বিষ ঢেলে রাতারগুলের সর্বনাশ by আবদুর রশিদ রেনু
দেশের
একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেটের রাতারগুলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে
দিনের পর দিন। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় এ বনাঞ্চলের ভূমি দখলের পর এবার বিষ
দিয়ে চলছে মাছ লুট। ইতিমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভূমি বেদখল হয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় এ বনাঞ্চল দখলকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্রমেই। ফলে
অপার সম্ভাবনার এ পর্যটন স্পট ও এর জীববৈচিত্র্যের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। এ
নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের
নির্লিপ্ত উদাসীনতায় চরম ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে সচেতন মহলে। অভিযোগ উঠেছে
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আঁতাত করেই চলেছে এসব কর্মকাণ্ড। বন বিভাগ ভূমি উদ্ধারে
ইতিবাচক কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এদিকে জীবজন্তুর বদলে জনসাধারণের অবাধ বিচরণ,
পিকনিক, নৌবিহার, ক্যামেরার ক্লিকে অভয়ারণ্য ছেড়ে পালানোর উপক্রম বনের
প্রাণিকুলের। বন ছেড়ে যাওয়া বন্যপ্রাণী মাঝেমধ্যে ধরা পড়ছে পার্শ্ববর্তী
জনপদে। পর্যটন বাণিজ্যের চিন্তায় তারা বিভোর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের
ব্যতিক্রমী এ বনের মোট আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। ১৯৮৫ সালে ৫০৪ একর
বনকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর রাতারগুল বিশ্বের সোয়াম্প
ফরেস্ট ও অভয়ারণ্যের তালিকাভুক্ত হয়। পৃথিবীর ২২টি জলারবনের মধ্যে রাতারগুল
অন্যতম এবং উপ-মহাদেশের দ্বিতীয়। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার উত্তর
সিলেট রেঞ্জ-২-এর রাতারগুল বিটের অধীনে ১০টি মৌজা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে
মেওয়াবিল, ঘোড়ামারা কান্দি, ছদিভদি হাওর, শিয়ালা হাওড়, লক্ষির হাওড়, শিমুল
বিল হাওড়, চলিতাবাড়ি, রাতারগুল, বগাবাড়ি ও পূর্ব মহেশখেড়। রাতারগুলো
জলারবনে কয়েকদিন ধরে বিষ ঢেলে মাছসহ লাখ লাখ জলজ প্রাণী ও অণুজীব হত্যা
করছে দুর্বৃত্তরা। বন বিভাগের ওয়েবসাইটে বলা আছে রাতারগুল দেশের
দৃষ্টিনন্দন জলাভূমির বন। এ বনাঞ্চল মাছের আবাসস্থলের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কয়েকদিন ধরে মাছের এসব গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল
সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। শনিবার গভীর রাত থেকে বিষ ঢেলে দেয়ার ফলে
বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, সাপ ব্যাঙ, কাঁকড়া আধমরা হয়ে ভেসে ওঠে। এলাকাবাসী
প্রতিদিন দল বেঁধে মেতে ওঠেন মাছ ধরার মহোৎসবে। বিষের পাশাপাশি কারেন্ট জাল
ফেলে অবাধে চলছে মাছ ধরা। গ্রামবাসীরা স্থানে স্থানে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি
করে বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জাম ব্যবহার করে দিনব্যাপী মাছ সংগ্রহের অংশ নেয়।
আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে সারা দিন মাছ সংগ্রহ করতে খইয়ার খালে মানুষের
ঢল নামে। এমন সংবাদ পেয়ে সোমবার সিলেট বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম
সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তিনি ফিরে এসে সাংবাদিকদের জানান, খাল থেকে
তুলনামূলকভাবে বড় আধমরা মাছগুলো দুর্বৃত্তরা ভোররাতেই সংগ্রহ করে নিয়েছে।
এখন আধমরা ছোট মাছগুলো মরে ভেসে উঠছে। সেসব মাছ সংগ্রহ করতেই বনের ভেতর
সাধারণ গ্রামবাসীর এ ঢল। জলজপ্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংসের এই জঘন্য ঘটনার
ব্যাপারে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাতারগুল জলারবনের প্রাণ বৈচিত্র্য
যে ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছেছে তা সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে
বোঝানো যাচ্ছে না। তিনি রাতারগুল জলারবনকে সুরক্ষায় অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ
মতামতে ‘সোয়াম্প ফরেস্ট’ আইন প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, এই বনের
বৈশিষ্ট অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মাছসহ জলজপ্রাণী হত্যা বন্ধ করতে হবে।
বন্যপ্রাণীর এ অভয়াশ্রমে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে ‘পোলো উৎসব’-এর মতো দল
বেঁধে মাছ সংগ্রহ করছে। বিষ ঢেলে মাছ লুটের বিষয়টি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের
জানানো হলেও তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। বাপা হবিগঞ্জ শাখার যুগ্ম সম্পাদক
ডা. এসএস আল আমিন সুমন বিষের প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করা বিভিন্ন প্রজাতির
২৭টি সাপের মৃত দেহ খালের পানিতে দেখার বিষয় নিশ্চিত করেন। পরিবেশকর্মী
সৈয়দ সোহাগ বলেন, খালের পানিতে বিষ ঢালার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ভেসে
থাকা মাছ বা সাপের ময়নাতদন্ত করা জরুরি।
No comments