বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ
অমর
২১শে ফেব্রুয়ারি আজ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মায়ের ভাষার দাবিতে
বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমান্বিত এক দিন। বাঙালির আত্মগৌরবের স্মারক অমর
একুশের প্রথম প্রহর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে মহান ভাষা
শহীদদের। মধ্যরাতের পর মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়
শহীদ মিনার। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। দিনটিকে ঘিরে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। মধ্যরাতের পর
থেকে সারা দেশের শহীদ মিনারে শুরু হয় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
অর্পণ। সকালে খালি পায়ে প্রভাত ফেরির মাধ্যমে শহীদদের জানানো হয় শ্রদ্ধা।
একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথমে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এবং
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময়
অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাজানো
হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২টা বাজার কিছু সময় আগেই শহীদ মিনারে
পৌঁছান। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ১২টা বাজার পূর্ব মুহূর্তে শহীদ মিনারে
পৌঁছান। এরপর প্রথমে প্রেসিডেন্ট ও তারপর প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ
শেষে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
জানান।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরে মন্ত্রিবর্গ ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, কূটনীতিক বর্গ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। ১৪ দলের পর বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। রাত দেড়টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শহীদদের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এ সময় তিনি শহীদ বেদীতে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপরই ঢল নামে সাধারণ মানুষের। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ফুল হাতে সারি বেঁধে এগিয়ে যান শহীদ বেদির দিকে। শ্রদ্ধা নিবেদনকে ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা গতকাল থেকেই ছিল নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সঙ্গে সারা দেশের শহীদ মিনারগুলোতেও একুশের প্রথম প্রহর থেকে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। সবার কণ্ঠে ছিল অমর সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..।’
দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২-এ জীবন দিয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকে মুখে মুখে বাংলা ভাষা। বাংলায় রচিত হচ্ছে হাজারো গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর অজস্র কথামালা। আজকের দিনটি শুধু সেই বীর ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর, যারা ভাষার জন্য অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনটি কেবল বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের সব প্রান্তে পালিত হবে বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুভেজা অমর একুশে। বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
৬৪ বছর আগের এই দিনে বাংলার সংগ্রামী ছেলেরা যে ত্যাগ ও গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তারই পথ ধরে আমরা মুখোমুখি হই স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাভ করি লাল সবুজের পতাকা। ১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় একটানা এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা, মিছিলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়, চারজন চারজন করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার। ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলতে থাকে। বিকাল ৩টায় গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। বিকাল ৪টায় পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। বুলেট কেড়ে নেয় জব্বার ও রফিকের প্রাণ। গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত রাত পৌনে আটটায় হাসপাতালে মারা যান। তাদের মৃত্যু সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণে সারা দেশে তৈরি হয় অসংখ্য শহীদ মিনার।
ভাষা শহীদদের প্রতি খালেদার শ্রদ্ধা, দোয়েল চত্ত্বরে বাঁধা: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে এই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে রাত ১২টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর তার গুলশানের বাসা থেকে বেরিয়ে শহীদ মিনারের রওনা হয়। রাত ১ টা ৫ মিনিটে তার গাড়ি বহরটি দোয়েল চত্ত্বরে এসে পৌঁছায়।
এসময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের সদস্যরা তার গাড়িটিকে বাঁধা দেন। তারা ওই গাড়ি বহরটিকে পলাশী হয়ে ঢুকতে বলেন। এসময় চেয়ারপারসনের সঙ্গে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে পুলিশ তর্কে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে পরে তার গাড়িবহরের সামনে থেকে ব্যারিকেড তুলে নেয়। এসময় গাড়ির সামনে অবস্থান নেয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে দেড়টার দিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় শহীদ মিনারে শৃংখলা ভেঙে পড়ে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, তরিকুল ইসলাম, আ.স.ম হান্নান শাহ, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে নিজের ডাকা লাগাতার অবরোধের মধ্যে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন।
