দেশ ও জনতা কি শুধু হেরেই যাবে? by অধ্যাপক এ কে এম মহীউদ্দীন
আলাপ-আলোচনার
মাধ্যমেই বর্তমান কঠিন সঙ্কটের নিষ্পত্তি হওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ
সমস্যাটা আদৌ আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়, সমস্যাটা পুরোপুরিই রাজনৈতিক। অতএব
সমস্যার মূলে গিয়ে তার সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানই দরকার। আর তা হতে পারে সব
পরে মধ্যে অবাধ ও খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে
এখন যদি আমরা বর্তমান এই সঙ্কটের সুরাহা করতে ব্যর্থ হই, তবে এর পরিণতি
দেশের ও জনগণের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। মূল প্রশ্ন এখানে কোন প জিতবে বা
হারবে তা নয়, মূল প্রশ্ন বাংলাদেশ ও এর জনগণ জিতবে না হারবে এবং কিভাবে
বাংলাদেশের জনগণের বিজয় নিশ্চিত করা যাবে?
আজ যদি বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধীদের সরকার নিশ্চিহ্নও করে দিতে সম হয় তবু দেশে শান্তি আসবে না। সরকারের স্বস্তিতে থাকার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। রাষ্ট্র আজ যে রূপ ধারণ করেছে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র যদি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, ফল কী হবে তার? এই ১৬ কোটি অস্থির ও উত্তেজনাপ্রবণ মানুষের দেশে তখন নতুন নতুন বিরোধী গজিয়ে উঠতে বাধ্য। কারণ, সব মানুষই পদে পদে এত বাধা, নিবর্তন ও পপাতিত্ব মেনে নিতে রাজি থাকবে না। সবাইকে ভয় দেখিয়ে বা অপবাদ দিয়ে দমিয়ে রাখা কারো পে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ মূল বিরোধিতা তো মতায় কে যাবে সেটা নিয়ে নয়। মূল বিরোধিতা রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হবে, তা নিয়ে। অতএব বিরোধিতা শুধু থাকবেই না, বরং বাড়তেই থাকবে। সুস্থিরভাবে কেউ আর তখন দেশ পরিচালনা করার অবকাশ পাবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অশান্তি লেগেই থাকবে। রাষ্ট্র ও সমাজে সবখানেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে বিশৃঙ্খলা। মারাত্মকভাবে বিভক্ত ও আত্মকলহে লিপ্ত বাংলাদেশ দুর্বল হতে থাকবে কেবল।
বিরোধীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে একটার পর একটা মামলা দিয়ে তাদের নাজেহাল করে ও নির্বিচারে তাদের জেলে পুরে সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারের সাময়িক কিছু সুবিধা হতে পারে। সরকারকে কিছুণের জন্য তা আনন্দ দিতে পারে। কিন্তু হার হবে বাংলাদেশের ও এর জনগণের। দেশ ও জনগণের সঙ্কট থেকেই যাবে। নতুনভাবে সঙ্কট শুধু আসতেই থাকবে দেশে। যেমন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জোরজবরদস্তিমূলক নির্বাচন সঙ্কট দূর না করে নতুনভাবে তা ডেকে নিয়ে এসেছে।
মতার জোরে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনী করে সরকার ভেবেছিল তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু হার হয় বাংলাদেশ ও তার জনগণের। দেশ ও জনগণের জন্য জন্ম দেয়া হয় এক অশুভ ভবিষ্যতের। শক্তি প্রয়োগ করে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কোনো রকম একটা একতরফার নির্বাচন করতে পেরে সরকার ভেবেছিল আবার তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু আবারো হার হয় দেশের ও এর জনগণের। দেশ ও এর জনগণকে বন্দী করে ফেলা হয় প্রথমবারের চেয়ে আরো গভীর সঙ্কটের আবর্তে। প্রতিবারই কিন্তু আগের বারের চেয়ে সঙ্কটের পরিধি ও মাত্রা বেড়েই চলেছে। এখন যে মহাসঙ্কট চলছে তারও সুরাহা যদি সরকার সব পরে সাথে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে না করে শক্তি প্রয়োগ করে করতে চায় তবে সরকার হয়তো সাময়িক বিজয়ের পুলক পেতে পারে। কিন্তু আবার হার হবে বাংলাদেশের ও এর জনগণের। আর এবারের হার হয়ে উঠতে পারে অকল্পনীয়ভাবে বেদনাদায়ক।
আমাদের মতো একটা সমস্যা জর্জরিত, দরিদ্র ও দুর্বল দেশের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ভার বইবার মতাই এমনিতে খুব কম। তার ওপর যদি রাষ্ট্র ও সমাজে অব্যাহত গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা এসে ভর করে তবে তো অবস্থা আমাদের সঙ্গিন হতে বাধ্য। সঙ্কটে দুর্বল হতে হতে সবকিছুই আমাদের ভেঙে পড়বে। আমাদের বোঝা দরকার যে বিভেদ, বিবাদ-বিসংবাদ, তিক্ততা, ােভ, অভিযোগ, পাল্টাঅভিযোগ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার পটভূমিতে আজকের এই রাজনৈতিক সঙ্কট তার মধ্যে সর্বনাশা গৃহযুদ্ধের বীজ পর্যন্ত লুকিয়ে আছে। এই বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পথে এখন। সরকারের উচিত তাই দেশের ও জনগণের সমূহ বিপদের কথা উপলব্ধি করে ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এখুনি আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কটের মূলে গিয়ে সুরাহা করা। এ সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান অবশ্যই আছে। সংবিধান কোনো বাধা নয়। বাধা হলেও তা কাটিয়ে ওঠারও উপায় নাগালের মধ্যেই আছে। প্রয়োজন শুধু প্রন্তরিকতা ও শুভবুদ্ধি।
আল্লাহ না করুন সরকার যদি জিদের বশে ও শক্তির ওপর ভর করে আপসের পথ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তবে গৃহযুদ্ধের সেই বীজ যে তরতাজা হয়ে গজাবে না তা কেউ জোর করে বলতে পারে না। সেই বিশৃঙ্খলার একটা পর্যায়ে বাইরের শক্তির ত্রাণকর্তা হিসেবে সরাসরি এখানে হস্তপে ঘটা মোটেই অবাস্তব নয়। আজকের প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতে সেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন থাকতে পারবে বলে আশা করা কঠিন। আমরা কি সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে চাই আমাদের ও আমাদের অনাগত সন্তানসন্ততিদের জন্য? মনে রাখা দরকার ভারতীয় উপমহাদেশ খুব বিপদসঙ্কুল স্থান এবং তার মধ্যে আমাদের অবস্থা বিশেষভাবে নাজুক।
প্রাচীন গ্রীকদের একটা কথা আছে। দেবতারা যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান, তখন প্রথমেই তাকে পাগল বানিয়ে দেন। তার আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, যা মনে আসে তাই বলতে ও করতে থাকে। পরিনামের কোনো হুঁশ আর থাকে না তখন। আল্লাহ আমাদের সে রকম পাগল হয়ে যাওয়া থেকে হেফাজত করুন।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আজ যদি বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধীদের সরকার নিশ্চিহ্নও করে দিতে সম হয় তবু দেশে শান্তি আসবে না। সরকারের স্বস্তিতে থাকার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। রাষ্ট্র আজ যে রূপ ধারণ করেছে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র যদি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, ফল কী হবে তার? এই ১৬ কোটি অস্থির ও উত্তেজনাপ্রবণ মানুষের দেশে তখন নতুন নতুন বিরোধী গজিয়ে উঠতে বাধ্য। কারণ, সব মানুষই পদে পদে এত বাধা, নিবর্তন ও পপাতিত্ব মেনে নিতে রাজি থাকবে না। সবাইকে ভয় দেখিয়ে বা অপবাদ দিয়ে দমিয়ে রাখা কারো পে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ মূল বিরোধিতা তো মতায় কে যাবে সেটা নিয়ে নয়। মূল বিরোধিতা রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হবে, তা নিয়ে। অতএব বিরোধিতা শুধু থাকবেই না, বরং বাড়তেই থাকবে। সুস্থিরভাবে কেউ আর তখন দেশ পরিচালনা করার অবকাশ পাবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অশান্তি লেগেই থাকবে। রাষ্ট্র ও সমাজে সবখানেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে বিশৃঙ্খলা। মারাত্মকভাবে বিভক্ত ও আত্মকলহে লিপ্ত বাংলাদেশ দুর্বল হতে থাকবে কেবল।
বিরোধীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে একটার পর একটা মামলা দিয়ে তাদের নাজেহাল করে ও নির্বিচারে তাদের জেলে পুরে সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারের সাময়িক কিছু সুবিধা হতে পারে। সরকারকে কিছুণের জন্য তা আনন্দ দিতে পারে। কিন্তু হার হবে বাংলাদেশের ও এর জনগণের। দেশ ও জনগণের সঙ্কট থেকেই যাবে। নতুনভাবে সঙ্কট শুধু আসতেই থাকবে দেশে। যেমন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জোরজবরদস্তিমূলক নির্বাচন সঙ্কট দূর না করে নতুনভাবে তা ডেকে নিয়ে এসেছে।
মতার জোরে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনী করে সরকার ভেবেছিল তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু হার হয় বাংলাদেশ ও তার জনগণের। দেশ ও জনগণের জন্য জন্ম দেয়া হয় এক অশুভ ভবিষ্যতের। শক্তি প্রয়োগ করে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কোনো রকম একটা একতরফার নির্বাচন করতে পেরে সরকার ভেবেছিল আবার তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু আবারো হার হয় দেশের ও এর জনগণের। দেশ ও এর জনগণকে বন্দী করে ফেলা হয় প্রথমবারের চেয়ে আরো গভীর সঙ্কটের আবর্তে। প্রতিবারই কিন্তু আগের বারের চেয়ে সঙ্কটের পরিধি ও মাত্রা বেড়েই চলেছে। এখন যে মহাসঙ্কট চলছে তারও সুরাহা যদি সরকার সব পরে সাথে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে না করে শক্তি প্রয়োগ করে করতে চায় তবে সরকার হয়তো সাময়িক বিজয়ের পুলক পেতে পারে। কিন্তু আবার হার হবে বাংলাদেশের ও এর জনগণের। আর এবারের হার হয়ে উঠতে পারে অকল্পনীয়ভাবে বেদনাদায়ক।
আমাদের মতো একটা সমস্যা জর্জরিত, দরিদ্র ও দুর্বল দেশের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ভার বইবার মতাই এমনিতে খুব কম। তার ওপর যদি রাষ্ট্র ও সমাজে অব্যাহত গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা এসে ভর করে তবে তো অবস্থা আমাদের সঙ্গিন হতে বাধ্য। সঙ্কটে দুর্বল হতে হতে সবকিছুই আমাদের ভেঙে পড়বে। আমাদের বোঝা দরকার যে বিভেদ, বিবাদ-বিসংবাদ, তিক্ততা, ােভ, অভিযোগ, পাল্টাঅভিযোগ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার পটভূমিতে আজকের এই রাজনৈতিক সঙ্কট তার মধ্যে সর্বনাশা গৃহযুদ্ধের বীজ পর্যন্ত লুকিয়ে আছে। এই বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পথে এখন। সরকারের উচিত তাই দেশের ও জনগণের সমূহ বিপদের কথা উপলব্ধি করে ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এখুনি আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কটের মূলে গিয়ে সুরাহা করা। এ সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান অবশ্যই আছে। সংবিধান কোনো বাধা নয়। বাধা হলেও তা কাটিয়ে ওঠারও উপায় নাগালের মধ্যেই আছে। প্রয়োজন শুধু প্রন্তরিকতা ও শুভবুদ্ধি।
আল্লাহ না করুন সরকার যদি জিদের বশে ও শক্তির ওপর ভর করে আপসের পথ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তবে গৃহযুদ্ধের সেই বীজ যে তরতাজা হয়ে গজাবে না তা কেউ জোর করে বলতে পারে না। সেই বিশৃঙ্খলার একটা পর্যায়ে বাইরের শক্তির ত্রাণকর্তা হিসেবে সরাসরি এখানে হস্তপে ঘটা মোটেই অবাস্তব নয়। আজকের প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতে সেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন থাকতে পারবে বলে আশা করা কঠিন। আমরা কি সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে চাই আমাদের ও আমাদের অনাগত সন্তানসন্ততিদের জন্য? মনে রাখা দরকার ভারতীয় উপমহাদেশ খুব বিপদসঙ্কুল স্থান এবং তার মধ্যে আমাদের অবস্থা বিশেষভাবে নাজুক।
প্রাচীন গ্রীকদের একটা কথা আছে। দেবতারা যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান, তখন প্রথমেই তাকে পাগল বানিয়ে দেন। তার আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, যা মনে আসে তাই বলতে ও করতে থাকে। পরিনামের কোনো হুঁশ আর থাকে না তখন। আল্লাহ আমাদের সে রকম পাগল হয়ে যাওয়া থেকে হেফাজত করুন।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments