বঙ্গবন্ধু, সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস প্রসঙ্গ by আ স ম আবদুর রব
বঙ্গবন্ধু
হচ্ছে স্বাধীনতার সমার্থক। স্বাধীনতার প্রশ্নে সদা-সর্বদা-সর্বাগ্রে
বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ হাজার বছরের
শৃংখল ভেঙ্গে দৈন্য গ্লানি অতিক্রম করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সব
বিরোধ ছাপিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অথচ
বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে-এটা ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের সম্মিলিত ফসল হচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের নায়ক হচ্ছে সিরাজুল আলম খান। কেউ কেউ এ সত্যকে বলি দিয়ে ইতিহাস রচনা করতে চাচ্ছে। সিরাজুল আলম খান ৬০-৭০ দশকে লক্ষ লক্ষ তরুন ছাত্রসমাজের কাছে ছিলেন স্বাধীনতার বাতিঘর-স্বপ্নের সারথী।
তিনি ছিলেন তরুন ছাত্র ও যুব সমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার-মূল প্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধু উপাধির পরিকল্পনা, পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, জয়বাংলা বাহিনী ও বিএলএফ গঠন সহ ছাত্র ও যুবসমাজের মননে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করার অসাধ্য কর্মকান্ডের অদৃশ্য নায়ক সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার অন্তঃপ্রান সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ও খুবই আস্থাভাজন। যারা অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না বা আংশিক জড়িত থাকলেও পুর্ণাঙ্গ বিষয় জানেন না। তারা কিউক্লিয়াস, জয়বাংলা বাহিনী, বিএলএফ এর কর্মযজ্ঞ নিয়ে কীভাবে অভিমত প্রদান করেন? সিরাজুল আলম খানের একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য বীর সংগ্রামী শামসুদ্দিন পেয়ারা দীর্ঘ ৩৬ বছর তাগিদ দিয়ে ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করতে পেরেছেন। এটা সিরাজুল আলম খান এর জীবনীগ্রন্থ নয়, স্মৃতিকথাও নয়-স্বাধীন বাংলার জন্য যা করেছেন তার অংশ বিশেষ।
এই বই নিয়ে বিষোদগার বা ক্রোধের যে মাত্রা দেখলাম, কৃতজ্ঞতার যে প্রকাশ দেখলাম, শ্রদ্ধাবোধের যে নমুনা দেখলাম, দ্বিমতের যে বর্ননা দেখলাম এতে আমার এক নবতর উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। সে উপলব্ধি হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা চিরকাল অকৃতজ্ঞ। যে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যা করতে পারে, তাজউদ্দিন আহমেদ সহ জাতীয় চার নেতা এবং শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করতে পারে, ১৫ আগষ্টকে নাজাত দিবস পালন করতে পারে, যে দেশের মানুষ ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেছিলো বলে যারা স্বাক্ষী দিতে পারে, সেখানে পদ-পদবীবিহীন সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করা কোন বিষয়ই নয়। বাঙালীর বৈশিষ্ট নিয়ে ঐতিহাসিক টমাস বেবিংটন মেকলে বলেছেন (বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ভারতে হিষ্টিং ইংলেন্ডে তার বিচার প্রবন্ধের আরশাদ আজিজ এর বঙ্গানুবাদ) ‘মহিষের কাছে সিং-এর যা মূল্য, বাঘের কাছে থাবার যে গুরুত্ব, মৌমাছির কাছে যেমন হুল, পুরানা গ্রিক কবিতা অনুশারে নারীর জন্য সৌন্দর্য যা বাঙালীর কাছে প্রতারনা তূলনীয় মূল্যবান। এরা লম্বা লম্বা প্রতিজ্ঞা করে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার সুন্দর অজুহাত দেখায়, প্রতারণা-মিথ্যা হলফ, জালিয়াতি, এসব তারা আত্মরক্ষার্থে কিংবা অন্যের ক্ষতি করার জন্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না’। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, বঙ্গবন্ধুর আত্মদান আমাদের হীনমন্যতা ধূয়ে-মুছে দিতে পারেনি। আমরা আত্ম রক্ষার্থে বা কারো ক্ষতি করতে মিথ্যা অস্ত্র ব্যবহারে অতুলনীয়।
বিষোদগার করার জন্যেই কেউ যদি মানসিক প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাহলে যে কোন বিষয়কে টেনে হিচড়ে বিষোদগারের উপযোগী করা যায়। তার একটি উদাহরণ, বঙ্গবন্ধু ৭ই জুন ১৯৬৬ মঙ্গলবার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লেখেছেন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল এবং পাকিস্তান অবজারভার হেড লাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। এখনে বঙ্গবন্ধু কেন ইত্তেফাকের কথা উল্লেখ করেন নাই-কোন মতলবে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করেছেন, বিষোদগারকাররীরা বিবেকের তাড়নায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করে শেষে বলতে পারেন কেন বঙ্গবন্ধু ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃত করেছেন জানি না। সিরাজুল আলম খানকেও তেমনি টেনে হিচড়ে বিষোদগারের উপকরণে পরিণত করছেন, উনার সব অবদানকে অস্বীকারের ক্রোধে আত্মিক সন্তুষ্টি লাভ করেছেন-এসব বিষয়ে সিরাজুল আলম খান প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করেন না। এককালে যারা মনে করতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে রাষ্ট্র থাকে না বা দেশপ্রেম থাকে না-তেমনি আজ কেউ কেউ মনে করছে নিউক্লিয়াস, বিএলএফ, সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার না করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয় না। তারা উভয়ই ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর ঘৃণার আওতাধীন। রাষ্ট্র নির্মানে ভূমিকা বা অবদানের স্বীকৃতি কারো প্রত্যায়ন পত্র দিয়ে নির্ধারিত হয় না। স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান এর কথা হয়েছে কতবার তা কেবল তারাই জানেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজেই বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা হয়েছে সেটাও বিষোদগারকারীগন অস্বীকার করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধু কারো সাথে কথা বলতে পারেন না, তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কেউ যেতে পারেন না-এসব বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর জন্য খুবই অপমানজনক।
আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার সংস্কৃতি ভয়াবহ। পক্ষে থাকলে গৌরব ও সম্মান আর বিপক্ষে থাকলে অপমান-অসম্মান। আমাদের সত্য পরিবর্তন হয়ে যায় ক্ষমতার আলোকে। ক্ষমতার দম্ভে সত্যকে হত্যা করা যায়-এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারা মনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবল তাদের জন্য বরাদ্দ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এতে রয়েছে অসখ্য মানুষের অবদান। মুক্তিযুদ্ধের পিছনে সামগ্রিক ধারণা-কর্মকান্ড এবং মৌলিক চিন্তাধারার সাথে অনেকের অজ্ঞতা রয়েছে-যা থাকাই স্বাভাবিক। যে যতটুকু জড়িত-যতটুকু শুনেছেন সে ততটুকুই বলতে পারবেন-এসবের বাইরে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য দুটি ধারার কর্মকান্ডের ফসল। জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ ও হীনমন্য। অন্যের কৃতিত্ব-অবদান-আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে নিজের ভাবমুর্তি এবং খ্যাতি বাড়ানো যে ভয়ংকর অন্যায় সেটা আমরা অনেকেই জানি না। আমরা অনেকেই কাজ করেছি ইতিহাসে স্থান নেয়ার জন্য আর অনেকেই কাজ করেছেন ইতিহাস নির্মানের জন্য। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান এর সম্পর্ক, সম্পর্কের গভীরতা-নৈকট্য-উচ্চতা নিয়ে অনেকেরই ধারণা নেই-জানাও নেই।
আমরা বর্তমানের স্বার্থ-সংঘাতের ভিত্তিতে অতীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ৭১ এর অনেক বীর সিপাহ সালার, সেক্টর কমান্ডার এবং বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্তদের পাকিস্তানী চর বা রাজাকার বলতেও দ্বিধাবোধ করিনি। এসব বলার মাধ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়-এইটুকু উপলব্ধি আমাদের হয় না। দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতি যে কী ভয়ংকর তার প্রমাণ হচ্ছে ১৫ই আগষ্ট। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর-সিঁড়িতে লাশ রেখেই দলীয় নেতারা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেই মন্ত্রী পরিষদের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের কেউ প্রয়োজন মনে করেননি। বরং হাসি ঠাট্টাছলে টুপি আর ড্রেস কোড নিয়ে কথা হয়েছে। সেই সরকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে। এই দেশেই ১৫ই আগষ্টকে নাজাত দিবস পালন করার মানুষ ছিলো। যারা বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যায় জড়িত ছিলো তাদেরকে “সূর্য সন্তান” বলে আখ্যায়িত করা হতো। সেখানে বাঙালির ‘জাতিরাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনে যিনি ৬২ সাল থেকে গোপন সংগঠন, ৬ দফা-১১ দফা আন্দোলনের কৌশল প্রণয়ন, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই রাজনৈতিক উইং বিএলএফ এবং সামরিক উইং জয়বাংলা বাহিনী গঠন করেন, পতাকা নির্মান ও উত্তোলন, ইশতেহার প্রণয়ন ও ঘোষণা, বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানের পরিকল্পনা করেন এবং বঙ্গবন্ধু কাল্ট সৃষ্টিতে যার অবদান সবচেয়ে বেশী সেই সিরাজুল আলম খানকে ক্ষমা চাইতে হবে-অর্বাচীন বালক, ষড়যন্ত্রকারী বলে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এটাই কম কিসে? স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মানে যুক্ত থাকার অপরাধে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মনি সহ তাদেরকে খুন করে আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ তার প্রমাণ দিয়েছি। সিরাজুল আলম খানকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বিচারের সম্মুখীন করা বা অপঘাতে মৃত্যু যে এখনো হয়নি, তাতেই তাকে ভাগ্যবান মনে করছি। সিরাজুল আলম খান কৃতিত্ব নিতে চাইলে নিজেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করতে পারতেন-পতাকা উত্তোলন করতে পারতেন-ইশতেহার পাঠ করতে পারতেন কিন্তু তা না করে যার দ্বারা যে কাজ তার দ্বার সেই কাজ সম্পন্ন করাকেই কর্তব্য মনে করেছেন-নিজের কৃতিত্বকে তুচ্ছ করে দেখেছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ।
আমরা কতিপয় যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে একটু অবদানের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম তারা গত ৪৮ বছর ধরে প্রতিদিন রেডিও, টিভি সংবাদপত্রে জনসভায় ও স্মৃতিচারণে আমাদের ভূমিকা-অবদান নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি কিন্তু সেই অবদানের কথা আর শেষ হচ্ছে না। আর সিরাজুল আলম খান গত ৪৮ বছরে একদিনও কোন রেডিও-টিভি বা পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেননি। পত্রিকায় কোন লেখা পাঠান নি, জনসভা বা কোন আলোচনা সভায় স্মৃতিচারণ করেননি। গত ৪৮ বছরে কখনও দলীয় পদ বা সরকারী পদ-পদবী গ্রহণ করেননি। আমরা অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছি, গাড়ি-বাড়ীর মালিক হয়েছি, সংসার পরিবারের অধিকারী হয়েছি। শুধু একজন সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করে সংসার জীবন ত্যাগ করেছেন, ব্যক্তিগত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই-এসবের প্রতি তাঁর কোন মোহও নেই। এই প্রজন্মে এমন অসাধারণ মানুষ খুব দুর্লভ।
গত ৪৮ বছরে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছি। সেখানে সিরাজুল আলম খান জাতির উত্থান পতনের কারণ, সভ্যতার ক্রমবিকাশের পিছনে মূল চালিকা শক্তি কি, সমাজের অভ্যন্তরে নতুন সমাজ শক্তির উদ্ভব এসব সমাজ শক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আন্তঃসম্পর্ক, সমাজ শক্তি সমূহের রাজনৈতিক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। একুশ শতকের বাঙালী অর্থাৎ বাঙালী এখন তৃতীয় জাগরনের পর্যায়ে রয়েছে। এই জাগরণ বাঙালী জীবনে নবতর সামাজিক উপাদানে সমৃদ্ধ-জাতিসত্বার উচ্চতর বিকাশ নিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মান করেছেন। স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বগত দিক নির্দেশনার প্রয়োজনে শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়ন করেন ড. জিল্লুর রহমান খান সহ যৌথভাবে। সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে শ্রেনী শক্তি-রাজনৈতিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপ-রাজনৈতিক প্রযুক্তি নিয়ে অবিরাম গবেষণা করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বজাতির স্বভাব সম্মন্ধে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন যদিও জাতি হিসেবে বাঙালী পরশ্রীকাতরতার জাতি। ‘পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোন ভাষা খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। বঙ্গবন্ধুর এই গভীর উপলব্ধির নির্মম শিকার হয়েছেন নিজেই, নিজের দল আওয়ামী লীগ দ্বারা। বাংলাদেশের মত রাজনৈতিক বিপ্লবের ফসল যে সকল রাষ্ট্র নির্মান হয়েছে-সে সকল দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির জনক বা স্থপতিদের অবদানের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, তুরষ্কের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তাদের মহান নেতাদের অবদান উল্লেখ করে (হো চি মিন-সান ইয়াৎ সেন-মাও সেতুং-কিম ইল সুং-কামাল আতাতুর্ক) সর্বোচ্চ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান করেছে কেবলমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া। বাংলাদেশের ৭২ এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উচ্চারিত হয়নি-কোন অবদানের কথাই বলা হয়নি। এমন কি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কথা ৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ নেই। সে পরশ্রীকাতরতায় সিরাজুল আলম খান জাতির নিকট অপমানিত-লাঞ্চিত হবেন না তা কী করে সম্ভব? দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে সরকারী ইতিহাস নির্মানের প্রবনতার বাইরে যখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নির্মিত হবে তখন সিরাজুল আলম খান সহ যার যা অবদান তা লিপিবদ্ধ হবে।
দলীয় স্তাবকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার চেয়ে সরকারী পদ পদবী নিয়ে ব্যস্ত ছিলো-এসব নিয়ে আমাদের কোন আত্ম উপলব্ধি নেই। ৬০-৭০ দশক ছিলো অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থানের বিশ্ব। সরকার উৎখাত এবং রক্তপাতের বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম বিরোধীতাকারী পরাশক্তি ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এটা সকলেরই জানা। এরমধ্যেই চিলির জাতীয়তাবাদী নেতা সালভেদর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। এতকিছুর পরও বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দেয়ার বিশেষ কোন উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি? কেন রক্ষী বাহিনী বা সেনাবাহিনীর প্রবল নিরাপত্তার চাদরে ৩২ নং ধানমন্ডি ঢেকে দেয়া হয়নি? এগুলোর মূল্যয়ন করা অতীব জরুরী। বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ঘটছে এটা বাতাসে বাতাসে গুঞ্জন চলছিলো। কিন্তু দলীয় স্তাবকগণ এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবহেলাকেই নিশ্চিত করেছে। অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থানের বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এটা বুঝার জন্যে মহামতি লেলিন হওয়ার দরকার ছিলো না। উপমহাদেশের অহিংসের নেতা মহাত্মা গন্ধী সহিংসতার শিকার এটার জানার পরও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা যারা নিশ্চিত করলো না-তারা জাতির কতবড় সর্বনাশের ভাগিদার-তা নির্ধারণ করা উচিত। সিরাজুল আলম খান প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব হবে না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই বঙ্গবন্ধুর নিকট লিখিত ১৫ দফা উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর ১ম দফাই ছিলো অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় বাংলাদেশেকে পুনর্গঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়া সকল দল ও গ্রুপ এর সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু। ৩নং দফায় ছিলো বঙ্গবন্ধুর মর্যাদায় বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল দলের উর্ধ্বে। প্রয়োজনে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে। ৫নং দফায় ছিলো চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী’ গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক, ‘এফএফ’ এবং ‘বিএলএফ’ সহ সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরী হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোন বাহিনী থাকবে না। উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে যদি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠন হতো এবং চিরাচারিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধাদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠিত হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ক্রমেই সম্ভব হতো না-এইসব মৌলিক সত্য আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে।
বাঙালীর বৈশিষ্ট অনুধাবনে সমকালীন সবচেয়ে বড় ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা। বঙ্গবন্ধু হত্যা কী পরিমাণ অকৃতজ্ঞ জাতিতে আমাদেরকে পরিণত করেছে তা আমাদের যেমন উপলব্ধিতে নেই-তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে দোষারোপের বৃত্তেই আবদ্ধ করে রেখেছি কোন আত্ম সমালোচনা নেই।
মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার আশংকা প্রকাশিত হওয়ার পরও তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার প্যাটেল যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি-যা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ভারত স্বাধীন হলো বইয়ে উল্লেখ করেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন এ আমাদের চিরকালের লজ্জা আর দুঃখ যে আমাকে আজ কবুল করতে হচ্ছে একেবারে প্রাথমিকতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আমরা অপরাগ হয়েছি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যার বাইরেও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে এমন একটা আত্ম সমালোচনা আমাদের কারো আছে ? মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এর ‘ভারত স্বাধীন হল’ বই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর। কারণ তাঁর মতামত এবং মূল্যায়নের সাথে অনেকেই একমত হতে পারবেন না। এ কারণে তিনি মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর বই প্রকাশ করতে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সিরাজুল আলম খানও যদি ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হল’ বা ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে স্মৃতিকথা’ লিখে যান হয়তো অনেক অজানা কথা আমরা জানতে পারবো।
যাদের আত্মবিশ্বাসহীনতা প্রবল তারা মনে করছেন সিরাজুল আলম খানকে হেয় না করতে পারলে ইতিহাসে জায়গা পাওয়া যাবে না। কিন্তু এসব প্রশ্নে সিরাজুল আলম খান কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন নি। যারা সমালোচনা করছেন তাদের বিরাট সুবিধা হলো এই ভেবে যে সিরাজুল আলম খান কারো কথার কোন জবাব দেবেন না। আমরা যারা বাগাড়ম্বরের অভিযাত্রী তারা কারো বিরোধীতা করতে গিয়ে তাকে প্রতিপক্ষ করে ফেলি এবং মাটির তলায় ঢেকে দিয়ে শান্তি অনুভব করি। সেখানে সিরাজুল আলম খান টুশব্ধটি করেননি এমনকি ব্যক্তিতভাবে কোন অভিযোগ করেননি। সিরাজুল আলম খান এর প্রজ্ঞা, মানসিক গঠন, জীবনবোধ, রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে আমাদেরকে অনেককাল অপেক্ষা করতে হবে।
বিবেকের তাড়নায় সিরাজুল আলম খানকে তুচ্ছ করতে যতো উৎসাহী তার চেয়ে ভালো হতো জনগণের নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু উপধি’ প্রদান করা হলো কার পরিকল্পনা ও নিদের্শে-এ সত্য প্রকাশ করলে, আরো ভালো হতো বঙ্গবন্ধু শব্দের উদ্ভাবক সংগ্রামী রেজাউল হক চৌধুরী মোস্তাক এর নাম উচ্চারণ করলে। গত ৫০ বছরে এ গভীর সত্য একবারও উচ্চরিত হয়নি-এতেই বুঝা যায় নৈতিক উচ্চতা থেকে সত্যকে প্রকাশ করা হচ্ছে না। বরং সত্যকে মাটি চাপা দেয়া হচ্ছে। এই একটা বিষয় দিয়েই বুঝা যায় সিরাজুল আলম খান এর বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীগণ ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়-ইতিহাস থেকে অন্যদের অবদান মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
মহান নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বলেছেন ‘এই যে নক্ষত্রের আলো সেও একদিন নিভে যাবে, সূর্য একদিন আর আলো দিবে না, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, সুতরাং কোন কিছুতেই আমি জাহির করার কিছু দেখি না, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের ভূমিকা খুবই সীমিত এবং আমাদের উচিৎ এই সীমাবদ্ধ ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন করা’-সিরাজুল আলম খান এই চেতনারই স্বার্থক উত্তরাধিকার।
প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের সম্মিলিত ফসল হচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের নায়ক হচ্ছে সিরাজুল আলম খান। কেউ কেউ এ সত্যকে বলি দিয়ে ইতিহাস রচনা করতে চাচ্ছে। সিরাজুল আলম খান ৬০-৭০ দশকে লক্ষ লক্ষ তরুন ছাত্রসমাজের কাছে ছিলেন স্বাধীনতার বাতিঘর-স্বপ্নের সারথী।
তিনি ছিলেন তরুন ছাত্র ও যুব সমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার-মূল প্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধু উপাধির পরিকল্পনা, পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, জয়বাংলা বাহিনী ও বিএলএফ গঠন সহ ছাত্র ও যুবসমাজের মননে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করার অসাধ্য কর্মকান্ডের অদৃশ্য নায়ক সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার অন্তঃপ্রান সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ও খুবই আস্থাভাজন। যারা অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না বা আংশিক জড়িত থাকলেও পুর্ণাঙ্গ বিষয় জানেন না। তারা কিউক্লিয়াস, জয়বাংলা বাহিনী, বিএলএফ এর কর্মযজ্ঞ নিয়ে কীভাবে অভিমত প্রদান করেন? সিরাজুল আলম খানের একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য বীর সংগ্রামী শামসুদ্দিন পেয়ারা দীর্ঘ ৩৬ বছর তাগিদ দিয়ে ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করতে পেরেছেন। এটা সিরাজুল আলম খান এর জীবনীগ্রন্থ নয়, স্মৃতিকথাও নয়-স্বাধীন বাংলার জন্য যা করেছেন তার অংশ বিশেষ।
এই বই নিয়ে বিষোদগার বা ক্রোধের যে মাত্রা দেখলাম, কৃতজ্ঞতার যে প্রকাশ দেখলাম, শ্রদ্ধাবোধের যে নমুনা দেখলাম, দ্বিমতের যে বর্ননা দেখলাম এতে আমার এক নবতর উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। সে উপলব্ধি হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা চিরকাল অকৃতজ্ঞ। যে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যা করতে পারে, তাজউদ্দিন আহমেদ সহ জাতীয় চার নেতা এবং শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করতে পারে, ১৫ আগষ্টকে নাজাত দিবস পালন করতে পারে, যে দেশের মানুষ ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেছিলো বলে যারা স্বাক্ষী দিতে পারে, সেখানে পদ-পদবীবিহীন সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করা কোন বিষয়ই নয়। বাঙালীর বৈশিষ্ট নিয়ে ঐতিহাসিক টমাস বেবিংটন মেকলে বলেছেন (বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ভারতে হিষ্টিং ইংলেন্ডে তার বিচার প্রবন্ধের আরশাদ আজিজ এর বঙ্গানুবাদ) ‘মহিষের কাছে সিং-এর যা মূল্য, বাঘের কাছে থাবার যে গুরুত্ব, মৌমাছির কাছে যেমন হুল, পুরানা গ্রিক কবিতা অনুশারে নারীর জন্য সৌন্দর্য যা বাঙালীর কাছে প্রতারনা তূলনীয় মূল্যবান। এরা লম্বা লম্বা প্রতিজ্ঞা করে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার সুন্দর অজুহাত দেখায়, প্রতারণা-মিথ্যা হলফ, জালিয়াতি, এসব তারা আত্মরক্ষার্থে কিংবা অন্যের ক্ষতি করার জন্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না’। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, বঙ্গবন্ধুর আত্মদান আমাদের হীনমন্যতা ধূয়ে-মুছে দিতে পারেনি। আমরা আত্ম রক্ষার্থে বা কারো ক্ষতি করতে মিথ্যা অস্ত্র ব্যবহারে অতুলনীয়।
বিষোদগার করার জন্যেই কেউ যদি মানসিক প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাহলে যে কোন বিষয়কে টেনে হিচড়ে বিষোদগারের উপযোগী করা যায়। তার একটি উদাহরণ, বঙ্গবন্ধু ৭ই জুন ১৯৬৬ মঙ্গলবার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লেখেছেন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল এবং পাকিস্তান অবজারভার হেড লাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। এখনে বঙ্গবন্ধু কেন ইত্তেফাকের কথা উল্লেখ করেন নাই-কোন মতলবে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করেছেন, বিষোদগারকাররীরা বিবেকের তাড়নায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করে শেষে বলতে পারেন কেন বঙ্গবন্ধু ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃত করেছেন জানি না। সিরাজুল আলম খানকেও তেমনি টেনে হিচড়ে বিষোদগারের উপকরণে পরিণত করছেন, উনার সব অবদানকে অস্বীকারের ক্রোধে আত্মিক সন্তুষ্টি লাভ করেছেন-এসব বিষয়ে সিরাজুল আলম খান প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করেন না। এককালে যারা মনে করতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে রাষ্ট্র থাকে না বা দেশপ্রেম থাকে না-তেমনি আজ কেউ কেউ মনে করছে নিউক্লিয়াস, বিএলএফ, সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার না করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয় না। তারা উভয়ই ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর ঘৃণার আওতাধীন। রাষ্ট্র নির্মানে ভূমিকা বা অবদানের স্বীকৃতি কারো প্রত্যায়ন পত্র দিয়ে নির্ধারিত হয় না। স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান এর কথা হয়েছে কতবার তা কেবল তারাই জানেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজেই বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা হয়েছে সেটাও বিষোদগারকারীগন অস্বীকার করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধু কারো সাথে কথা বলতে পারেন না, তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কেউ যেতে পারেন না-এসব বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর জন্য খুবই অপমানজনক।
আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার সংস্কৃতি ভয়াবহ। পক্ষে থাকলে গৌরব ও সম্মান আর বিপক্ষে থাকলে অপমান-অসম্মান। আমাদের সত্য পরিবর্তন হয়ে যায় ক্ষমতার আলোকে। ক্ষমতার দম্ভে সত্যকে হত্যা করা যায়-এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারা মনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবল তাদের জন্য বরাদ্দ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এতে রয়েছে অসখ্য মানুষের অবদান। মুক্তিযুদ্ধের পিছনে সামগ্রিক ধারণা-কর্মকান্ড এবং মৌলিক চিন্তাধারার সাথে অনেকের অজ্ঞতা রয়েছে-যা থাকাই স্বাভাবিক। যে যতটুকু জড়িত-যতটুকু শুনেছেন সে ততটুকুই বলতে পারবেন-এসবের বাইরে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য দুটি ধারার কর্মকান্ডের ফসল। জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ ও হীনমন্য। অন্যের কৃতিত্ব-অবদান-আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে নিজের ভাবমুর্তি এবং খ্যাতি বাড়ানো যে ভয়ংকর অন্যায় সেটা আমরা অনেকেই জানি না। আমরা অনেকেই কাজ করেছি ইতিহাসে স্থান নেয়ার জন্য আর অনেকেই কাজ করেছেন ইতিহাস নির্মানের জন্য। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান এর সম্পর্ক, সম্পর্কের গভীরতা-নৈকট্য-উচ্চতা নিয়ে অনেকেরই ধারণা নেই-জানাও নেই।
আমরা বর্তমানের স্বার্থ-সংঘাতের ভিত্তিতে অতীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ৭১ এর অনেক বীর সিপাহ সালার, সেক্টর কমান্ডার এবং বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্তদের পাকিস্তানী চর বা রাজাকার বলতেও দ্বিধাবোধ করিনি। এসব বলার মাধ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়-এইটুকু উপলব্ধি আমাদের হয় না। দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতি যে কী ভয়ংকর তার প্রমাণ হচ্ছে ১৫ই আগষ্ট। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর-সিঁড়িতে লাশ রেখেই দলীয় নেতারা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেই মন্ত্রী পরিষদের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের কেউ প্রয়োজন মনে করেননি। বরং হাসি ঠাট্টাছলে টুপি আর ড্রেস কোড নিয়ে কথা হয়েছে। সেই সরকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে। এই দেশেই ১৫ই আগষ্টকে নাজাত দিবস পালন করার মানুষ ছিলো। যারা বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যায় জড়িত ছিলো তাদেরকে “সূর্য সন্তান” বলে আখ্যায়িত করা হতো। সেখানে বাঙালির ‘জাতিরাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনে যিনি ৬২ সাল থেকে গোপন সংগঠন, ৬ দফা-১১ দফা আন্দোলনের কৌশল প্রণয়ন, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই রাজনৈতিক উইং বিএলএফ এবং সামরিক উইং জয়বাংলা বাহিনী গঠন করেন, পতাকা নির্মান ও উত্তোলন, ইশতেহার প্রণয়ন ও ঘোষণা, বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানের পরিকল্পনা করেন এবং বঙ্গবন্ধু কাল্ট সৃষ্টিতে যার অবদান সবচেয়ে বেশী সেই সিরাজুল আলম খানকে ক্ষমা চাইতে হবে-অর্বাচীন বালক, ষড়যন্ত্রকারী বলে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এটাই কম কিসে? স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মানে যুক্ত থাকার অপরাধে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মনি সহ তাদেরকে খুন করে আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ তার প্রমাণ দিয়েছি। সিরাজুল আলম খানকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বিচারের সম্মুখীন করা বা অপঘাতে মৃত্যু যে এখনো হয়নি, তাতেই তাকে ভাগ্যবান মনে করছি। সিরাজুল আলম খান কৃতিত্ব নিতে চাইলে নিজেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করতে পারতেন-পতাকা উত্তোলন করতে পারতেন-ইশতেহার পাঠ করতে পারতেন কিন্তু তা না করে যার দ্বারা যে কাজ তার দ্বার সেই কাজ সম্পন্ন করাকেই কর্তব্য মনে করেছেন-নিজের কৃতিত্বকে তুচ্ছ করে দেখেছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ।
আমরা কতিপয় যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে একটু অবদানের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম তারা গত ৪৮ বছর ধরে প্রতিদিন রেডিও, টিভি সংবাদপত্রে জনসভায় ও স্মৃতিচারণে আমাদের ভূমিকা-অবদান নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি কিন্তু সেই অবদানের কথা আর শেষ হচ্ছে না। আর সিরাজুল আলম খান গত ৪৮ বছরে একদিনও কোন রেডিও-টিভি বা পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেননি। পত্রিকায় কোন লেখা পাঠান নি, জনসভা বা কোন আলোচনা সভায় স্মৃতিচারণ করেননি। গত ৪৮ বছরে কখনও দলীয় পদ বা সরকারী পদ-পদবী গ্রহণ করেননি। আমরা অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছি, গাড়ি-বাড়ীর মালিক হয়েছি, সংসার পরিবারের অধিকারী হয়েছি। শুধু একজন সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করে সংসার জীবন ত্যাগ করেছেন, ব্যক্তিগত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই-এসবের প্রতি তাঁর কোন মোহও নেই। এই প্রজন্মে এমন অসাধারণ মানুষ খুব দুর্লভ।
গত ৪৮ বছরে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছি। সেখানে সিরাজুল আলম খান জাতির উত্থান পতনের কারণ, সভ্যতার ক্রমবিকাশের পিছনে মূল চালিকা শক্তি কি, সমাজের অভ্যন্তরে নতুন সমাজ শক্তির উদ্ভব এসব সমাজ শক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আন্তঃসম্পর্ক, সমাজ শক্তি সমূহের রাজনৈতিক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। একুশ শতকের বাঙালী অর্থাৎ বাঙালী এখন তৃতীয় জাগরনের পর্যায়ে রয়েছে। এই জাগরণ বাঙালী জীবনে নবতর সামাজিক উপাদানে সমৃদ্ধ-জাতিসত্বার উচ্চতর বিকাশ নিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মান করেছেন। স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বগত দিক নির্দেশনার প্রয়োজনে শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়ন করেন ড. জিল্লুর রহমান খান সহ যৌথভাবে। সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে শ্রেনী শক্তি-রাজনৈতিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপ-রাজনৈতিক প্রযুক্তি নিয়ে অবিরাম গবেষণা করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বজাতির স্বভাব সম্মন্ধে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন যদিও জাতি হিসেবে বাঙালী পরশ্রীকাতরতার জাতি। ‘পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোন ভাষা খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। বঙ্গবন্ধুর এই গভীর উপলব্ধির নির্মম শিকার হয়েছেন নিজেই, নিজের দল আওয়ামী লীগ দ্বারা। বাংলাদেশের মত রাজনৈতিক বিপ্লবের ফসল যে সকল রাষ্ট্র নির্মান হয়েছে-সে সকল দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির জনক বা স্থপতিদের অবদানের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, তুরষ্কের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তাদের মহান নেতাদের অবদান উল্লেখ করে (হো চি মিন-সান ইয়াৎ সেন-মাও সেতুং-কিম ইল সুং-কামাল আতাতুর্ক) সর্বোচ্চ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান করেছে কেবলমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া। বাংলাদেশের ৭২ এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উচ্চারিত হয়নি-কোন অবদানের কথাই বলা হয়নি। এমন কি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কথা ৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ নেই। সে পরশ্রীকাতরতায় সিরাজুল আলম খান জাতির নিকট অপমানিত-লাঞ্চিত হবেন না তা কী করে সম্ভব? দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে সরকারী ইতিহাস নির্মানের প্রবনতার বাইরে যখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নির্মিত হবে তখন সিরাজুল আলম খান সহ যার যা অবদান তা লিপিবদ্ধ হবে।
দলীয় স্তাবকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার চেয়ে সরকারী পদ পদবী নিয়ে ব্যস্ত ছিলো-এসব নিয়ে আমাদের কোন আত্ম উপলব্ধি নেই। ৬০-৭০ দশক ছিলো অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থানের বিশ্ব। সরকার উৎখাত এবং রক্তপাতের বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম বিরোধীতাকারী পরাশক্তি ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এটা সকলেরই জানা। এরমধ্যেই চিলির জাতীয়তাবাদী নেতা সালভেদর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। এতকিছুর পরও বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দেয়ার বিশেষ কোন উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি? কেন রক্ষী বাহিনী বা সেনাবাহিনীর প্রবল নিরাপত্তার চাদরে ৩২ নং ধানমন্ডি ঢেকে দেয়া হয়নি? এগুলোর মূল্যয়ন করা অতীব জরুরী। বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ঘটছে এটা বাতাসে বাতাসে গুঞ্জন চলছিলো। কিন্তু দলীয় স্তাবকগণ এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবহেলাকেই নিশ্চিত করেছে। অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থানের বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এটা বুঝার জন্যে মহামতি লেলিন হওয়ার দরকার ছিলো না। উপমহাদেশের অহিংসের নেতা মহাত্মা গন্ধী সহিংসতার শিকার এটার জানার পরও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা যারা নিশ্চিত করলো না-তারা জাতির কতবড় সর্বনাশের ভাগিদার-তা নির্ধারণ করা উচিত। সিরাজুল আলম খান প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব হবে না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই বঙ্গবন্ধুর নিকট লিখিত ১৫ দফা উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর ১ম দফাই ছিলো অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় বাংলাদেশেকে পুনর্গঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়া সকল দল ও গ্রুপ এর সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু। ৩নং দফায় ছিলো বঙ্গবন্ধুর মর্যাদায় বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল দলের উর্ধ্বে। প্রয়োজনে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে। ৫নং দফায় ছিলো চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী’ গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক, ‘এফএফ’ এবং ‘বিএলএফ’ সহ সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরী হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোন বাহিনী থাকবে না। উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে যদি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠন হতো এবং চিরাচারিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধাদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠিত হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ক্রমেই সম্ভব হতো না-এইসব মৌলিক সত্য আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে।
বাঙালীর বৈশিষ্ট অনুধাবনে সমকালীন সবচেয়ে বড় ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা। বঙ্গবন্ধু হত্যা কী পরিমাণ অকৃতজ্ঞ জাতিতে আমাদেরকে পরিণত করেছে তা আমাদের যেমন উপলব্ধিতে নেই-তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে দোষারোপের বৃত্তেই আবদ্ধ করে রেখেছি কোন আত্ম সমালোচনা নেই।
মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার আশংকা প্রকাশিত হওয়ার পরও তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার প্যাটেল যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি-যা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ভারত স্বাধীন হলো বইয়ে উল্লেখ করেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন এ আমাদের চিরকালের লজ্জা আর দুঃখ যে আমাকে আজ কবুল করতে হচ্ছে একেবারে প্রাথমিকতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আমরা অপরাগ হয়েছি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যার বাইরেও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে এমন একটা আত্ম সমালোচনা আমাদের কারো আছে ? মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এর ‘ভারত স্বাধীন হল’ বই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর। কারণ তাঁর মতামত এবং মূল্যায়নের সাথে অনেকেই একমত হতে পারবেন না। এ কারণে তিনি মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর বই প্রকাশ করতে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সিরাজুল আলম খানও যদি ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হল’ বা ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে স্মৃতিকথা’ লিখে যান হয়তো অনেক অজানা কথা আমরা জানতে পারবো।
যাদের আত্মবিশ্বাসহীনতা প্রবল তারা মনে করছেন সিরাজুল আলম খানকে হেয় না করতে পারলে ইতিহাসে জায়গা পাওয়া যাবে না। কিন্তু এসব প্রশ্নে সিরাজুল আলম খান কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন নি। যারা সমালোচনা করছেন তাদের বিরাট সুবিধা হলো এই ভেবে যে সিরাজুল আলম খান কারো কথার কোন জবাব দেবেন না। আমরা যারা বাগাড়ম্বরের অভিযাত্রী তারা কারো বিরোধীতা করতে গিয়ে তাকে প্রতিপক্ষ করে ফেলি এবং মাটির তলায় ঢেকে দিয়ে শান্তি অনুভব করি। সেখানে সিরাজুল আলম খান টুশব্ধটি করেননি এমনকি ব্যক্তিতভাবে কোন অভিযোগ করেননি। সিরাজুল আলম খান এর প্রজ্ঞা, মানসিক গঠন, জীবনবোধ, রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে আমাদেরকে অনেককাল অপেক্ষা করতে হবে।
বিবেকের তাড়নায় সিরাজুল আলম খানকে তুচ্ছ করতে যতো উৎসাহী তার চেয়ে ভালো হতো জনগণের নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু উপধি’ প্রদান করা হলো কার পরিকল্পনা ও নিদের্শে-এ সত্য প্রকাশ করলে, আরো ভালো হতো বঙ্গবন্ধু শব্দের উদ্ভাবক সংগ্রামী রেজাউল হক চৌধুরী মোস্তাক এর নাম উচ্চারণ করলে। গত ৫০ বছরে এ গভীর সত্য একবারও উচ্চরিত হয়নি-এতেই বুঝা যায় নৈতিক উচ্চতা থেকে সত্যকে প্রকাশ করা হচ্ছে না। বরং সত্যকে মাটি চাপা দেয়া হচ্ছে। এই একটা বিষয় দিয়েই বুঝা যায় সিরাজুল আলম খান এর বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীগণ ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়-ইতিহাস থেকে অন্যদের অবদান মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
মহান নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বলেছেন ‘এই যে নক্ষত্রের আলো সেও একদিন নিভে যাবে, সূর্য একদিন আর আলো দিবে না, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, সুতরাং কোন কিছুতেই আমি জাহির করার কিছু দেখি না, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের ভূমিকা খুবই সীমিত এবং আমাদের উচিৎ এই সীমাবদ্ধ ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন করা’-সিরাজুল আলম খান এই চেতনারই স্বার্থক উত্তরাধিকার।
No comments