নেতৃত্ব-ইটন-ফৌজদারহাট by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
গত
২০ বছরে অনেক পত্রিকায় লিখেছি বা লিখে আসছি যেমন- ভোরের কাগজ, প্রথম আলো,
জনকণ্ঠ, মানবজমিন, ইত্তেফাক, সমকাল, কালের কণ্ঠ, প্রভৃতি। বর্তমানে বেশি
লিখি নয়া দিগন্ত ও যুগান্তরে। প্রত্যেক সপ্তাহে, বুধবারের দুই-তিন দিন আগে
লেখার সময় এলেই, নয়া দিগন্তের কলামের বিষয়বস্তু কী হবে সেটা নিয়ে যৎকিঞ্চিত
চিন্তা করি। হার্ডকপি বা মুদ্রিত কপির সার্কুলেশন হিসেবে, পত্রিকার গ্রাহক
সংখ্যা দুই-তিন লাখের মধ্যে হলেও, অনলাইনে এই পত্রিকার পাঠক সংখ্যা
পঞ্চান্ন লাখের উপরে বলে জানা যায়। অতএব এত বিশাল সংখ্যক গ্রাহকের সমীপে
বক্তব্য উপস্থাপন করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা স্বাভাবিক। জীবনঘনিষ্ঠ
বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ভালো। নিজে কলাম পড়ি ১৯৭২ সাল থেকে; লিখি ১৯৯৭ সাল
থেকে; অর্থাৎ পাঠক হিসেবে যেমন অভিজ্ঞতা আছে, লেখক হিসেবেও অভিজ্ঞতা আছে।
সেই সুবাদে মনের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত কামনা এরূপ : মানুষ ও দেশ যেন আমার
লেখনীর মাধ্যমে উপকৃত হয়। ছোটকালে স্কুল-কলেজে আমরা যেমন বিতর্কে অংশ
নিয়েছি, তেমনি এখনো ছাত্রছাত্রীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
বিতর্কের বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ও আলাপপ্রিয় বিষয় অতীতে যেমন ছিল
এখনো আছে: ‘অসি বড়, না মসি বড়’। অসি মানে তরবারি তবা বন্দুক তথা যুদ্ধের
অস্ত্র তথা যুদ্ধ মানে বল প্রয়োগ বা শক্তি। মসি মানে কলম তথা লেখনী,
উদ্দীপনা সৃষ্টি তথা সচেতনতা সৃষ্টি অথবা শান্তিময় পরিবেশে ভাব বিনিময়
কিংবা বিনয়ী ভাষায় আহ্বান তথা ভদ্র ভাষায় প্রতিবাদ জ্ঞাপন। ১৯৭০ থেকে ১৯৯৬
সাল পর্যন্ত একজন সৈনিক ছিলাম, অর্থাৎ অসি আমার হাতে ছিল। ১৯৭১ সালের মহান
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে অন্যতম উদাহরণ, যেখানে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা আনতে
হয়েছে। কিন্তু সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল বিনা অস্ত্রে,
সাহিত্যে-ভাষণে-বচনে-চিন্তায়। আমার অবসর জীবনে অসির সাথে সম্পৃক্ত নই বা
সেটার ওপর নির্ভরশীল নই; আমার প্রাধান্য মসিতে। তাই আজ লিখব একটি পরিচিত
বিষয় নিয়ে; নেতৃত্ব সৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে। উদাহরণ
হচ্ছে, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ (সংক্ষেপে এফসিসি)।
মিশ্র কথন
বুধবার ১৭ জানুয়ারি নয়া দিগন্তে আমার কলামের শেষ অনুচ্ছেদটি ছিল ফৌজদারহাট নিয়ে। ফৌজদারহাট মানে এফসিসি। আমার লেখা একাদশতম বইয়ের নাম ‘মিশ্র কথন’। সেই বইটি প্রখ্যাত দোকানগুলোতে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অনলাইন বিক্রেতাদের কাছেও এবং ই-বুক হিসেবেও পাওয়া যায়। সেই বইয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের নাম : ‘জীবনের ভিত্তি ক্যাডেট কলেজ অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়’। আমার বইয়ের ৩৭ থেকে ৮২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজ শিক্ষার ওপরই তথা এফসিসির শিক্ষার ওপরে আলোচনা আছে। এর এক জায়গায় ইংল্যান্ডের ইটন নামক স্থানে অবস্থিত পাবলিক স্কুল এবং বাংলাদেশের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অতি সংক্ষিপ্ত পরিপূরক আলোচনা করেছি।
ইটন ও ডিউক অব ওয়েলিংটন
ইটন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ১৮ জুন ১৮১৫ সালে সংঘটিত ওয়াটারলু যুদ্ধে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানের নেতৃত্বাধীন ফরাসি বাহিনীকে পরাস্তকারী, ব্রিটিশ সেনাপতি যার নাম ছিল আর্থার ওয়েলেসলি। যুদ্ধ জয়ের পর, পুরস্কার ও সম্মানের অংশ হিসেবে, ব্রিটিশ রাজকীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে, তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট ওয়েলেসলিকে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’ হিসেবে মনোনীত করেন। বলে রাখা ভালো, ওয়েলিংটন তৎকালীন ইংল্যান্ডেরই একটি জায়গার নাম। আভিজাত্য ও গুরুত্বের ক্রমবিন্যাসে সম্রাটের পরেই হলেন প্রিন্স এবং প্রিন্সের পরে হলেন ডিউকেরা। বর্তমান ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ফিলিপ হলেন ডিউক অব এডিনবরা’। স্কটল্যান্ডের রাজধানী নগরীর নাম এডিনবরা। যুদ্ধজয়ী সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলি হলেন প্রথম ডিউক অব ওয়েলিংটন এবং পরে তিনি হয়েছিলেন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ তথা স্টেটসম্যান। ওয়াটারলুর যুদ্ধজয়ী সেনাপতির মূল নাম সবাই ভুলে গেছে; ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’ নামটি ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত। ওয়াটারলুর যুদ্ধের পরে, সেই ডিউক অব ওয়েলিংটন বলেছিলেন : ‘দি ব্যাটল অব ওয়াটারলু ওয়াজ ওয়ান অন দি প্লেইং ফিল্ডস অব ইটন।’ অর্থাৎ ওয়াটারলুর যুদ্ধ জয় হয়েছিল ইটনের খেলার মাঠেই। বাক্যটিকে প্রতীকী বা রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। ব্যাখ্যাটা এরূপ : ইটনে অবস্থিত স্কুলে লেখাপড়া করার সময় আর্থার ওয়েলেসলি যে গুণাবলি অর্জন করেছিলেন, ইটনের শিক্ষার মাধ্যমে যেসব বৈশিষ্ট্য তার চরিত্রে স্থান পেয়েছিল, সেগুলোর সুবাদেই তিনি প্রখ্যাত সেনাপতি নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছিলেন।
ফৌজদারহাট ও ইবরাহিম
ইটন ও ডিউক অব ওয়েলিংটনের আলোচনার পর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ তথা এফসিসির আলোচনা করব। আমি নিতান্তই একজন নগণ্য ব্যক্তি, সাবেক সৈনিক, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী, একজন সাধারণ সাংসারিক ব্যক্তি। ওয়াটারলুর যুদ্ধের মতো কোনো যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করিনি। কিন্তু জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে যে কয়টি স্থানে জয়ী হতে পেরেছি, এর পেছনে অবদান আছে এফসিসির শিক্ষার; এ ওই আমলের শিক্ষকদের। আমি নবম ব্যাচের ছাত্র। ছাত্রদের মধ্যে যাদের পিতা মাসিক উপার্জনে দরিদ্র ছিলেন, তাদের মধ্যে আমার পিতা অন্যতম। তৎকালীন সরকার প্রত্যেক ক্যাডেটের পেছনে মাথাপিছু ব্যয় করত ৪০০ টাকা মাসিক। তার মধ্যে ক্যাডেটদের কাছ থেকে আদায় করা হত সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। আমার পিতা দিতেন মাত্র ২৫ টাকা, বাকিটা স্কলারশিপ। বহু ছাত্র বা বন্ধুই একদম বিনামূল্যেও পড়েছেন, অর্থাৎ পূর্ণ স্কলারশিপ। ১৯৬২ সালে ঢুকেছিলাম, ১৯৬৮ সালে বের হয়েছি। ওই বছর ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, যদি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র না হতাম অর্থাৎ যদি চট্টগ্রাম বন্দর হাইস্কুলেই থেকে যেতাম, তাহলে প্রথম স্থান অধিকার করতাম না। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুল থেকে ২৪তম ওয়ার কোর্সের সেরা বা প্রথম স্থান অধিকারকারী বা সর্বোত্তম ক্যাডেট হিসেবে কমিশন পেয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে ঐতিহ্যবাহী কমান্ডার ইন চিফস কেইন আমার হাতে তুলে দেয়া হয়। ওই আমলের মিলিটারি একাডেমিতে, দুই বছর মেয়াদি বা লং কোর্সে সর্বোত্তম ক্যাডেটের পুরস্কার হতো সোর্ড অব অনার; ৯ মাসব্যাপী ওয়ার কোর্সে সর্বোত্তম ক্যাডেটের পুরস্কার হচ্ছে কমান্ডার ইন চিফস কেইন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে মাত্র একজন বাঙালি সোর্ড অব অনার পেয়েছিলেন এবং তিন জন বাঙালি কমান্ডার ইন চিফ’স কেইন পেয়েছিলেন; অর্থাৎ মোট চারজন বাঙালি নিজ নিজ আমলে, সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার, ১১৫ পাউন্ড ওজনের শ্যামলা বর্ণের বাঙালি ছেলে ইবরাহিম ওই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল ফৌজদারহাটের শিক্ষার জনই। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধে যতথাসাধ্য সম্ভব ততটুকু অবদান রেখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে ২৭ বছরের চাকরি জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সম্ভব ততটুকু করেছি এবং সাফল্যের সাথেই করেছি। সময়ের আগেই বাধ্যতামূলক অবসর পেয়েছি সত্য, কিন্তু অবসর জীবনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি পূর্ণোদ্যমে। ‘কাজে লাগানো’ বলতে, নিজের জন্য যত না, তার থেকে শতগুণ বেশি দেশের জন্য ও মানুষের জন্য। প্রতিকূল ও বৈরী পরিবেশে টিকে আছি; টেলিভিশনে বক্তব্য রাখি, পত্রিকায় কলাম লিখি, রাজপথে হাঁটি- এ সবকিছুর পেছনেই ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার অবদান আছে। এই কলামের পাঠক আমার শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে কেউ যেন ভুল না বোঝেন; মহান আল্লাহর দয়ায় তথা মহান আল্লাহর রহমতেই সবকিছু হয়েছে এবং হচ্ছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু জাগতিক উসিলা বা জাগতিক কাঠামো বা মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয়। মহান আল্লাহ তায়ালাই এই উসিলা, এই কাঠামো, এই মাধ্যম এবং মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেন।
মিশ্র কথন
বুধবার ১৭ জানুয়ারি নয়া দিগন্তে আমার কলামের শেষ অনুচ্ছেদটি ছিল ফৌজদারহাট নিয়ে। ফৌজদারহাট মানে এফসিসি। আমার লেখা একাদশতম বইয়ের নাম ‘মিশ্র কথন’। সেই বইটি প্রখ্যাত দোকানগুলোতে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অনলাইন বিক্রেতাদের কাছেও এবং ই-বুক হিসেবেও পাওয়া যায়। সেই বইয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের নাম : ‘জীবনের ভিত্তি ক্যাডেট কলেজ অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়’। আমার বইয়ের ৩৭ থেকে ৮২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজ শিক্ষার ওপরই তথা এফসিসির শিক্ষার ওপরে আলোচনা আছে। এর এক জায়গায় ইংল্যান্ডের ইটন নামক স্থানে অবস্থিত পাবলিক স্কুল এবং বাংলাদেশের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অতি সংক্ষিপ্ত পরিপূরক আলোচনা করেছি।
ইটন ও ডিউক অব ওয়েলিংটন
ইটন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ১৮ জুন ১৮১৫ সালে সংঘটিত ওয়াটারলু যুদ্ধে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানের নেতৃত্বাধীন ফরাসি বাহিনীকে পরাস্তকারী, ব্রিটিশ সেনাপতি যার নাম ছিল আর্থার ওয়েলেসলি। যুদ্ধ জয়ের পর, পুরস্কার ও সম্মানের অংশ হিসেবে, ব্রিটিশ রাজকীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে, তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট ওয়েলেসলিকে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’ হিসেবে মনোনীত করেন। বলে রাখা ভালো, ওয়েলিংটন তৎকালীন ইংল্যান্ডেরই একটি জায়গার নাম। আভিজাত্য ও গুরুত্বের ক্রমবিন্যাসে সম্রাটের পরেই হলেন প্রিন্স এবং প্রিন্সের পরে হলেন ডিউকেরা। বর্তমান ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ফিলিপ হলেন ডিউক অব এডিনবরা’। স্কটল্যান্ডের রাজধানী নগরীর নাম এডিনবরা। যুদ্ধজয়ী সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলি হলেন প্রথম ডিউক অব ওয়েলিংটন এবং পরে তিনি হয়েছিলেন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ তথা স্টেটসম্যান। ওয়াটারলুর যুদ্ধজয়ী সেনাপতির মূল নাম সবাই ভুলে গেছে; ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’ নামটি ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত। ওয়াটারলুর যুদ্ধের পরে, সেই ডিউক অব ওয়েলিংটন বলেছিলেন : ‘দি ব্যাটল অব ওয়াটারলু ওয়াজ ওয়ান অন দি প্লেইং ফিল্ডস অব ইটন।’ অর্থাৎ ওয়াটারলুর যুদ্ধ জয় হয়েছিল ইটনের খেলার মাঠেই। বাক্যটিকে প্রতীকী বা রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। ব্যাখ্যাটা এরূপ : ইটনে অবস্থিত স্কুলে লেখাপড়া করার সময় আর্থার ওয়েলেসলি যে গুণাবলি অর্জন করেছিলেন, ইটনের শিক্ষার মাধ্যমে যেসব বৈশিষ্ট্য তার চরিত্রে স্থান পেয়েছিল, সেগুলোর সুবাদেই তিনি প্রখ্যাত সেনাপতি নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছিলেন।
ফৌজদারহাট ও ইবরাহিম
ইটন ও ডিউক অব ওয়েলিংটনের আলোচনার পর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ তথা এফসিসির আলোচনা করব। আমি নিতান্তই একজন নগণ্য ব্যক্তি, সাবেক সৈনিক, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী, একজন সাধারণ সাংসারিক ব্যক্তি। ওয়াটারলুর যুদ্ধের মতো কোনো যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করিনি। কিন্তু জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে যে কয়টি স্থানে জয়ী হতে পেরেছি, এর পেছনে অবদান আছে এফসিসির শিক্ষার; এ ওই আমলের শিক্ষকদের। আমি নবম ব্যাচের ছাত্র। ছাত্রদের মধ্যে যাদের পিতা মাসিক উপার্জনে দরিদ্র ছিলেন, তাদের মধ্যে আমার পিতা অন্যতম। তৎকালীন সরকার প্রত্যেক ক্যাডেটের পেছনে মাথাপিছু ব্যয় করত ৪০০ টাকা মাসিক। তার মধ্যে ক্যাডেটদের কাছ থেকে আদায় করা হত সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। আমার পিতা দিতেন মাত্র ২৫ টাকা, বাকিটা স্কলারশিপ। বহু ছাত্র বা বন্ধুই একদম বিনামূল্যেও পড়েছেন, অর্থাৎ পূর্ণ স্কলারশিপ। ১৯৬২ সালে ঢুকেছিলাম, ১৯৬৮ সালে বের হয়েছি। ওই বছর ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, যদি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র না হতাম অর্থাৎ যদি চট্টগ্রাম বন্দর হাইস্কুলেই থেকে যেতাম, তাহলে প্রথম স্থান অধিকার করতাম না। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুল থেকে ২৪তম ওয়ার কোর্সের সেরা বা প্রথম স্থান অধিকারকারী বা সর্বোত্তম ক্যাডেট হিসেবে কমিশন পেয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে ঐতিহ্যবাহী কমান্ডার ইন চিফস কেইন আমার হাতে তুলে দেয়া হয়। ওই আমলের মিলিটারি একাডেমিতে, দুই বছর মেয়াদি বা লং কোর্সে সর্বোত্তম ক্যাডেটের পুরস্কার হতো সোর্ড অব অনার; ৯ মাসব্যাপী ওয়ার কোর্সে সর্বোত্তম ক্যাডেটের পুরস্কার হচ্ছে কমান্ডার ইন চিফস কেইন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে মাত্র একজন বাঙালি সোর্ড অব অনার পেয়েছিলেন এবং তিন জন বাঙালি কমান্ডার ইন চিফ’স কেইন পেয়েছিলেন; অর্থাৎ মোট চারজন বাঙালি নিজ নিজ আমলে, সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার, ১১৫ পাউন্ড ওজনের শ্যামলা বর্ণের বাঙালি ছেলে ইবরাহিম ওই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল ফৌজদারহাটের শিক্ষার জনই। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধে যতথাসাধ্য সম্ভব ততটুকু অবদান রেখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে ২৭ বছরের চাকরি জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সম্ভব ততটুকু করেছি এবং সাফল্যের সাথেই করেছি। সময়ের আগেই বাধ্যতামূলক অবসর পেয়েছি সত্য, কিন্তু অবসর জীবনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি পূর্ণোদ্যমে। ‘কাজে লাগানো’ বলতে, নিজের জন্য যত না, তার থেকে শতগুণ বেশি দেশের জন্য ও মানুষের জন্য। প্রতিকূল ও বৈরী পরিবেশে টিকে আছি; টেলিভিশনে বক্তব্য রাখি, পত্রিকায় কলাম লিখি, রাজপথে হাঁটি- এ সবকিছুর পেছনেই ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার অবদান আছে। এই কলামের পাঠক আমার শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে কেউ যেন ভুল না বোঝেন; মহান আল্লাহর দয়ায় তথা মহান আল্লাহর রহমতেই সবকিছু হয়েছে এবং হচ্ছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু জাগতিক উসিলা বা জাগতিক কাঠামো বা মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয়। মহান আল্লাহ তায়ালাই এই উসিলা, এই কাঠামো, এই মাধ্যম এবং মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেন।
এই প্রেক্ষাপটেই আমার বক্তব্য : ডিউক অব ওয়েলিংটনের জন্য ইটন যেমন, ইবরাহিমের জন্য ফৌজদারহাট তেমন।
ক্যাডেট কলেজ সমাচার
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের হাসান আবদাল নামক শহরে প্রথম ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ, জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আগ্রহে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও একটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২৮ এপ্রিল ১৯৫৮ সালে সে সময়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ মাইল উত্তরে, ফৌজদারহাট নামক স্থানে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ট্রাংক রোডের পূর্ব পাশে, অনুচ্চ পাহাড় সারির পাদদেশে এই কলেজ চালু হয়; নাম ছিল দি ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ। আইয়ুব খানের উদ্যোগেই প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ফেলো অব দি রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম মরিস ব্রাউন, জন্মসূত্রে নিউজিল্যান্ডবাসী এবং চাকরিসূত্রে বিলাতি। কর্নেল ব্রাউনের অবদান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ এবং তার আমলের সব ছাত্রের ইতিহাসে ও মানসপটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ছয় বছর পর ১৯৬৪ সালে, রাজশাহীর সারদাতে, বর্তমান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এবং তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহে আরো তিনটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়। ফলে প্রথমটির নাম বদলিয়ে রাখতে হয় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা চালুর পেছনে যে ধারণাটি কাজ করেছিল, সেটি ছিল : দেশের ও জাতীয় জীবনের সর্ব আঙ্গিকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি সৃষ্টি করা। এই কলামে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, দেশে এবং বিদেশে বহু পেশায় ও কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা তথা ক্যাডেট কলেজগুলোর ছাত্ররা। আমার পরিবারে, আমার থেকে বারো বছর ছোট ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ মইনুদ্দিন, এফসিসির ২১তম ব্যাচের ক্যাডেট। মইনুদ্দিন জাপান থেকে পিএইচডি করেছেন নিউরো সার্জারিতে, আমেরিকার আরকানসাস থেকে তিন বছর অ্যাডভান্সড প্রশিক্ষণ নিয়েছেন; এখন নিউরো সার্জারির প্রফেসর। আমার ছেলে সৈয়দ ফজলুল করিম মুজাহিদ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ১২তম ব্যাচের ছাত্র। আমার তৃতীয় ছোটভাই প্রথিতযশা শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী সৈয়দ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ছেলে রায়াত বিন নাসির, বর্তমানে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। পুরনো অনেক সাবেক ক্যাডেটের ছেলেও ‘সাবেক ক্যাডেট’ হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এমনকি, অনেক সাবেক ক্যাডেটের নাতিরাও ক্যাডেট কলেজগুলোতে পড়ছে। তবে অবশ্যই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে রাখি যে, বাংলাদেশী সমাজের যেকোনো স্তরের যে কোনো ইনকাম গ্রুপের, যেকোনো স্বচ্ছ পেশার, যেকোনো ধর্মের ও ভাষার যেকোনো পরিবারের সন্তানদের জন্য ক্যাডেট কলেজে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত। ঢোকার পরীক্ষা বা পরীক্ষার ধাপগুলো অতি কঠিন, অতি স্বচ্ছ এবং পাস করার জন্য প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
ক্যাডেট কলেজের মৃত্যুদণ্ড ও রক্ষা
১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তির আগ্রহে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সব ক্যাডেট কলেজে ওই পদ্ধতির শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হবে এবং ওই কলেজগুলোর ক্যাম্পাসকে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করা হবে। তখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কিছু সাবেক ক্যাডেট (যাদের ‘ওল্ড ফৌজিয়ান’ বলা হয়) সংগঠিত হয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন ক্যাডেট কলেজ রক্ষার জন্য (‘সেইভ ক্যাডেট কলেজ’ মুভমেন্ট)। আমার লেখা বই মিশ্রকথনের যথাস্থানে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। ওই আন্দোলনকারী ওল্ড ফৌজিয়ানরা, তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাহায্য কামনা করেন এবং সেই সাহায্য পেয়েছেন। জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে, তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি ও পরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর সাহায্য কামনা করেন এবং সাহায্য পান। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল ওসমানী ছাত্রদের ধৈর্যসহকারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। মূলত জেনারেল ওসমানীর কারণেই বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দেন যে, ক্যাডেট কলেজগুলো বহাল থাকবে।
রি-ইউনিয়ন বা পুনর্মিলনী
বলছিলাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের। ২৮ এপ্রিল ১৯৫৮ থেকে ২৮ এপ্রিল ২০১৮ সময়কাল হচ্ছে ৬০ বছর। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবস্থার কারণে ক্যাডেট কলেজগুলোতে পুনর্মিলনী বা রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছর অন্তর। ঘটনাক্রমে ২০১৮তে কলেজের হীরকজয়ন্তীর (ডায়মন্ড জুবলি) সঙ্গে রি-ইউনিয়নের বছর মিলে যায়। ফলে ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০১৮ তিন দিনব্যাপী রি-ইউনিয়ন হলো। প্রায় দুই হাজার সাবেক ছাত্র ও তাদের স্ত্রী পরিবার অংশ নেয়। অতীতের মতো এবারো রি-ইউনিয়ন খরচের ৯০ ভাগই বহন করেছে সাবেক ক্যাডেটরা তথা ওল্ড ফৌজিয়ানরা এবং তারা এটা সংগ্রহ করেন বিভিন্ন দানশীল বা শিক্ষা-অনুরাগী বা ক্যাডেটকলেজ-বান্ধব ব্যক্তি এবং করপোরেট সংগঠনগুলো থেকে। উদাহরণস্বরূপ শুধুমাত্র বলছি, মোট ছয়টি ব্রেকফার্স্ট, লাঞ্চ ও ডিনার এর প্রত্যেকটি স্পন্সর করা হয়েছে। সোলস এবং এলআরবি গিয়েছিল, সেটাও স্পন্সর করা হয়েছে এবং স্পন্সরদের সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওল্ড ফৌজিয়ানরা জড়িত; অথবা ধনী ও উদার ওল্ড ফৌজিয়ানরা নিজেরাই স্পন্সর করেছেন। প্রত্যেকবার রি-ইউনিয়নের সময় যে ফান্ড সংগ্রহ করা হয়, সেখান থেকে একটি বড় অংশ কলেজকে অনুদান হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়। তিন-চার বছর আগে এরূপ অনুদান দিয়ে, সব ক্যাডেটের শোয়ার খাট বদলানো হয়েছিল। আরো কিছু টাকা তহবিলে জমা রাখা হয়েছিল। সরকার অনুমতি দিয়েছে, সাবেক ক্যাডেটরা ইচ্ছা করলে, ক্যাডেট কলেজের ভৌতকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে বা সুযোগ-সুবিধার উন্নয়নে অনুদান দিতে পারেন। কিন্তু এটা কারো ব্যক্তিগত নামে হবে না, এটা ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নামে হবে বা কোনো ফাউন্ডেশনের অথবা কোনো ফান্ডের নামে হবে। এটা সব ক্যাডেট কলেজের জন্য প্রযোজ্য। অতীতের বছরগুলোতে কলেজের নতুন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সেন্টার নবায়ন করা, লাইব্রেরি নবায়ন করা, কম্পিউটার সেন্টার সমৃদ্ধ করা এবং এবারে জিমনেসিয়াম নবায়ন করা হয়েছে। ওল্ড ফৌজিয়ান আর্কিটেক্ট কর্তৃক শুভেচ্ছার বিনিময়ে নকশা বানানো হয়েছে এবং নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক স্তম্ভ এবং কলেজের প্রবেশমুখে হীরকজয়ন্তী গেট; এগুলোর সম্পূর্ণ খরচ ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বহন করেছে। বৃহদাকারের একটি রেস্ট হাউজ তথা গেস্ট হাউজ নির্মিত হবে; সেখানেও অর্ধেক খরচ অনুদান হিসেবে দেবে ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। ক্যাডেট কলেজের অতীত ও বর্তমান শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ওয়েলফেয়ার ফান্ড সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আরো করা হবে। কলেজের বাইরে, শীতকালে বা বর্ষাকালে এবং সাইক্লোনের সময় দুস্থদের পাশে সবসময়ই সব ক্যাডেট কলেজের ওল্ড ক্যাডেটরা দাঁড়ান। রোহিঙ্গাদের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে; সরকারি মাধ্যমে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ন্যাশনাল সলিডারিটি ফর দি রোহিঙ্গা নামে আহ্বান জানিয়েছি এবং এখনো আহবান করে যাচ্ছি। এবারের রি-ইউনিয়নটি ছিল আনন্দদায়ক এবং সাফল্যমণ্ডিত। ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয়, ঢাকা চ্যাপ্টার, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার নেতাদেরকে, বিশেষ আহ্বায়ক কমিটিকে এবং স্পন্সরদেরকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যান্য প্রথিতযশা স্কুল ও কলেজের সাবেক ছাত্ররাও এভাবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অবদানের বৃত্ত গড়ে তুলেছেন অথবা ভবিষ্যতে গড়ে তুলবেন।
সাবেকদের পদচারণা
দেশের সব ছাত্র ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ পাবে না; এটাই বাস্তবতা। ক্যাডেট কলেজে পড়লেই মাত্র দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর এসএসসি বা এইচএসসির মেধা তালিকায় স্থান পাবে- এমনও কোনোমতেই নয়। শুধু ক্যাডেট কলেজে পড়লেই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন পাওয়ার সময় মেধা তালিকায় উপরের দিকে থাকবে, এমনও নয়। ক্যাডেট কলেজে পড়েননি এমন ছাত্র বা ব্যক্তিদের সংখ্যা, কলেজে পড়ুয়াদের তুলনায় হাজার গুণ বেশি। সামরিক বাহিনীতে জেনারেল বা অ্যাডমিরাল বা এয়ার মার্শাল, সরকারে সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর, ব্যাংকগুলোতে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, পুলিশে এসপি, বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন বা ইঞ্জিনিয়ার, তাবলিগ জামাতে মুরুব্বি, বড় বড় হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার, শিল্প উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশে পার্লামেন্ট সদস্য যতজন হবেন বা হচ্ছেন, তার মধ্যে ক্ষুদ্র অংশ মাত্র সাবেক ক্যাডেটরা; সব ক্যাডেট কলেজের। কিন্তু আচরণে, দক্ষতায়, বৈশিষ্ট্যে এই ক্ষুদ্র অংশ তথা মাইনরিটি, উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয়। একটি কথা না বললেই নয়; নভোমণ্ডলে তারকা বা গ্রহ যেমন কক্ষচ্যুত হয়, ট্রেন লাইনের ট্রেন যেমন লাইনচ্যুত হয়, তেমনি শুধু ফৌজদারহাট বলে নয়, সব ক্যাডেট কলেজেরই সাবেকদের মধ্যে কোনো না কোনো সাবেক ক্যাডেট কক্ষচ্যুত, পথচ্যুত, লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারেন; সামাজিক প্রক্রিয়ায় এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিতে হবে। তাই আমরা সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাকে আলোচনা আর না। আমরা আলোচনার বিষয় করাচি তাদেরকেই, যারা ইতিবাচক অবদান রেখেছেন বা রেখেই যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও ফৌজিয়ানরা
এফসিসির সাবেক ছাত্রদের (১৯৫৮-১৯৭১) মধ্যে ৪৭ জন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন; তাদের মধ্যে আটজন শহীদ। এই ৪৭ জনের মধ্যে একজন বীর উত্তম (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের) লেফটেন্যান্ট আনোয়ার যাঁর নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্কুল আছে, একজন বীর বিক্রম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র এবং সুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ সদস্য) বদিউল আলম। ওই ৪৭ জনের মধ্যে জীবিত খেতাবপ্রাপ্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলেন- সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান (অব:) এ এস এম লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম, সাবেক রাষ্ট্রদূত (অব:) মেজর জেনারেল সাইদ আহমেদ বীর প্রতীক, বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীর বিক্রম এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও টিভি ব্যক্তিত্ব অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক।
একটি বক্তৃতা
এফসিসির সদ্য সমাপ্ত রি-ইউনিয়নে উদ্বোধনী সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এবং সকালের উদ্বোধনী প্যারেডে সালাম গ্রহণের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান। উভয়েই উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। প্রধান দিবসে সন্ধ্যাবেলা রি-ইউনিয়ন স্পিকার ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী (বাংলাদেশে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করেন) প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী-গবেষক প্রফেসর মুহাম্মদ আতাউল করিম। বৃহত্তর সিলেটের বড়লেখার সন্তান আতাউল করিম ফৌজদারহাটের ১২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি এসএসসির পর কলেজ থেকে চলে গিয়েছিলেন। ৩৫ মিনিট দীর্ঘ বক্তব্যে, তিনি তরুণদের জন্য অত্যন্ত বাস্তবসম্মত উদাহরণ উপস্থাপনা এবং প্রণোদনা প্রদান করেন। তার দীর্ঘ বক্তব্য থেকে যদি আমাকে কিছু কথা বেছে নিতে হয়, তাহলে আমি বলবো, এক. জীবনে লক্ষ্য স্থির করতে হয়, কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। দুই. ধীরেসুস্থে বিবেচনার পর লক্ষ্য স্থির হয়ে গেলে সেটা অর্জনের জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হতে হয়।
ক্যাডেট কলেজ সমাচার
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের হাসান আবদাল নামক শহরে প্রথম ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ, জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আগ্রহে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও একটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২৮ এপ্রিল ১৯৫৮ সালে সে সময়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ মাইল উত্তরে, ফৌজদারহাট নামক স্থানে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ট্রাংক রোডের পূর্ব পাশে, অনুচ্চ পাহাড় সারির পাদদেশে এই কলেজ চালু হয়; নাম ছিল দি ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ। আইয়ুব খানের উদ্যোগেই প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ফেলো অব দি রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম মরিস ব্রাউন, জন্মসূত্রে নিউজিল্যান্ডবাসী এবং চাকরিসূত্রে বিলাতি। কর্নেল ব্রাউনের অবদান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ এবং তার আমলের সব ছাত্রের ইতিহাসে ও মানসপটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ছয় বছর পর ১৯৬৪ সালে, রাজশাহীর সারদাতে, বর্তমান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এবং তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহে আরো তিনটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়। ফলে প্রথমটির নাম বদলিয়ে রাখতে হয় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা চালুর পেছনে যে ধারণাটি কাজ করেছিল, সেটি ছিল : দেশের ও জাতীয় জীবনের সর্ব আঙ্গিকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি সৃষ্টি করা। এই কলামে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, দেশে এবং বিদেশে বহু পেশায় ও কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা তথা ক্যাডেট কলেজগুলোর ছাত্ররা। আমার পরিবারে, আমার থেকে বারো বছর ছোট ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ মইনুদ্দিন, এফসিসির ২১তম ব্যাচের ক্যাডেট। মইনুদ্দিন জাপান থেকে পিএইচডি করেছেন নিউরো সার্জারিতে, আমেরিকার আরকানসাস থেকে তিন বছর অ্যাডভান্সড প্রশিক্ষণ নিয়েছেন; এখন নিউরো সার্জারির প্রফেসর। আমার ছেলে সৈয়দ ফজলুল করিম মুজাহিদ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ১২তম ব্যাচের ছাত্র। আমার তৃতীয় ছোটভাই প্রথিতযশা শিল্প উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী সৈয়দ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ছেলে রায়াত বিন নাসির, বর্তমানে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। পুরনো অনেক সাবেক ক্যাডেটের ছেলেও ‘সাবেক ক্যাডেট’ হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এমনকি, অনেক সাবেক ক্যাডেটের নাতিরাও ক্যাডেট কলেজগুলোতে পড়ছে। তবে অবশ্যই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে রাখি যে, বাংলাদেশী সমাজের যেকোনো স্তরের যে কোনো ইনকাম গ্রুপের, যেকোনো স্বচ্ছ পেশার, যেকোনো ধর্মের ও ভাষার যেকোনো পরিবারের সন্তানদের জন্য ক্যাডেট কলেজে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত। ঢোকার পরীক্ষা বা পরীক্ষার ধাপগুলো অতি কঠিন, অতি স্বচ্ছ এবং পাস করার জন্য প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
ক্যাডেট কলেজের মৃত্যুদণ্ড ও রক্ষা
১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তির আগ্রহে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সব ক্যাডেট কলেজে ওই পদ্ধতির শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হবে এবং ওই কলেজগুলোর ক্যাম্পাসকে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করা হবে। তখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কিছু সাবেক ক্যাডেট (যাদের ‘ওল্ড ফৌজিয়ান’ বলা হয়) সংগঠিত হয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন ক্যাডেট কলেজ রক্ষার জন্য (‘সেইভ ক্যাডেট কলেজ’ মুভমেন্ট)। আমার লেখা বই মিশ্রকথনের যথাস্থানে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। ওই আন্দোলনকারী ওল্ড ফৌজিয়ানরা, তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাহায্য কামনা করেন এবং সেই সাহায্য পেয়েছেন। জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে, তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি ও পরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর সাহায্য কামনা করেন এবং সাহায্য পান। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল ওসমানী ছাত্রদের ধৈর্যসহকারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। মূলত জেনারেল ওসমানীর কারণেই বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দেন যে, ক্যাডেট কলেজগুলো বহাল থাকবে।
রি-ইউনিয়ন বা পুনর্মিলনী
বলছিলাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের। ২৮ এপ্রিল ১৯৫৮ থেকে ২৮ এপ্রিল ২০১৮ সময়কাল হচ্ছে ৬০ বছর। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবস্থার কারণে ক্যাডেট কলেজগুলোতে পুনর্মিলনী বা রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছর অন্তর। ঘটনাক্রমে ২০১৮তে কলেজের হীরকজয়ন্তীর (ডায়মন্ড জুবলি) সঙ্গে রি-ইউনিয়নের বছর মিলে যায়। ফলে ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০১৮ তিন দিনব্যাপী রি-ইউনিয়ন হলো। প্রায় দুই হাজার সাবেক ছাত্র ও তাদের স্ত্রী পরিবার অংশ নেয়। অতীতের মতো এবারো রি-ইউনিয়ন খরচের ৯০ ভাগই বহন করেছে সাবেক ক্যাডেটরা তথা ওল্ড ফৌজিয়ানরা এবং তারা এটা সংগ্রহ করেন বিভিন্ন দানশীল বা শিক্ষা-অনুরাগী বা ক্যাডেটকলেজ-বান্ধব ব্যক্তি এবং করপোরেট সংগঠনগুলো থেকে। উদাহরণস্বরূপ শুধুমাত্র বলছি, মোট ছয়টি ব্রেকফার্স্ট, লাঞ্চ ও ডিনার এর প্রত্যেকটি স্পন্সর করা হয়েছে। সোলস এবং এলআরবি গিয়েছিল, সেটাও স্পন্সর করা হয়েছে এবং স্পন্সরদের সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওল্ড ফৌজিয়ানরা জড়িত; অথবা ধনী ও উদার ওল্ড ফৌজিয়ানরা নিজেরাই স্পন্সর করেছেন। প্রত্যেকবার রি-ইউনিয়নের সময় যে ফান্ড সংগ্রহ করা হয়, সেখান থেকে একটি বড় অংশ কলেজকে অনুদান হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়। তিন-চার বছর আগে এরূপ অনুদান দিয়ে, সব ক্যাডেটের শোয়ার খাট বদলানো হয়েছিল। আরো কিছু টাকা তহবিলে জমা রাখা হয়েছিল। সরকার অনুমতি দিয়েছে, সাবেক ক্যাডেটরা ইচ্ছা করলে, ক্যাডেট কলেজের ভৌতকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে বা সুযোগ-সুবিধার উন্নয়নে অনুদান দিতে পারেন। কিন্তু এটা কারো ব্যক্তিগত নামে হবে না, এটা ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নামে হবে বা কোনো ফাউন্ডেশনের অথবা কোনো ফান্ডের নামে হবে। এটা সব ক্যাডেট কলেজের জন্য প্রযোজ্য। অতীতের বছরগুলোতে কলেজের নতুন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সেন্টার নবায়ন করা, লাইব্রেরি নবায়ন করা, কম্পিউটার সেন্টার সমৃদ্ধ করা এবং এবারে জিমনেসিয়াম নবায়ন করা হয়েছে। ওল্ড ফৌজিয়ান আর্কিটেক্ট কর্তৃক শুভেচ্ছার বিনিময়ে নকশা বানানো হয়েছে এবং নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক স্তম্ভ এবং কলেজের প্রবেশমুখে হীরকজয়ন্তী গেট; এগুলোর সম্পূর্ণ খরচ ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বহন করেছে। বৃহদাকারের একটি রেস্ট হাউজ তথা গেস্ট হাউজ নির্মিত হবে; সেখানেও অর্ধেক খরচ অনুদান হিসেবে দেবে ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। ক্যাডেট কলেজের অতীত ও বর্তমান শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ওয়েলফেয়ার ফান্ড সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আরো করা হবে। কলেজের বাইরে, শীতকালে বা বর্ষাকালে এবং সাইক্লোনের সময় দুস্থদের পাশে সবসময়ই সব ক্যাডেট কলেজের ওল্ড ক্যাডেটরা দাঁড়ান। রোহিঙ্গাদের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে; সরকারি মাধ্যমে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ন্যাশনাল সলিডারিটি ফর দি রোহিঙ্গা নামে আহ্বান জানিয়েছি এবং এখনো আহবান করে যাচ্ছি। এবারের রি-ইউনিয়নটি ছিল আনন্দদায়ক এবং সাফল্যমণ্ডিত। ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয়, ঢাকা চ্যাপ্টার, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার নেতাদেরকে, বিশেষ আহ্বায়ক কমিটিকে এবং স্পন্সরদেরকে এ জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যান্য প্রথিতযশা স্কুল ও কলেজের সাবেক ছাত্ররাও এভাবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অবদানের বৃত্ত গড়ে তুলেছেন অথবা ভবিষ্যতে গড়ে তুলবেন।
সাবেকদের পদচারণা
দেশের সব ছাত্র ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ পাবে না; এটাই বাস্তবতা। ক্যাডেট কলেজে পড়লেই মাত্র দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর এসএসসি বা এইচএসসির মেধা তালিকায় স্থান পাবে- এমনও কোনোমতেই নয়। শুধু ক্যাডেট কলেজে পড়লেই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন পাওয়ার সময় মেধা তালিকায় উপরের দিকে থাকবে, এমনও নয়। ক্যাডেট কলেজে পড়েননি এমন ছাত্র বা ব্যক্তিদের সংখ্যা, কলেজে পড়ুয়াদের তুলনায় হাজার গুণ বেশি। সামরিক বাহিনীতে জেনারেল বা অ্যাডমিরাল বা এয়ার মার্শাল, সরকারে সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর, ব্যাংকগুলোতে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, পুলিশে এসপি, বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন বা ইঞ্জিনিয়ার, তাবলিগ জামাতে মুরুব্বি, বড় বড় হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার, শিল্প উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশে পার্লামেন্ট সদস্য যতজন হবেন বা হচ্ছেন, তার মধ্যে ক্ষুদ্র অংশ মাত্র সাবেক ক্যাডেটরা; সব ক্যাডেট কলেজের। কিন্তু আচরণে, দক্ষতায়, বৈশিষ্ট্যে এই ক্ষুদ্র অংশ তথা মাইনরিটি, উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয়। একটি কথা না বললেই নয়; নভোমণ্ডলে তারকা বা গ্রহ যেমন কক্ষচ্যুত হয়, ট্রেন লাইনের ট্রেন যেমন লাইনচ্যুত হয়, তেমনি শুধু ফৌজদারহাট বলে নয়, সব ক্যাডেট কলেজেরই সাবেকদের মধ্যে কোনো না কোনো সাবেক ক্যাডেট কক্ষচ্যুত, পথচ্যুত, লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারেন; সামাজিক প্রক্রিয়ায় এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিতে হবে। তাই আমরা সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাকে আলোচনা আর না। আমরা আলোচনার বিষয় করাচি তাদেরকেই, যারা ইতিবাচক অবদান রেখেছেন বা রেখেই যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও ফৌজিয়ানরা
এফসিসির সাবেক ছাত্রদের (১৯৫৮-১৯৭১) মধ্যে ৪৭ জন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন; তাদের মধ্যে আটজন শহীদ। এই ৪৭ জনের মধ্যে একজন বীর উত্তম (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের) লেফটেন্যান্ট আনোয়ার যাঁর নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্কুল আছে, একজন বীর বিক্রম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র এবং সুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ সদস্য) বদিউল আলম। ওই ৪৭ জনের মধ্যে জীবিত খেতাবপ্রাপ্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলেন- সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান (অব:) এ এস এম লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম, সাবেক রাষ্ট্রদূত (অব:) মেজর জেনারেল সাইদ আহমেদ বীর প্রতীক, বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীর বিক্রম এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও টিভি ব্যক্তিত্ব অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক।
একটি বক্তৃতা
এফসিসির সদ্য সমাপ্ত রি-ইউনিয়নে উদ্বোধনী সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এবং সকালের উদ্বোধনী প্যারেডে সালাম গ্রহণের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান। উভয়েই উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। প্রধান দিবসে সন্ধ্যাবেলা রি-ইউনিয়ন স্পিকার ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী (বাংলাদেশে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করেন) প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী-গবেষক প্রফেসর মুহাম্মদ আতাউল করিম। বৃহত্তর সিলেটের বড়লেখার সন্তান আতাউল করিম ফৌজদারহাটের ১২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি এসএসসির পর কলেজ থেকে চলে গিয়েছিলেন। ৩৫ মিনিট দীর্ঘ বক্তব্যে, তিনি তরুণদের জন্য অত্যন্ত বাস্তবসম্মত উদাহরণ উপস্থাপনা এবং প্রণোদনা প্রদান করেন। তার দীর্ঘ বক্তব্য থেকে যদি আমাকে কিছু কথা বেছে নিতে হয়, তাহলে আমি বলবো, এক. জীবনে লক্ষ্য স্থির করতে হয়, কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। দুই. ধীরেসুস্থে বিবেচনার পর লক্ষ্য স্থির হয়ে গেলে সেটা অর্জনের জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হতে হয়।
তিন.
লক্ষ্য অর্জন এক-দুই বছরের ব্যাপার নয়, দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাপার। যদি বলা হয়
যে, কোনো একজনের জীবনের লক্ষ্য ডাক্তার হওয়া, সেটা হবে আংশিক বক্তব্য।
বর্ধিত বক্তব্য হবে একজন ভালো ডাক্তার হওয়া। আরো বর্ধিত বক্তব্য হবে
(অর্থাৎ উপার্জনের বাইরে), ডাক্তার হিসেবে সমাজে অবদান রাখা। তাই প্রত্যেক
লক্ষ্য অর্জনের পথে ধাপে ধাপে নিজের কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন ও পুনর্মূলায়ন
করতে হবে। চার. লক্ষ্য অর্জনের পথে বিভিন্ন সুযোগ আসে। চলার পথে যদি
উন্নতির বা উন্নয়নের জন্য বা উপকারের জন্য কোনো সুযোগ আসে তাহলে সেই সুযোগ
গ্রহণ করতে হবে। পাঁচ. সুযোগ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি দরকার। প্রস্তুতির
গ্রহণ করার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদের এবং সার্বক্ষণিক। প্রত্যেকেই তার
জীবনে সুযোগ গ্রহণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। সাত. হঠাৎ হঠাৎ
মানুষের জীবনে সৌভাগ্যের দরজা খুলে যায়। সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময়
কোনো সময় প্রতিযোগিতা থাকে, কোনো সময় প্রতিযোগিতা থাকে না। যাই হোক,
প্রবেশের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে। সে যোগ্যতা হঠাৎ করে অর্জন করা যায়
না। এ জন্য সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments