শিল্পের ত্রিমুখী বর্তমান by শুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেঙ্গল
গ্যালারিতে চলছে এ সময়ের তিন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শনী_
'দ্য প্যারাডক্সিক্যাল নাউ'। আনিসুজ্জামান সোহেল, ফিরোজ মাহমুদ ও ইয়াসমিন
জাহান নুপুর_ এ শিল্পীত্রয়ী তাদের কাজের ধরন ও সৌকর্যে আলাদা। অঙ্কনরীতির
সরলীকরণ, বিচিত্র প্রতীকের ব্যবহার, ইতিহাস চেতনা, সত্যের সুদৃঢ় প্রকাশ,
বর্তমানকে অঙ্গীকার করবার প্রচেষ্টা_ এমন নানাভাবেই এই তিন শিল্পীর চিন্তার
জগৎ থেকে শুরু করে শিল্পচর্চা ও প্রয়োগভঙ্গিগত দিক থেকে তিন রকম। কিন্তু
সেই তিন রকমের শিল্প বাস্তবতাকে একটি বর্তমানে এনে দাঁড় করিয়ে, আমাদের এই
বিচিত্র, বিপরীতধর্মী আর ওলটপালট বাস্তবতার এক শিল্পব্যঞ্জনাই যেন তৈরি
করেছে বেঙ্গলের এই নতুন আয়োজন। সমসাময়িক ত্রিমুখী বৈশিষ্ট্যে আলোকিত তিন
শিল্পীকে একটি পরিসরে উপস্থাপনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে, তাকে অনেকটাই নতুন
তাৎপর্যে মণ্ডিত করতে পেরেছে এই প্রদর্শনী। একই সময়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে তিনজন
শিল্পীর শিল্পরচনার পার্থক্যকে যেমন এখানে উপজীব্য করা যায়_ তেমনি এখানে
স্পষ্ট হয় এই সময়ের অন্তর্গত বিপরীতধর্মিতাও। যে বৈপরীত্য নিয়ে আমরা ক্রমশ
ধাবিত হচ্ছি আসন্ন কোনো এক ধ্বংসের পথে।
আনিসুজ্জামান সোহেল রেখাপ্রধান কাজ করেন অনেক আগে থেকেই। তার রেখায় ধরা পড়ে সমাজবাস্তবতার প্রতি বিকট এক ধরনের কটাক্ষ, প্রতিবাদ। ক্রমশ নষ্ট হতে থাকা সময়ের একটা প্রামাণ্য উপলব্ধি বিস্তৃত হয় তার কাজে। এই ক্রমশ প্যাকেজনির্ভর হয়ে আসা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রতিনিয়ত যে যন্ত্রণা_ শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল তার ক্যানভাসে সেই যন্ত্রণাকে রেখাবদ্ধ করেন । বিভিন্ন ফর্মে জীবনের বিচিত্র যন্ত্রণা এবং তাকে বয়ে চলার দৃশ্যাবলিকে তুলে ধরেন তার চিত্রকর্মে। সেখানে দেখা যায় সময়ের অন্তর্বর্তী নানান উপাদান। এসব উপাদান আমাদের খুবই পরিচিত এবং এই পরিচিত জিনিসপত্রের জঞ্জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে, আমাদের সময়টা যেন কাতরাচ্ছে। সেই কাতরতা আর আর্তচিৎকারের অবয়ব থাকে আনিসুজ্জামানের ছবিতে। আর এ সবকিছুই তিনি প্রকাশ করেন রৈখিক এক গতিময়তার মাধ্যমে। সময়টাও যেমন বড্ড গতিশীল, আর শিল্পীর করণকৌশলের গতিও চিত্রকর্মে সেই আক্রান্ত গতিময়তারই অনুগামী। অস্তিত্ব সংকটের আধুনিক চিত্রায়ণ বেশ যত্ন ও কৌশলের সঙ্গে ঠাঁই করে নেয় তার কাজে। যুদ্ধ, অস্ত্র, বাজার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সবই উঠে আসে রাজনীতি সচেতনতায়। বক্তব্যে উচ্চকিত এবং সরাসরি হলেও রঙের ব্যবহারে তিনি উচ্চকিত নন, বরং সচেতনভাবে মিতব্যয়ী। ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের যৌথতায় ঘরানা তৈরি হয় তার ছবির নিজস্ব।
কালোবাজার মানুষকে এবং শিল্পকে পণ্য করে, আনিসুজ্জামান সোহেল দাঁড়াতে চান এর বিরুদ্ধে। তার ক্যানভাসও সম্পূর্ণ কালো। প্রতিনিয়ত যে বাণিজ্যিক মনোভাব মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে, দুর্বিষহ করে তুলছে_ শিল্পের মাধ্যমে সরাসরি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চান শিল্পী। পুরো কালো ক্যানভাসে কাজ করা সহজ কথা নয়, তার এই কাজগুলোকে খুব সহজেই মনে হতে পারে সমাজের এক্স-রে রিপোর্ট। শিল্পী বলেন, 'বিব্রত অবজারভেশনের সঙ্গে কুঁচকে যাওয়া ইনট্যুইশন মিলিয়ে আমি শুধু ম্যানিপুলেটেড মেটাফোরের আশ্রয় নিই, যারা নিজেরাই লড়ে চলে পরস্পর দ্বন্দে-দ্বন্দ্বে অশেষ সংঘাতে। একে একটা খেলার কান্নাও বলা চলে, আবার কান্নার খেলাও বটে! সৌন্দর্য আর পাশবিক কদর্যতাও এখানে পদে পদে যুদ্ধে লড়ে, অমোঘ অমীমাংসিত! রিয়্যাল আর সাররিয়্যালের অনামা অচেনা কোনো মাঝখানে ওভাবেই ঝুলে থাকি আমি আর আমার চেষ্টা!' প্রদর্শনীতে 'কিপ স্ক্রিমিং' শিরোনামের বিশাল ক্যানভাসে তার এই সময় চেতনাকে দেখতে পাবেন দর্শক।
শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের যাত্রাটা আবার বর্ণিল। তবে সেই বর্ণময়তার ভেতরে ভ্রমণ আছে ইতিহাসের, আমাদের বিগত পরাজয়ের, শোষিত হয়ে পড়ে থাকা হাজার বছরের।
উপনিবেশকালীন সময়ের যুদ্ধ-বিদ্রোহ, সংঘাত এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রতীকায়িত উপস্থাপনা দেখা যায় তার চিত্রকর্মে। বাংলার নবাবদের দুর্ভাগ্য আর স্বাধীনতা হারানো শিল্পীর চিন্তার বিষয়বস্তু। এবং ইতিহাসের সেই কালপর্বের নানা চরিত্র, মোটিফ, প্রতীক শিল্পীর ক্যানভাসে স্থান পায়। দক্ষ ড্রইংয়ের মাধ্যমে উজ্জ্বল রঙ এবং নানামাত্রিক মোটিফের ব্যবহার ফিরোজ মাহমুদের কাজকে ইতিহাস আর শিল্পীর চেতনাকে ছাড়িয়ে নান্দনিক এক মাত্রাও দান করে। তার ছবিতে রহস্যময় কিংবা ঐতিহাসিক কোনো অশনিসংকেতের প্রতীক হিসেবে প্যাঁচার উপস্থিতি রয়েছে। সঙ্গে এসেছে তরবারি, ঘোড়া, তীর, ধনুক। স্টেনসিলের এই কাজগুলো শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের মিশ্র করণকৌশলের দক্ষতারই পরিচায়ক। শিল্পী তার 'সিনারিও' সিরিজের ছয়টি কাজের মাধ্যমে সেই প্রমাণ রেখেছেন।
শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নুপুরের কাজের বিষয়বস্তু প্রাচীন স্থাপনার নির্মাণশৈলী। বিশেষ করে মোগল আমলের স্থাপত্যকর্মের বিভিন্ন নমুনা_ যেমন, সে সময়ের দরজা, জানালা, স্তম্ভ, গম্বুজ। এসব জিনিসের নির্মাণশৈলী শিল্পী নুপুর লক্ষ্য করেন তার রূপান্তর চেতনার অনুষঙ্গ হিসেবে। তার শিল্পচর্চায় সময় খননের যে প্রচেষ্টা_ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসীম মহাকাশের নানা রহস্যময়তা। জলরঙে 'মেমোরি অব দ্য আর্থ' শিরোনামে তার যে কাজটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, তা চিরাচরিত জলরঙের ছবির ধারণাকে ভেঙে দেয় একেবারেই। শুধু তাই নয়, জলরঙের স্বাভাবিক প্রয়োগকে শিল্পী তার সূক্ষ্ম প্রয়োগদক্ষতায় নতুন এক মাত্রা প্রদান করেছেন।
'গোল্ডেন ডোরস', 'লুসিড ড্রিম', 'মেমোরি অব দ্য আর্থ'_ এ চিত্রকর্মগুলো শিল্পপিপাসুদের নতুনত্বের সঙ্গে বিচিত্র শিল্পচিন্তার সন্ধান দিতে পারে। আর এ তিন শিল্পীর তিন ধরনের কাজকে একই প্রদর্শনীতে নতুন এক দৃষ্টি নিয়ে উপভোগ করবার সুযোগ তো থাকছেই। প্রদর্শনীতে তিন শিল্পীর ২৬টি ড্রইং এবং ১০টি স্থাপনাকর্মসহ মোট শিল্পকর্মের সংখ্যা ৩৬টি। প্রদর্শনী আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
আনিসুজ্জামান সোহেল রেখাপ্রধান কাজ করেন অনেক আগে থেকেই। তার রেখায় ধরা পড়ে সমাজবাস্তবতার প্রতি বিকট এক ধরনের কটাক্ষ, প্রতিবাদ। ক্রমশ নষ্ট হতে থাকা সময়ের একটা প্রামাণ্য উপলব্ধি বিস্তৃত হয় তার কাজে। এই ক্রমশ প্যাকেজনির্ভর হয়ে আসা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রতিনিয়ত যে যন্ত্রণা_ শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল তার ক্যানভাসে সেই যন্ত্রণাকে রেখাবদ্ধ করেন । বিভিন্ন ফর্মে জীবনের বিচিত্র যন্ত্রণা এবং তাকে বয়ে চলার দৃশ্যাবলিকে তুলে ধরেন তার চিত্রকর্মে। সেখানে দেখা যায় সময়ের অন্তর্বর্তী নানান উপাদান। এসব উপাদান আমাদের খুবই পরিচিত এবং এই পরিচিত জিনিসপত্রের জঞ্জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে, আমাদের সময়টা যেন কাতরাচ্ছে। সেই কাতরতা আর আর্তচিৎকারের অবয়ব থাকে আনিসুজ্জামানের ছবিতে। আর এ সবকিছুই তিনি প্রকাশ করেন রৈখিক এক গতিময়তার মাধ্যমে। সময়টাও যেমন বড্ড গতিশীল, আর শিল্পীর করণকৌশলের গতিও চিত্রকর্মে সেই আক্রান্ত গতিময়তারই অনুগামী। অস্তিত্ব সংকটের আধুনিক চিত্রায়ণ বেশ যত্ন ও কৌশলের সঙ্গে ঠাঁই করে নেয় তার কাজে। যুদ্ধ, অস্ত্র, বাজার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সবই উঠে আসে রাজনীতি সচেতনতায়। বক্তব্যে উচ্চকিত এবং সরাসরি হলেও রঙের ব্যবহারে তিনি উচ্চকিত নন, বরং সচেতনভাবে মিতব্যয়ী। ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের যৌথতায় ঘরানা তৈরি হয় তার ছবির নিজস্ব।
কালোবাজার মানুষকে এবং শিল্পকে পণ্য করে, আনিসুজ্জামান সোহেল দাঁড়াতে চান এর বিরুদ্ধে। তার ক্যানভাসও সম্পূর্ণ কালো। প্রতিনিয়ত যে বাণিজ্যিক মনোভাব মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে, দুর্বিষহ করে তুলছে_ শিল্পের মাধ্যমে সরাসরি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চান শিল্পী। পুরো কালো ক্যানভাসে কাজ করা সহজ কথা নয়, তার এই কাজগুলোকে খুব সহজেই মনে হতে পারে সমাজের এক্স-রে রিপোর্ট। শিল্পী বলেন, 'বিব্রত অবজারভেশনের সঙ্গে কুঁচকে যাওয়া ইনট্যুইশন মিলিয়ে আমি শুধু ম্যানিপুলেটেড