কিশোরদের অপরাধ-প্রবণতা কেন বাড়ছে by আবুল মোমেন
কিছু
কিছু কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তারা দল বাঁধছে এবং এক দল অন্য দলের সঙ্গে
দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে। খুনের মতো সহিংসতায় মেতে উঠতে তাদের বাধছে না।
তেরো-চৌদ্দ থেকে ষোলো-সতেরো বছরের কিশোররা এসব করছে। এ বয়সের আরেক দল
ধর্মীয় জঙ্গিবাদের দিকেও ঝুঁকছে। আরেক দল মাদকের নেশায় পড়ে যাচ্ছে।
এরা
অবশ্যই দেশের কিশোরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নয়, কিন্তু একটি সুস্থ সমাজে এত
কিশোর বিপথগামী হওয়ার কথা তো নয়। সব কিশোরই জীবনের এ পর্যায়ে যৌন চেতনার
উন্মেষে শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভোগে। সমাজ, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
তাকে এ সমস্যার সমাধান দেয় না, তাদের ভোগান্তি লাঘবে পাশে দাঁড়ায় না। উল্টো
সমস্যার জট খুলতে গিয়ে শাসনের ব্যবস্থাই কেবল বাড়ছে। উপদেশ, আইন,
নীতিবাক্য, শাস্তি দিয়ে বা শাস্তির ভয় দেখিয়ে শিং গজানো ছেলেদের বাগে রাখতে
চায় সমাজ ও রাষ্ট্র। এতে কিশোরদের বিপথগামিতার সংক্রমণ বাড়বে। সাধারণত
ছেলেদের একদল থাকে লাজুক এবং তারা মেয়েদের এড়িয়ে চলে, কিন্তু প্রায় সবাই
মেয়েদের প্রতি আগ্রহ কিংবা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক (অর্থাৎ বন্ধুত্ব) করার সহজ
কোনো পথ জানে না। উল্টো দিক থেকেও বিষয়টা সত্য, অর্থাৎ মেয়েরাও একইভাবে
মেলামেশার কোনো সহজ পথ জানে না। তেমন কোনো পথ সমাজও তাদের জন্য খুলে দিতে
পারেনি। এখন তো প্রায় একতরফা নানাভাবে ছেলেদের কথায়, আচরণে, দৃষ্টিতে যৌন
নিগ্রহের শিকার হয়ে মেয়েদের পক্ষে ছেলেদের প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করাই
মুশকিল হয়ে পড়েছে। এতে মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের নিয়ে ভয় তৈরি হচ্ছে। বাস্তবতা
সুস্থ সমাজ গঠনের পথে বাধা। এ বিষয়টা সংবেদনশীল ও জটিল এবং এ নিয়ে কাজ
করার ক্ষেত্রে আমাদের মনোভাব, ভাবনা ও অভ্যাসে কিছু বদল ঘটানোর চ্যালেঞ্জ
আছে, সে কথা শেষে বলছি। আগে প্রথম দুটি বিষয় একটু বোঝার চেষ্টা করা যায়।
কেন ছেলেরা দল বেঁধে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে, প্রতিপক্ষের যে কাউকে খুন
করতেও পিছপা হচ্ছে না এবং কেনই-বা তাদের একটি দল ধর্মীয় মৌলবাদ ও তা থেকে
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে মানুষ খুন করার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে? ব্যক্তিত্বের
উন্মেষ শৈশবে হলেও কিশোর বয়সে ঘটে ব্যক্তিত্বের জাগরণ। এটাই বয়ঃসন্ধিকাল। এ
সময় কিশোরের শরীরে-মনে যে আলোড়ন ঘটে, তাতে ভাঙা-গড়া, উল্লঙ্ঘন-উত্তরণ দুটি
ক্রিয়ারই প্রণোদনা কাজ করে।
এ সময়ে তাদের মধ্যে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার
প্রবণতা তীব্র হয়, তারা চায় সনাতন সাধারণ গতানুগতিকের গণ্ডি ভেঙে নতুন,
অসাধারণ, গণ্ডিছাপানো কোনো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। তাকে মহৎ আদর্শ
অনুপ্রাণিত করে, কিশোরই পারে তেমন আদর্শের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে।
আমাদের ইতিহাস থেকে আমরা চৌদ্দ বছরের কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর নাম
করতে পারি, যে কিনা দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে
দাঁড়িয়েছিল। আর সেই কিশোরকে স্মরণ করতে পারি, যার কথা পাকিস্তানি এক সামরিক
কর্মকর্তা লিখেছিলেন তাঁর বইয়ে। কিশোরকে ধরে এনে হাত বেঁধে বারবার বলা
হয়েছিল, বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ। সে প্রতিবার উচ্চারণ করেছিল, ‘জয় বাংলা’।
টোপ দেওয়া হলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। তবু কিশোর
রাজি হয়নি। সে আবারও বলেছিল, জয় বাংলা। শেষে তাকে বলা হলো, পাকিস্তান
জিন্দাবাদ বললে মিলবে মুক্তি আর জয় বাংলা বললে গুলি, নির্ঘাত মৃত্যু। সেই
কিশোর তখন মাতৃভূমির মাটি কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
সে জয় বাংলা বলতে বলতে প্রাণ দিয়েছিল। একটা কথা বলা দরকার, সেই
মুক্তিযুদ্ধের দিনে মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা আর স্বাধীনতার বেদিতে প্রাণ
উৎসর্গ করার যে অঙ্গীকার সবার অন্তর ছুঁয়েছিল, তার মহত্ত্বই দিয়েছিল জাতিকে
লড়বার প্রেরণা। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-সবার মনে কিশোরের
মতো মহান স্বপ্ন ডানা মেলেছিল, আর কিশোরেরই মতো নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার,
সংসারের ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র গণ্ডি ছাপিয়ে দেশের ও ইতিহাসের বৃহৎ পরিসরে
নিজেকে যুক্ত করার অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল। সব বড় কাজের পেছনে তরুণ প্রাণের
দীপ্তি ও শক্তিই মূল চালিকা শক্তি। সেই জাতিই সার্বিকভাবে উন্নতি করে, যার
মানবসম্পদ তাদের মনের তারুণ্যকে, কিশোরের সতেজ সরলতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
এই কৈশোর, এই তারুণ্য নিষ্পাপ এবং সত্যের শক্তিতে বলীয়ান। সেটা কেন পাপে
জড়াবে, অসত্যের কাছে নতজানু হবে? আমাদের সমাজমানসে অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে
প্রায় স্বাধীনতার পর থেকেই। তরুণদের একাংশও তখন থেকেই অবক্ষয়ের শিকার
হয়েছে। মাঝেমধ্যে প্রকৃত তারুণ্য জেগে উঠে সমাজকে বাঁচার পুষ্টি দিয়েছে,
আশির দশকে আন্দোলন-সংগ্রামে ও নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের সময়, একুশ শতকের
নতুন সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর প্রণোদনায় তারা অনেক সাফল্য দেখিয়েছে।
বিচ্ছিন্নভাবে কৃষি উৎপাদনে বা শিক্ষায় সজীব তরুণ প্রাণের নানা সাফল্য আমরা
দেখছি। এসবই ঘটেছে সংশ্লিষ্ট তরুণ বা সেই সব প্রবীণের দ্বারা, যাঁদের
অন্তরের তারুণ্য ক্ষয় পায়নি।
সমাজে এই সজীব প্রাণশক্তির সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু
প্রাণের অপশক্তির যে দ্বন্দ্ব হওয়ার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখন তা
বজায় নেই। প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটছে বিচ্ছিন্নভাবে এবং কিছুটা অর্থনৈতিক বা
বৈষয়িক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। এর কিন্তু নিজের গণ্ডি ছাপিয়ে
মহত্ত্বের ব্যাপ্ত পরিসরে ভূমিকা রাখার সামর্থ্য থাকবে না। তার জন্য চাই
মানবিক আদর্শের নিঃস্বার্থ প্রকাশ, যেমনটা ব্রিটিশবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী
স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরা দেখেছিলাম। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি এককালে এমন
ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু আজ তাদের সে সক্ষমতা আর নেই। তবে পরিস্থিতি যত
দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে, যেভাবে কিশোর-তরুণেরা বিপথগামী হচ্ছে, তাতে
অক্ষমতার কাঁদুনি গাওয়া সাজে না। আমাদের সামর্থ্য অর্জন করতেই হবে, সে পথ
খুঁজে নিতে হবে। কীভাবে কিশোরদের সহজাত মহত্ত্বের উচ্চাভিলাষকে সমাজ ধারণ ও
লালন করতে পারে, সেটা ভাবা উচিত। তাদের মনে কিছু করার, কিছু একটা করে
দেখানোর, দেখিয়ে দেওয়া যে আমি কিন্তু এ রকম কাজ পারি, সেই সঙ্গে তার মধ্যে
ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা থাকে প্রবল। তারা এমন কিছু করে দেখাতে চায়, যা দশজনের
নজর কাড়বে। সেই সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর-তরুণের মধ্যে কাজ করে
অন্যের, বিশেষত দুস্থের পাশে দাঁড়ানোর, কারও বিপদে কাজে লাগার আগ্রহ। তাদের
মধ্যে জাগ্রত এসব ইচ্ছাই তো ইতিবাচক, কিন্তু তা চর্চার, বিকাশের সুযোগ না
পেলে এই সব ইতিবাচক প্রণোদনাই তাদের ঠেলে দেবে বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারিজমে,
