‘বাঙালি, আমাকে বাঁচাও’ by আবু এন এম ওয়াহিদ
ভাষা শহীদদের স্মরণে কলকাতায় স্মারক প্রতিষ্ঠা |
মারা
যাওয়ার মাত্র ৯ মাস আগে, জানুয়ারি ২৫, ২০১২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার
সম্পাদকীয় পাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। বাংলা
ভাষার এই স্বনামধন্য এবং সুপরিচিত কবি ও ঔপন্যাসিক প্রবন্ধটা লিখেছিলেন
কন্নড় ভাষার এক মহাকবির গুণকীর্তন করে। সুনীল যার সম্পর্কে লিখেছিলেন তিনি
সাহিত্য জগতে কুয়েমপু ছদ্মনামে পরিচিত। তার আসল নাম যেমনি অনেকের কাছে
অজানা তেমনি উচ্চারণে বড়ই কঠিন- কুপ্পালি ভেঙ্কাটাপাগোডা পুট্টাপা। সম্ভবত
পিতামাতার দেয়া এ রকম একটা দাঁতভাঙা নামের কারণেই কবি একটা সহজ ছদ্মনাম
বেছে নিয়েছিলেন। আসলে এ নামেও একটা জটিলতা আছে। ইংরেজিতে কুয়েমপু লিখতে
গেলে শুরুতে একটা ‘ভি’ অক্ষর আছে, কিন্তু উচ্চারণে সেটা উহ্য থাকে। কুয়েমপু
কর্নাটকের একজন অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি। কন্নড় ভাষায় এম গোবিন্দ পাইর পরেই
তার স্থান।
কুয়েমপু সম্পর্কে তার সে লেখার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, কুয়েমপু কন্নড় ভাষায় লিখলেও বাংলা ও বাংলা ভাষার সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যোগাযোগ ও মনের টান। রবীন্দ্র যুগে জন্মে, রবীন্দ্রভক্ত হয়েও তিনি ছিলেন স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। কুয়েমপুর সাহিত্যকর্ম এতই নিখাদ ও নিখুঁত যে, নিজের সাথেই কেবল তার তুলনা চলে; অন্য কারো সাথে নয়। ঘরকুনো এ মানুষটা ১৯২৯ সালে কলকাতায় এসেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখা হয়েছিল কি না, তা কেউ জানে না। কুয়েমপু স্বীকার করেছেন যে, সাহিত্য চর্চায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতেন। তার ওপর রবিঠাকুরের প্রভাব এতই প্রবল ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের অনুকরণে কুয়েমপু তার গ্রামের বাড়িতে একটা আশ্রমের মতো বানিয়েছিলেন।
কুয়েমপুর জন্ম ১৯০৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবদ্দশায় তিনি লিখেছেন প্রচুর। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য, জীবনী প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার ছিল বিস্তর ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সাহিত্যের এসব ক্ষেত্রে তিনি সফলতার উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন। কুয়েমপুর অনেক লেখা ভারতীয় বিভিন্ন এবং বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার যে গ্রন্থটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো, ‘রামায়ণ দর্শন’। এ বিশাল বইটাও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এখানে তিনি সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতন রামকেও অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছেন। কুয়েমপু খুব প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। বিদেশ যাওয়া তো দূরের কথা, নিজের কর্মস্থল ছাড়া ভারতবর্ষের ভেতরেও অন্য কোনো রাজ্যে তিনি সহজে যেতে চাইতেন না। তাই সাধারণ পাঠকের মধ্যে তার পরিচিতি একটু কম বৈকি। কিন্তু জনপ্রিয় না হলেও অন্য এক দিক থেকে কুয়েমপু ছিলেন খুবই ভাগ্যবান। জীবনে তিনি উদার ও পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য হয়েছেন। জ্ঞানপীঠ ও ভারতরত্ন উপাধি পাওয়া সে দেশের যেকোনো কবি-সাহিত্যিকের জন্য চাট্টিখানি কথা নয়! অন্য আরো অনেক স্বীকৃতির সাথে কুয়েমপু এ দুটো গৌরবেরও অধিকারী।
কথা বলতে বলতে অনেক বলা হয়ে গেল। আমার আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু কিন্তু কুয়েমপু নন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নন। ভিন্নধর্মী, সম্পূর্ণরূপে অন্য এক বিষয় নিয়ে এ লেখায় আলোকপাত করার ইচ্ছা আছে। তবে কেন এখানে কুয়েমপুকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এ রচনার ভূমিকা টানলাম, এক্ষুনি পাঠকদের কাছে তা খোলাসা করে বলছি। কুয়েমপুকে নিয়ে আলোচ্য প্রবন্ধের শেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিমানবন্দরে অলস চিন্তা’ শিরোনামে মাত্র ছোট্ট একটা প্যারা লিখেছেন। ওই প্যারার সাথে তার মূল রচনার কী সম্পর্ক এবং কী তাৎপর্য অনেক কসরত করেও আমি তার কোনো হদিস পাইনি। পাঠকদের সুবিধার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতিটা হুবহু তুলে ধরছি-
‘কর্নাটকের মানুষ তাদের ভাষাকে খুব ভালবাসে। রাজ্য পরিচালনার অনেক ক্ষেত্রে কন্নড় ভাষার প্রয়োগ হয়। বেঙ্গালুরুর অতি আধুনিক, অতি সুদৃশ্য বিমানবন্দরে বসে কফি খেতে খেতে দেখতে পাচ্ছি, সমস্ত লিখিত নির্দেশিকাতেই ইংরেজি হিন্দির সঙ্গে কন্নড় ভাষাও স্থান করে নিয়েছে। বাইরে অলসভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল। আমাদের কলকাতায় তো খুব শিগগিরই সম্পূর্ণ আধুনিক এবং বেশ বড় আকারের বিমানবন্দরের উদ্বোধন হবে। সেখানে কি একটাও বাংলা অক্ষর থাকবে? সন্দেহ হচ্ছে কেন? মনে কেন কুডাক ডাকছে! কাউকে তো দাবি জানাতে হবে। সবাই যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখি, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। তাই আমি আবার এই প্রশ্ন তুলছি : কলকাতার নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?’
পাঠকেরা এবার বুঝতে পারছেন, কত বড় আফসোস নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একজন বড় মাপের বাঙালি লেখক এমন প্রশ্ন তুলতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ একটা স্বাধীন দেশের স্বশাসিত স্বাধীন রাজ্য। বাংলা ভারতবর্ষের একটা অতি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা। বাংলা ছাড়া ভারতের অন্য কোনো ভাষার লেখক নোবেল পুরস্কার আনতে পারেননি, কিংবা অন্য কোনো উপায়েও এত বড় বিশ্বস্বীকৃতি কেউ পাননি। তারপরও ভারতের বাঙালিরা গোটা দেশে দূরে থাক, খোদ পশ্চিমবঙ্গে, এমনকি তার রাজধানী কলকাতাতেও দীর্ঘ ৬৪ বছরেও বাংলা ভাষাকে মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। আমি কখনো কলকাতা যাইনি। যারা গিয়েছেন তাদের দেখায়, তাদের লেখায়, তাদের কথায় হরহামেশাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
দৈনিক আমার দেশের সিনিয়র সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী কলকাতা থেকে ফিরে এসে নিজ পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৭, ২০১১ সালে ‘এপারে বাংলা ওপারে হিন্দি’ শিরোনামে একটা উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। ওই নিবন্ধে সঞ্জীব চৌধুরীর মূল বক্তব্য একটাই। অর্থাৎ, দিনে দিনে কলকাতায় বাংলা ভাষা এবং বাঙালি কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আর বাংলার জায়গাটা হিন্দি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে। তার মতে, কলকাতায় এখন বাংলার চেয়ে ইংরেজির প্রচলন বরং বেশি। এখনো কলকাতায় যেটুকু বাংলা শোনা যায়, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের ভিজিটর, যারা লেখাপড়া, চিকিৎসা, ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দেখতে যান তাদের জন্য। কলকাতায় বাংলা ভাষার হাল যে এমন হবে, তার আলামত অনেক আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী তার নিবন্ধের শুরুতে তা খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। ১৯৭৪ সালে তার এক বন্ধু দীপক কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে এক পানশালার আড্ডায় কাটিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। যতক্ষণ তিনি সেখানে বসেছিলেন, ঠাণ্ডা-গরম পানীয় পরিবেশনের সাথে গিটারের সুরে একের পর এক চলছিল হিন্দি সঙ্গীতের সুর। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে দীপক একটা বাংলা গান শোনার আরজি পেশ করেছিলেন। তখন গিটার বাদক জবাবে বলেছিলেন, ‘দাদা আপনি কি জয় বাংলার লোক?’ দীপক মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালে ওই বাদক গিটারে নতুন সুর তুলেছিলেন, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান...’। উনিশ শ’ চুয়াত্তরে কলকাতায় দীপকের অভিজ্ঞতা এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সে দিনকার আফসোস থেকে বোঝা যায়, হিন্দির দৌরাত্ম্যে কলকাতার ‘বাংলা’ শরীরে বিষের ক্রিয়া পুরো মাত্রায় শুরু হয়ে গেছে। সীমান্ত পেরিয়ে মাত্র ক’মাইল দূরে সে বিষের যন্ত্রণা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মন-মগজে অনুভূত হতে কি খুব বেশি দেরি? বাংলা ভাষার মুখে যদি কোনো ভাষা থাকত তাহলে আজ কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলত, ‘বাঙালি, আমাকে বাঁচাও’!
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Email : wahid2569@gmail.com
কুয়েমপু সম্পর্কে তার সে লেখার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, কুয়েমপু কন্নড় ভাষায় লিখলেও বাংলা ও বাংলা ভাষার সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যোগাযোগ ও মনের টান। রবীন্দ্র যুগে জন্মে, রবীন্দ্রভক্ত হয়েও তিনি ছিলেন স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। কুয়েমপুর সাহিত্যকর্ম এতই নিখাদ ও নিখুঁত যে, নিজের সাথেই কেবল তার তুলনা চলে; অন্য কারো সাথে নয়। ঘরকুনো এ মানুষটা ১৯২৯ সালে কলকাতায় এসেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখা হয়েছিল কি না, তা কেউ জানে না। কুয়েমপু স্বীকার করেছেন যে, সাহিত্য চর্চায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতেন। তার ওপর রবিঠাকুরের প্রভাব এতই প্রবল ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের অনুকরণে কুয়েমপু তার গ্রামের বাড়িতে একটা আশ্রমের মতো বানিয়েছিলেন।
কুয়েমপুর জন্ম ১৯০৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবদ্দশায় তিনি লিখেছেন প্রচুর। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য, জীবনী প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার ছিল বিস্তর ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সাহিত্যের এসব ক্ষেত্রে তিনি সফলতার উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন। কুয়েমপুর অনেক লেখা ভারতীয় বিভিন্ন এবং বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার যে গ্রন্থটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো, ‘রামায়ণ দর্শন’। এ বিশাল বইটাও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এখানে তিনি সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতন রামকেও অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছেন। কুয়েমপু খুব প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। বিদেশ যাওয়া তো দূরের কথা, নিজের কর্মস্থল ছাড়া ভারতবর্ষের ভেতরেও অন্য কোনো রাজ্যে তিনি সহজে যেতে চাইতেন না। তাই সাধারণ পাঠকের মধ্যে তার পরিচিতি একটু কম বৈকি। কিন্তু জনপ্রিয় না হলেও অন্য এক দিক থেকে কুয়েমপু ছিলেন খুবই ভাগ্যবান। জীবনে তিনি উদার ও পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য হয়েছেন। জ্ঞানপীঠ ও ভারতরত্ন উপাধি পাওয়া সে দেশের যেকোনো কবি-সাহিত্যিকের জন্য চাট্টিখানি কথা নয়! অন্য আরো অনেক স্বীকৃতির সাথে কুয়েমপু এ দুটো গৌরবেরও অধিকারী।
কথা বলতে বলতে অনেক বলা হয়ে গেল। আমার আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু কিন্তু কুয়েমপু নন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নন। ভিন্নধর্মী, সম্পূর্ণরূপে অন্য এক বিষয় নিয়ে এ লেখায় আলোকপাত করার ইচ্ছা আছে। তবে কেন এখানে কুয়েমপুকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এ রচনার ভূমিকা টানলাম, এক্ষুনি পাঠকদের কাছে তা খোলাসা করে বলছি। কুয়েমপুকে নিয়ে আলোচ্য প্রবন্ধের শেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিমানবন্দরে অলস চিন্তা’ শিরোনামে মাত্র ছোট্ট একটা প্যারা লিখেছেন। ওই প্যারার সাথে তার মূল রচনার কী সম্পর্ক এবং কী তাৎপর্য অনেক কসরত করেও আমি তার কোনো হদিস পাইনি। পাঠকদের সুবিধার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতিটা হুবহু তুলে ধরছি-
‘কর্নাটকের মানুষ তাদের ভাষাকে খুব ভালবাসে। রাজ্য পরিচালনার অনেক ক্ষেত্রে কন্নড় ভাষার প্রয়োগ হয়। বেঙ্গালুরুর অতি আধুনিক, অতি সুদৃশ্য বিমানবন্দরে বসে কফি খেতে খেতে দেখতে পাচ্ছি, সমস্ত লিখিত নির্দেশিকাতেই ইংরেজি হিন্দির সঙ্গে কন্নড় ভাষাও স্থান করে নিয়েছে। বাইরে অলসভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল। আমাদের কলকাতায় তো খুব শিগগিরই সম্পূর্ণ আধুনিক এবং বেশ বড় আকারের বিমানবন্দরের উদ্বোধন হবে। সেখানে কি একটাও বাংলা অক্ষর থাকবে? সন্দেহ হচ্ছে কেন? মনে কেন কুডাক ডাকছে! কাউকে তো দাবি জানাতে হবে। সবাই যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখি, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। তাই আমি আবার এই প্রশ্ন তুলছি : কলকাতার নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?’
