‘...তাগো বিচার হইল না, এইডা ক্যামন দেশ!’ by সোহরাব হাসান
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান ভাবতে
পারেন। ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে খুন হওয়া জুবায়ের হত্যা মামলায়
গত বুধবার হাইকোর্ট পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুই আসামির যাবজ্জীবন বহাল
রেখেছেন (যদিও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন
মালয়েশিয়ায় পলাতক রয়েছেন)। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর
ছিদ্দিক হত্যা মামলায় কেউ শাস্তি পাননি। গত বছরের ৭ মে ঢাকার চতুর্থ
অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলায় অভিযুক্ত ১০ আসামিকেই বেকসুর
খালাস দিয়েছেন। আরও বিস্ময়কর হলো নয় মাস আগে আবু বকর হত্যা মামলার রায় হলেও
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর মা–বাবাকে খবরটি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।
জাতির বিবেক বলে পরিচিত গণমাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে তত্ত্ব–তালাশ করেনি। তবে
প্রথম আলোর প্রতিবেদক আসাদুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, তিনি দেরিতে হলেও
মামলার পুরোনো কাগজপত্র খুঁজে বের করে ঘটনাটি জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন।
কেবল আবু বকর হত্যা মামলা নয়, আরও অনেক ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।
আবু বকর ছিদ্দিক খুন হয়েছিলেন ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এ এফ রহমান হলে সিট
বরাদ্দ নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে জুবায়ের
খুন হন ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের নৃশংসতার শিকার
হয়ে। জুবায়েরের মামলায় বিচারিক আদালত পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চ আদালত পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল
রাখলেও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিকে খালাস দিয়েছেন। আসামিপক্ষ আপিল
করার কথা বলেছে। আপিল নিষ্পত্তির পর আশা করা যায় কারাগারে আটক অপরাধীরা
অন্তত শাস্তি পাবেন। কিন্তু আবু বকর হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১০ আসামির কেউই
শাস্তি পাননি।
আবু বকরের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামে।
তাঁর বাবা রুস্তম আলী দিনমজুর। বড় ভাই মুদি দোকানদার। প্রচণ্ড আর্থিক অনটন
সত্ত্বেও তাঁরা আবু বকরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন বড় আশা নিয়ে।
উচ্চশিক্ষা শেষে বাবা–মায়ের দুঃখ–কষ্ট ঘোচাবেন। কিন্তু সেই আশা নিভিয়ে দিল
ছাত্রলীগের সিট বরাদ্দের দ্বন্দ্ব। সেদিন এ এফ রহমান হলের সংঘর্ষে ৪০০৪
নম্বর কক্ষের বাসিন্দা আবু বকর ছিদ্দিকসহ ৩০ জন গুরুতর আহত হন এবং ৩
ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। আবু বকর ছিদ্দিকের
স্মৃতি আমাদের অনেকের কাছে ধূসর হয়ে গেলেও তাঁর মা–বাবা আট বছর ধরেই
বেদনার পাষাণভার বয়ে চলেছেন। তাঁরা জানতেন, সন্তানকে আর কখনো ফিরে পাবেন
না। তবু মনে আশা ছিল অন্তত সন্তান হত্যার বিচার হবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে।
কিন্তু সেই আশার দীপও নিভে গেল আদালতে ঘোষিত রায়ে অভিযুক্ত সব আসামি
বেকসুর খালাসের মধ্য দিয়ে। জুবায়ের হত্যার মতো এই মামলার আসামিরাও ছিলেন
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। কেবল আবু বকর নন, আরও অনেক হত্যা ও দুর্ঘটনা আমাদের
স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। এই সময়েই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর নিকট
অতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রলীগের তিন
