পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে by গোলাম রব্বানী
যেকোনো
উন্নয়ন প্রকল্পের আগে তার পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা জরুরি। সংবিধানের
১৮(এ) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারের দায়িত্ব পরিবেশ
সংরক্ষণ করা; কেননা, গাছ পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান এবং আমাদের জীবনের
অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ কারণে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য যদি কোনো গাছ কাটার
দরকার হয় তাহলে অবস্থানগত ছাড়পত্র, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা এবং গাছ কাটার
জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরিবেশ
সমীক্ষার বিষয়টি আমাদের কাছে এখনো খুব পরিষ্কার নয়। এর জন্য আমাদের পরিবেশ
মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু তাদের কাছে পরিবেশগত প্রভাব বলতে আসলে কী বোঝায়,
তার আইনি ব্যাখ্যা কী আছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সংজ্ঞা, পরিমাপের
একক নির্ধারণ করা আছে? সরকার উন্নয়নমূলক কাজ করছে, করতেই হবে। তাই বলে
বাছবিচার ছাড়া? রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে,
মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর করা হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা
হচ্ছে, সেগুলোর কোথাও কি ঠিকমতো পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা হয়েছে?
সেই
সমীক্ষা কখনো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে? সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে
আমাদের দেশে পরিবেশগত প্রভাবের সমীক্ষার জন্য আদৌ কোনো নির্দেশক নীতি আছে
কি? অথচ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় ছোট-বড় যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের আগে
ঠিকমতো পরিবেশ সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। ফলে ওদের পরিবেশ অনেক ভালো। ওদের
উন্নয়নও অনেক টেকসই। তাই বলে খরচ কিন্তু বেশি হয় না। দেখা গেছে, কাজ শুরুর
আগে পরিবেশ সমীক্ষা করা লাভজনক। সাধারণত কোনো উন্নয়নমূলক কাজ যে পরিকল্পনা
কমিটি গ্রহণ করে, তারা টেন্ডার দেয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেটা বাস্তবায়নের
ব্যবস্থা করে। তারা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানকে কাজের দায়িত্ব দেয়। সাধারণত
প্রকৌশল সংস্থার ভেতরেই পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার দল থাকে, যারা সমীক্ষা
করে প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদন পরিকল্পনা কমিশনের কাছে যায়। পরিকল্পনা
কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় কাজ শুরু করা যাবে কি না। সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে ঠিক
কীভাবে করাটা সবচেয়ে ভালো, সেটাও তারা ঠিক করে। আমাদের জানা দরকার
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ক্ষেত্রে ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে (সরকার শেষ পর্যন্ত
গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে)। এই মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের
পরিকল্পনা কমিশনে কে কে আছেন? প্রকল্পের ঠিকাদারি সংস্থাটির নাম কী?
সংস্থাটি যে প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের পরিবেশগত প্রভাব
সমীক্ষা করার সক্ষমতা আছে কি না? না থাকলে তাদের বাজেটে এই সমীক্ষার জন্য
বরাদ্দ আছে কি না? বাইরের কোনো সংস্থাকে সমীক্ষার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে
কি না? আগে একে বলা হতো পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট
অ্যাসেসমেন্ট, ইআইএ), ইদানীং বলা হচ্ছে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা
(এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, ইএসআইএ)। কারণটাও
পরিষ্কার, শুধু মাটি বা সেখানকার গাছপালার মূল্যই জমির সবকিছু নয়। এর
সামাজিক মূল্য আছে। ধরা যাক, যশোর রোডের শিরীষগাছের বাজারমূল্য ৫০০ কোটি
টাকা, কিন্তু এই গাছের সঙ্গে জড়িত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক মূল্য
টাকায় হিসাব করা যায় না। এগুলো অমূল্য সম্পদ বলেই সমীক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিক
যে মডেল বা ফ্রেমওয়ার্ক আছে, তা কখনোই সম্পূর্ণ নয়। যেসব কোম্পানি সমীক্ষা
করে থাকে তারা তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করে। পরিবেশগত
প্রভাব সমীক্ষার বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। তবে যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না
কেন, কিছু কিছু মৌলিক বিষয় থাকতে হবে, যেমন সম্প্রসারণ কাজটি বাস্তবায়ন
করতে গেলে স্থানীয় ও জাতীয় কোন কোন সংস্থার কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে তার
বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। মহাসড়ক–সংশ্লিষ্ট পরিবেশের আদর্শ অবস্থা নির্ণয়
করতে হবে। তারপর সম্প্রসারণের জন্য কী কী পরিবর্তন আনতে হবে, তার
পুঙ্খানুপুঙ্খ তালিকা করতে হবে ।
১. যেমন এই রাস্তা ঘিরে কী কী উদ্ভিদের জীবন নির্ভর করে, তাদের উৎপাদিত অক্সিজেন এবং শোষিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কত। এগুলো না থাকলে ওই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর তার কোন ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে।
২. রাস্তার গাছগুলোতে পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুড়সহ কত প্রজাতির প্রাণী বছরের কখন কী কারণে আসে, তা নিবিড়ভাবে হিসাব করতে হবে। কেটে ফেললে তারা কোথায় যাবে? এমন কিছু প্রাণী ও পাখি আছে, যেগুলো শুধু শিরীষগাছের ফুল-ফলের সময় আসে ও তা খায়, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায় এবং তারপর চলে যায়। পরের বছর আবার আসে।
৩. মহাসড়কের দুই ধারে ফসলি জমি। এটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী উজাড় করে ফেললে প্রকৃতির আচরণ বদলে যাবে। কৃষিতে তার প্রভাব পড়বে। মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাবে, পিএইচের মাত্রা বেড়ে যাবে, অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাবে। মাটি উৎপাদনক্ষমতা হারাবে। পরিবেশের এই পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কত বছর লাগবে, সেটা বের করতে হবে। সম্প্রসারণের পর পরিবেশ আদর্শ অবস্থায় ফিরে আসতে যদি ১০০ বছর লাগে, ক্ষতির পরিমাণ হিসাবের সময় তা আমলে নিতে হবে। মহাসড়ক সম্প্রসারণের বিকল্প উপায়গুলো বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। সেখানে প্রযুক্তিগত বিকল্প এবং তার খরচের ব্যাখ্যা থাকতে হবে। গাছ রেখে পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করার সময় অনেক ভারী গাড়িসহ যন্ত্রপাতি আসবে। ভয়াবহ শব্দদূষণের ফলে প্রাণীগুলো ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে। কীভাবে কম শব্দ এবং ভীতি তৈরি না করে রাস্তা তৈরি করা যায়, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা উল্লেখ করতে হবে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিকল্প থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে।
১. যেমন এই রাস্তা ঘিরে কী কী উদ্ভিদের জীবন নির্ভর করে, তাদের উৎপাদিত অক্সিজেন এবং শোষিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কত। এগুলো না থাকলে ওই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর তার কোন ধরনের প্রভাব পড়বে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে।
২. রাস্তার গাছগুলোতে পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুড়সহ কত প্রজাতির প্রাণী বছরের কখন কী কারণে আসে, তা নিবিড়ভাবে হিসাব করতে হবে। কেটে ফেললে তারা কোথায় যাবে? এমন কিছু প্রাণী ও পাখি আছে, যেগুলো শুধু শিরীষগাছের ফুল-ফলের সময় আসে ও তা খায়, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায় এবং তারপর চলে যায়। পরের বছর আবার আসে।
৩. মহাসড়কের দুই ধারে ফসলি জমি। এটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী উজাড় করে ফেললে প্রকৃতির আচরণ বদলে যাবে। কৃষিতে তার প্রভাব পড়বে। মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাবে, পিএইচের মাত্রা বেড়ে যাবে, অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাবে। মাটি উৎপাদনক্ষমতা হারাবে। পরিবেশের এই পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কত বছর লাগবে, সেটা বের করতে হবে। সম্প্রসারণের পর পরিবেশ আদর্শ অবস্থায় ফিরে আসতে যদি ১০০ বছর লাগে, ক্ষতির পরিমাণ হিসাবের সময় তা আমলে নিতে হবে। মহাসড়ক সম্প্রসারণের বিকল্প উপায়গুলো বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। সেখানে প্রযুক্তিগত বিকল্প এবং তার খরচের ব্যাখ্যা থাকতে হবে। গাছ রেখে পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করার সময় অনেক ভারী গাড়িসহ যন্ত্রপাতি আসবে। ভয়াবহ শব্দদূষণের ফলে প্রাণীগুলো ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে। কীভাবে কম শব্দ এবং ভীতি তৈরি না করে রাস্তা তৈরি করা যায়, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা উল্লেখ করতে হবে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিকল্প থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে।
মুজিবনগরের আম্রকানন, রমনার বটমূলের মতো এই মহাসড়কের
গাছগুলোর সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিকল্প নেই। মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা
করার সময় নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, সম্প্রসারণের সময় সমীক্ষায় উল্লিখিত
বিষয়গুলো যথাযথ অনুসরণ করা হচ্ছে কি না—এসব পর্যবেক্ষণের জন্য কী কী
ব্যবস্থা নিতে হবে, তাও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। ভালো মানের সমীক্ষায়
জনসাধারণের অংশগ্রহণে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে কারণে সমীক্ষার জন্য যে
প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের পরিকল্পনা, মাঠপর্যায়ে সমীক্ষার দলিল
ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন ধাপে ধাপে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি
পর্যায়ে সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের
ভেতর একাধিক মাধ্যমে মতামত আহ্বান করা হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এই
অদূরদর্শিতা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি। উন্নয়নের জোয়ারকে টেকসই করতে
ছোট-বড় প্রতিটি প্রকল্পের যথাযথ পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে
হবে।
গোলাম রব্বানী: পরিবেশ ও সমাজবিষয়ক গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, যুক্তরাজ্য।
গোলাম রব্বানী: পরিবেশ ও সমাজবিষয়ক গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, যুক্তরাজ্য।
No comments