নিশ্চদ্র নিরাপত্তা: শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতকাল বিকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। শহীদ মিনারমুখী সব রাস্তায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সতর্ক পাহারা। তাদের সঙ্গে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের কয়েক হাজার সদস্য। সন্ধ্যার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার ছাড়া কোনো গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, অমর একুশে উদযাপনের জন্য শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পুরো রাজধানীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার থাকবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দিতে পুরো এলাকায় ছিল চার স্তরের নিরাপত্তা। সব মিলিয়ে ৯০০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন পুরো এলাকায়। এছাড়া র্যাব সদস্যরাও পুরো এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করা হবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামীকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিকাল তিনটায় অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরে মন্ত্রিবর্গ ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, কূটনীতিক বর্গ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। ১৪ দলের পর বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। রাত দেড়টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শহীদদের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এ সময় তিনি শহীদ বেদীতে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপরই ঢল নামে সাধারণ মানুষের। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ফুল হাতে সারি বেঁধে এগিয়ে যান শহীদ বেদির দিকে। শ্রদ্ধা নিবেদনকে ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা গতকাল থেকেই ছিল নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সঙ্গে সারা দেশের শহীদ মিনারগুলোতেও একুশের প্রথম প্রহর থেকে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। সবার কণ্ঠে ছিল অমর সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..।’
দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২-এ জীবন দিয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকে মুখে মুখে বাংলা ভাষা। বাংলায় রচিত হচ্ছে হাজারো গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর অজস্র কথামালা। আজকের দিনটি শুধু সেই বীর ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর, যারা ভাষার জন্য অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনটি কেবল বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের সব প্রান্তে পালিত হবে বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুভেজা অমর একুশে। বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
৬৪ বছর আগের এই দিনে বাংলার সংগ্রামী ছেলেরা যে ত্যাগ ও গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তারই পথ ধরে আমরা মুখোমুখি হই স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাভ করি লাল সবুজের পতাকা। ১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় একটানা এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা, মিছিলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়, চারজন চারজন করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার। ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলতে থাকে। বিকাল ৩টায় গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। বিকাল ৪টায় পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। বুলেট কেড়ে নেয় জব্বার ও রফিকের প্রাণ। গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত রাত পৌনে আটটায় হাসপাতালে মারা যান। তাদের মৃত্যু সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণে সারা দেশে তৈরি হয় অসংখ্য শহীদ মিনার।
ভাষা শহীদদের প্রতি খালেদার শ্রদ্ধা, দোয়েল চত্ত্বরে বাঁধা: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে এই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে রাত ১২টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর তার গুলশানের বাসা থেকে বেরিয়ে শহীদ মিনারের রওনা হয়। রাত ১ টা ৫ মিনিটে তার গাড়ি বহরটি দোয়েল চত্ত্বরে এসে পৌঁছায়।
এসময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের সদস্যরা তার গাড়িটিকে বাঁধা দেন। তারা ওই গাড়ি বহরটিকে পলাশী হয়ে ঢুকতে বলেন। এসময় চেয়ারপারসনের সঙ্গে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে পুলিশ তর্কে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে পরে তার গাড়িবহরের সামনে থেকে ব্যারিকেড তুলে নেয়। এসময় গাড়ির সামনে অবস্থান নেয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে দেড়টার দিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় শহীদ মিনারে শৃংখলা ভেঙে পড়ে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, তরিকুল ইসলাম, আ.স.ম হান্নান শাহ, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে নিজের ডাকা লাগাতার অবরোধের মধ্যে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন।
নিশ্চদ্র নিরাপত্তা: শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতকাল বিকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। শহীদ মিনারমুখী সব রাস্তায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সতর্ক পাহারা। তাদের সঙ্গে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের কয়েক হাজার সদস্য। সন্ধ্যার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার ছাড়া কোনো গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, অমর একুশে উদযাপনের জন্য শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পুরো রাজধানীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার থাকবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দিতে পুরো এলাকায় ছিল চার স্তরের নিরাপত্তা। সব মিলিয়ে ৯০০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন পুরো এলাকায়। এছাড়া র্যাব সদস্যরাও পুরো এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করা হবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামীকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিকাল তিনটায় অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন।
No comments