নেতা-কর্মী খুন হন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। চট্টগ্রামে এক মা আমরণ অনশন শুরু
করেছিলেন তাঁর সন্তান হত্যার বিচারের দাবিতে। পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের
আশ্বাসে তিনি অনশন ভেঙেছেন। কিন্তু বিচারহীনতার নীরবতা ভাঙবে কি? আবু বকর
হত্যা মামলার বিচারের এই পরিণতি দেখে আমরা বিস্ময় প্রকাশ করতে পারি, দেশের
বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করতে পারি। কিন্তু তাতে আবু
বকরের মা–বাবার কান্না থামবে না। সন্তান হারানোর বেদনা এবং প্রতিকার না
হওয়ার ক্ষোভ তাঁরা পুষে রাখবেন সারা জীবন। নিহত ব্যক্তি যদি দিনমজুরের
সন্তান না হয়ে কোনো প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হতেন, তাহলে কি বিচারের বাণী
এভাবে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে পারত? কিংবা যদি এই হত্যার শিকার হতেন
ছাত্রলীগেরই কোনো ডাকসাইটে নেতা, তাহলে কি সাক্ষ্য–প্রমাণের অভাবে আসামিরা
বেকসুর খালাস পেতেন? তাহলে কি দিনমজুর মা–বাবার সন্তান হত্যার বিচারটুকু
পাওয়ারও অধিকার নেই? সেই ঘটনার পর প্রথম আলোয় মন্তব্য প্রতিবেদন লেখা
হয়েছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী আবু বকরের মা–বাবাকে এখন কী বলবেন?’ রাষ্ট্রের কাছে
সেই প্রশ্ন আবারও রাখছি।
বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি থেকে কবে আমরা বের হয়ে
আসতে পারব? দিনমজুর বাবা যে সন্তানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে, সেই সন্তানই কিনা ফিরে গেল লাশ হয়ে। আর হত্যার
প্রায় আট বছর পর জানা গেল, আবু বকরকে কেউ হত্যা করেননি। খুনের দায়ে যাঁদের
বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাঁরা সবাই ‘বীরদর্পে’ কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন।
আমরা ভারতীয় পরিচালক রাজকুমার গুপ্তর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নো ওয়ান কিলড
জেসিকার কথা জানি। সেখানে নায়িকা খুন হলেও তার খুনিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ
কারণে পরিচালক সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ‘জেসিকাকে কেউ খুন করেনি।’ এখানে
জেসিকার স্থলে গরিব দিনমজুরের মেধাবী সন্তান আবু বকরের নাম বসিয়ে দেওয়া
যায়। এ ক্ষেত্রে তদন্তে পুলিশের গাফিলতিই প্রধানত দায়ী। আবু বকর খুন হওয়ার
পর ওই হলের আবাসিক ছাত্র ও তাঁর বন্ধু ওমর ফারুক হল ছাত্রলীগের সভাপতি
সাইদুজ্জামানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বাদী বলেছেন, মামলার আনীত
অভিযোগ তাঁর লেখা নয়। পুলিশ লিখে দিয়েছে। মামলায় গুলির কথা বলা হলেও
ময়নাতদন্তে এসেছে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকর মারা গেছেন। বাদীর নারাজি
পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তভাব সিআইডির কাছে ন্যস্ত হলেও হত্যা রহস্য
উদ্ঘাটিত হয়নি। মামলার বিচার হয়ে থাকে আদালতে উত্থাপিত তথ্য–প্রমাণ, আলামত
এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতে। কিন্তু আবু বকর হত্যা মামলায় শুরু
থেকেই সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি না ভোঁতা
অস্ত্রের আঘাত—এই দ্বৈরথে বেকসুর খালাস পেয়েছেন আসামিরা।
তা ছাড়া মামলায়
সাক্ষ্য–প্রমাণ হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে নিহত আবু বকরের পরনের
একটি রক্তমাখা লুঙ্গি ছাড়া কিছু উপস্থাপন করেননি। মামলার এজাহারের তথ্য
অনুযায়ী, সিট দখলকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এ এফ রহমান হলের
সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের সমর্থকদের
মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। রাত দেড়টা থেকে ভোর পর্যন্ত ওই সংঘর্ষ চলে। উভয় পক্ষ
রামদা, চাপাতি, পাইপ, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়।
সংঘর্ষ চলাকালে আবু বকর গুরুতর আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আবু বকর হত্যা মামলার রায়ে পুলিশের দুর্বল
তদন্তের বিষয়টি এসেছে আদালতের পর্যবেক্ষণেও। আদালত বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা
আসামিদের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র কিংবা আলামত জব্দ করতে পারেননি। ময়নাতদন্ত
প্রতিবেদনে আদালত দেখতে পান যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের
আঘাতে। রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষীই বলেননি যে আবু বকর সিদ্দিক আসামিদের
ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী প্রায় সব সাক্ষী সুস্পষ্টভাবে
বলেছেন যে ঘটনার সময় ছাত্রদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশের ছোড়া
টিয়ার শেলের আঘাতে আবু বকর মারা যান, যা ভিকটিম আবু বকরের ময়নাতদন্ত
প্রতিবেদন সমর্থন করে। মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আবু বকর হত্যা
মামলার ২২ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আবু বকর
হত্যার পর তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, ‘যেভাবেই হোক
আমি এটাকে হত্যাকাণ্ডই বলব। আমি বরাবর ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। কিন্তু
ছাত্ররাজনীতির নামে মাস্তানি চলতে দেওয়া যায় না।’ প্রথম আলোর খবর থেকে জানা
গেল, তিনি এখনো আবু বকরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু আমাদের
ক্ষমতার রাজনীতি কি কখনো রুস্তম আলীর পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছে? জানতে
চেয়েছে সন্তানহারা পরিবারটি কেমন আছে? আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন,
ছাত্ররাজনীতির নামে মাস্তানি চলতে দেওয়া যায় না।
কিন্তু এখনো সেই
মাস্তানি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। আমরা আবু বকর হত্যা মামলার এই পরিণতিতে
ব্যথিত হলেও খুব অবাক হইনি। সে সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সাহারা
খাতুন। আবু বকর হত্যা সম্পর্কে সাংবাদিকেরা তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি
বলেছিলেন, ‘সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা কোনো ব্যাপার নয়। এমনটি ঘটতেই পারে।
আমরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছি সেটাই বড় বিষয় (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০, প্রথম আলো)।’
আজ আট বছর পর প্রমাণিত হলো আসলেই আবু বকরের হত্যার ঘটনাটি কোনো ব্যাপার নয়।
ব্যাপার হলে সঠিকভাবে মামলা দায়ের করা হতো। সুষ্ঠু তদন্ত হতো। বিচারে
আসামিরা শাস্তি পেতেন। আবু বকরের মৃত্যুর ৪২ দিন পর তাঁর পরীক্ষার ফল
প্রকাশিত হলে দেখা যায়, তিনি যুগ্মভাবে প্রথম হয়েছিলেন। জিপিএ-৪–এর মধ্যে
পেয়েছিলেন ৩.৭৫। প্রথম আলো শিরোনাম করেছিল ‘এবারে প্রথম হয়ে কাঁদালেন বকর।’
সন্তান হত্যার বিচার হলে, অপরাধীরা শাস্তি পেলে সন্তানহারা মা–বাবা কিছুটা
হলেও সান্ত্বনা পেতেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে
আদালতের রায়ের খবর শুনে আবু বকরের মা রাবেয়া খাতুন আঞ্চলিক ভাষায় যে কথাটি
উচ্চারণ করলেন সেটি রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার তথা আমাদের সবার প্রতি প্রচণ্ড
চপেটাঘাত। তিনি বলেছেন, ‘আমার নির্দোষ বাবারে যারা হত্যা করল, তাগো বিচার
হইল না, এইডা ক্যামন দেশ।’ আবু বকরের মায়ের এই প্রশ্নের জবাব কি সরকারের
জানা আছে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments