ভিয়েনায় যেভাবে বিদেশিনীর প্রেমে পড়েছিলেন সুভাষ বসু
১৯৩৪
সালের কথা। নেতাজি হিসেবে পরিচিত সুভাষ চন্দ্র বসু সেসময় অস্ট্রিয়ার
রাজধানী ভিয়েনাতে ছিলেন। তার শরীর বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ হচ্ছিল। ১৯৩২-এর
ফেব্রুয়ারী থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ার সময়
থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য সুভাষ বসুকে শেষমেশ ইউরোপে
যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার, তবে শর্ত চিকিৎসার খরচ তার
পরিবারকেই দিতে হবে। ভিয়েনায় চিকিৎসা করানোর সময়ই সুভাষচন্দ্র ঠিক
করলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে ইউরোপে বসবাসরত ভারতীয় ছাত্রদের
সংঘবদ্ধ করা দরকার। এক ইউরোপীয় প্রকাশক ওই সময় তাকে 'দা ইন্ডিয়ান
স্ট্রাগল' নামে একটা বই লেখার কাজ দেন। বইটি লেখার জন্য একজন সহকারীর
প্রয়োজন হল, যিনি ইংরেজী আর টাইপিং - দুটিই ভালোমতো জানবেন। সুভাষ
চন্দ্রের বন্ধু ড. মাথুর দুজনের নাম সুপারিশ করে পাঠালেন। তার মধ্যে যাকে
বেশি উপযুক্ত মনে হলো - তাকে সাক্ষাতকারের জন্য ডেকে পাঠালেন সুভাষ। কিন্তু
কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
তখনই দ্বিতীয়জনের ডাক পড়ল। ২৩ বছর
বয়সী এমিলি শেঙ্কল এসেছিলেন ইন্টারভিউ দিতে। সুন্দরী অস্ট্রিয়ান ওই
তরুণীকেই সহকারী হিসাবে কাজে নিয়োগ করলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৪ সালের
জুন মাস। সুভাষ চন্দ্রে বয়স তখন ৩৭ বছর। তার ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল কী করে
ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতকে স্বাধীন করা যায় তার ওপর। শেঙ্কলের সঙ্গে দেখা
হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ধারণাও করতে পারেননি যে ওই অস্ট্রিয় তরুণী তার
জীবনে একটা নতুন ঝড় তুলে দিতে পারেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর বড়ভাই শরৎ বসুর
নাতি ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসু নিজের বই 'হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট -
সুভাষ চন্দ্র বসু এন্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার'-এ লিখেছেন,
এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল।
সুগত বসুর মতে তার আগে পর্যন্ত সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনে প্রেম বা বিয়ের
বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছিল। সেসবে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। কিন্তু এমিলির
সৌন্দর্য সুভাষের ওপরে যেন কী একটা জাদু করে দিল। এমিলিকে উদ্ধৃত করে সুগত
বসু তার বইতে লিখেছেন, "প্রেমের আভাসটা সুভাষ চন্দ্র বসুর দিক থেকেই
এসেছিল। ধীরে ধীরে সেটা একটা রোমান্টিক সম্পর্কের দিকে মোড় নেয়। ১৯৩৪-এর
মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছর দুয়েক অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লাভাকিয়াতে থাকার
সময়ে সম্পর্কটা আরও মধুর হয়ে উঠেছিল।" ১৯১০ সালের ২৬ জানুয়ারি
অস্ট্রিয়ার এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম হয়েছিল এমিলির। তার বাবা প্রথমে
মেয়েকে এক ভারতীয়র অধীনে কাজ করতে দিতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু সুভাষ
চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার পরে তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নোয়াতেই
হয়েছিল এমিলির বাবাকে।
প্রেমপত্র বিনিময় পর্ব
ইতিহাসলেখক রুদ্রাংশু মুখার্জী সুভাষ চন্দ্র আর জওহরলাল নেহরুর জীবন নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তার বই 'নেহরু এন্ড বোস - প্যারালাল লাইভস'-এ। ওই বইতে একটু অনুচ্ছেদ রয়েছে 'টু উইমেন এন্ড টু বুক্স' নামে। সেখানে নেহরু আর সুভাষ চন্দ্রের জীবনে তাঁদের দুজনের পত্নীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন রুদ্রাংশু মুখার্জী। মুখার্জী লিখেছেন, "সুভাষ এবং এমিলি দুজনেই একেবারে গোড়ার দিকেই মেনে নিয়েছিলেন যে তাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটি সম্পর্কের মতো হবে না। সেখানে নানা অসুবিধা আসবে। একে অন্যকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলোতে সংবোধন করার ধরণ দেখেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এমিলি সম্বোধন করতেন 'মিস্টার বোস' বলে, আর সুভাষ চন্দ্র লিখতেন মিস শেঙ্কল বা পার্ল শেঙ্কল।" পরিচয় গোপন করার বাধ্যবাধকতা আর যুদ্ধের সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সাহায্য পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপের মধ্যে সুভাষচন্দ্র নিজের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও সুভাষচন্দ্র এমিলির জন্য কতটা চিন্তা করতেন, তার প্রমাণ একটা চিঠিতে পাওয়া যায়, যেটাকে সুভাষ চন্দ্রের প্রেমপত্রও বলা যেতে পারে। এই চিঠি অবশ্য প্রথমে এমিলিকে লেখা সুভাষ চন্দ্রের চিঠিগুলির সংগ্রহে ছিল না। কিন্তু এমিলি নিজেই এই চিঠিটা তুলে দিয়েছিলেন শরৎ চন্দ্র বসুর ছেলে, ডা. শিশির বসুর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুর হাতে।
৫ মার্চ, ১৯৩৬ সালে লেখা চিঠিটা শুরু হয়েছিল এইভাবে :
"মাই ডার্লিং, কখনও সখনও হিমবাহও গলে যায়। আমার মনে এখন অনেকটা সেরকমই অবস্থা। আমি যে তোমায় কতটা ভালবাসি সেটা জানাতে এই চিঠিটা লেখা থেকে নিজেকে সম্বরণ করতে পারলাম না। 'মাই ডার্লিং', আমাদের নিজেদের মতো করে কী বলতে পারি, যে তুমি আমার হৃদয়ের রাণী?" সুভাষ চন্দ্র ওই চিঠিতেই লিখছেন, "আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়তো জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করে দেয়া হতে পারে, কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়তো আমাকে কখনও আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনও তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না। কিন্তু ভরসা রেখ, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।" "আমি তোমার অন্তরে থাকা নারীত্বকে ভালবাসি, তোমার আত্মার সঙ্গে আমার প্রেম। তুমিই আমার জীবনে প্রথম প্রেম," এমিলি শেঙ্কলকে লিখেছিলেন সুভাষ চন্দ্র। একেবারে শেষে ওই চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন সুভাষ। কিন্তু এমিলি সেটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।
গোপন বিবাহ
বোঝাই যাচ্ছে যে সুভাষ চন্দ্র বসু এমিলি শেঙ্কলের প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন। এই বিষয়ে সুভাষ চন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহযোগী এ সি এন নাম্বিয়ার সুগত বসুকে জানিয়েছিলেন, "সুভাষ একজন প্রকৃত আদর্শবাদী ব্যক্তি ছিল। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু যদি কোনও বিচ্যতির কথা বলতে হয়, তাহলে সেটা হয়েছিল তিনি যখন এমিলির প্রেমে পড়লেন, সেই সময়ে। খুবই ভালবাসতেন এমিলিকে। একেবারে প্রেমে ডুবে যাওয়া যাকে বলে, সেইরকম।" সেই সময়ে সুভাষচন্দ্রের মনের অবস্থা কীরকম ছিল, সেটা বোঝা যায় আরেকটি চিঠিতে। ১৯৩৭ এর এপ্রিল বা মার্চ মাসে এমিলিকে লেখা ওই চিঠির পুরোটাই ইংরেজী ক্যাপিটাল অক্ষরে লেখা। "গত কিছুদিন যাবত তোমাকে চিঠি লেখার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আশা করি তুমি বুঝতে পারবে যে তোমাকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা লিখে বোঝানো কঠিন। তোমাকে শুধু এটাই বলতে চাই, আমি আগেও যেরকম ছিলাম এখনও সেরকমই আছি।" এই চিঠি দেয়া নেয়ার পালার পরে প্রথম যেবার এমিলি আর সুভাষ চন্দ্রের দেখা হয়েছিল, তখনই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. কৃষ্ণা বসুকে এমিলি বলেছিলেন, ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। দুজনেরই পছন্দের রিসর্ট ছিল ওটা। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কৃষ্ণা বসু বলছেন, নিজের বিয়ের তারিখটা ছাড়া আর কোনো কিছুই বলতে চাননি এমিলি। তবে সুভাষ চন্দ্র আর এমিলির মেয়ে অনিতা বসু তার মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছেন, তার ভিত্তিতেই বলেছিলেন ভারতীয় নববধূর মতো বিয়ের সময়ে তার মাথায় সিঁদুর পরানো হয়েছিল।
প্রেমপত্র বিনিময় পর্ব
ইতিহাসলেখক রুদ্রাংশু মুখার্জী সুভাষ চন্দ্র আর জওহরলাল নেহরুর জীবন নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তার বই 'নেহরু এন্ড বোস - প্যারালাল লাইভস'-এ। ওই বইতে একটু অনুচ্ছেদ রয়েছে 'টু উইমেন এন্ড টু বুক্স' নামে। সেখানে নেহরু আর সুভাষ চন্দ্রের জীবনে তাঁদের দুজনের পত্নীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন রুদ্রাংশু মুখার্জী। মুখার্জী লিখেছেন, "সুভাষ এবং এমিলি দুজনেই একেবারে গোড়ার দিকেই মেনে নিয়েছিলেন যে তাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটি সম্পর্কের মতো হবে না। সেখানে নানা অসুবিধা আসবে। একে অন্যকে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলোতে সংবোধন করার ধরণ দেখেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এমিলি সম্বোধন করতেন 'মিস্টার বোস' বলে, আর সুভাষ চন্দ্র লিখতেন মিস শেঙ্কল বা পার্ল শেঙ্কল।" পরিচয় গোপন করার বাধ্যবাধকতা আর যুদ্ধের সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সাহায্য পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপের মধ্যে সুভাষচন্দ্র নিজের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও সুভাষচন্দ্র এমিলির জন্য কতটা চিন্তা করতেন, তার প্রমাণ একটা চিঠিতে পাওয়া যায়, যেটাকে সুভাষ চন্দ্রের প্রেমপত্রও বলা যেতে পারে। এই চিঠি অবশ্য প্রথমে এমিলিকে লেখা সুভাষ চন্দ্রের চিঠিগুলির সংগ্রহে ছিল না। কিন্তু এমিলি নিজেই এই চিঠিটা তুলে দিয়েছিলেন শরৎ চন্দ্র বসুর ছেলে, ডা. শিশির বসুর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুর হাতে।
৫ মার্চ, ১৯৩৬ সালে লেখা চিঠিটা শুরু হয়েছিল এইভাবে :
"মাই ডার্লিং, কখনও সখনও হিমবাহও গলে যায়। আমার মনে এখন অনেকটা সেরকমই অবস্থা। আমি যে তোমায় কতটা ভালবাসি সেটা জানাতে এই চিঠিটা লেখা থেকে নিজেকে সম্বরণ করতে পারলাম না। 'মাই ডার্লিং', আমাদের নিজেদের মতো করে কী বলতে পারি, যে তুমি আমার হৃদয়ের রাণী?" সুভাষ চন্দ্র ওই চিঠিতেই লিখছেন, "আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়তো জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করে দেয়া হতে পারে, কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়তো আমাকে কখনও আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনও তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না। কিন্তু ভরসা রেখ, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।" "আমি তোমার অন্তরে থাকা নারীত্বকে ভালবাসি, তোমার আত্মার সঙ্গে আমার প্রেম। তুমিই আমার জীবনে প্রথম প্রেম," এমিলি শেঙ্কলকে লিখেছিলেন সুভাষ চন্দ্র। একেবারে শেষে ওই চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন সুভাষ। কিন্তু এমিলি সেটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।
গোপন বিবাহ
বোঝাই যাচ্ছে যে সুভাষ চন্দ্র বসু এমিলি শেঙ্কলের প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন। এই বিষয়ে সুভাষ চন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহযোগী এ সি এন নাম্বিয়ার সুগত বসুকে জানিয়েছিলেন, "সুভাষ একজন প্রকৃত আদর্শবাদী ব্যক্তি ছিল। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু যদি কোনও বিচ্যতির কথা বলতে হয়, তাহলে সেটা হয়েছিল তিনি যখন এমিলির প্রেমে পড়লেন, সেই সময়ে। খুবই ভালবাসতেন এমিলিকে। একেবারে প্রেমে ডুবে যাওয়া যাকে বলে, সেইরকম।" সেই সময়ে সুভাষচন্দ্রের মনের অবস্থা কীরকম ছিল, সেটা বোঝা যায় আরেকটি চিঠিতে। ১৯৩৭ এর এপ্রিল বা মার্চ মাসে এমিলিকে লেখা ওই চিঠির পুরোটাই ইংরেজী ক্যাপিটাল অক্ষরে লেখা। "গত কিছুদিন যাবত তোমাকে চিঠি লেখার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আশা করি তুমি বুঝতে পারবে যে তোমাকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা লিখে বোঝানো কঠিন। তোমাকে শুধু এটাই বলতে চাই, আমি আগেও যেরকম ছিলাম এখনও সেরকমই আছি।" এই চিঠি দেয়া নেয়ার পালার পরে প্রথম যেবার এমিলি আর সুভাষ চন্দ্রের দেখা হয়েছিল, তখনই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. কৃষ্ণা বসুকে এমিলি বলেছিলেন, ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। দুজনেরই পছন্দের রিসর্ট ছিল ওটা। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কৃষ্ণা বসু বলছেন, নিজের বিয়ের তারিখটা ছাড়া আর কোনো কিছুই বলতে চাননি এমিলি। তবে সুভাষ চন্দ্র আর এমিলির মেয়ে অনিতা বসু তার মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছেন, তার ভিত্তিতেই বলেছিলেন ভারতীয় নববধূর মতো বিয়ের সময়ে তার মাথায় সিঁদুর পরানো হয়েছিল।
বিয়েটা এতটাই গোপণীয় রাখা
হয়েছিল যে সুভাষচন্দ্রের ভাইপো অমিয় বসু বিয়ের সময়েই বাদগাস্তিনে
গিয়েছিলেন, তবুও এমিলিকে দেখে তার সেই সময়েও নিজের কাকার সহকারী ছাড়া
অন্য কিছু মনে হয়নি। নিজের বিয়ে নিয়ে এত গোপণীয়তার সম্ভাব্য কারণ
হিসাবে রুদ্রাংশু মুখার্জী লিখেছেন, সম্ভবত সুভাষ চন্দ্র নিজের রাজনৈতিক
জীবনে এই বিয়ের কোনো প্রভাব পড়ুক, সেটা চাননি। একজন বিদেশীনিকে বিয়ে
করার ঘটনায় মানুষের মনে তার যে ভাবমূর্তি রয়েছে, তার ওপরে প্রভাব ফেলতে
পারে বলেই তিনি হয়তো মনে করেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র আর এমিলি শেঙ্কলের
প্রেমপর্বের ওপরেই একটা বই লিখেছেন তিনবার ভারতের সংসদ সদস্য নির্বাচিত
হওয়া ড. কৃষ্ণা বসু । 'আ ট্রু লাভ স্টোরি - এমিলি এন্ড সুভাষ' নামের ওই
বইটিতে দুজনের প্রেমপর্বের অনেক জানা- অজানা তথ্য রয়েছে। এমিলিকে সুভাষ
ভালোবেসে 'বাঘিনী' বলে ডাকতেন। আবার এরকম ঘটনারও উদাহরণ আছে, এমিলির
বুদ্ধিমত্তা যে সুভাষের ধারে কাছেও ছিল না, এবং সেটা সুভাষ কখনও কখনও
প্রকাশও করে দিতেন। কৃষ্ণা বসুর লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন যে এমিলি
কয়েকটি ভারতীয় পত্রপত্রিকার জন্য ভিয়েনা থেকে রিপোর্ট লিখতে শুরু করুন।
এমিলি সেই অনুযায়ী 'দা হিন্দু' এবং 'মর্ডান রিভিউ' পত্রিকার জন্য বেশ কিছু
লেখাও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংবাদের বিশ্লেষণ ঠিকমতো করতে না
পারায় এমিলির বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়নি। সুভাষ তাকে চিঠি দিয়ে
জানিয়েছেন, "তোমার লেখা ঠিক হয়নি, তাই ছাপা হলো না।" একবার ভারতের ওপরে
বেশ কিছু বই আনতে বলেছিলেন এমিলি। ১৯৩৭-এর ১২ অগাস্ট লেখা এক চিঠিতে
সুভাষচন্দ্র এমিলিকে লিখেছিলেন, "তুমি ভারতের ওপরে কিছু বই আনতে দিয়েছ।
তবে আমার মনে হয় না ওইসব বইগুলো তোমাকে পড়তে দিয়ে খুব একটা লাভ হবে।
তোমার কাছে যেসব বইগুলো আছে, তুমি তো সেগুলোই পড়ে ওঠনি।" "তুমি যতদিন না
সিরিয়াস হবে, ততদিন পড়ার ব্যাপারে তোমার মন লাগবে না। ভিয়েনাতে তোমার
কাছে এখনই কত বই রয়েছে। আমার তো মনে হয় না সেগুলো তুমি উল্টেপাল্টেও
দেখেছ কখনও," স্ত্রীকে লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র। এরকম কিছু কড়া শব্দ কখনও
সখনও ব্যবহার করলেও এমিলি আর সুভাষ একে অপরকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। ১৯৩৪ থেকে
১৯৪৫ - এই প্রায় ১২ বছর সময়কালে দুজনে বছর তিনেকেরও কম সময় একসঙ্গে
কাটাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেই দুজনের প্রেমের চিহ্ন হিসেবে ১৯৪২
সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নেয় তাদের কন্যা অনিতা। মেয়েকে দেখার জন্য ১৯৪২-এর
ডিসেম্বরে ভিয়েনায় পৌঁছান সুভাষ চন্দ্র। তারপরে বড়ভাই শরৎ চন্দ্রকে
বাংলায় লেখা একটি চিঠিতে সুভাষ চন্দ্র স্ত্রী আর কন্যার ব্যাপারে
বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। তারপরেই সুভাষ চন্দ্র বসু সেই মিশনে রওনা হন,
যেখান থেকে এমিলি বা অনিতার কাছে আর কোনওদিনই ফিরে আসেন নি। এমিলি অবশ্য
সুভাষের স্মৃতি নিয়েই ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। একটা ছোট টেলিগ্রাফ
অফিসে চাকরী করে সুভাষ চন্দ্রের শেষ স্মৃতি - নিজের মেয়ে অনিতাকে বড়
করেছেন - জার্মানীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বানিয়েছেন। তবে সুভাষ চন্দ্রের
পরিবার থেকে কোনো রকম সাহায্য নিতে অস্বীকার করে গেছেন এমিলি। শুধু তাই
নয়, সুভাষ চন্দ্র নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে যে গোপণীয়তা রক্ষা করতে
চাইতেন, যেভাবে সেটা গোটা দুনিয়ার কাছ থেকে আড়াল করতে চাইতেন, এমিলিও
সম্পূর্ণভাবে তার মর্যাদা রেখে গেছেন চির জীবন।
No comments