হেফাজতের সঙ্গে আ.লীগের সখ্যের অভিযোগ: বিভ্রান্তিতে নেতা-কর্মীরা
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সখ্যের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যেই একধরনের বিভ্রান্তি বা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। দলটির অনেক নেতা বলছেন, এমন কোনো সখ্য হলে সেটা তাঁদের দল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই টানাপোড়েনের এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বাদ দিয়ে তাঁরা সবাইকে নিয়েই চলতে চান। সুপ্রিম কোর্টের চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে হেফাজতের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত আছে। আজ শুক্রবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, হেফাজতে ইসলামকে আওয়ামী লীগ একের পর এক ছাড় দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই। বিভাগীয় শহর রাজশাহীর আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতা নুরুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় হেফাজতের যে তাণ্ডব আমরা দেখেছি, এর পরে যদি হেফাজতের যে পলিটিক্যাল ভিউ, সেটার সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়, সেটা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য খুব বেশি মঙ্গলজনক হবে—এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। আমার যাদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কথাবার্তা হয়, তাঁদের অনেকেই উদ্বিগ্ন যে আসলে এইটা হচ্ছে কি বা অ্যাকচুয়ালি কী হয়েছে—এটা এখন পর্যন্ত আমরা পরিষ্কার না।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে রংপুর বিভাগের একটি জেলার আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, তাঁরা দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আজ দুপুরে এক আড্ডায় বসেছিলেন। সেখানে একজন আরেকজনকে ‘হেফাজত’ বলে টিপ্পনী কাটছিলেন। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বরিশাল, মাদারীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, হেফাজতের সঙ্গে তাঁদের দলের সখ্যের অভিযোগ তাঁরা মানতে পারছেন না। যশোরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা সাহারুল ইসলাম বলেন, তাঁদের দলের ভেতরে সুবিধাবাদী কোনো অংশ এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ও রকম কোনো আলোচনা হয় নাই। আর আমি যেটা বুঝেছি, এইখানে নব্য যারা, তারা সুবিধার জন্যই এগুলো করতে পারে—আমরা তৃণমূলের মানুষ তা–ই মনে করি। আমরা যারা তৃণমূলের নেতা, ধরেন আমি উপজেলায় রাজনীতি করি, আমাদের সঙ্গে এ রকম কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। আর আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কারও না।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হেফাজত ইস্যুতে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও অনেকেই অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাঁদের কেউই মুখ খুলছেন না। তবে অনেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিস্থিতির ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, সরকারকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ করে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। সে কারণে এর উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের ভেতর আলোচনা হয়েছে। দলটির অনেকে বলেছেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য সরকারকে বেশি ছাড় দিতে হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দলে টানাপোড়েন বা কারও মধ্যে অস্বস্তির অভিযোগ নাকচ করে বলেন, ‘এখানে অস্বস্তি বোধ করার তো বিষয় না। ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার একটা অংশ সরকারি কাঠামোর বাইরে ছিল। সেটা শেখ হাসিনা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটা কাঠামোর ভেতরে আনলেন।’
আওয়ামী লীগ কি তাহলে ইসলামপন্থীদের একটা অংশকে তাদের সঙ্গে রাখার কৌশল হিসেবে এসব করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী বাদে সবাইকে নিয়েই তো চলছে। কারে না নিয়ে চলছে! আমরাই বলব, ইনক্লুসিভ সোসাইটি আবার যখন সবাইরে নিয়ে চলার, একেবারে ক্ষতিকারক বিষাক্ত পদার্থ এগুলো বাদে যখন সবাইরে নিয়ে চলার কথা আসে, তখন আবার বলে আওয়ামী লীগ আপস করছে। মানে আওয়ামী লীগের অবস্থা হলো পড়লে পাস করবে না, পাস কররে চাকরি পাবে না, চাকরি পাইলে বেতন পাবে না, বেতন পাইলে টাকা তুলবে না। এইটা শুনেই আওয়ামী লীগকে পথ চলতে হয়।’ বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেও এসেছে, দেশের বাস্তবতাকে মানতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ তাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবস্থান টিকিয়ে রাখবে, সেটাই চাইছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীও উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে-ই-হাদিসকে স্নাতকোত্তর স্তরের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী ওই সাক্ষাতেই উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
No comments