দেশের মানুষ এবং আমার পরিবারের ভাগ্য এক হয়ে গেছে
রাজনীতিতে
যোগ দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে একাকার করে ফেলেছেন
বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, নিজের কোনো
পৃথক আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাই তার আশা-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত
হয়েছে। এদেশের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়, চড়াই-উৎরাই, সমস্যা-সংকট এবং
বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে তার জীবন। তিনি অভিযোগ
করেছেন, তার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অসত্য ও কুৎসিত অপপ্রচার চালানো
হয়েছে। এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও এদেশের জনগণের বর্তমান সার্বিক দুর্দশার সঙ্গে এসব হেনস্থা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই তার সুদৃঢ় বিশ্বাস।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় দেয়া দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিকালে বিএনপি চেয়ারপারসন এসব কথা বলেন। মামলার প্রেক্ষাপট ও পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান, রাজনীতিতে আগমন, আন্দোলন-সংগ্রাম, সরকার গঠন ও সরকার পরিচালনা, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও অধিকার বঞ্চনার নানা উদাহরণ তুলে ধরেন আদালতে। নিজেকে সামান্য মানুষ আখ্যায়িত করে খালেদা জিয়া বলেছেন, আমি যত সামান্য মানুষই হই না কেন, আমার প্রতি বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়। দেশ ও জাতির দুর্দশা থেকে এটিকে আলাদা করে দেখা যাবে না। আমার নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার। কাজেই আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সব কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধি-বিধান, আইন-কানুন ও বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়।
দেশ-জনগণ ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা
জবানবন্দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, প্রায় তিন যুগ আগে মানুষের ডাকে ও ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে আমি রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখি। সেদিন থেকেই বিসর্জন দিয়েছি নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে। আমি কেন রাজনীতিতে এসেছিলাম? নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন ছেড়ে কেন আমি ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চিত পথে পা দিয়েছিলাম? তখন আমার সামনে মসনদ কিংবা ক্ষমতার কোনো হাতছানি ছিলো না। রাষ্ট্রক্ষমতার অবৈধ দখলদাররা চায়নি আমি রাজনীতিতে থাকি। আমি রাজনীতি না করলে তারা আমাকে অনেক বেশি সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলেছিলো। রাজনীতি করলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে আমাকে ভয়-ভীতিও দেখানো হয়েছিলো। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। কারণ, দেশে তখন গণতন্ত্র ছিলো না। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়া হয়েছিলো। জনগণের অধিকার ছিলো না। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমাকে রাজপথে নামতে হয়েছিলো। আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে। আমার সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। খালেদা জিয়া বলেন, আমি সব সময় চেয়েছি, বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়। মানুষের যেন অধিকার থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে। আমি চেয়েছি, আমাদের অর্থনীতি যেন শক্তিশালী হয়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পায়। সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যই আমার রাজনীতি। আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে একাকার করে ফেলেছি। আমার নিজের কোনো পৃথক আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাই আমার আশা-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমার জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে এদেশের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। তাদের সুখ-দুঃখ ও উত্থান-পতনের সঙ্গে। দেশের মানুষের জীবনের চড়াই-উৎরাই ও সমস্যা-সংকটের সঙ্গে। তাদের বিজয়, বিপর্যয় এবং সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে। দেশ ও জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গেই একাকার হয়ে গেছে আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সম্ভবত সে কারণেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ যখনই দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের মুখে পড়েছে, তখন আমিও দুর্যোগের মুখে পড়েছি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশ ও জাতি যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে, অধিকার হারিয়েছে, বিপন্ন হয়েছে তখন আমিও নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছি। আমার পরিবারও পড়েছে নানামুখী সমস্যা-সংকটে। একইভাবে দেশ ও জাতি যখন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে, জনগণ যখন বিজয়ী হয়েছে, তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেয়েছে তখন আমার নাগরিক অধিকারগুলোও সমুন্নত থেকেছে। জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা যখন সমুন্নত হয়েছে, আইনের শাসন-সুবিচার-গণতন্ত্র ফিরে এসেছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে আমিও সংকট, বিপদ, আক্রমণ, নির্যাতন ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।
আমার নাগরিক অধিকার হরণ হয়েছে বারবার
আদালতের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা হচ্ছে। জারি করা হচ্ছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। প্রায় চার দশকের স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমাকে আমার বাসা ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে বালির ট্রাক দিয়ে কয়েক দফায় দীর্ঘদিন অবরোধ করে রাখা হয়েছে। আমি আমার অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় সে সময় বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। সেই অবরুদ্ধ অবস্থাতেই আমি মৃত্যু-সংবাদ পাই বিদেশে চিকিৎসাধীন আমার একটি সন্তানের। আর সেদিনই আমার এবং আমার সঙ্গে অবরুদ্ধদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, রাস্তায় গাড়ি পোড়ানো এবং বিস্ফোরক দিয়ে মানুষ হত্যার। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায়ই নাকি আমরা এসব করেছি।
এগুলো কি কোনো সভ্য ও মানবিক আচরণ? খালেদা জিয়া বলেন, শাসক মহলের নির্দেশে আমার স্বাধীন চলাচল বিভিন্নভাবে ব্যাহত করা হয়েছে। প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আমার ওপর বারবার হামলার ঘটনা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছে। আমার গাড়ির ওপর গুলি চালানো হয়েছে। আমার গাড়ি বহরে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও নিরাপত্তা রক্ষীরা তাতে আহত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা কেউ আটক হয়নি। কোনো ঘটনার বিচার হয়নি আজ পর্যন্ত। আমার নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অসত্য ও কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং এদেশের জনগণের বর্তমান সার্বিক দুর্দশার সঙ্গে আমার এসব হেনস্থা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। তাই, মাননীয় আদালত, আমি যত সামান্য মানুষই হই না কেন, আমার প্রতি বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়। দেশ ও জাতির দুর্দশা থেকে এটিকে আলাদা করে দেখা যাবে না। কাজেই আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সকল কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধি-বিধান, আইন-কানুন ও বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়। তিনি বলেন, পুরো বিষয়গুলো ব্যাখ্যা না করলে কেবল আইনগত খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরে এই মামলাটির সঠিক চিত্র বিশদ ও নিখুঁতভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই আমি অনুরোধ করবো আমার কথাগুলো একটু শুনবেন। আমাকে সময় দেবেন, যাতে আমি আমার সব কথা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে পারি। যাতে আমি পুরো প্রেক্ষাপট ও পটভূমি তুলে ধরতে পারি। খালেদা জিয়া বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি, জাতির যে অবস্থা এবং ইতিহাসের যে ধারাক্রম আজকে এ ধরনের মামলা সৃষ্টি করেছে সে কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে। না হলে আমার বক্তব্য ও জবাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যে কথাগুলো না বললে সব কিছু স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে না, সেই কথাগুলো তো আমাকে এই সুযোগে বলতেই হবে।
দেশে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার নেই
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশে এখন সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত কোনো সংসদ ও সরকার নেই। সবকিছু একতরফা ও একদলীয় ভিত্তিতে চলছে। যে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে সেই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। যে তথাকথিত সংসদ গঠন করা হয়েছে, সেই সংসদের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হয়নি। বাকি সদস্যদেরও ভোটাররা নির্বাচিত করেনি। প্রহসনের মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়নি। প্রহসনের সংসদ এবং সেই সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকার কখনো বৈধ হতে পারে না। সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দল পর্যন্ত নেই। খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে বিভিন্ন রকম কারসাজি সত্ত্বেও বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সেই শোচনীয় পরাজয় দেখে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীনরা আর কোনো ঝুঁকি নেয়ার সাহস পায়নি। এরপর থেকে তারা পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো পর্যন্ত দখল ও যুদ্ধে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তারা মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ ও অপসারণ করছে। খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে আমরা যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে এক গভীর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা সেই সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাই। আমরা দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বদলে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এটাই কি আমার অপরাধ? সেই কারণেই কি এতো হেনস্তা, এতো মামলা-মোকদ্দমা আমার বিরুদ্ধে?
আমার পরিচয় দেশবাসী জানে
আদালতের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও চাঁদাবাজিসহ নানান রকম মামলা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু তার পরম সৌভাগ্য, কখনো তাকে আমার মতো আদালতে এমন করে হাজিরা দিতে হয়নি। আমি আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক। তাই এই বয়সে এতো ব্যস্ততা ও নানান সমস্যার মধ্যেও যতদূর সম্ভব আদালতে সশরীরে হাজির থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার নিযুক্ত আইনজীবীরা আইনানুগ পন্থায় মামলাসমূহ মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমি কখনো অনিবার্য কারণে আদালতে উপস্থিত হতে না পারলে আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মতো ঘটনা ঘটছে। খালেদা জিয়া বলেন, আমার পরিচয় দেশবাসী জানে। আদালতেরও অজানা নয়। আমি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সফল অধিনায়ক। তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক এবং জননির্বাচিত ও নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাভাষী সৈনিকদের প্রতিরোধ যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ আমাকে ইতিহাস দিয়েছে। এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সে কর্তব্য পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দু’টি শিশু সন্তানসহ গ্রেপ্তার হয়ে এই রাজধানীতে আরো অনেকের সঙ্গে চরম অনিশ্চিত ও দুঃসহ বন্দিজীবন আমাকে কাটাতে হয়েছে। আমাদের বন্দিশিবিরের ওপর বোমাবর্ষণের সময়ে আল্লাহ্র অসীম রহমতে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেছি। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নয়, এরপর আরো অনেকবারই চরম বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আজও বেঁচে আছি। জবানবন্দিতে খালেদা জিয়া বলেন, প্রায় পৌনে নয় বছর স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে জনগণের কাতারে থেকে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমি আপসহীন ভূমিকা রেখেছি। আমি এর জন্য মানুষের অপরিসীম সমর্থন ও দোয়া পেয়েছি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আসনে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে আমি তিন-তিনবার তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছি। আমি আমার জনগণের সেবা করার চেষ্টা করেছি তাদের অর্পিত দায়িত্ব সাধ্য, সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী পালন করে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার এবং মানুষকে দুর্দশামুক্ত করে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছি। উন্নয়নে, উৎপাদনে, শিক্ষায়, নারীশিক্ষায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং সন্ত্রাস মুক্তির অভিযানে অবদান রেখে মানুষের জন্য স্বস্তি ও সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরার পরদিন ১৯শে অক্টোবর বিশেষ আদালতে হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। সেদিন তিনি আদালতে তার প্রথমদিনের জবানবন্দি দেন। একসপ্তাহের মাথায় গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি দিলেন।
হয়েছে। এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও এদেশের জনগণের বর্তমান সার্বিক দুর্দশার সঙ্গে এসব হেনস্থা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই তার সুদৃঢ় বিশ্বাস।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় দেয়া দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিকালে বিএনপি চেয়ারপারসন এসব কথা বলেন। মামলার প্রেক্ষাপট ও পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান, রাজনীতিতে আগমন, আন্দোলন-সংগ্রাম, সরকার গঠন ও সরকার পরিচালনা, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও অধিকার বঞ্চনার নানা উদাহরণ তুলে ধরেন আদালতে। নিজেকে সামান্য মানুষ আখ্যায়িত করে খালেদা জিয়া বলেছেন, আমি যত সামান্য মানুষই হই না কেন, আমার প্রতি বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়। দেশ ও জাতির দুর্দশা থেকে এটিকে আলাদা করে দেখা যাবে না। আমার নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার। কাজেই আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সব কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধি-বিধান, আইন-কানুন ও বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়।
দেশ-জনগণ ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা
জবানবন্দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, প্রায় তিন যুগ আগে মানুষের ডাকে ও ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে আমি রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখি। সেদিন থেকেই বিসর্জন দিয়েছি নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে। আমি কেন রাজনীতিতে এসেছিলাম? নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন ছেড়ে কেন আমি ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চিত পথে পা দিয়েছিলাম? তখন আমার সামনে মসনদ কিংবা ক্ষমতার কোনো হাতছানি ছিলো না। রাষ্ট্রক্ষমতার অবৈধ দখলদাররা চায়নি আমি রাজনীতিতে থাকি। আমি রাজনীতি না করলে তারা আমাকে অনেক বেশি সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলেছিলো। রাজনীতি করলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে আমাকে ভয়-ভীতিও দেখানো হয়েছিলো। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। কারণ, দেশে তখন গণতন্ত্র ছিলো না। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়া হয়েছিলো। জনগণের অধিকার ছিলো না। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমাকে রাজপথে নামতে হয়েছিলো। আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে। আমার সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। খালেদা জিয়া বলেন, আমি সব সময় চেয়েছি, বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়। মানুষের যেন অধিকার থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে। আমি চেয়েছি, আমাদের অর্থনীতি যেন শক্তিশালী হয়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পায়। সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যই আমার রাজনীতি। আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে একাকার করে ফেলেছি। আমার নিজের কোনো পৃথক আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাই আমার আশা-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমার জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে এদেশের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। তাদের সুখ-দুঃখ ও উত্থান-পতনের সঙ্গে। দেশের মানুষের জীবনের চড়াই-উৎরাই ও সমস্যা-সংকটের সঙ্গে। তাদের বিজয়, বিপর্যয় এবং সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে। দেশ ও জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গেই একাকার হয়ে গেছে আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সম্ভবত সে কারণেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ যখনই দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের মুখে পড়েছে, তখন আমিও দুর্যোগের মুখে পড়েছি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশ ও জাতি যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে, অধিকার হারিয়েছে, বিপন্ন হয়েছে তখন আমিও নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছি। আমার পরিবারও পড়েছে নানামুখী সমস্যা-সংকটে। একইভাবে দেশ ও জাতি যখন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে, জনগণ যখন বিজয়ী হয়েছে, তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেয়েছে তখন আমার নাগরিক অধিকারগুলোও সমুন্নত থেকেছে। জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা যখন সমুন্নত হয়েছে, আইনের শাসন-সুবিচার-গণতন্ত্র ফিরে এসেছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে আমিও সংকট, বিপদ, আক্রমণ, নির্যাতন ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।
আমার নাগরিক অধিকার হরণ হয়েছে বারবার
আদালতের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা হচ্ছে। জারি করা হচ্ছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। প্রায় চার দশকের স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমাকে আমার বাসা ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে বালির ট্রাক দিয়ে কয়েক দফায় দীর্ঘদিন অবরোধ করে রাখা হয়েছে। আমি আমার অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় সে সময় বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। সেই অবরুদ্ধ অবস্থাতেই আমি মৃত্যু-সংবাদ পাই বিদেশে চিকিৎসাধীন আমার একটি সন্তানের। আর সেদিনই আমার এবং আমার সঙ্গে অবরুদ্ধদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, রাস্তায় গাড়ি পোড়ানো এবং বিস্ফোরক দিয়ে মানুষ হত্যার। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায়ই নাকি আমরা এসব করেছি।
এগুলো কি কোনো সভ্য ও মানবিক আচরণ? খালেদা জিয়া বলেন, শাসক মহলের নির্দেশে আমার স্বাধীন চলাচল বিভিন্নভাবে ব্যাহত করা হয়েছে। প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আমার ওপর বারবার হামলার ঘটনা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছে। আমার গাড়ির ওপর গুলি চালানো হয়েছে। আমার গাড়ি বহরে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও নিরাপত্তা রক্ষীরা তাতে আহত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা কেউ আটক হয়নি। কোনো ঘটনার বিচার হয়নি আজ পর্যন্ত। আমার নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে বারবার।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অসত্য ও কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এর কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং এদেশের জনগণের বর্তমান সার্বিক দুর্দশার সঙ্গে আমার এসব হেনস্থা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। তাই, মাননীয় আদালত, আমি যত সামান্য মানুষই হই না কেন, আমার প্রতি বর্তমান শাসক মহলের আচরণের কারণ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি কিন্তু সামান্য নয়। দেশ ও জাতির দুর্দশা থেকে এটিকে আলাদা করে দেখা যাবে না। কাজেই আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সকল কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধি-বিধান, আইন-কানুন ও বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়। তিনি বলেন, পুরো বিষয়গুলো ব্যাখ্যা না করলে কেবল আইনগত খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরে এই মামলাটির সঠিক চিত্র বিশদ ও নিখুঁতভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই আমি অনুরোধ করবো আমার কথাগুলো একটু শুনবেন। আমাকে সময় দেবেন, যাতে আমি আমার সব কথা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে পারি। যাতে আমি পুরো প্রেক্ষাপট ও পটভূমি তুলে ধরতে পারি। খালেদা জিয়া বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি, জাতির যে অবস্থা এবং ইতিহাসের যে ধারাক্রম আজকে এ ধরনের মামলা সৃষ্টি করেছে সে কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে। না হলে আমার বক্তব্য ও জবাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যে কথাগুলো না বললে সব কিছু স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে না, সেই কথাগুলো তো আমাকে এই সুযোগে বলতেই হবে।
দেশে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার নেই
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশে এখন সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত কোনো সংসদ ও সরকার নেই। সবকিছু একতরফা ও একদলীয় ভিত্তিতে চলছে। যে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে সেই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। যে তথাকথিত সংসদ গঠন করা হয়েছে, সেই সংসদের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হয়নি। বাকি সদস্যদেরও ভোটাররা নির্বাচিত করেনি। প্রহসনের মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়নি। প্রহসনের সংসদ এবং সেই সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকার কখনো বৈধ হতে পারে না। সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দল পর্যন্ত নেই। খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে বিভিন্ন রকম কারসাজি সত্ত্বেও বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সেই শোচনীয় পরাজয় দেখে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীনরা আর কোনো ঝুঁকি নেয়ার সাহস পায়নি। এরপর থেকে তারা পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো পর্যন্ত দখল ও যুদ্ধে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তারা মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ ও অপসারণ করছে। খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে আমরা যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে এক গভীর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা সেই সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাই। আমরা দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বদলে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এটাই কি আমার অপরাধ? সেই কারণেই কি এতো হেনস্তা, এতো মামলা-মোকদ্দমা আমার বিরুদ্ধে?
আমার পরিচয় দেশবাসী জানে
আদালতের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও চাঁদাবাজিসহ নানান রকম মামলা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু তার পরম সৌভাগ্য, কখনো তাকে আমার মতো আদালতে এমন করে হাজিরা দিতে হয়নি। আমি আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক। তাই এই বয়সে এতো ব্যস্ততা ও নানান সমস্যার মধ্যেও যতদূর সম্ভব আদালতে সশরীরে হাজির থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার নিযুক্ত আইনজীবীরা আইনানুগ পন্থায় মামলাসমূহ মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমি কখনো অনিবার্য কারণে আদালতে উপস্থিত হতে না পারলে আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মতো ঘটনা ঘটছে। খালেদা জিয়া বলেন, আমার পরিচয় দেশবাসী জানে। আদালতেরও অজানা নয়। আমি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সফল অধিনায়ক। তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক এবং জননির্বাচিত ও নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাভাষী সৈনিকদের প্রতিরোধ যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ আমাকে ইতিহাস দিয়েছে। এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সে কর্তব্য পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দু’টি শিশু সন্তানসহ গ্রেপ্তার হয়ে এই রাজধানীতে আরো অনেকের সঙ্গে চরম অনিশ্চিত ও দুঃসহ বন্দিজীবন আমাকে কাটাতে হয়েছে। আমাদের বন্দিশিবিরের ওপর বোমাবর্ষণের সময়ে আল্লাহ্র অসীম রহমতে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেছি। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নয়, এরপর আরো অনেকবারই চরম বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আজও বেঁচে আছি। জবানবন্দিতে খালেদা জিয়া বলেন, প্রায় পৌনে নয় বছর স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে জনগণের কাতারে থেকে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমি আপসহীন ভূমিকা রেখেছি। আমি এর জন্য মানুষের অপরিসীম সমর্থন ও দোয়া পেয়েছি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আসনে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে আমি তিন-তিনবার তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছি। আমি আমার জনগণের সেবা করার চেষ্টা করেছি তাদের অর্পিত দায়িত্ব সাধ্য, সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী পালন করে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার এবং মানুষকে দুর্দশামুক্ত করে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছি। উন্নয়নে, উৎপাদনে, শিক্ষায়, নারীশিক্ষায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং সন্ত্রাস মুক্তির অভিযানে অবদান রেখে মানুষের জন্য স্বস্তি ও সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরার পরদিন ১৯শে অক্টোবর বিশেষ আদালতে হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। সেদিন তিনি আদালতে তার প্রথমদিনের জবানবন্দি দেন। একসপ্তাহের মাথায় গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি দিলেন।
No comments