অতি
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি পর পর সাজালে এই ছবিটাই ক্রমশই জোরালো হয়ে উঠছে৷ এই
যেমন বিশিষ্ট কন্নড় লেখক এম. এম. কালবার্গি এবং নরেন্দ্র দাভোলকর ও
গোবিন্দ পানসারের মতে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদীদের হত্যাকাণ্ড, উত্তর
প্রদেশের দাদরিতে গোমাংস রাখার ও খাওয়ার গুজবে মহম্মদ আখলাক নামে এক প্রৌঢ়
মুসলিমের ঘরে ঢুকে তাঁকে খুন করা৷ কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে গরু
এক পবিত্র জীব৷ মায়ের সঙ্গে তুলনীয়৷ তাই বিভিন্ন রাজ্যে গোহত্যা, গরুর
মাংস খাওয়া এবং কিছু কিছু বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে মোদীর জমানাতেই৷ নিষেধাজ্ঞা
না মানলেই যখন তখন হামলার শিকার হতে হচ্ছে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক
সাক্ষাৎকারে নতুন দিল্লির ‘সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ'-এর অধ্যাপক রাকেশ
বটব্যাল বলেছেন, মোদীর নির্বাচনি জয়ের পর থেকেই এটা লক্ষ করা যাচ্ছে যে,
ঘরে ফেরার নাম দিয়ে সংখ্যালঘুদের হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার প্রবণতা বাড়ছে৷
এমনকি স্কুলে এবং পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসেও৷ জনপ্রিয় পাকিস্তানি
সংগীতশিল্পী গজল সম্রাট গুলাম আলিকে মুম্বইতে অনুষ্ঠান করতে দেয়নি
মহারাষ্ট্রের কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা দল, যে দল রাজ্যের বিজেপি
সরকারের জোটসঙ্গী৷ এই শিবসেনার দাপটে এই সপ্তাহ খানেক আগে পাকিস্তানের
প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ কসুরির একটি বই-প্রকাশ অনুষ্ঠানের
বিরুদ্ধাচরণ করতে অনুষ্ঠানের আয়োজক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সুধীন্দ্র
কুলকার্নির মুখে কালি-লেপা হামলা চালানো হয়৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঘটনার মিছিল চলেছে লাগাতার নানাভাবে৷ হিন্দু মৌলবাদীদের
এই অ-সহনশীলতা এবং বিদ্বেষমূলক অপরাধ আটকাতে সরকার ব্যর্থ হওয়ার প্রতিবাদে
এ পর্যন্ত ২৩ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাঁদের সাহিত্য পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন৷
কেউ কেউ সরকারি পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছেন৷ সবার আগে সাহিত্য আকাদেমি
পুরস্কার ফেরত দেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাইঝি নয়নতারা
সেহগল৷ তাঁর মতে, ভারতের সাস্কৃতিক বৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে৷ এই প্রতিবাদে
সামিল হয়ে কাশ্মিরী লেখক গুলাম নবি খায়াল বলেছেন, সংখ্যালঘুরা ক্রমশই
নিজেদের বিপন্ন মনে করছ৷ উল্লেখ্য, হালে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে একজন মুসলিম
নির্দল বিধায়কের ওপর রাজ্য-সরকারের শরিকদল বিজেপি যেভাবে হামলা চালিয়েছে,
তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি৷ অভিযোগ ঐ বিধায়ক নাকি তাঁর ব্যক্তিগত
ভোজসভায় গোমাংস পরিবেশন করেছেন৷ প্রতিবাদী সাহিত্যিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন
বুকার পুরস্কার জয়ী লেখক সলমন রুশদি৷ অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদ-মুসলিমিন
পার্টির প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েসি মনে করেন, মুসলমানরা ভারতে নিজেদের
অবরুদ্ধ বলে মনে করতে শুরু করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এতদিন মুখে
কুলুপ এঁটে ছিলেন৷ কিন্তু মুক্তচিন্তামনাদের প্রতিবাদ যেভাবে জোরদার হয়ে
উঠছে, তাতে তিনি তাঁর মৌন ভঙ্গ করে বলেছেন, ঘটনাবলি খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং
অনভিপ্রেত৷ মোদী সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেছেন সাহিত্যিকরা তাড়হুড়ো
করে আকাদেমি পুরস্কার ফেরত দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ পরিস্থিতি যদি তাঁদের
কাছে উদ্বেগজনক হয়ে থাকে, তাহলে তাঁরা তা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে
লিখিত অভিযোগ করতে পারতেন৷ সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি বলেছেন, প্রতিবাদ
অন্যভাবেও করা যেতে পারতো৷ কারণ আকাদেমি পুরস্কার সরকারি নয়৷ এই নিয়ে লেখক
মহলে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ অনেক লেখক আকাদেমি পুরস্কার ফেরতের পথকে সঠিক
বলে মনে করেন না৷ তবে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, কট্টর দক্ষিণপন্থি
হিন্দুত্ববাদীদের বিদ্বেষমূলক রাজনীতির ঘটনা যেভাবে ঘটছে, ভারতের মতো দেশে
তা কখনই কাম্য হতে পারে না৷
|
বাড়িতে
‘গোমাংস’ ভোজের আয়োজন করেছেন—এই অভিযোগে ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের স্বতন্ত্র
বিধায়ক প্রকৌশলী রশিদের মুখে কালি ও মবিল মাখিয়ে দিয়েছে হিন্দু সেনা নামে
একটি উগ্র হিন্দু সংগঠন। আজ সোমবার বিকেলে রাজধানী নয়াদিল্লিতে এক প্রেস
কনফারেন্স করার সময় রশিদের মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে
পার্লামেন্টে জম্মু-কাশ্মীরের বিজেপির বিধায়কেরাও একই অভিযোগে রশিদকে
