কাকে মেরে কাকে বাঁচাল ছাত্রলীগ! by নিশাত সুলতানা
প্রথম আলোর শিরোনাম হয়েছে ‘ছাত্রলীগের
হামলায় আহত ৪০ শিক্ষার্থী’। কদিন ধরেই সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, ডাকসু
নির্বাচন, আন্দোলনকারী ছাত্রীদের যৌন হয়রানির জের ধরে প্রক্টরকে আটকে
রাখা, ফলে অজ্ঞাত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা, অতঃপর
তদন্ত ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি ইত্যাদি নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল
ক্যাম্পাসে।
উপাচার্যকে ঘেরাও করাকে কেন্দ্র করে একদিকে বাম সংগঠনরে কর্মী
ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় প্রায় অর্ধশত
শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন কিংবা সামাজিক
মাধ্যমসমূহে হামলা, সহিংসতা, নির্মমতা আর নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত
হয়েছে। বিশেষত ছাত্রীদের ওপর হামলার দৃশ্য ছিল রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেওয়ার
মতো। এই ছবিগুলো একমুহূর্তে আমাকে নিয়ে যায় আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলে পুলিশি অভিযানের ভয়াবহতম দুঃস্বপ্নের
মুহূর্তগুলোতে। ২০০২ সালের ২৩ জুলাই মধ্যরাতে ছাত্রদলের ক্যাডার ও পুলিশ
বাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিত হামলার শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন
শামসুন নাহার হলের সাধারণ ছাত্রীরা। ছাত্রীরা সেদিন শুধু নির্যাতনের শিকারই
হননি, অনেককেই রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় থানায় এবং আটকে রাখা হয়
থানা হাজতে। সেই রাতে প্রত্যক্ষ করেছিলাম নির্যাতনের ভয়াবহতা। ২৪ জুলাই
সকালটি আজও ভুলতে পারিনি। খুব চেনা, খুব ভালোবাসার হলটিকে সেই সকালে মনে
হয়েছিল যেন এক বধ্যভূমি; চারদিকে সুনসান নীরবতা। পুরো হলে আর লনে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য জুতা-স্যান্ডেল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আর দুই
হাতে ভারী দুই ব্যাগ টানতে টানতে সেই সকালে বেরিয়ে আসি হল থেকে। সেদিনের
সেই সকালে হল ছেড়ে বেরিয়ে এলেও ২৩ জুলাই রাতের সেই ভয়াবহতম স্মৃতি শামসুন
নাহার হলে বসবাসকারী প্রতিটি ছাত্রীকে আজও তাড়া করে ফেরে, আমি নিশ্চিত।
যেমন উপাচার্যের কার্যালয়ের ভেতরে ছাত্রলীগের রড দিয়ে প্রহারের ঘটনাও ভুলতে
পারবেন না নির্যাতিতরা। আজও বুঝে উঠতে পারি না, কেন আমরা সেই রাতে এমন
নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। রাজনৈতিক পরিচয়ে হলে বসবাসকারী
বহিরাগতদের হল থেকে উচ্ছেদ করার মতো সাধারণ একটি ঘটনার এমন নির্মম পরিণতি
আজও মেনে নিতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো
সাধারণ দাবিদাওয়া সব সময়ই কেন যেন অসাধারণ এক কৌশলে রাজনৈতিক রূপ নিয়ে
ফেলে আর সাধারণ ছাত্রছাত্রী হন সেই রাজনীতির শিকার। রাজনৈতিক দলের
সম্পৃক্ততার পর কে আসল, কে নকল, আন্দোলনের লক্ষ্য কী, কীই বা উদ্দেশ্য
কিংবা পরিণতি—সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। ২০০২ সালের ২৩ জুলাই
মধ্যরাতে ছাত্রীদের পুলিশি হামলার মুখে রেখে নিজ কোয়ার্টারের উদ্দেশে হল
ছেড়েছিলেন তৎকালীন শামসুন নাহার হলের মাননীয় প্রভোস্ট।
আজ ২০১৮ সালেও
ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়ার সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে ছাত্রলীগের
নিরাপত্তাবলয়ে আশ্রয় খোঁজেন বর্তমান উপাচার্য। এরপর শুরু হয় ছাত্রলীগের
আক্রমণ। ২০০২ সালে শামসুন নাহার হলের বৈধ ছাত্রীরাই নাকি ছিলেন হলের
নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আর আজ নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিতে আখ্যা পেয়েছেন সহিংস ও বহিরাগত হিসেবে। ২০০২ সালে
তৎকালীন ছাত্রদল যেমন হলের নিরাপত্তা রক্ষাকারী হিসেবে পুলিশের সঙ্গে
একাত্ম হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছাত্রীদের ওপর, আজও তেমনি উপাচার্য মহোদয়কে
বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ছাত্রলীগ।
উপাচার্য মহোদয় এমনই উপাচার্য যিনি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভয় পান, আর কাছে
টানেন সন্ত্রাসীদের। একবার যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর মহান রাজনৈতিক
নেতারা এই সমব্যথী দৃষ্টিতে ছাত্রছাত্রীদের আর আমাদের মনোবেদনার কথা
ভাবতেন! একবার কি ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ
ছাত্রছাত্রী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভাবমূর্তির কথা ভাবা যায় না? যদি
না যায়, তাহলে প্রতিবাদ উঠবেই, শিক্ষার্থীরা ভালোবাসার শক্তিতে অশুভর
মুখোমুখি হবেই! লন্ডন-ভিত্তিক টাইমস হাইয়ার এডুকেশন জানিয়েছে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার সেরা ৩৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
অবশ্য নিচের দিকে। আগামী ৫-৭ ফেব্রুয়ারি চীনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এশিয়ান
ইউনিভার্সিটি সামিট-এ ঢাবি উপাচার্য আমন্ত্রিত। সেখানে যদি কেউ তাঁকে
প্রশ্ন করে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা কতটা নিরাপদ? কী উত্তর
দেবেনে তিনি? শামসুন নাহার হলের ঘটনার পরের আন্দোলনে তৎকালীন উপাচার্য ও
প্রক্টরের পতন হয়েছিল, ছাত্রদল দেশজুড়ে গণধিক্কৃত হয়েছিল। আজকের দাপুটে
নায়ক-নায়িকারা সেটা যেন মনে রাখেন।
(লেখার বিষয়বস্তু লেখকের ব্যক্তিগত মত)
নিশাত সুলতানা : লেখক, গবেষক
purba_du@yahoo.com
(লেখার বিষয়বস্তু লেখকের ব্যক্তিগত মত)
নিশাত সুলতানা : লেখক, গবেষক
purba_du@yahoo.com
No comments