এ দৃশ্য শুধু অবাঞ্ছিত নয়, মর্মান্তিকও by মিনা ফারাহ

অস্কার তালিকায় সেলমা
আমাদের সমস্যা হলো, এমনকি মার্কিন সিভিল ওয়ার সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও কথিত বুদ্ধিজীবীরা বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস কখনোই আলোচনা করেন না। হয় ফ্যাসিবাদ উন্মোচন করতে এটা তাদের মোনাফেকি কিংবা বুদ্ধিজীবী হওয়ার উপযুক্তই নন তারা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলান্ধ শিক্ষকেরা, যারা নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনীতির কাছে অধিকাংশই বিক্রি হয়ে গেছেন। মধ্যরাতের টকশোতে অনেকেই সব কিছু বলেন, একমাত্র অবৈধ নির্বাচন ও ভোটাধিকার বাদে। কালোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য শ্বেতাঙ্গদের বিচার হয়নি। গোয়েবলস ও মিলোশভিচদের বিচার হয়েছে। বাংলাদেশেও নির্মূল কার্যক্রমে একই অপরাধ করা হচ্ছে। একটার পর একটা ফাঁকা মাঠে গোল দিচ্ছে সরকার কিন্তু পশ্চিমারা কোনো অর্থবহ পদপেই নিচ্ছে না। ক্যান্সারের চিকিৎসা মলম? এ দিকে খালেদাকে রাজনীতি থেকে উৎখাতে সব আয়োজন সম্পন্ন প্রায়। যেকোনো মুহূর্তে বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ সম্পাদক।
বলছি ভোটাধিকারের কথা। ড. কিংয়ের নেতৃত্বে ভোটাধিকার দাবির আন্দোলন যে কত তীব্র হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হলিউডের ছবি ‘সেলমা’ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সাংবিধানিক অধিকার সত্ত্বেও কালোদের ভোট দিতে দিতেন না আলাবামার প্রচণ্ড বর্ণবাদী গভর্নর জজ ওয়ালেস। পরে ড. কিংকে সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জনসনের একক সিদ্ধান্তে কালোদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হলো। আর আততায়ীর গুলিতে বাকি জীবন হুইলচেয়ারে কাটাতে হলো গভর্নরকে।
বাংলাদেশের মানুষেরও ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে ৫ জানুয়ারি নামক কালো দিবসে। বর্ণবিদ্বেষী গভর্নরের পেটোয়াবাহিনীর চেয়ে ভয়ঙ্কর এ দেশের পেটোয়াবাহিনী। অন্তত ড. কিংকে ভয় পেতেন প্রেসিডেন্ট জনসন। এমনকি হোয়াইট হাউজে বসে তার সাথে সিভিল রাইটস বিলটি নিয়ে আলোচনাও করতেন। কিন্তু সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখানো কেউ কেউ নিজেকে প্রমাণ করেছেন, গভর্নর ওয়ালেসের চেয়ে অধিক নির্যাতক তারা। বাংলাদেশের পেটোয়াবাহিনীর দৃশ্য, ১৮০০ শতাব্দীর মার্কিন বর্ণবাদী দণি অঞ্চলের রাজ্যগুলোর মতোই। এ দেশের বিভিন্ন বাহিনীর মতোই বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গরা খুন করত কিন্তু লাশ দাফনের সুযোগ পর্যন্ত দিতো না। কোনো আন্তর্জাতিক আইন মানছে না পেটোয়াবাহিনী। গভর্নর ওয়ালেসের মতো এত পুলিশ কার বিরুদ্ধে? আন্তর্জাতিক আইনে পেপার ¯েপ্র নিষিদ্ধ সত্ত্বেও খালেদার অফিসে অনক্যামেরা ¯েপ্র মারার পরেও নীরব জাতিসঙ্ঘ? তখন থেকে তিনি অসুস্থ, এরপর কোকোর মৃত্যু সব দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। পুরুষ নির্যাতকের কথা সবাই জানে, কিন্তু খালেদাকে নির্যাতনের মাধ্যমে প্রমাণ হলো অন্য ধরনের নির্যাতনও  এ দেশে রয়েছে। শতাব্দীর সর্বাধিক নির্যাতিত নারী খালেদা। শুধু নারী নয়, ভয়ে পুরুষশূন্য গ্রামের পর গ্রাম। ‘এমডিজি’র নামে ‘নারী নির্যাতন’ ও ‘নারীর উন্নয়নকে’ গুলিয়ে ফেলেছেন বান কি মুন।
সংলাপ? মূর্খরাই বাজে কথা বেশি বলে। যারা বোঝে, জানে সংলাপের যোগ্যতা হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কবে, প্রশ্ন সেটাই! প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের প্রশ্ন, খালেদা কেন জ্বালাওপোড়াও করে মানুষ হত্যা করছেন। জানতে চায়, কী চান খালেদা জিয়া? সত্যিই কি জানে না বলে জিজ্ঞেস করে? আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী নেতারা জানেন, ৫ জানুয়ারিতে অন্যায়ভাবে গদি দখল না করলে একটি মৃত্যুও হতো না। কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। একই অপকর্মের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে জেলে ভরেছিল ভারতের আদালত।
বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মহাসঙ্কট, দেশ বিভাগের আগে থেকেই ভুলের পর ভুল। আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী তারাও। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেসের কাছে মাথা বন্ধক রেখে জিন্নার লেজে আগুন দিলে লাভ কী? তখন যদি স্বাধীন বাংলার দাবিতে অনড় থাকতেন সোহরাওয়ার্দি, বারবার দাঙ্গা আর যুদ্ধ দেখতে হতো না। হিন্দু-মুসলমান বাস্তবতায় কোনো সুস্থ লোক বাংলাকে দুই ভাগ করার কথা চিন্তাও করবে না। এখন যারা মাসতুতভাই হতে উদগ্রীব, আমার প্রশ্ন, তখন তারা ছিলেন কোথায়? বলছি, ৬৭ বছরে একবারও কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না বুদ্ধিজীবীরা।
প্রধান বিচারপতি এবং আমার পিতার নাম এক হওয়ায় আমি যারপর নাই আনন্দিত। কন্যার দাবি নিয়ে কিছু আইনের ব্যত্যয় বিচারপতির কাছে জানতে চাই। সুশাসন ছাড়া কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না, ৩৫ বছর আমেরিকায় থেকে এটাই প্রধান শিা। কিন্তু হচ্ছেটা কী? সিমলা চুক্তির মাধ্যমে সব অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া হলো, এরপর সহযোগীদের বিচার এবং নিষিদ্ধ করা নিয়ে কেন পেরেশানি? ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি ওআইসি সম্মেলনে গণহত্যার হুকুমদাতা ভুট্টোর সাথে কোলাকুলি এবং টিক্কা খানের সাথে হ্যান্ডশেক থেকে আমরা কি বুঝব? ওআইসি সম্মেলনের ঘটনা সত্য হলে, ট্রাইবুন্যাল-৭৩ কে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ নিধনে সিভিল ওয়ারের অবস্থা কেন হলো, ভায়োলেন্স নয়, আমরা আইনের শাসন চাই।
বাংলার ঘরে ঘরে আজ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুলেট, স্বৈরতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য। কম গণতন্ত্র আর বেশি উন্নতির জন্য পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে অবশ্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের নতুন কলম্বাস প্রধানমন্ত্রী। বাঙালির ইতিহাস খুব খারাপ এবং স্মৃতিশক্তিও দুর্বল। কত দ্রুত ভুলে গেছি, ভাসানীর সপ্তাহিক ‘হক কথার’ করুণ পরিণতি! এবার মিডিয়ার কণ্ঠযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের মাত্রা বহুগুণ বেশি। বাকি রইল, চায়ের কাপে ঝড় তোলা মানুষগুলোর কণ্ঠযন্ত্র ফেলে দেয়া। ক্রীতদাস প্রথা থেকে গার্মেন্ট যাঁতাকল, কোটি কোটি নির্যাতিত গরিবের রক্তচোষারা গণতন্ত্রকে কত বেশি হেয় করে, প্রমাণ ৫ জানুয়ারি। মীরজাফরের অনুসারী না পেলে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ২০০ বছর কেন, ছয় মাসের বেশি টিকত না। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো জ্ঞানপাপীদের শিক হোক।
তোমারে বধিবে যে
হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী কংসবধ। অত্যাচারী রাজা কংস স্বপ্নে দেখলেন, তাকে বধ করার জন্য বোনের পেটে সন্তান এসেছে। বোনের স্থান হলো দ্বারকার কারাগারে, ঘিরে রাখা হলো হাজারো সৈন্য দিয়ে। পিতা বাসুদেব এর মধ্যেই নবজাতককে ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়ে পৌঁছে যান পালক মাতার ঘরে। অত্যাচারী কংস নবজাত কৃষ্ণকে না পেয়ে একদিকে দেবকীকে বেত্রাঘাত, অন্য দিকে খুঁজে খুঁজে সব নবজাতকের হত্যাযজ্ঞ। কংস ঘুমোতে পারে না, খেতেও পারে না। উঠতে বসতে কর্ণমূলে বাজে, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ যুবক কৃষ্ণ ও অত্যাচারী কংসের যুদ্ধ হলে, কংসবধ শেষে মাকে মুক্ত করে রাজা হলেন শ্রীকৃষ্ণ। জেমিনির ব্যানারে ছবিটি দেখেছিলাম ১৯৬৪ সালের রূপকথা সিনেমা হলে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে শেরপুরে তখন কারেন্ট ছিল না, ডায়নামোর বিকট শব্দে অভ্যস্ত ছিলাম। যা হোক, আওয়ামী লীগের একমাত্র ভয়, তারেক। কংসের মতোই না পারে খেতে, না পারে ঘুমোতে।
৫ জানুয়ারি যারা কায়েম করতে পারে, তারা সবকিছুই পারে। খালেদা যথার্থই বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না।’
কিছু কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। সব আয়োজন, বডিল্যাংগুয়েজ, সাঙ্কেতিক ভাষা, কর্মকাণ্ড, রেড ও গ্রিন সিগন্যাল, খালেদা বিদায়ের সিগন্যাল এগুলো। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদার বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মধ্যরাতে হঠাৎ বিদ্যুতের লাইন কেটে মহড়া শুরু। বেগম জিয়া সম্পূর্ণ অনিরাপদ, অরতি। প্রচণ্ড চাপে আওয়ামী লীগ। এইরকম ক্রান্তিকালে, হঠাৎ যদি কেউ ঘোষণা দিয়ে বলেন, শর্ট সার্কিটে বড় ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য দায়ী ত্র“টিপূর্ণ বিদ্যুৎলাইন কিংবা যদি বলেন, ক্রুদ্ধ শ্রমিকেরা আগুন দিয়েছে... তখন? বিদ্যুৎ নিয়ে যে খেলা খেলছেন মন্ত্রী, আমার সন্দেহ, বড় বিপদ আসন্ন।
দারুণ লিখেছেন মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীরপ্রতীক। ৪৪ বছরে আরো গজব হয়েছে। আমার মনে হয়, কোকোরটা ‘গজব’ হলে আগেরটা সুনামি। তোফায়েলের ধারণা, ওপরওয়ালা নাকি প্রতিশোধ নিয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যদি সত্যিই মনে করেন, খালেদা জিয়া ঘুমের ভান করছিলেন, দোয়া করি ঘরে ঘরে পুত্রশোক হোক। তখন কি অপরপকে বলবেন, ‘ছেলে মারা গেছে, তাতে কী? এটাই তো সংলাপের সুযোগ!’
নারীর জন্য ঘর
ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছেন, ‘কান্নার জন্য নারীর একটি ঘর চাই।’ খালেদার সেই ঘরটি ছিল। কিন্তু কাঁদতে দেয়নি এমডিজির নারী নির্যাতক বাহিনী। মিনিটে ৪৮ হাজার টাকা খরচ করে অবাঞ্ছিত সমালোচনায় সংসদে করের কত কোটি টাকা খরচ করল সরকারের লোকেরা? আদালত থাকলে, সংসদ পিতৃহত্যার প্রতিশোধের জায়গা কেন? কোকোর দাফনের দিন পুলিশ ফাঁড়িতে কেক কাটার দৃশ্য মানেইÑ সমবেদনার মুখোশ উন্মোচন হলো। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভয়ানক উত্তেজক বাক্যবাণ, জাতির মস্তিষ্কে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের মতো বিষ ছড়াচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মৃত্যুর পর কংগ্রেস কিন্তু তার ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’র কিচ্ছাকাহিনী নিয়ে জনগণের করের টাকা ধ্বংস করেনি, আমরা করেছি।
বলছি, জনমানুষের ভোটে নির্বাচিত না হলে যা হয়, কারা মানুষ পোড়াচ্ছে সবাই জানে, বিশেষ করে জ্ঞানপাপীরাই অর্থের কাছে সবচেয়ে বেশি মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন। মধ্যরাতের টকশোতে ঝগড়া-ঝাটির নোংরা দৃশ্য। ৯ম ও ১০ম সংসদ সময়কাল এতটাই ‘অভিশপ্ত’, প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে, কঙ্গো, নাইজারের মতো লাশ আর লাশ প্রমাণ করে, সরকার কত অযোগ্য, অপদার্থ। খালেদাকে ধ্বংস করার হুমকি দেয়া গডফাদারকে সংসদে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তার ঘোষণা দিলেন কে? ২৭ জানুয়ারি পত্রিকার খবরÑ আওয়ামী নেতার বাড়ি থেকে ককটেল উদ্ধার, ২৯ জানুয়ারি নিউ এইজ পত্রিকাÑ পেট্রলবোমাসহ আওয়ামী নেতার ছেলে হাতেনাতে গ্রেফতার। যেদিন কোকোর মৃত্যু হলো, সেইদিনই খালেদার বিরুদ্ধে হুকুমের আসামি হওয়ার মামলা করার মধ্যে সব এজেন্ডা নিহিত। তারেককে শিক্ষা দিতে হবে, সেজন্য খালেদাকে গ্রেফতার করতে হবে, অন্যথায় কংসের ভয়।
আমার যুক্তিগুলো অনুমান নয় বরং আইননির্ভর। মশকারা বটে! আওয়ামীপন্থীরা বারবার জানতে চায়, কেন জ্বালাও-পোড়াও! কারণ সব ক’টাই জানে কিন্তু বলবে না। কারণ এত কম পরিশ্রমে আর কোনো দেশেই বিলিয়নিয়ার হওয়া সম্ভব নয়।  কেউ যখন বড় অঙ্কের বীমা কিনে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে বীমা কোম্পানির কাছে তিপূরণ চায়, সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও তাই অন্যায়। সত্যিই কি সরকারপ্রধান জানেন না, কেন জ্বালাওপোড়াও! সবাই স্মরণ করুন, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে পেট্রলবোমায় দগ্ধদের ভিড়ে হিমশিম খাওয়া বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে গীতা সরকার নামে একজন দগ্ধ মহিলার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ‘অসুস্থ সরকার চাই না, সুস্থ সরকার চাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, ওনারে এক হইতে বলেন, আপনারা সবাই এক হন। হয়ে আমাদের রা করেন।’ বার্ন ইউনিট রাজনীতিতে খালেদা কখনোই জড়াননি। সুতরাং সেখান থেকে ফিরে আসার পরই একমাত্র ঘোষণা হওয়া উচিত ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ৫ জানুয়ারিতে অনড় থেকে প্রমাণ করলেন, আবারো বার্ন ইউনিটের জন্য অনেকটা দায়ী তাঁরা। প্রফেসর সাহেবেরা বলুন, সংবিধান এমন কী আসমানি কিতাব, যা সংশোধন করে মানুষ পোড়ানোর সুযোগ বন্ধ করা যেত না? গীতা সরকারের সন্দেহই সঠিক? তাকে মাইলস্টোন ধরলে বলা যায়, আবারো যারা জেনেশুনে বার্ন ইউনিটের পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, পরিস্থিতির জন্য দায়ী তারা। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই। ৫ জানুয়ারির প্রহসন করা সংসদীয় গণতন্ত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কিছুই করেনি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট। সিভিল আইনে, ভলান্টারি ম্যান স্লটারের শাস্তি ৩০ বছর পর্যন্ত জেল। ক্ষমতাসীনেরা সবাইকে বোকা মনে করেন। মিথ্যা দলিল দেখিয়ে কেউ সম্পদ অর্জন করলে জালিয়াতকে আইনের কাছে সোপর্দ করা যায়। ৫ জানুয়ারিতে যা হলো, ভোটার ফ্রড-বলপ্রয়োগ সিল মেরে বাক্স ভরা-নিজস্ব বাহিনী দিয়ে কেন্দ্র দখলে রাখা এভাবে ভোটাধিকার লুটেরাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা না করে কি ফুলের মালা দেবে? ১৫৪ আসনে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য হওয়ার মানেই ভুয়া তথ্য দিয়ে বাড়ি কেনার সমান অন্যায়। ‘জনতার মঞ্চ’ নির্মাণের হোতা আওয়ামী লীগকে অবিলম্বে না থামালে অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে। ২০২১-২০৪১ এর টোপ দিয়ে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার কাজ শেষ করছে।
উন্নতির ষড়যন্ত্র
সড়ক ও জলপথ, খনিজসম্পদ, সস্তাশ্রম, সমুদ্রজয়, ইত্যাদি নিয়ে তোড়জোড় বাংলাদেশের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে এনেছে? এ দিকে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার মতো টালমাটাল বাংলাদেশ। এই অঞ্চলকে ‘বিগ-বি-বেল্ট’ ঘোষণা দিয়েছে বিগ ব্রাদাররা। সবাই জানে, খনিজসম্পদ কুগিত রাখতে পশ্চিমাদের নিয়োগপ্রাপ্ত পাপেট দিয়ে চলছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ। আমাদের সমস্যা সেটাই। এই শতাব্দী হবে খনিজসম্পদ দখলে রাখার উন্মাত্ত প্রতিযোগিতা। খনিজসম্পদ দখল চক্রের সাথে গোপনে কাজ করছে ক্ষমতাবান মহল, পাবলিককে কিছুই জানায় না। বঙ্গোপসাগরের তলে যে বিপুল সম্পদ, তাতে আমার সন্দেহ, ‘সমুদ্র বিজয়’ আসলে কার স্বার্থে? আগেও বলেছি, ১৫০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির দেশে অবিশ্বাস্য অঙ্কের বিনিয়োগ বাস্তবসম্মত নয়। বঙ্গোপসাগর দখলে রাখতে চাইলে আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিরতা সৃষ্টি করা অনেকের প্রয়োজন। ওদের স্বার্থে ভবিষ্যতে হয়তো আরো ৫ জানুয়ারি হবে।
এই অঞ্চলে কোনো কোনো রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ মিশনে নিয়োজিত। ৫ জানুয়ারির বার্তা বহু আগেই দিয়েছিল তারা। এক দিকে লাশ, অন্য দিকে পঙ্কজ শরন আর ট্রেন চুক্তি, ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির দৃষ্টান্ত। ৫ জানুয়ারি প্রথম স্বৈরগণতন্ত্রের ঘটনা, যা সম্ভব হলো পুঁজিবাদীদের আঁতাতে। এদের সামনে এক কথা, পেছনে আরেক। এত সস্তাশ্রম আর এত লোভী দল একসাথে এশিয়ার আর কোথাও পাবে কি? বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কম দায়ী নন বান কি মুন। তারানকোর সফরের পরও কিভাবে ৫ জানুয়ারি ঘটতে পারে? বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট সত্ত্বেও পাইকারি এমডিজি পুরস্কারে আমার পুরনো সন্দেহই সত্য হলো, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। গোপন চুক্তি হয়ে থাকলে উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ, তবে ‘এমডিজি’জনিত অতিরিক্ত মাখামাখি, জাতিসঙ্ঘের ইতিহাসে প্রথম। উন্নয়ন, পুরস্কার, অটিজম মিলে যেন লেজেগোবরে। আফ্রিকার প্রায় ৪৫টি গৃহযুদ্ধ লেগে থাকা দেশে শান্তি রা করছেন বাংলাদেশীরা, অন্য দিকে নিজ দেশের মানুষদেরই শান্তি নেই। র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির মহাপরিচালকদের কার্যকলাপ জাতিসঙ্ঘের সনদ পরিপন্থী সত্ত্বেও বান কি মুনের নিষ্ক্রিয়তা কেন? অনেক দেশেই জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হয়েছে। ‘৫ জানুয়ারি’ বন্ধ করে আগেই বহুজাতিক তদন্ত কমিটি পাঠিয়ে শান্তির ব্যবস্থা করতে পারত জাতিসঙ্ঘ। তাহলে এত মানুষ মরত না। সেই মতা মুনের ছিল বলেই বিশ্বাস করি।
জাতিসঙ্ঘের বহু কলঙ্কের অন্যতম হলো ইরাক যুদ্ধ। ২০০৩ সালে মিথ্যা রেজুলেশন পাস হয়েছিল। সাদ্দামের মিথ্যা মারণাস্ত্রের খবর ‘ফাঁস’ করলেন কলিন পাওয়েল নিজে। এর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে গণহত্যা বন্ধ হচ্ছে না। জাতিসঙ্ঘের দুর্বল ভূমিকায় উদ্ভব হচ্ছে নতুন নতুন জঙ্গি দলের।
আমাদের প্রধান সমস্যা, ব্যক্তিকে সৃষ্টিকর্তার মতো মর্যাদা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার দুরভিসন্ধি। এজন্যই ৬৭ বছরেও শান্তির দেখা নেই। ক্ষমতাসীনের মতার সীমানা নির্ধারণে ব্যর্থ, বুদ্ধিজীবীদের চোখে সব দোষ খালেদার।  উন্নতি বিক্রেতারা আওয়ামী লীগকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত মতায় রাখতে চায় এবং এটাই প্রধান সমস্যা। শার্লি এবদুর ঘটনা জানি কিন্তু মহানবী সা:কে অপমানের পরেও জেলখানায় ভিআইপি আদরে কেন লতিফ সিদ্দিকী?
ঐতিহাসিক ঘটনাটি ডেভিড ক্যামেরনের জানার কথা। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার নেয়ার পথে যাত্রা বিরতিকালে লন্ডনে সবচেয়ে বড় উপদেশ দিয়েছিলেন ড. লুথার কিং। বলেছিলেন, পশ্চিমারা যদি সাউথ আফ্রিকা থেকে স্বর্ণ কেনা বন্ধ করে, বর্ণবাদ সমস্যা সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবে। ইহুদি নির্মূল ও জার্মানিকে সব চেয়ে উন্নত দেশ বানানোÑ দুটোই হিটলারের বৈশিষ্ট্য। আমরা কি সেটা চাই? গার্মেন্ট ব্যবসায় অবশ্যই চাই; কিন্তু তার চেয়ে বেশি চাই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার। রানাপ্লাজা ও তাজরীনের ঘটনার পরও পাশ্চাত্যের সস্তা শ্রমের লোভ একচুল কমল না। পশ্চিমারা নির্বাচন চায় না বলেই বার্ন ইউনিট খোলা।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশন বিষয়গুলো যেভাবে দেখে। যাদেরকে বন্ধু মনে করছে আওয়ামী লীগ, আসলেই ওরা ধোঁকাবাজ। ১৯৭১ বনাম ২০১৫। ৭১-এ বাংলাদেশের পে চারবার ভেটো দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল রাশিয়া। ৭১-এর ২৫ অক্টোবর আমেরিকার সহায়তায় তাইওয়ানকেন্দ্রিক চীন সরকারকে উৎখাত করে জাতিসঙ্ঘে আনা হলো আমেরিকাবান্ধব কমিউনিস্ট সরকার। এরপর যতবারই ভেটো, চীন ও আমেরিকা একপ। খুলে গেল চীনের রুদ্ধদুয়ার। এখন বাংলাদেশ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘে কোনো সিদ্ধান্ত হলে রাশিয়া ও চীন ঢাকার সরকারের পে ভেটো দেবে। বলতে গেলে বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা ক্রিমিয়ার মতো, রুশ-মার্কিনের টানাটানি। বাশার আল আসাদকে চাইলেও উৎখাত করতে পারবে না ন্যাটোশক্তি এবং এরাই উন্নতিবাজদের খুঁটির উৎস। একব্যক্তির মাথায় উন্নতির কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছেন ঝানু বুদ্ধিমানেরা।
ব্যবসা ও গণতন্ত্র
সম্পদের লোভে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের মতোই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও জানতে চায়, জ্বালাওপোড়াও কেন? আশ্চর্য! যেন কচি খোকা; ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, তাদের কাছে বড় ৫০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট। প্রায় এক কোটি গরিবের ঘাম ঝরিয়ে খাওয়া মালিকদের লাভের অঙ্কে কিছু কম পড়ায়, গণতন্ত্রনিধন দেখছেন না। গরিব শ্রমিকদের পুঁজি করে নানা সময়ে সরকারের সাথে দেনদরবার চালিয়ে বিপুল সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে দেশে ও বিদেশে। তাদের প্রায় ৭০ ভাগই সংসদ সদস্য। গণতন্ত্র প্রত্যাশীরা জানেন, ব্যবসায় লাটে উঠলেও ভোটাধিকারের গুরুত্ব কমে না; একবিন্দুও নয়। বরং বলুন, মতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে, তখন দেখবেন ম্যাজিকের মতো রাতারাতি কিভাবে বার্ন ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
গণহত্যার বিচার
নির্যাতন আর গলাবাজি দিয়ে আর কত রাষ্ট্র পরিচালনা! রাজাপাকসের মতোই, দিনরাত ভয় দেখানো এবং দেখে নেয়ার হুমকিই যেন প্রধান কাজ। আমরা কি মানুষ না? জাতিসঙ্ঘের সনদে গণহত্যার সংজ্ঞা, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে টার্গেট করে এক বা একাধিক হত্যা। বেছে বেছে নির্দিষ্ট সংগঠনের লোকজনের বুকে গুলি করে অব্যাহত খুন। ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব নিলেন। নানা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন সাপেে গণহত্যার বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে না জাতিসঙ্ঘ। সব অপরাধীকে বিচারের আওতায় না আনলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আওয়ামী রাজনীতির উৎস, বাঁশ ও লাঠি। ৩০৩ দিন হরতালসহ গানপাউডারের সংস্কৃতি চালু করেছে। ১৯৯৬ সনে অসহযোগ করে শিাব্যবস্থাকে ধ্বংস, সংখ্যালঘু নির্যাতনের রেকর্ড, একজন বিশ্বজিতকে নির্মূল করে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা...। এসব কোনো রাজনৈতিক দলের কাজের মধ্যে পড়ে না। এগুলো চললে বাংলাদেশে কখনোই শান্তি আসবে না।
সারমর্ম
একমাত্র করণীয় : দ্রুত নিরপেক্ষ নির্বাচন। নুরেমবার্গ ট্রায়েলের মতো আর্কাইভের তথ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী সব অপরাধীর বিচার।
বি.দ্র. : লেখাটি অ্যাক্টিভিজমের ভিত্তিতে।
ইমেইল : farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.com

No comments

Powered by Blogger.