মনের মধ্যে জন্ম নেবে ক্ষোভ ও হতাশা, যা তাদের নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক কাজে
টেনে নিতে পারে। যেসব কিশোর গ্যাংস্টার হওয়ার রোমাঞ্চে মেতে সিনেমার
খলনায়কের মতো বাহাদুরি দেখাতে যায়, তারা ক্রমেই অপরাধের মারাত্মক সব
পর্যায়ে জড়িয়ে যেতে থাকে। এরাই প্রতিশোধ, জিঘাংসায় লিপ্ত হয়, অস্ত্র চালাতে
পারে, খুনকে অপরাধের চেয়ে বাহাদুরি হিসেবে গণ্য করতে শেখে। আইন, নিয়ম,
বিধান ভাঙার মধ্যেও হিরোইজমের তৃপ্তি খোঁজে। বিপথগামীদের এই দল উত্তেজনার
খোরাক বা বিধি ভাঙার রসদ হিসেবে নেশায় মাতে, দল বেঁধে অপরাধ করে, এক
অপরাধের সূত্র ধরে অপরাধের চক্র তৈরি হয়, অপরাধের সূত্রেই তারা পরস্পরের
ঘনিষ্ঠ হয়, আবার কখনো স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়ায়, তাতে মারামারি-খুনোখুনি
হতেই থাকে। আরেক দলের ঝুঁকি নেওয়ার দুঃসাহস থাকে না, কিন্তু অপরাধপ্রবণতার
জ্বালা তাদের ভোগায় এবং অনেকেই ডুবে যায় হতাশায়, তারা মাদকে আকৃষ্ট হতে
পারে। অপর একটি দলকে মহৎ আদর্শের খোরাক জোগাচ্ছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী
গোষ্ঠীগুলো। পশ্চিমের ভ্রান্ত নীতির ফলে মুসলিমদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও
হতাশার আবেগ তৈরি হয়েছে। কিশোর-তরুণেরা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে, মূল
প্রতিপক্ষকে চিনতে না পেরে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধরন ঠিক করতে না পেরে
খুন-জখমের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
এসবের কারণ এ বয়সে তাদের যে মূল
ভূমিকা, সেই শিক্ষার্থীর জীবনটা পরীক্ষা ও মুখস্থের চাপে ক্লিষ্ট; তারা
স্কুল ও কোচিংয়ের বৃত্তে বন্দী। তাদের জীবনে সৃজনশীলতা, নির্মল বিনোদন, দলে
মিলে গঠন ও নির্মাণ, কিংবা জাতীয় জীবনের কোনো বড় আহ্বানে ভূমিকা পালনের
সুযোগ নেই। এই পরীক্ষা-কোচিংয়ের নিষ্পেষণ তাদের কচি মনের স্বাভাবিক বিকাশ
রুদ্ধ করে দেয়। এই অবরুদ্ধ-অবদমিত প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটে অস্বাভাবিক পথে।
সব মিলিয়ে কিশোরদের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন।
সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে কিংবা সাধারণভাবে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কেমনভাবে সহজ
সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, তাতে পরিবেশের ভূমিকা বড়, অভিভাবকদের এ বিষয়ে
মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সমাজে চাই নানান
গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ। চাই বড়দের কার্যকর নির্দেশনা ও সক্রিয়
সাহচর্য। অথচ তাদের পাশে মা-বাবা, শিক্ষক বা সমাজ সেভাবে নেই। তারা
অভিভাবকহীন বড় হচ্ছে। যথাযথ অভিভাবকত্বও কিন্তু শেখার বিষয়। মা-বাবাসহ
সমাজের অভিভাবকেরা যোগ্যতায় পিছিয়ে আছেন, এমনকি এ বিষয়ে সচেতনও নন। তারই
খেসারত দিচ্ছে কিশোর ও তরুণেরা। এই শূন্যতা, এই অযোগ্যতা পূরণ আজ পরিবার,
সমাজ ও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সন্তানকে সময় ও সঙ্গ দিতে হবে,
বয়ঃসন্ধিকালে তাদের চলাফেরা, সঙ্গীদল, আচরণ, কথাবার্তার দিকে বিশেষভাবে
মনোযোগ দিতে হবে। স্কুলে তাদের আনন্দময় সৃজনশীল চর্চার অবকাশ দিতে হবে।
সমবয়সীদের সঙ্গে সুস্থ বিনোদন, নির্মল আনন্দ ও সৃজনশীল দলীয় কাজে উৎসাহ
দিতে হবে। সরকারকে পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যার শিক্ষা থেকে সরে এসে
সত্যিকারের পঠনপাঠনের জগৎ খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অভিভাবককে
অভিভাবকত্বের যথার্থ সমসাময়িক পাঠ নিতে হবে। পুলিশ বা বিচারক, বিধান বা
উপদেশ, আইন বা ধমক, জেল বা বেতের বাড়ি বর্তমান সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখাতে
পারে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments