পুতিন মিথ by সুসান বি. গ্লেসার
ইদানীং
মার্কিন গণমাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সংক্রান্ত কভারেজ
খেয়াল করলে মনে হবে লোকটা ১০ ফুট লম্বা এক ভয়ালসদৃশ ব্যক্তি। তিনি যেন
স্রেফ অঙ্গুলি হেলনে গণতন্ত্রপ্রিয় আমেরিকানদের রাতের ঘুম হারাম করে দিতে
পারেন। তিনি যেন এক মহা শক্তিধর ব্যক্তি যিনি আমেরিকাকে বহু জায়গায়
নাস্তানাবুদ করার ক্ষমতা রাখেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা একটাই। রাশিয়া নিয়ে
সবচেয়ে তুখোড় যেসব বিশেষজ্ঞকে আমি চিনি, তারা এবং খোদ বহু রাশিয়ানই
পুতিনকে নিয়ে এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন। অনেকেই বরং মনে করেন, পুতিনের এমন
ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে আমেরিকানরা, যাদেরকে তিনিই পছন্দ করেন না।
রাশিয়ার এই নেতা এক ধরণের সমীহ করার মতো ভাবমূর্তি অর্জন করে ফেলেছেন। ঠিক যেটা তিনি চান।
পুতিনের হাতে এক দশকের কারাদ- পাওয়ার আগ পর্যন্ত রাশিয়ার সবচেয়ে ধন্যাঢ্য ব্যক্তিটি ছিলেন মিখাইল খদরকোভস্কি। পরে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। পুতিনের এই সমীহ জাগানিয়া ভাবমূর্তিকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘মহান ও ভয়ঙ্কর পুতিনকে নিয়ে লোককথা (মিথ)’ হিসেবে।
এর অর্থ এই নয় যে, পুতিন আসলে গণতন্ত্রপন্থী ব্যক্তি যাকে অনেকে বুঝতে পারেন না। সকল রাশিয়া বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক যিনি শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, বিশ্বমঞ্চে সম্ভাব্য যেকোনো ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি নিশ্চিতভাবেই নির্বাচিত হওয়ার পথে।
কিন্তু যেখানে ওয়াশিংটনের রাজনীতিকরা পুতিনকে মহাপ-িত কৌশলবিদ হিসেবে তুলে ধরছে যিনি কিনা পশ্চিমাদের বুদ্ধি ও শক্তির দৌড়ে পরাজিত করছেন, সেখানে ক্রেমলিন পর্যবেক্ষকরা পুতিনকে দেখেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে। এটা সত্য যে, পুতিন অনেক সময়ই সোভিয়েত আমলের কৌশলে ফিরে যান, যা তিনি শিখেছেন কেজিবি অফিসার থাকাকালে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীদের হাত অনেক দুর্বল। তারা প্রায়ই আক্রমণাত্মক ভঙ্গির বদলে রক্ষণাত্মকভাবে দেশ পরিচালনা করেন। বহির্মূখি হওয়ার বদলে তারা অনেক অন্তর্মূখি। আমরা যতটা ভাবি, ক্ষমতা নিয়ে তারা এর চেয়েও বেশি অনিশ্চয়তাই ভোগেন। যারাই হুমকি হয়ে উঠেন, সত্যিকার অর্থে হোক বা এমনিতেই, তাদেরই দমন করা হয়।
খোদরকোভস্কি এক সাক্ষাৎকারে যুক্তি দেখান, পুতিনকে নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে যে ঘোর বাড়ছে তাতে একটা ফাঁক আছে। জোসেফ স্তালিনের পর পুতিনই এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বেশিদিন দায়িত্ব পালন করা প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমেরিকানরা যেই জিনিসটি দেখতে পারছেন না, তা হলো পুতিন অন্তত স্তালিনের নবরূপ নন।
খোদরকোভস্কির ভাষ্য, ‘পশ্চিমে এক ধরণের মনোভাব আছে যে, পুতিন পুরো দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু বাস্তবে এটি একেবারে সত্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘মস্কোর বাইরের রাশিয়া তিনি পরিচালনা করেন না। দেশের অন্যান্য অঞ্চল যারা পরিচালনা করেন তাদের সঙ্গে তার বোঝাপড়াটা খুবই সাধারণ। আমার যত ভোট দরকার সেসব তোমরা এনে দেবে। বিনিময়ে তোমরা তোমাদের এলাকা নিয়ে যা ইচ্ছে করার সুযোগ পাবে। এভাবেই মূলত কাজ করছে বিষয়টি। সামনের নির্বাচনেও ঠিক এটাই ঘটবে।’
২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার কথিত হস্তক্ষেপ নিয়ে এখন যে চ্যাঁচামেচি চলছে আমেরিকায়, তাতে পুতিনকে একপ্রকারে মহাশক্তিধর হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু পুতিন নিয়ে এই অতিরঞ্জিত ধারণা আরও আগে থেকে পশ্চিমে বিদ্যমান। এই অতিরঞ্জনের ফলে অনেক সময়ই ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা।
পুলিৎজার পুরষ্কার জয়ী সোভিয়েত ইতিহাসবিদ আনা আপেলবম যুক্তি দেখান যে, পুতিন সরকার যে অন্যান্য দেশের নির্বাচনেও হস্তক্ষেপ করেছে সেসবের প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রে অনেকে প্রথমে অগ্রাহ্য করেছেন। যখন তারা এ নিয়ে গা দিতে শুরু করেছেন ততদিনে দেরিয়ে হয়ে গেছে। কারণ, রাশিয়া ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রেও একই কাজ শুরু করেছে। এখন আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অতিরঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।
ট্রাম্পের নির্বাচন জয়ের জন্য রাশিয়ার হ্যাকারদের দায়ী করার মধ্যে ফাঁক হলো আমেরিকান সমাজের যেসব ফাটলকে হ্যাকাররা ব্যবহার করেছিল সেসবকে স্বীকার করা হয় না।
আনা আপেলবম বলেন, ‘রাশিয়া চরমপন্থী রাজনীতি আবিষ্কার করে না। তারা যেটা করে তা হলো, তারা ব্লাক লিভস ম্যাটার (উদারমনা কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার বিষয়ক আন্দোলন)-এর মতো একটা গ্রুপ তৈরি করবে, যেটা আসলে ভুয়া। আবার একই সাথে তারা অভিবাসন-বিরোধী গ্রুপও তৈরি করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অবশ্যই, এ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের মধ্যেও ফাটল আছে। নয়তো ওই গ্রুপগুলোর বার্তা মানুষ শুনবে কেন? অন্য কথায় বলতে গেলে, আমাদের মধ্যে যেই সমস্যা আছে সেটা পুতিনের সৃষ্ট নয়। পুতিন শুধু বুঝতে পেরেছিলেন যে এই সমস্যা আমাদের আছে। এরপর তিনি সেসবকে ব্যবহার করেন।’
মার্কিন নির্বাচনে কারচুপির জন্য আমরা পুতিনকে দায়ী করতে পারি? অবশ্যই। কিন্তু আপেলবম যেই যুক্তি দেখিয়েছেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো রাশিয়া কেলেঙ্কারি আলোচনায় রাশিয়ার ভূমিকাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় না।
আগামী বছর ২৮শে মার্চ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু যেই আবহ তৈরি হয়েছে নির্বাচনকে ঘিরে তা থেকে বোঝা সম্ভব পুতিনবাদ আসলে কীভাবে কাজ করে। এটাও বোঝা যায়, আমেরিকা-বিরোধীতা কীভাবে সবসময় তাকে ক্ষমতায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে।
১৯৯৯ সালের নববর্ষ থেকে পুতিনের শাসন শুরু হয়েছে। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি, কিন্তু এটি প্রায় নিশ্চিত যে তিনি অন্তত আরও ৬ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবেন, যা শেষ হবে ২০২৪ সালে। প্রধান বিরোধী দলীয় ব্যক্তিত্ব অ্যালেক্সি নাভালনিকে নির্বাচনে লড়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র তারই কিছুটা জনসমর্থন আছে। কিন্তু এখন এই দুর্নীতিবিরোধী প্রচারকের বদলে নির্বাচনে একমাত্র লিবারেল প্রার্থী হবেন সম্ভবত সেনিয়া সোবচাক। তিনি রাশিয়া প্লেবয় ম্যাগাজিনের সাবেক মডেল ও রিয়েলিটি টিভি তারকা। তার মৃত পিতা ছিলেন সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র। এই মেয়রের হাত ধরেই পুতিনের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র হয়ে পরে প্রেসিডেন্ট হন।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এটা ভুয়া প্রার্থিতা। আনা আপেলবম মনে করেন, সেনিয়া সোবচাককে দাঁড় করানো হয়েছে যাতে বিরোধী পক্ষকে বোকা প্রমাণ করা যায়। একে নির্বাচন না বলে গণভোট বলা উচিৎ যার মাধ্যমে প্রতি ছয় বছর পর পর রাশিয়ান জনগণ পুতিনের ক্ষমতা নবায়ন করে।
যেই বিরোধী পক্ষ আছে তারা শুধু দুর্বল তা-ই নয়। তাদের মধ্যে বিভাজনও চরমে। যেমন, খোদরকোভস্কিকে যখন নাভালনি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি বলেন নাভালনি বা অন্য কোনো বিরোধী ব্যক্তিত্বকে সমর্থন দিতে তিনি প্রস্তুত নন। বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র নাভালনিরই কিছুটা জনসমর্থন আছে রাশিয়ায়। খোদরকোভস্কি নিজেও ভিন্নমতালম্বী হলেও তার সম্পর্কে রাশিয়ানদের বিরূপ ধারণা রয়েছে। তাকে ভাবা হয় সেসব অভিজাতদের একজন যারা নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত-পরবর্তী অস্থিতিশীলতার সময় টাকা বানিয়েছেন। কোনো নির্দিষ্ট বিরোধী পক্ষকে সমর্থন না দেওয়ার কারণ হিসেবে খোদরকোভস্কি যুক্তি দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পক্ষকে টার্গেট করা সহজ হবে। তবে তিনি নাভালনিকে আখ্যায়িত করেছেন একজন ‘কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে।
আবার আগামী নির্বাচনে কোনো শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ নেই বলে এই নয় যে, পুতিনকে কারও বিরুদ্ধে লড়তে হয় না। বরং, এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে আগামী বছর খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়বেন পুতিন। তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আমেরিকা-বিরোধীতা এত প্রবল থাকবে যা দেখে মনে হবে পুতিনের অপর নির্বাচনী প্রতিপক্ষ বোধ হয় আমেরিকা!
খোদরকোভস্কি বলেন, ‘পুতিনের কিছু স্পষ্ট সমস্যা রয়েছে। তার দেশের অর্থনীতি নিশ্চল হয়ে আছে। তাকে নিয়মিতই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে হয়। আমেরিকার ঘাড়ে দোষ চাপাতে হয়। তাই তাকে এমন কিছু দেখাতে হয় যে তিনি আমেরিকাকে পরাজিত করছেন। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ায় তিনি আমেরিকাকে হারাচ্ছেন, আইএস’কে নয় কিন্তু। ইউক্রেনে তিনি কিন্তু ইউক্রেনিয়ানদের পরাজিত করেননি। তিনি সেখানেও আমেরিকাকে হটিয়েছেন।’
গত সপ্তাহে ভালদাই ক্লাবের এক বার্ষিক বৈঠকে একদল বিদেশী বিশেষজ্ঞকে ক্রেমলিন থেকে রাশিয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পুতিনের কথা শোনার জন্য। এই বৈঠক নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি। সেখানে নিজের বক্তৃতায় পুতিন অনেকখানি সোজাসাপ্টা ভাষায়ই বলেছেন, তার ভাবমূর্তি আমেরিকা-বিরোধী বিশ্ব মনোভাবের ওপর স্থাপিত।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে রাশিয়া বিষয়ক জাতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন অ্যাঙ্গেলা স্টেন্ট। তিনিও ওই ভাষণে অংশ নিয়েছিলেন। স্টেন্ট বলেন, রাশিয়ার যুঝতে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কীভাবে করা সম্ভব এ নিয়ে সকল প্রশ্নই পুতিন এড়িয়ে গেছেন। তিনি বরং জোর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী এক বিশ্বনেতা হিসেবে তার ভূমিকার ওপর। অ্যাঙ্গেলা স্টেন্ট আরও বলেন, এটা ছিল খুবই আমেরিকা-বিরোধী এক বক্তৃতা। তবে ভীতির এক নতুন উপাদান তিনি সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন, সেটা হলো সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে হুঁশিয়ারি। তিনি মূলত বলছিলেন যে, আমরা এখন খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছি। এটাই ছিল তার বার্তা।
আমি স্টেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, খোদরকোভস্কি ও অন্যরা যেই যুক্তি দেখিয়েছেন, অর্থাৎ পুতিনকে তার প্রকৃত ক্ষমতার চেয়েও বড় করে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছে, তার সঙ্গে তিনি একমত কিনা। স্টেন্ট জবাবে বলেন, ‘রাশিয়ায় আমার অনেক বন্ধু ঠিক এটাই বিশ্বাস করে। তারা সবাই একই কথা বলেছে: তোমাদের আমেরিকানদের সমস্যা কি! তোমরাই তাকে এমন ব্যক্তিতে পরিণত করেছো যার যেন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে! এই বিষয়টি শুধু তাকে মহাশক্তিধর হিসেবে ফুটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে তা নয়। এর মাধ্যমে আমেরিকাকে বেশ দুর্বল হিসেবে দেখানো হয়ে যায়।’
কিন্তু স্টেন্ট যেই আমেরিকা-বিরোধীতা পুতিনের কাছ থেকে শুনেছেন, সেটি অনেক ধরেই চলছে। ২০১২ সালেও এর ওপর ভিত্তি করে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন পুতিন। তবে গত সপ্তাহের তার ওই কড়া আমেরিকা-বিরোধী বক্তব্যের পর এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে তার সব আশা শেষ।
(সুসান বি. গ্লেসার মার্কিন রাজনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন পলিটিকো’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রধান কলামিস্ট। এই লেখাটি পলিটিকোতে প্রকাশিত তার লেখা একটি নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ।)
রাশিয়ার এই নেতা এক ধরণের সমীহ করার মতো ভাবমূর্তি অর্জন করে ফেলেছেন। ঠিক যেটা তিনি চান।
পুতিনের হাতে এক দশকের কারাদ- পাওয়ার আগ পর্যন্ত রাশিয়ার সবচেয়ে ধন্যাঢ্য ব্যক্তিটি ছিলেন মিখাইল খদরকোভস্কি। পরে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। পুতিনের এই সমীহ জাগানিয়া ভাবমূর্তিকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘মহান ও ভয়ঙ্কর পুতিনকে নিয়ে লোককথা (মিথ)’ হিসেবে।
এর অর্থ এই নয় যে, পুতিন আসলে গণতন্ত্রপন্থী ব্যক্তি যাকে অনেকে বুঝতে পারেন না। সকল রাশিয়া বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক যিনি শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, বিশ্বমঞ্চে সম্ভাব্য যেকোনো ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি নিশ্চিতভাবেই নির্বাচিত হওয়ার পথে।
কিন্তু যেখানে ওয়াশিংটনের রাজনীতিকরা পুতিনকে মহাপ-িত কৌশলবিদ হিসেবে তুলে ধরছে যিনি কিনা পশ্চিমাদের বুদ্ধি ও শক্তির দৌড়ে পরাজিত করছেন, সেখানে ক্রেমলিন পর্যবেক্ষকরা পুতিনকে দেখেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে। এটা সত্য যে, পুতিন অনেক সময়ই সোভিয়েত আমলের কৌশলে ফিরে যান, যা তিনি শিখেছেন কেজিবি অফিসার থাকাকালে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীদের হাত অনেক দুর্বল। তারা প্রায়ই আক্রমণাত্মক ভঙ্গির বদলে রক্ষণাত্মকভাবে দেশ পরিচালনা করেন। বহির্মূখি হওয়ার বদলে তারা অনেক অন্তর্মূখি। আমরা যতটা ভাবি, ক্ষমতা নিয়ে তারা এর চেয়েও বেশি অনিশ্চয়তাই ভোগেন। যারাই হুমকি হয়ে উঠেন, সত্যিকার অর্থে হোক বা এমনিতেই, তাদেরই দমন করা হয়।
খোদরকোভস্কি এক সাক্ষাৎকারে যুক্তি দেখান, পুতিনকে নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে যে ঘোর বাড়ছে তাতে একটা ফাঁক আছে। জোসেফ স্তালিনের পর পুতিনই এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বেশিদিন দায়িত্ব পালন করা প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমেরিকানরা যেই জিনিসটি দেখতে পারছেন না, তা হলো পুতিন অন্তত স্তালিনের নবরূপ নন।
খোদরকোভস্কির ভাষ্য, ‘পশ্চিমে এক ধরণের মনোভাব আছে যে, পুতিন পুরো দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু বাস্তবে এটি একেবারে সত্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘মস্কোর বাইরের রাশিয়া তিনি পরিচালনা করেন না। দেশের অন্যান্য অঞ্চল যারা পরিচালনা করেন তাদের সঙ্গে তার বোঝাপড়াটা খুবই সাধারণ। আমার যত ভোট দরকার সেসব তোমরা এনে দেবে। বিনিময়ে তোমরা তোমাদের এলাকা নিয়ে যা ইচ্ছে করার সুযোগ পাবে। এভাবেই মূলত কাজ করছে বিষয়টি। সামনের নির্বাচনেও ঠিক এটাই ঘটবে।’
২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার কথিত হস্তক্ষেপ নিয়ে এখন যে চ্যাঁচামেচি চলছে আমেরিকায়, তাতে পুতিনকে একপ্রকারে মহাশক্তিধর হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু পুতিন নিয়ে এই অতিরঞ্জিত ধারণা আরও আগে থেকে পশ্চিমে বিদ্যমান। এই অতিরঞ্জনের ফলে অনেক সময়ই ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা।
পুলিৎজার পুরষ্কার জয়ী সোভিয়েত ইতিহাসবিদ আনা আপেলবম যুক্তি দেখান যে, পুতিন সরকার যে অন্যান্য দেশের নির্বাচনেও হস্তক্ষেপ করেছে সেসবের প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রে অনেকে প্রথমে অগ্রাহ্য করেছেন। যখন তারা এ নিয়ে গা দিতে শুরু করেছেন ততদিনে দেরিয়ে হয়ে গেছে। কারণ, রাশিয়া ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রেও একই কাজ শুরু করেছে। এখন আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অতিরঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।
ট্রাম্পের নির্বাচন জয়ের জন্য রাশিয়ার হ্যাকারদের দায়ী করার মধ্যে ফাঁক হলো আমেরিকান সমাজের যেসব ফাটলকে হ্যাকাররা ব্যবহার করেছিল সেসবকে স্বীকার করা হয় না।
আনা আপেলবম বলেন, ‘রাশিয়া চরমপন্থী রাজনীতি আবিষ্কার করে না। তারা যেটা করে তা হলো, তারা ব্লাক লিভস ম্যাটার (উদারমনা কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার বিষয়ক আন্দোলন)-এর মতো একটা গ্রুপ তৈরি করবে, যেটা আসলে ভুয়া। আবার একই সাথে তারা অভিবাসন-বিরোধী গ্রুপও তৈরি করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অবশ্যই, এ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের মধ্যেও ফাটল আছে। নয়তো ওই গ্রুপগুলোর বার্তা মানুষ শুনবে কেন? অন্য কথায় বলতে গেলে, আমাদের মধ্যে যেই সমস্যা আছে সেটা পুতিনের সৃষ্ট নয়। পুতিন শুধু বুঝতে পেরেছিলেন যে এই সমস্যা আমাদের আছে। এরপর তিনি সেসবকে ব্যবহার করেন।’
মার্কিন নির্বাচনে কারচুপির জন্য আমরা পুতিনকে দায়ী করতে পারি? অবশ্যই। কিন্তু আপেলবম যেই যুক্তি দেখিয়েছেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো রাশিয়া কেলেঙ্কারি আলোচনায় রাশিয়ার ভূমিকাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় না।
আগামী বছর ২৮শে মার্চ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু যেই আবহ তৈরি হয়েছে নির্বাচনকে ঘিরে তা থেকে বোঝা সম্ভব পুতিনবাদ আসলে কীভাবে কাজ করে। এটাও বোঝা যায়, আমেরিকা-বিরোধীতা কীভাবে সবসময় তাকে ক্ষমতায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে।
১৯৯৯ সালের নববর্ষ থেকে পুতিনের শাসন শুরু হয়েছে। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি, কিন্তু এটি প্রায় নিশ্চিত যে তিনি অন্তত আরও ৬ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবেন, যা শেষ হবে ২০২৪ সালে। প্রধান বিরোধী দলীয় ব্যক্তিত্ব অ্যালেক্সি নাভালনিকে নির্বাচনে লড়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র তারই কিছুটা জনসমর্থন আছে। কিন্তু এখন এই দুর্নীতিবিরোধী প্রচারকের বদলে নির্বাচনে একমাত্র লিবারেল প্রার্থী হবেন সম্ভবত সেনিয়া সোবচাক। তিনি রাশিয়া প্লেবয় ম্যাগাজিনের সাবেক মডেল ও রিয়েলিটি টিভি তারকা। তার মৃত পিতা ছিলেন সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র। এই মেয়রের হাত ধরেই পুতিনের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র হয়ে পরে প্রেসিডেন্ট হন।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এটা ভুয়া প্রার্থিতা। আনা আপেলবম মনে করেন, সেনিয়া সোবচাককে দাঁড় করানো হয়েছে যাতে বিরোধী পক্ষকে বোকা প্রমাণ করা যায়। একে নির্বাচন না বলে গণভোট বলা উচিৎ যার মাধ্যমে প্রতি ছয় বছর পর পর রাশিয়ান জনগণ পুতিনের ক্ষমতা নবায়ন করে।
যেই বিরোধী পক্ষ আছে তারা শুধু দুর্বল তা-ই নয়। তাদের মধ্যে বিভাজনও চরমে। যেমন, খোদরকোভস্কিকে যখন নাভালনি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি বলেন নাভালনি বা অন্য কোনো বিরোধী ব্যক্তিত্বকে সমর্থন দিতে তিনি প্রস্তুত নন। বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র নাভালনিরই কিছুটা জনসমর্থন আছে রাশিয়ায়। খোদরকোভস্কি নিজেও ভিন্নমতালম্বী হলেও তার সম্পর্কে রাশিয়ানদের বিরূপ ধারণা রয়েছে। তাকে ভাবা হয় সেসব অভিজাতদের একজন যারা নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত-পরবর্তী অস্থিতিশীলতার সময় টাকা বানিয়েছেন। কোনো নির্দিষ্ট বিরোধী পক্ষকে সমর্থন না দেওয়ার কারণ হিসেবে খোদরকোভস্কি যুক্তি দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পক্ষকে টার্গেট করা সহজ হবে। তবে তিনি নাভালনিকে আখ্যায়িত করেছেন একজন ‘কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে।
আবার আগামী নির্বাচনে কোনো শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ নেই বলে এই নয় যে, পুতিনকে কারও বিরুদ্ধে লড়তে হয় না। বরং, এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে আগামী বছর খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়বেন পুতিন। তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আমেরিকা-বিরোধীতা এত প্রবল থাকবে যা দেখে মনে হবে পুতিনের অপর নির্বাচনী প্রতিপক্ষ বোধ হয় আমেরিকা!
খোদরকোভস্কি বলেন, ‘পুতিনের কিছু স্পষ্ট সমস্যা রয়েছে। তার দেশের অর্থনীতি নিশ্চল হয়ে আছে। তাকে নিয়মিতই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে হয়। আমেরিকার ঘাড়ে দোষ চাপাতে হয়। তাই তাকে এমন কিছু দেখাতে হয় যে তিনি আমেরিকাকে পরাজিত করছেন। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ায় তিনি আমেরিকাকে হারাচ্ছেন, আইএস’কে নয় কিন্তু। ইউক্রেনে তিনি কিন্তু ইউক্রেনিয়ানদের পরাজিত করেননি। তিনি সেখানেও আমেরিকাকে হটিয়েছেন।’
গত সপ্তাহে ভালদাই ক্লাবের এক বার্ষিক বৈঠকে একদল বিদেশী বিশেষজ্ঞকে ক্রেমলিন থেকে রাশিয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পুতিনের কথা শোনার জন্য। এই বৈঠক নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি। সেখানে নিজের বক্তৃতায় পুতিন অনেকখানি সোজাসাপ্টা ভাষায়ই বলেছেন, তার ভাবমূর্তি আমেরিকা-বিরোধী বিশ্ব মনোভাবের ওপর স্থাপিত।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে রাশিয়া বিষয়ক জাতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন অ্যাঙ্গেলা স্টেন্ট। তিনিও ওই ভাষণে অংশ নিয়েছিলেন। স্টেন্ট বলেন, রাশিয়ার যুঝতে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কীভাবে করা সম্ভব এ নিয়ে সকল প্রশ্নই পুতিন এড়িয়ে গেছেন। তিনি বরং জোর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী এক বিশ্বনেতা হিসেবে তার ভূমিকার ওপর। অ্যাঙ্গেলা স্টেন্ট আরও বলেন, এটা ছিল খুবই আমেরিকা-বিরোধী এক বক্তৃতা। তবে ভীতির এক নতুন উপাদান তিনি সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন, সেটা হলো সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে হুঁশিয়ারি। তিনি মূলত বলছিলেন যে, আমরা এখন খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছি। এটাই ছিল তার বার্তা।
আমি স্টেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, খোদরকোভস্কি ও অন্যরা যেই যুক্তি দেখিয়েছেন, অর্থাৎ পুতিনকে তার প্রকৃত ক্ষমতার চেয়েও বড় করে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছে, তার সঙ্গে তিনি একমত কিনা। স্টেন্ট জবাবে বলেন, ‘রাশিয়ায় আমার অনেক বন্ধু ঠিক এটাই বিশ্বাস করে। তারা সবাই একই কথা বলেছে: তোমাদের আমেরিকানদের সমস্যা কি! তোমরাই তাকে এমন ব্যক্তিতে পরিণত করেছো যার যেন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে! এই বিষয়টি শুধু তাকে মহাশক্তিধর হিসেবে ফুটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে তা নয়। এর মাধ্যমে আমেরিকাকে বেশ দুর্বল হিসেবে দেখানো হয়ে যায়।’
কিন্তু স্টেন্ট যেই আমেরিকা-বিরোধীতা পুতিনের কাছ থেকে শুনেছেন, সেটি অনেক ধরেই চলছে। ২০১২ সালেও এর ওপর ভিত্তি করে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন পুতিন। তবে গত সপ্তাহের তার ওই কড়া আমেরিকা-বিরোধী বক্তব্যের পর এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে তার সব আশা শেষ।
(সুসান বি. গ্লেসার মার্কিন রাজনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন পলিটিকো’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রধান কলামিস্ট। এই লেখাটি পলিটিকোতে প্রকাশিত তার লেখা একটি নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ।)
No comments