মারপিট করেন। এর আগে দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাবেক উপদেষ্টা
সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি মাখিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের কট্টর
হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার সমর্থকেরা। পাকিস্তানের সাবেক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান
আয়োজন করায় ১৩ অক্টোবর মুম্বাইয়ে কুলকার্নির বাড়ির সামনেই এ ঘটনা ঘটানো হয়।
ওই ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় আবারও মুখে কালি মাখানোর ঘটনা ঘটল। এনডিটিভি
ও দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়, আজ বিকেলে দিল্লির প্রেসক্লাবে এক সংবাদ
সম্মেলনের আয়োজন করেন জম্মু-কাশ্মীরের স্বতন্ত্র বিধায়ক প্রকৌশলী রশিদ।
সংবাদ সম্মেলন চলার সময়ে সাংবাদিক ও পরিবারের সদস্যদের সামনেই তিনজন হঠাৎ
করেই ওই বিধায়কের মুখে কালি এবং মবিল মাখিয়ে দেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে
দীপক ও দেব ইন্দিরা ইন্দ্রা সিং নামের দুজনকে পুলিশ আটক করেছে। সংবাদ
সংস্থাগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে বিষ্ণু গুপ্তার
নেতৃত্বাধীন হিন্দু সেনা নামের একটি কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন। খবরে বলা
হয়েছে, ৭ অক্টোবর নিজের বাড়ি শ্রীনগরে রশিদ ‘গোমাংস’ ভোজের আয়োজন করেন। এতে
রাগান্বিত হয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দল করেন না। আজ এ
ঘটনার পর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ব দেখুক ভারত কীভাবে বদলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও
বলেন, ‘অনেকে বলে থাকেন তালেবান পাকিস্তানকে গিলে ফেলছে; কিন্তু তারা দেখুক
এখানে (ভারত) কী ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। কাশ্মীরে এ
পর্যন্ত ৮০ হাজার লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। একজন প্রকৌশলীর মুখে কালি ছিটানোর
ঘটনায় আর এমন কী-ইবা হবে। তাদের জানা উচিত এটা নরেন্দ্র মোদির ভারত,
মহাত্মা গান্ধীর ভারত নয়।’ |
|
ভারতের
সাবেক মন্ত্রী এল কে আদবানি ঘনিষ্ঠ বিজেপির প্রাক্তন উপদেষ্টা সুধীন্দ্র
কুলকার্নির পর এবার মুখে কালি পড়ল জম্মু-কাশ্মীরের এমপি ইঞ্জিনিয়ার রশিদের
মুখে। সোমবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন চলাকালীন তার মুখে কালি মাখানো
ছাড়াও পোড়া মোবিলের কালো তেল ছুড়ে মারা হয়। কেন্দ্রের গোমাংস বিরোধী
নীতির বিরুদ্ধাচারণ করে, 'বিফ পার্টি'র আয়োজন করাতেই, বিক্ষোভের মুখে পড়তে
হয় রশিদকে। গত ১৫ দিনের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তার ওপর হামলা হল।
দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, সাংবাদিক বৈঠকে জম্মু-কাশ্মীরের এই বিধায়ক যখন
বক্তব্য পেশ করছিলেন, তখনই হামলা হয়। টিভি চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, বিষ্ণু
গুপ্তার নেতৃত্বাধীন হিন্দু সেনা এই ঘটনার দায় স্বীকার করে। এর আগে
জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার মধ্যে বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়
ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে। সরকারি সার্কিট হাউজের লনে বিফ পার্টির আয়োজন করাতেই
বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। জম্মু-কাশ্মীরের
মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদ বিধায়কের ওপর এ ধরনের হামলার নিন্দা
করেছেন। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহও ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। |
|
হিন্দুদের
কাছে গরু একটি পবিত্র প্রাণী৷ তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গরুর
মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে চায়৷ রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ আরএসএস এর
পশ্চিমবঙ্গের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘গরু জবাই কিংবা চোরাই পথে চালান, আর
হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা বা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা একই কথা৷’’ |
|
ভারত
থেকে চোরাই পথে আসা গরুই এতদিন বাংলাদেশের মানুষের মাংসের প্রধান উৎস ছিল৷
গত চার দশক ধরে সেটা হয়ে আসছে৷ এর সঙ্গে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য
জড়িয়ে আছে৷ |
|
নিজের
লেখা বইয়ের প্রকাশের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মুম্বই এসেছিলেন পাকিস্তানের
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ কসুরি৷ অনুষ্ঠান হয়েছে, পুস্তকও প্রকাশিত
হয়েছে৷ কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী অনুষ্ঠান বাতিল না হওয়ায় অনুষ্ঠানে এসে
সুধেন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে শিবসেনা সমর্থকরা৷ ভারতের
সাবেক কূটনীতিক সুধেন্দ্র কুলকার্নির একমাত্র অপরাধ তিনি এক পাকিস্তানির বই
প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ প্রতিবেদন: সামরা ফাতিমা |
No comments