সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয় by কামাল আহমেদ
‘মামলা
করাই তাঁর নেশা ও পেশা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি খবর ছাপা হয়েছিল ১৯
নভেম্বর ২০১৪ সালে। ওই প্রতিবেদনটি যাঁকে নিয়ে করা হয়েছিল, তিনি জননেত্রী
পরিষদ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি, এ বি সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে তখন
বলেছিলেন যে সারা দেশে সংগঠনকে পরিচিত করার লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
মামলা করে যেতে চান তিনি। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, গরিব মানুষ হিসেবে
প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পেতেই তাঁর এই চেষ্টা। এ বি সিদ্দিকীর ভাষ্য ছিল,
অন্যরা আলোচনা সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে যেভাবে নিজেদের সংগঠনের গুরুত্ব
তুলে ধরে, তিনি মামলা করে তাঁর সংগঠনকে সেভাবে তুলে ধরছেন। আলোচনা সভা ও
মানববন্ধন করতে যেহেতু অনেক টাকা লাগে, সেহেতু বিকল্প হিসেবে তিনি বেছে
নিয়েছেন মামলাবাজি। মামলা করার টাকা পান কোথায় জানতে চাইলে এ বি সিদ্দিকী
প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘টাকা লাগে না তো। আমি মামলা করতে চাইলেই আইনজীবীরা
এগিয়ে আসেন। তাঁরা আগ্রহ দেখিয়ে আমার মামলা নেন, শুনানি করেন। পরে
মিডিয়ায় বক্তৃতা দেন। এতে তাঁরাও হাইলাইটেড হন।’ বরং যেসব আইনজীবী তাঁর
মামলায় লড়েন, কখনো কখনো তাঁরাই তাঁকে টাকা দেন।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে পঁচাত্তরটির মতো। সারা দেশে এ বি সিদ্দিকীর দেখানো কৌশল অনুসরণের হিড়িক দেখে আমাদের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। যাঁরা মামলা করছেন, তাঁরা কী চান, সেটা বোঝার জন্য সিদ্দিকীর ওই সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত হতে পারে। এঁদের সবার মূল উদ্দেশ্য প্রায় নিঃখরচায় প্রচার পাওয়া এবং দলীয় প্রধান বা প্রভাবশালী নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ। এ বি সিদ্দিকী নিজেও বলেছেন যে তিনি মামলা করেন প্রধানমন্ত্রীর কৃপাদৃষ্টির আশায়। তবে গণমামলার প্রতিযোগিতার আরেকটি কারণ হতে পারে— কোনো নেপথ্যচারী গোষ্ঠীর সংগঠিত উদ্যোগ।
হাজার হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলার খবর আসতে থাকায় অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে এসব মামলার জন্য মামলাকারীদের খরচ জোগাচ্ছেন কারা? নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে? ক্ষতিপূরণের মামলায় কত টাকা খরচ লাগতে পারে, তার উত্তর আছে ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি অ্যাক্টে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ সংশোধনীর পর আইনটি যে অবস্থায় আছে, তাতে দেওয়ানি আইনে মানহানির মামলা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ যত টাকাই দাবি করা হোক না কেন, তার জন্য সর্বোচ্চ ফি দিতে হবে ৩৫ হাজার টাকা। সুতরাং, হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা খুব ব্যয়বহুল নয়। তবে সেই টাকাও এসব মামলাকারী খরচ করেননি। তাঁরা দেওয়ানি মামলার পথেই হাঁটেননি। উদ্দেশ্য যেহেতু রাজনৈতিক ফায়দা আদায় এবং একজন সম্পাদককে হয়রানি করা, সেহেতু তাঁরা মামলাও করেছেন ফৌজদারি আইনে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণের মামলা করেন দেওয়ানি আইনে। রাষ্ট্রদ্রোহের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, যদি না জেনারেল সিসির মিসর অথবা জেনারেল প্রয়ুথ চান-ওচার থাইল্যান্ডের মতো দেশ হয়।
মাহ্ফুজ আনাম যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকেন, তবে তাঁর বিচার হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু জেলায় জেলায়, কোথাও কোথাও উপজেলায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে একই মুসাবিদার কপি ব্যবহার করে (ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মামলার কপিতে এমনটি দেখা গেছে। কুমিল্লায় যে পাঁচটি মামলা হয়েছে, তার প্রতিটিতে মামলাকারীদের নাম-ঠিকানা ছাড়া পুরোটা হুবহু এক) একাধিক মামলার বহর দেখে বোঝা যায়, মামলাকারীদের অন্যতম লক্ষ্য মাহ্ফুজ আনামকে হয়রানি করা এবং ভয় দেখানো। দিনের পর দিন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় আদালতে গিয়ে হাজিরা দিতে তাঁকে বাধ্য করা। যেসব আইনজীবী এসব মামলায় তাঁদের মক্কেলদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা কোন বিবেচনায় সেটি করছেন, তার উত্তর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।
শুরুতে যে এ বি সিদ্দিকীর কথা বলেছিলাম, তাঁর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন খলিলুর রহমান। সে সময় খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এ বি সিদ্দিকীর মামলাগুলো পরিচালনায় তিনি কোনো অর্থ নেন না। শুধু গণমাধ্যমে তাঁর নাম আসে—এতেই তিনি সন্তুষ্ট। সারা দেশে প্রায় পঁচাত্তরজন আইনজীবী কি শুধু প্রচার পাওয়ার আশাতেই এসব মামলায় যুক্ত হয়েছেন? আইনের শাসন বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই যদি বিবেচ্য হতো, তাহলে এভাবে গণহারে মামলা করা থেকে আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের কি নিরুৎসাহিত করতেন না? এ কথা তো সবাই জানেন যে অপরাধ যদি কিছু হয়েই থাকে, তাহলেও এক অপরাধের বারবার বিচার চলে না।
মাহ্ফুজ আনাম তাঁর কাগজে ২০০৬-০৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছাপানো কিছু খবরের বিষয়ে একটি টিভি টক শোতে যে মন্তব্য করেছেন, তাকে কেন্দ্র করেই এসব মামলার হিড়িক। টক শোতে তিনি বলেছেন যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সেই সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া কিছু অভিযোগ তাঁরা ছাপিয়ে ভুল করেছেন। কেননা, সেগুলো অন্য কোনো সূত্র থেকে যাচাই না করেই ছাপা হয়েছিল। তাঁর সম্পাদিত ডেইলি স্টার-এর পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর সম্পাদকজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে যেটি ছিল তাঁর স্বেচ্ছামূলক স্বীকারোক্তি। স্বভাবতই তাঁর ভুল স্বীকারের সাহসকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকে, যাঁদের মধ্যে তথ্যমন্ত্রীও রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টিতে কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না। তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যে যেন একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একদল দৌড়েছে আদালতে, আরেক দল দাবি করছে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে তাঁর পদত্যাগ। এর মধ্যে লক্ষণীয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন এমন কয়েকজনও মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আবেদন করেছেন। আর সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে অথবা টক শোতে অংশ নিয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে মাহ্ফুজ আনামের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক, যাকে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা জাস্টিন রোলাট ‘বাংলাদেশের নিউইয়র্ক টাইমস’ বলে অভিহিত করেছেন, সেই ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়েরের নিন্দা জানিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ একটি বিবৃতি দিয়েছে। সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠনটি বিবৃতিটি দিতে সপ্তাহ খানেক সময় নেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তবে সম্পাদকদের তাড়াহুড়া না করারই কথা। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বিবৃতি দিয়ে তাঁরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী।’
মানহানির মামলা কিংবা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের দাবি এবং সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি—এসবের মধ্যে অবশ্য যে প্রশ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে, তা হলো, ভয়মুক্ত ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কী? সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে ভীতিকর পরিবেশের কারণে নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই না করেই খবর ছাপা হতো, সেই একই ধরনের খবর ছাপা বন্ধ হবে কবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র থেকে সরবরাহ করা কত তথ্যই না ছাপা হচ্ছে, টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। স্বতন্ত্র কোনো সূত্র থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করার কাজটি কজন করছেন? নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে দেওয়া কথিত স্বীকারোক্তি ছাপা বা প্রচার করা কি বন্ধ হয়েছে? ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিদের খবরগুলোর কথা ভেবে দেখুন! র্যাব-পুলিশের ভাষ্যের বাইরে স্বতন্ত্র সূত্র থেকে খবর যাচাই করেন কজন? গোপনে ধারণ করা টেলিকথনের (মান্নার সঙ্গে খোকার, খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথিত অমিত শাহর) কথা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃত হননি!
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনগুরুত্ব বিবেচনায় নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য কি কখনোই প্রচার করা যায় না? সব সময় যে এক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম চলবে, এটি নিশ্চয়ই কেউ দাবি করবেন না। আলাদা আলাদা ঘটনার জন্য আলাদা আলাদা বিবেচনা কাজ করে। যে ধরনের স্বীকারোক্তিভিত্তিক সংবাদের কারণে মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে, সেই একই রকম খবর তো ক্ষমতাচ্যুত বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধেও ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কি মানবেন যে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে ছাপানো ওই সব খবরও ভুল এবং উদ্দেশ্যমূলক ছিল?
সংবাদপত্র সব সময় শতভাগ নির্ভুল হবে, এমনটি আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু ভুল সংশোধন এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা কী হবে? বাংলাদেশে সংবাদপত্রশিল্পের মালিক ও সাংবাদিকেরা অনেক দিন ধরেই দাবি করে আসছেন যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাবিষয়ক সব অভিযোগ নিষ্পত্তির কাজটি হোক প্রেস কাউন্সিলে। কিন্তু প্রেস কাউন্সিলের কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে হয় অনেকে জানেন না, নয়তো প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তাঁরা আস্থা রাখতে পারেন না। আর মামলার উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে হয়রানি করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া, তাহলে সেই মামলাকারী প্রেস কাউন্সিলে যে যাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, সাংবাদিকতার জন্য হয়রানি বন্ধে কার্যকর আইনগত সংস্কারের উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রেস কাউন্সিলকেও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে সাধারণ নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনুগত ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল থাকলে সেই প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, গণমাধ্যমকেই নিজেদের আচরণবিধি ও আদর্শ নীতিমালা ঠিক করতে হবে। এ কাজ সম্পাদক পরিষদের মতো ফোরামের পক্ষেই সম্ভব। দেশে দেশে সে রকমটিই হয়ে থাকে। এক-এগারোর সরকারের আমলে সাংবাদিকতায় যে চর্চা হয়েছে, সেটি যেমন প্রথম নয়, তেমনি তা শেষও নয়। আবার সাংবাদিকতায় ভুলভ্রান্তিমুক্ত থাকাও জরুরি।
আল-জাজিরা টেলিভিশনের একটি স্লোগান আমাদের অনেকেরই খুব পছন্দ। মিসরে তাদের তিনজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে জেনারেল সিসির সরকার যখন বিচারের মুখোমুখি করেছিল, তখন তারা ওই স্লোগান তোলে। স্লোগানটি হচ্ছে, ‘জার্নালিজম ইজ নট এ ক্রাইম’। সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। সুতরাং, সাংবাদিকতাকে অন্য দশটা ফৌজদারি অপরাধের মতো শ্রেণীকরণ করা হবে অন্যায়। আর সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সম্পাদকেরাই নেতৃত্ব দেবেন, সেটা নিশ্চয়ই দুরাশা নয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে পঁচাত্তরটির মতো। সারা দেশে এ বি সিদ্দিকীর দেখানো কৌশল অনুসরণের হিড়িক দেখে আমাদের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। যাঁরা মামলা করছেন, তাঁরা কী চান, সেটা বোঝার জন্য সিদ্দিকীর ওই সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত হতে পারে। এঁদের সবার মূল উদ্দেশ্য প্রায় নিঃখরচায় প্রচার পাওয়া এবং দলীয় প্রধান বা প্রভাবশালী নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ। এ বি সিদ্দিকী নিজেও বলেছেন যে তিনি মামলা করেন প্রধানমন্ত্রীর কৃপাদৃষ্টির আশায়। তবে গণমামলার প্রতিযোগিতার আরেকটি কারণ হতে পারে— কোনো নেপথ্যচারী গোষ্ঠীর সংগঠিত উদ্যোগ।
হাজার হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলার খবর আসতে থাকায় অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে এসব মামলার জন্য মামলাকারীদের খরচ জোগাচ্ছেন কারা? নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে? ক্ষতিপূরণের মামলায় কত টাকা খরচ লাগতে পারে, তার উত্তর আছে ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি অ্যাক্টে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ সংশোধনীর পর আইনটি যে অবস্থায় আছে, তাতে দেওয়ানি আইনে মানহানির মামলা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ যত টাকাই দাবি করা হোক না কেন, তার জন্য সর্বোচ্চ ফি দিতে হবে ৩৫ হাজার টাকা। সুতরাং, হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা খুব ব্যয়বহুল নয়। তবে সেই টাকাও এসব মামলাকারী খরচ করেননি। তাঁরা দেওয়ানি মামলার পথেই হাঁটেননি। উদ্দেশ্য যেহেতু রাজনৈতিক ফায়দা আদায় এবং একজন সম্পাদককে হয়রানি করা, সেহেতু তাঁরা মামলাও করেছেন ফৌজদারি আইনে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণের মামলা করেন দেওয়ানি আইনে। রাষ্ট্রদ্রোহের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না, যদি না জেনারেল সিসির মিসর অথবা জেনারেল প্রয়ুথ চান-ওচার থাইল্যান্ডের মতো দেশ হয়।
মাহ্ফুজ আনাম যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকেন, তবে তাঁর বিচার হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু জেলায় জেলায়, কোথাও কোথাও উপজেলায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে একই মুসাবিদার কপি ব্যবহার করে (ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মামলার কপিতে এমনটি দেখা গেছে। কুমিল্লায় যে পাঁচটি মামলা হয়েছে, তার প্রতিটিতে মামলাকারীদের নাম-ঠিকানা ছাড়া পুরোটা হুবহু এক) একাধিক মামলার বহর দেখে বোঝা যায়, মামলাকারীদের অন্যতম লক্ষ্য মাহ্ফুজ আনামকে হয়রানি করা এবং ভয় দেখানো। দিনের পর দিন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় আদালতে গিয়ে হাজিরা দিতে তাঁকে বাধ্য করা। যেসব আইনজীবী এসব মামলায় তাঁদের মক্কেলদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা কোন বিবেচনায় সেটি করছেন, তার উত্তর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।
শুরুতে যে এ বি সিদ্দিকীর কথা বলেছিলাম, তাঁর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন খলিলুর রহমান। সে সময় খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এ বি সিদ্দিকীর মামলাগুলো পরিচালনায় তিনি কোনো অর্থ নেন না। শুধু গণমাধ্যমে তাঁর নাম আসে—এতেই তিনি সন্তুষ্ট। সারা দেশে প্রায় পঁচাত্তরজন আইনজীবী কি শুধু প্রচার পাওয়ার আশাতেই এসব মামলায় যুক্ত হয়েছেন? আইনের শাসন বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই যদি বিবেচ্য হতো, তাহলে এভাবে গণহারে মামলা করা থেকে আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের কি নিরুৎসাহিত করতেন না? এ কথা তো সবাই জানেন যে অপরাধ যদি কিছু হয়েই থাকে, তাহলেও এক অপরাধের বারবার বিচার চলে না।
মাহ্ফুজ আনাম তাঁর কাগজে ২০০৬-০৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছাপানো কিছু খবরের বিষয়ে একটি টিভি টক শোতে যে মন্তব্য করেছেন, তাকে কেন্দ্র করেই এসব মামলার হিড়িক। টক শোতে তিনি বলেছেন যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সেই সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া কিছু অভিযোগ তাঁরা ছাপিয়ে ভুল করেছেন। কেননা, সেগুলো অন্য কোনো সূত্র থেকে যাচাই না করেই ছাপা হয়েছিল। তাঁর সম্পাদিত ডেইলি স্টার-এর পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর সম্পাদকজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে যেটি ছিল তাঁর স্বেচ্ছামূলক স্বীকারোক্তি। স্বভাবতই তাঁর ভুল স্বীকারের সাহসকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকে, যাঁদের মধ্যে তথ্যমন্ত্রীও রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টিতে কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না। তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যে যেন একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একদল দৌড়েছে আদালতে, আরেক দল দাবি করছে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে তাঁর পদত্যাগ। এর মধ্যে লক্ষণীয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন এমন কয়েকজনও মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আবেদন করেছেন। আর সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে অথবা টক শোতে অংশ নিয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে মাহ্ফুজ আনামের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক, যাকে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা জাস্টিন রোলাট ‘বাংলাদেশের নিউইয়র্ক টাইমস’ বলে অভিহিত করেছেন, সেই ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়েরের নিন্দা জানিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ একটি বিবৃতি দিয়েছে। সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠনটি বিবৃতিটি দিতে সপ্তাহ খানেক সময় নেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তবে সম্পাদকদের তাড়াহুড়া না করারই কথা। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বিবৃতি দিয়ে তাঁরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী।’
মানহানির মামলা কিংবা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের দাবি এবং সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি—এসবের মধ্যে অবশ্য যে প্রশ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে, তা হলো, ভয়মুক্ত ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কী? সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে ভীতিকর পরিবেশের কারণে নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই না করেই খবর ছাপা হতো, সেই একই ধরনের খবর ছাপা বন্ধ হবে কবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র থেকে সরবরাহ করা কত তথ্যই না ছাপা হচ্ছে, টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। স্বতন্ত্র কোনো সূত্র থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করার কাজটি কজন করছেন? নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে দেওয়া কথিত স্বীকারোক্তি ছাপা বা প্রচার করা কি বন্ধ হয়েছে? ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিদের খবরগুলোর কথা ভেবে দেখুন! র্যাব-পুলিশের ভাষ্যের বাইরে স্বতন্ত্র সূত্র থেকে খবর যাচাই করেন কজন? গোপনে ধারণ করা টেলিকথনের (মান্নার সঙ্গে খোকার, খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথিত অমিত শাহর) কথা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃত হননি!
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনগুরুত্ব বিবেচনায় নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য কি কখনোই প্রচার করা যায় না? সব সময় যে এক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম চলবে, এটি নিশ্চয়ই কেউ দাবি করবেন না। আলাদা আলাদা ঘটনার জন্য আলাদা আলাদা বিবেচনা কাজ করে। যে ধরনের স্বীকারোক্তিভিত্তিক সংবাদের কারণে মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে, সেই একই রকম খবর তো ক্ষমতাচ্যুত বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধেও ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কি মানবেন যে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে ছাপানো ওই সব খবরও ভুল এবং উদ্দেশ্যমূলক ছিল?
সংবাদপত্র সব সময় শতভাগ নির্ভুল হবে, এমনটি আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু ভুল সংশোধন এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা কী হবে? বাংলাদেশে সংবাদপত্রশিল্পের মালিক ও সাংবাদিকেরা অনেক দিন ধরেই দাবি করে আসছেন যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাবিষয়ক সব অভিযোগ নিষ্পত্তির কাজটি হোক প্রেস কাউন্সিলে। কিন্তু প্রেস কাউন্সিলের কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে হয় অনেকে জানেন না, নয়তো প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তাঁরা আস্থা রাখতে পারেন না। আর মামলার উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে হয়রানি করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া, তাহলে সেই মামলাকারী প্রেস কাউন্সিলে যে যাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, সাংবাদিকতার জন্য হয়রানি বন্ধে কার্যকর আইনগত সংস্কারের উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রেস কাউন্সিলকেও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে সাধারণ নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনুগত ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল থাকলে সেই প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, গণমাধ্যমকেই নিজেদের আচরণবিধি ও আদর্শ নীতিমালা ঠিক করতে হবে। এ কাজ সম্পাদক পরিষদের মতো ফোরামের পক্ষেই সম্ভব। দেশে দেশে সে রকমটিই হয়ে থাকে। এক-এগারোর সরকারের আমলে সাংবাদিকতায় যে চর্চা হয়েছে, সেটি যেমন প্রথম নয়, তেমনি তা শেষও নয়। আবার সাংবাদিকতায় ভুলভ্রান্তিমুক্ত থাকাও জরুরি।
আল-জাজিরা টেলিভিশনের একটি স্লোগান আমাদের অনেকেরই খুব পছন্দ। মিসরে তাদের তিনজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে জেনারেল সিসির সরকার যখন বিচারের মুখোমুখি করেছিল, তখন তারা ওই স্লোগান তোলে। স্লোগানটি হচ্ছে, ‘জার্নালিজম ইজ নট এ ক্রাইম’। সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। সুতরাং, সাংবাদিকতাকে অন্য দশটা ফৌজদারি অপরাধের মতো শ্রেণীকরণ করা হবে অন্যায়। আর সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সম্পাদকেরাই নেতৃত্ব দেবেন, সেটা নিশ্চয়ই দুরাশা নয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments