হাসপাতালে বাচ্চা বদল
ঘটনাটি
বলিউডের সিনেমার কাহিনির মতো। প্রথমত, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দুটো শিশুর
জন্ম হয় এবং হাসপাতালে থাকতেই এই দুটো শিশু দুর্ঘটনাবশত বদলাবদলি হয়ে
যায়।
দ্বিতীয়ত: একেবারেই ভিন্ন রকমের দুটো পরিবারে তাদের জন্ম। একটি শিশু উপজাতি এক হিন্দু পরিবারে আর অন্যটি মুসলিম। কিন্তু তারপর কি হলো? কর্তৃপক্ষের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করে যে পরিবারে তাদের জন্ম তাদেরকে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ওই দুটো শিশু যে পরিবারে বড় হয়েছে তাদেরকে ছেড়ে নিজের জন্মদাতা পিতামাতার কাছে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। পরে ওই দুটো দম্পতি আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং নিশ্চিত করেন যে তারা একে অপরের সন্তানকে লালন পালন করবেন। এই ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে। শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান তিনি তার স্ত্রী সালমা পারভীনকে মঙ্গলদাই হাসপাতালে নিয়ে যান ২০১৫ সালের ১১ই মার্চ সকাল ৬টার সময় এবং তার এক ঘণ্টা পরেই তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরের দিনই তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। `এক সপ্তাহ পর আমার স্ত্রী বললো এই বাচ্চা আমাদের না। আমি বললাম, কি বলছো তুমি? একটি নিষ্পাপ শিশুর ব্যাপারে তোমার এভাবে কথা বলা ঠিক না। আমার স্ত্রী বললো প্রসূতি কক্ষে নাকি একজন বোড়ো মহিলা ছিলো এবং তার মনে হচ্ছে ওই মহিলার বাচ্চার সাথে আমাদের বাচ্চা বদল হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত: একেবারেই ভিন্ন রকমের দুটো পরিবারে তাদের জন্ম। একটি শিশু উপজাতি এক হিন্দু পরিবারে আর অন্যটি মুসলিম। কিন্তু তারপর কি হলো? কর্তৃপক্ষের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করে যে পরিবারে তাদের জন্ম তাদেরকে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ওই দুটো শিশু যে পরিবারে বড় হয়েছে তাদেরকে ছেড়ে নিজের জন্মদাতা পিতামাতার কাছে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। পরে ওই দুটো দম্পতি আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং নিশ্চিত করেন যে তারা একে অপরের সন্তানকে লালন পালন করবেন। এই ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে। শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান তিনি তার স্ত্রী সালমা পারভীনকে মঙ্গলদাই হাসপাতালে নিয়ে যান ২০১৫ সালের ১১ই মার্চ সকাল ৬টার সময় এবং তার এক ঘণ্টা পরেই তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরের দিনই তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। `এক সপ্তাহ পর আমার স্ত্রী বললো এই বাচ্চা আমাদের না। আমি বললাম, কি বলছো তুমি? একটি নিষ্পাপ শিশুর ব্যাপারে তোমার এভাবে কথা বলা ঠিক না। আমার স্ত্রী বললো প্রসূতি কক্ষে নাকি একজন বোড়ো মহিলা ছিলো এবং তার মনে হচ্ছে ওই মহিলার বাচ্চার সাথে আমাদের বাচ্চা বদল হয়ে গেছে।
আমি তার কথা বিশ্বাস করি
নি। কিন্তু দিনের পর দিন সে এই কথাটা আমাকে বলতেই থাকলো।' তাদের সন্তানের
নাম রাখা হয় জুনায়েত। সালমা পারভীন জানান, শুরু থেকেই তার সন্দেহ
হয়েছিলো যে এই বাচ্চা তাদের নয়। `যখন আমি তার মুখ দেখলাম আমার মনে একটা
সন্দেহ তৈরি হলো। আমার তখন প্রসূতি কক্ষের ওই মহিলার কথা মনে পড়লো।
বাচ্চাটার চেহারার সাথে ওই মহিলার চেহারার মিল আছে। বাচ্চাটার ছোট ছোট দুটো
চোখ দেখেই আমি সেটা বুঝতে পারি। আমাদের পরিবারের কারোর চোখই ওরকম নয়,'
বলেন তিনি। আহমেদ তখন হাসপাতালে ছুটে যান এবং সেখানকার এক কর্মকর্তাকে তার
স্ত্রীর সন্দেহের কথা জানান। তখন ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন যে তার স্ত্রী
মানসিকভাবে সুস্থ নন। তার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। আহমেদ তখন তথ্য জানার
অধিকার সংক্রান্ত একটি পিটিশন দায়ের করেন। সেদিন সকাল সাতটা থেকে যতো
শিশুর জন্ম হয়েছিলো তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান তিনি। তার এক মাস
পর তিনি সাতজন নারীর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেন। কাগজপত্র দেখার
পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন একটি উপজাতি মহিলার ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ খবর
নেওয়ার। কারণ ওই মহিলার সন্তান জন্মদানের সাথে তাদের সন্তানের জন্ম হওয়ার
সময় ও ঘটনার মধ্যে তিনি অনেক মিল দেখতে পেয়েছেন। এই দুটো মহিলাই পুত্র
সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। দুটো শিশুরই ওজন তিন কেজি এবং তাদের জন্ম মাত্র
পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে। এরপর ওই মহিলার খোঁজে তিনি দু'বার তার গ্রামে
গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে যাওয়ার সাহস পান নি। `তখন আমি
তাদেরকে একটি চিঠি লিখি। আমি বলি যে আমার স্ত্রী সন্দেহ করছে তাদের
বাচ্চার সাথে আমাদের বাচ্চা বদল হয়ে গেছে এবং এবিষয়ে তাদের কোনো সন্দেহ
আছে কীনা। চিঠির নিচে আমি আমার ফোন নম্বর দিয়ে দেই।'
আহমেদের বাড়ি থেকে
প্রায় ১৯ মাইল দূরে এই বোড়ো পরিবারের গ্রাম- বার্লি। সেখানে অনিল ও
শেওয়ালি বোড়ো দম্পতির সন্তান রইয়ান চন্দ্রা। আহমেদের চিঠি পাওয়ার আগ
পর্যন্ত ওই বোড়ো দম্পতির সন্দেহ হয় নি যে তাদের সন্তান অন্য কোনো শিশুর
সাথে বদল হয়ে গেছে। এরকম কিছু হতে পারে বলে তারা কেউই সেটা বিশ্বাস করতে
পারছিলেন না। কিন্তু পুরো ঘটনাটিই বদলে যায় যখন এই দুটো পরিবার একসাথে
মিলিত হয়। `যখন আমি অন্য শিশুটিকে প্রথম দেখলাম তখনই মনে হলো যে আমার
স্বামীর সাথে তার চেহারার প্রচুর মিল। আমার তখন এতো খারাপ লাগছিলো যে আমি
কতোক্ষণ কাঁদলাম। আমরা বোড়োরা দেখতে অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমাদের নাক চোখ
দেখতে মুসলমানদের মতো নয়,' বলেন শেওয়ালি বোড়ো। সালমা পারভীন বলেন,
প্রথমবার দেখার সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রইয়ানই তাদের বাচ্চা।
সেই মুহূর্তেই তিনি বাচ্চা দুটোকে আবার বদলে নিতে চেয়েছিলেন। তবে বোড়ো
নারী তাতে রাজি হননি। পরে আহমেদের অনুরোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে
তদন্ত করতে শুরু করে। হাসপাতালের প্রসূতি কক্ষে সেদিন যেসব নার্স ছিলেন
তাদের সাথেও কথাবার্তা বলা হয়। তাদের কাজে কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তি হওয়ার
কথা তারা অস্বীকার করেন। এতেও ক্ষান্ত হননি আহমেদ। তিনি তখন তার স্ত্রী ও
শিশুর রক্তের নমুনা পাঠান ডিএনএ টেস্টের জন্যে। পরীক্ষার ফলাফল যখন তার
হাতে আসে তিনি তার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যান। সেখানে দেখা যায় শিশু
জুনায়েতের সাথে সালমা পারভীনের জিনগত কোন মিল পাওয়া যায় নি। হাসপাতাল
থেকে তখন আহমেদের পরিবারকে জানানো হয় যে আইনের কাছে এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য
নয়। তখন তিনি পরের বছরের ডিসেম্বর মাসে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের
করেন। এই মামলাটি যিনি তদন্ত করেছেন সেই সাব-ইন্সপেক্টর হেমন্ত বড়ুয়া
বিবিসিকে বলেছেন, হাসপাতাল থেকে তিনি শিশুদের জন্মসংক্রান্ত কাগজপত্র
সংগ্রহ করেছেন এবং সবকিছু মিলিয়ে দেখতে তিনি ওই দুটো পরিবারের সাথেও কথা
বলেছেন। পরে তিনি ওই দুটো দম্পতি ও দুটো শিশুর রক্তের নমুনা নিয়ে কলকাতায়
যান পরীক্ষার জন্যে। তবে ফর্মে কিছু ত্রুটি থাকায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরি এই
পরীক্ষা করাতে রাজি হননি। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন আমরা দ্বিতীয়বারের
মতো নমুনা সংগ্রহ করি। রাজধানী গৌহাটিতে ফরেনসিক ল্যাবে এই টেস্ট সম্পন্ন
করা হয়। ওই পরীক্ষায় প্রমাণ হয় যে আসলেই বাচ্চা দুটো জন্মের সময় বদলা
বদলি হয়ে গেছে।’ বড়ুয়া তখন আহমেদকে পরামর্শ দেন বিষয়টি নিয়ে আদালতে
যাওয়ার জন্যে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিনি আবেদন করেন দুটো বাচ্চাকে আবার
বদল করার জন্যে। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে বাচ্চা দুটোকে যার যার আসল পরিবারের
কাছে ফেরত দেওয়া হবে। এজন্যে দুটো পরিবার আদালতেও হাজির হয়। কিন্তু বাদ
সাধে দুটো শিশু।
যে পরিবারে তারা বেড়ে উঠেছে সেই পরিবার ছেড়ে যেতে তারা
আর রাজি হয়নি। সালমা পারভীন বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের বলেন, চাইলে আমরা
আমাদের বাচ্চা দুটো বদলাবদলি করে নিতে পারি। কিন্তু আমরা তখন বলি যে না,
আমরা সেটা করবো না। কারণ গত তিন বছর ধরে আমরা তাদেরকে বড় করেছি। হঠাৎ করেই
আমরা তো আর তাদেরকে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে পারি না।’ ‘এছাড়াও জুনায়েত
কাঁদছিলো। সে ছিলো আমার দেবরের কোলে। সে তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। দু'হাত
দিয়ে তার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে তখন কাঁদতে লাগলো। আমাদের ছেড়ে সে
যেতে চাইছিলো না।’ একই আচরণ করতে থাকে বোড়ো পরিবারে বড়ো হওয়া শিশু
রইয়ানও। অনিল বোড়ো বলেন, এখন যদি তাদেরকে বদল করা হয় তাহলে তারা
মানসিকভাবে কষ্ট পেতে পারে। তারা এতো ছোট্ট যে কি ঘটছে তার কিছুই তারা
বুঝতে পারছে না। তারপর থেকে ওই দুটো শিশু আগের মতোই ভিন্ন পরিবারে আদর যত্ন
আর ভালোবাসায় বেড়ে উঠছে। কিন্তু বিবিসির প্রতিবেদক দুটো পরিবারের কাছে
জানতে চেয়েছিলেন শিশুদের ধর্মীয় পরিচয় ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হতে পারে
কীনা। ‘বাচ্চা তো বাচ্চাই। সে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার উপহার। সে হিন্দুও নয়,
মুসলিমও নয়। সবার উৎস একই। পৃথিবীতে আসার পরেই তারা হিন্দু বা মুসলিম হয়ে
যায়,’ বলেন আহমেদ। তিনি বলেন, এখন যদি বাচ্চা দুটোকে বদল করা হয় তাহলে
নতুন পরিবারে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে না। কারণ দুটো পরিবারের
ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, অভ্যাস এসব একেবারেই আলাদা। একজন মা যে শিশুটিকে
বড় করেন তার সাথে তার একটি বন্ধন তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু যে শিশুটিকে তিনি
গর্ভে ধারণ করেন তার জন্যেও ওই নারী একটা টান অনুভব করেন। এই আকুলতা দুই
মায়ের মধ্যেও আছে। তবে তারা বলছেন, বাচ্চা দুটো বড়ো হওয়ার পর তারাই
সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে তারা আসলে কোন পরিবারের সাথে থাকতে আগ্রহী। এখন এই
দুটো পরিবার যেটা চেষ্টা করছে তা হলো- তাদের মধ্যে যাতে নিয়মিত দেখা
সাক্ষাৎ হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং শিশু দুটোর সাথে যাতে
তাদের আসল পরিবারের একটা সম্পর্ক বজায় থাকে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
No comments