যরা স্যালুট দিল। ঘটনার আকস্মিকতায়
চ্যাপলিন ভয়ে দৌড় দিতে গেলে মূর্তির হাতের উন্মুক্ত তলোয়ার তার
পশ্চাদ্দেশের কোমরের বেল্টে ঢুকে যায়। পেছনে তলোয়ারবিদ্ধ অবস্থায় তলোয়ারে
ঝুলে থেকে বাতাসে সাঁতার কাটতে থাকে চার্লি চ্যাপলিন। দৃশ্যটি কল্পনা করুন।
প্রচুর খরচ করে বানানো মূর্তির তলোয়ারে পশ্চাদ্দেশ আটকে ঝুলে আছে গত রাতে
না খাওয়া পথের ছেলে চ্যাপলিন, আর বেজে চলেছে বিউগল, স্যালুট দিচ্ছে
নগরপিতাসহ এলিট গার্ড! এখানে চার্লি চ্যাপলিন যদি ঝুলে না থেকে বেল্ট খুলে
নগ্ন হয়ে যেতেন, সেটা হয়ে যেত ভাঁড়ামি। হিউমার, কমেডি আর ভাঁড়ামি পাশাপাশি
বহমান নদী। কমেডির পানি জীবাণুমুক্ত, ভাঁড়ামির পানি বিষাক্ত। আপনি যখন
কিছুই না করে চুপচাপ বসে থাকেন, সেটাও হতে পারে কমেডি। আবার কমেডি করতে
গিয়ে স্থূল কথাবার্তা বা মুখ ভেংচি কাটাকাটি করলে তা হয়ে যাবে ভাঁড়ামি।
জীবনের চারদিকে রয়েছে কমেডি। আপনি তা ধরতে না পারলে হয়ে যাবে ট্র্যাজেডি।
কমেডি-সম্রাট চার্লি চ্যাপলিনের ভাষায়, ‘জীবনকে ক্লোজ শটে দেখলে তা
ট্র্যাজেডি আর লং শটে দেখলে তা কমেডি!’
শায়ের খান: লেখক, নাট্যকার, অনুষ্ঠান নির্মাতা
শায়ের খান: লেখক, নাট্যকার, অনুষ্ঠান নির্মাতা
No comments