পাঠকেরা এবার বুঝতে পারছেন, কত বড় আফসোস নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একজন বড় মাপের বাঙালি লেখক এমন প্রশ্ন তুলতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ একটা স্বাধীন দেশের স্বশাসিত স্বাধীন রাজ্য। বাংলা ভারতবর্ষের একটা অতি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা। বাংলা ছাড়া ভারতের অন্য কোনো ভাষার লেখক নোবেল পুরস্কার আনতে পারেননি, কিংবা অন্য কোনো উপায়েও এত বড় বিশ্বস্বীকৃতি কেউ পাননি। তারপরও ভারতের বাঙালিরা গোটা দেশে দূরে থাক, খোদ পশ্চিমবঙ্গে, এমনকি তার রাজধানী কলকাতাতেও দীর্ঘ ৬৪ বছরেও বাংলা ভাষাকে মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। আমি কখনো কলকাতা যাইনি। যারা গিয়েছেন তাদের দেখায়, তাদের লেখায়, তাদের কথায় হরহামেশাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
দৈনিক আমার দেশের সিনিয়র সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী কলকাতা থেকে ফিরে এসে নিজ পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৭, ২০১১ সালে ‘এপারে বাংলা ওপারে হিন্দি’ শিরোনামে একটা উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। ওই নিবন্ধে সঞ্জীব চৌধুরীর মূল বক্তব্য একটাই। অর্থাৎ, দিনে দিনে কলকাতায় বাংলা ভাষা এবং বাঙালি কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আর বাংলার জায়গাটা হিন্দি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে। তার মতে, কলকাতায় এখন বাংলার চেয়ে ইংরেজির প্রচলন বরং বেশি। এখনো কলকাতায় যেটুকু বাংলা শোনা যায়, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের ভিজিটর, যারা লেখাপড়া, চিকিৎসা, ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দেখতে যান তাদের জন্য। কলকাতায় বাংলা ভাষার হাল যে এমন হবে, তার আলামত অনেক আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী তার নিবন্ধের শুরুতে তা খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। ১৯৭৪ সালে তার এক বন্ধু দীপক কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে এক পানশালার আড্ডায় কাটিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। যতক্ষণ তিনি সেখানে বসেছিলেন, ঠাণ্ডা-গরম পানীয় পরিবেশনের সাথে গিটারের সুরে একের পর এক চলছিল হিন্দি সঙ্গীতের সুর। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে দীপক একটা বাংলা গান শোনার আরজি পেশ করেছিলেন। তখন গিটার বাদক জবাবে বলেছিলেন, ‘দাদা আপনি কি জয় বাংলার লোক?’ দীপক মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালে ওই বাদক গিটারে নতুন সুর তুলেছিলেন, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান...’। উনিশ শ’ চুয়াত্তরে কলকাতায় দীপকের অভিজ্ঞতা এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সে দিনকার আফসোস থেকে বোঝা যায়, হিন্দির দৌরাত্ম্যে কলকাতার ‘বাংলা’ শরীরে বিষের ক্রিয়া পুরো মাত্রায় শুরু হয়ে গেছে। সীমান্ত পেরিয়ে মাত্র ক’মাইল দূরে সে বিষের যন্ত্রণা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মন-মগজে অনুভূত হতে কি খুব বেশি দেরি? বাংলা ভাষার মুখে যদি কোনো ভাষা থাকত তাহলে আজ কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলত, ‘বাঙালি, আমাকে বাঁচাও’!
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Email : wahid2569@gmail.com
No comments