শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল আট দেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে শুক্রবার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে। এতে মিয়ানমারের পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে থাইল্যান্ডে। দক্ষিণ-পশ্চিম চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।

শুক্রবার রাত পৌনে একটার দিকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে অন্তত ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৩২ জনের বেশি। থাইল্যান্ডে অন্তত নয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দুই দেশেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন বহু মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল মিয়ানমারের মান্দালয় শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের ১২ মিনিট পর ৬ দশমিক ৪ মাত্রার একটি পরাঘাত (আফটার শক) হয়।

ভূমিকম্পের পর রাজধানী নেপিডো, মান্দালয়, সাইগাইংসহ ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। দেশটির সামরিক বাহিনী পরিচালিত সম্প্রচারমাধ্যম এমআরটিভি জানিয়েছে, নিহত ১৪৪ জনের মধ্যে নেপিডোয় ৯৬ জন, সাইগাইংয়ে ১৮ জন ও মান্দালয়ে ৩০ জন রয়েছেন। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শক্তিশালী কম্পনে নেপিডো, সাইগাইং, মান্দালয়সহ পাঁচটি শহরে ভবন ধসে পড়েছে। এ ছাড়া একটি সেতু ও একটি রেলসেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ইরাবতী নদীর ওপর আভা সেতু ধসে পড়েছে। সেতুটি ভেঙে পানির মধ্যে হেলে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে ‘সব দেশ’কে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মিয়ানমারের এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় শোক প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের জনগণের পাশে দাঁড়াতে এরই মধ্যে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দল কার্যক্রম শুরু করেছে।

শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ

ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের মান্দালয় শহর। শহরটির এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, ‘সবকিছু কাঁপতে শুরু করলে আমরা সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। আমার চোখের সামনে পাঁচতলা একটি ভবন ধসে পড়ে। আমাদের শহরের সবাই এখন রাস্তার ওপর রয়েছেন। ভয়ে কেউ ভবনের ভেতরে যাচ্ছেন না।’

ইন্টারনেটে প্রকাশিত ছবিতে মান্দালয় শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে। শহরের বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত। মিয়ানমারের শেষ রাজার বাসভবন ‘মান্দালয় প্রাসাদের’ দেয়ালের একাংশও ভেঙে পড়েছে। ভূমিকম্পে মিয়ানমারের আরেক শহর তাউনগোয় একটি মসজিদের একাংশ ধসে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া শান প্রদেশের আউং বান শহরে একটি হোটেল ভবনের নিচে ২০ জন চাপা পড়েছেন। নিহত হয়েছেন দুজন।

রাজধানী নেপিডোতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই শহরেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের (৯৬) মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সেখানে অনেক ভবন ধসে পড়েছে। অনেক গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের কারণে অনেক জায়গায় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির মিয়ানমার অঞ্চলের পরিচালক মোহামেদ রিয়াস বলেন, মিয়ানমারে জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয়, খাবার ও চিকিৎসাসহায়তা প্রয়োজন।

মিয়ানমারের শোচনীয় একসময়ে এই ভূমিকম্প হলো বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিয়ানমারবিষয়ক গবেষক জো ফ্রিম্যান। তিনি বলেন, দেশটিতে চলমান সংঘাতের কারণে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সেখানে আগে থেকেই ত্রাণসহায়তার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে ভূমিকম্পের কারণে সেই সংকট আরও তীব্র হলো।

মিয়ানমারে ২০২১ সালে নির্বাচিত অং সান সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা। এর পর থেকে দেশটিতে বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। বর্তমানে দেশটির বড় অংশ বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। দেশটির এক–তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।

থাইল্যান্ডে ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১১৭ জন আটকা

৭ থেকে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে শক্তিশালী ভূমিকম্প বলা হয়। বিশ্বজুড়ে বছরে আনুমানিক ১৮টি এমন ভূমিকম্প হয়। এর চেয়ে তীব্র ৮ থেকে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে বলা হয় প্রলংকরী, এ ধরনের ভূমিকম্প বছরে আনুমানিক একটি হয়ে থাকে।

গতকালের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি এত শক্তিশালী ছিল যে উৎপত্তিস্থল থেকে ১ হাজার ২০ কিলোমিটার দূরত্বের ব্যাংককে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে ব্যাংককে ৩৩ তলা একটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়েছে। ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্তত ১১৭ জন চাপা পড়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে অন্তত ৪০৯ জন উদ্ধারকাজে নেমেছেন।

ব্যাংককে হতাহতের বিষয়ে শহরের ডেপুটি গভর্নর তাভিদা কামোলভেজ বলেন, নির্মাণাধীন ওই ভবনের নিচে চাপা পড়ে এ পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু হয়েছে। শহরের আরেক এলাকায় নিহত হয়েছেন একজন। পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যাংককের গভর্নর চাদচার্ট সিত্তিপান্ত।

ব্যাংকক একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। ভূমিকম্পে গতকাল বিকেল পর্যন্ত শহরটিতে ১৬৯টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল ভূমিকম্পের সময় লোকজন ভয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকেই ছিলেন পর্যটক। কম্পনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে একটি অভিজাত হোটেলের ছাদের সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে নিচে পড়তে থাকে।

ভূমিকম্পের পর গতকাল থাইল্যান্ডের শেয়ারবাজারের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ৩১ মার্চ শেয়ারবাজারের লেনদেন আবার শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ব্যাংকককে দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করেছে শহর কর্তৃপক্ষ।

ভূমিকম্পের সময় ব্যাংককে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন শহরটির বাসিন্দা বুই থু। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখতে পেলাম দেয়াল ফেটে যাচ্ছে। সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে পড়ছে। চারদিক থেকে শুধু মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।’

ভূম্পিকম্পে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন এক মা ও তাঁর শিশুসন্তান।  গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোয়
ভূম্পিকম্পে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন এক মা ও তাঁর শিশুসন্তান। গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোয়। ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.