মেটাফোরের আশ্রয় নিই, যারা নিজেরাই লড়ে চলে পরস্পর দ্বন্দে-দ্বন্দ্বে অশেষ সংঘাতে। একে একটা খেলার কান্নাও বলা চলে, আবার কান্নার খেলাও বটে! সৌন্দর্য আর পাশবিক কদর্যতাও এখানে পদে পদে যুদ্ধে লড়ে, অমোঘ অমীমাংসিত! রিয়্যাল আর সাররিয়্যালের অনামা অচেনা কোনো মাঝখানে ওভাবেই ঝুলে থাকি আমি আর আমার চেষ্টা!' প্রদর্শনীতে 'কিপ স্ক্রিমিং' শিরোনামের বিশাল ক্যানভাসে তার এই সময় চেতনাকে দেখতে পাবেন দর্শক।
শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের যাত্রাটা আবার বর্ণিল। তবে সেই বর্ণময়তার ভেতরে ভ্রমণ আছে ইতিহাসের, আমাদের বিগত পরাজয়ের, শোষিত হয়ে পড়ে থাকা হাজার বছরের।
উপনিবেশকালীন সময়ের যুদ্ধ-বিদ্রোহ, সংঘাত এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রতীকায়িত উপস্থাপনা দেখা যায় তার চিত্রকর্মে। বাংলার নবাবদের দুর্ভাগ্য আর স্বাধীনতা হারানো শিল্পীর চিন্তার বিষয়বস্তু। এবং ইতিহাসের সেই কালপর্বের নানা চরিত্র, মোটিফ, প্রতীক শিল্পীর ক্যানভাসে স্থান পায়। দক্ষ ড্রইংয়ের মাধ্যমে উজ্জ্বল রঙ এবং নানামাত্রিক মোটিফের ব্যবহার ফিরোজ মাহমুদের কাজকে ইতিহাস আর শিল্পীর চেতনাকে ছাড়িয়ে নান্দনিক এক মাত্রাও দান করে। তার ছবিতে রহস্যময় কিংবা ঐতিহাসিক কোনো অশনিসংকেতের প্রতীক হিসেবে প্যাঁচার উপস্থিতি রয়েছে। সঙ্গে এসেছে তরবারি, ঘোড়া, তীর, ধনুক। স্টেনসিলের এই কাজগুলো শিল্পী ফিরোজ মাহমুদের মিশ্র করণকৌশলের দক্ষতারই পরিচায়ক। শিল্পী তার 'সিনারিও' সিরিজের ছয়টি কাজের মাধ্যমে সেই প্রমাণ রেখেছেন।
শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নুপুরের কাজের বিষয়বস্তু প্রাচীন স্থাপনার নির্মাণশৈলী। বিশেষ করে মোগল আমলের স্থাপত্যকর্মের বিভিন্ন নমুনা_ যেমন, সে সময়ের দরজা, জানালা, স্তম্ভ, গম্বুজ। এসব জিনিসের নির্মাণশৈলী শিল্পী নুপুর লক্ষ্য করেন তার রূপান্তর চেতনার অনুষঙ্গ হিসেবে। তার শিল্পচর্চায় সময় খননের যে প্রচেষ্টা_ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসীম মহাকাশের নানা রহস্যময়তা। জলরঙে 'মেমোরি অব দ্য আর্থ' শিরোনামে তার যে কাজটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, তা চিরাচরিত জলরঙের ছবির ধারণাকে ভেঙে দেয় একেবারেই। শুধু তাই নয়, জলরঙের স্বাভাবিক প্রয়োগকে শিল্পী তার সূক্ষ্ম প্রয়োগদক্ষতায় নতুন এক মাত্রা প্রদান করেছেন।
'গোল্ডেন ডোরস', 'লুসিড ড্রিম', 'মেমোরি অব দ্য আর্থ'_ এ চিত্রকর্মগুলো শিল্পপিপাসুদের নতুনত্বের সঙ্গে বিচিত্র শিল্পচিন্তার সন্ধান দিতে পারে। আর এ তিন শিল্পীর তিন ধরনের কাজকে একই প্রদর্শনীতে নতুন এক দৃষ্টি নিয়ে উপভোগ করবার সুযোগ তো থাকছেই। প্রদর্শনীতে তিন শিল্পীর ২৬টি ড্রইং এবং ১০টি স্থাপনাকর্মসহ মোট শিল্পকর্মের সংখ্যা ৩৬টি। প্রদর্শনী আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
No comments