সীমাহীন ক্ষমতার রাশ টানবে কে? by মশিউল আলম
থাই
পর্বতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মনীষী কনফুসিয়াস। সঙ্গে তাঁর অন্যতম শিষ্য সে
লু। তাঁরা যেতে যেতে দেখলেন, একটা কবরের পাশে বসে অঝোরে বিলাপ করছেন এক
নারী। কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যকে বললেন, ‘ওই নারীকে জিজ্ঞাসা করো, তিনি এভাবে
কাঁদছেন কেন।’
সে লু নারীটির কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনার কান্না দেখে মনে হচ্ছে আপনি উপর্যুপরি দুঃখের শিকার।’
নারী উত্তরে বললেন, ‘আসলেই তা-ই। একদিন এইখানে আমার শ্বশুর বাঘের কবলে পড়ে মারা যান। আমার স্বামীরও মৃত্যু হয়েছে একইভাবে। আর এখন আমার ছেলেকে বাঘে মেরে ফেলল।’
শুনে কনফুসিয়াস তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান না কেন?’
নারী বললেন, ‘যাই না, কারণ এখানে কোনো অত্যাচারী সরকার নাই।’
তখন কনফুসিয়াস বললেন, ‘আমার বৎসরা শোনো, অত্যাচারী সরকার বাঘের চেয়েও ভয়ংকর।’
বার্ট্রান্ড রাসেল ‘দ্য টেমিং অব পাওয়ার’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে এই গল্পটি উল্লেখ করে বলেছেন, সরকার যাতে বাঘের চেয়ে কম ভয়ংকর হয়, সেটা নিশ্চিত করার সমস্যাটি অতি প্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে: সামরিক একনায়কতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক শাসন, গোষ্ঠীতন্ত্র, সাধু-সন্তদের শাসন, গণতন্ত্র ইত্যাদি। মূল লক্ষ্য ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা, শুধু ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সরকারকে বাঘের চেয়ে কম ভয়ংকর রাখা সম্ভব।
প্রায় একই রকমের কথা শুনলাম ঢাকার নিউ ইস্কাটনে এক সবজি বিক্রেতার মুখে। তাঁর বক্তব্য, দেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে, তার গোড়ার কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের সীমাহীন ক্ষমতার দাপট। তারা বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের জন্য কোনো জায়গাই রাখেনি। তাদের দমন-পীড়নে বিএনপি জনগণের চোখের সামনে থেকে প্রায় নাই হয়ে গেছে। তাদের এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি বলা যায়, যার অধিকাংশ নেতাই হয় কারাগারে আছেন, নয়তো গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা এখন এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য যা যা করতে পারেন, তার সবই করবেন।
আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি বিএনপির সমর্থক?’ তিনি বললেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ধানের শিষে, আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন নৌকায়। আমি জানতে চাইলাম, সামনের নির্বাচনে কোন মার্কায় ভোট দেবেন, ধানের শিষে? তিনি হেসে বললেন, ‘ভোটের শিক্ষা আমার হয়া গেছে। আমি আর ভোট-টোটের মধ্যে নাই।’
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নতুন নির্বাচন চায়। রাজধানীর পথেঘাটে, বিপণিবিতানে, ফুটপাতের দোকানে কিংবা রিকশায় যেতে যেতে রিকশাচলকের সঙ্গে আলাপ করে এ রকমই আমার মনে হয়েছে। যেমন রোববার সন্ধ্যায় রিকশায় গ্রিন রোড ধরে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে যেতে যেতে রিকশাচালক কথাচ্ছলে বলছিলেন, ‘খালি কন, ভোট হইব, লগে লগে দেখবেন পেট্টলবোমা মারা বন্ধ হইয়া গেছে। দেখবেন, আর গাড়িতে আগুন দিতাছে না। মানুষ মরতাছে না। মানুষ মারা বন্ধ করতে হইলে ভোট দিতে হইব। যদ্দিন ভোট না হইতাছে, তদ্দিন মানুষ মারা চলতেই থাকব।’
কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ক্রমাগত বলে চলেছে, ২০১৯ সালের এক দিন আগেও তারা নির্বাচন দেবে না। অন্যদিকে, বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর চলমান অবরোধ-হরতালের এক নম্বর লক্ষ্য সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা, নতুন নির্বাচন আদায় করা। দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থানের কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান কীভাবে ঘটবে, তা সম্ভবত এই মুহূর্তে কেউই জানে না। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৮০ পেরিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে মসজিদের প্রাচীর ঘেঁষে রিকশা–ভ্যান শ্রমিক লীগের ব্যানার টানানো। সম্ভবত কোনো সমাবেশের আয়োজন চলছে। কিন্তু লোকসমাগম তখনো শুরু হয়নি। ব্যানার থেকে বেশ দূরে দাঁড়ানো এক যুবকের সঙ্গে কথা শুরু করি, ‘আপনাদের সমাবেশ?’
‘আপনে কে?’ যুবকের জিজ্ঞাসা। আমি নিজের পরিচয় ও আমার পত্রিকার নাম বললাম। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সমাবেশ।’
‘কিসের দাবিতে?’
‘আগুন দিয়ে মানুষ মারার প্রতিবাদে। আপনারা সাংবাদিক, সবই তো জানেন।’
আমি বলি, ‘আপনার কী মনে হয়, বিরোধী দল কেন আগুন দিয়ে মানুষ মারছে?’
‘ভোট চায়, ইলেকশান।’
আমি জানতে চাই, ‘তাদের এই চাওয়াটা কি অন্যায়?’
‘এক বছর আগেই তো ভোট হইল, হেরা সেই ভোটে গেল না ক্যান?’
‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে বিএনপি কি তাঁর অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে?’
‘তাইলে এখন ফাল পারতাছে ক্যান? ভোটে না গিয়া এখন আবার ভোটের জন্য মানুষ মারতাছে ক্যান? শালারা মানুষ মাইরা ভোট আদায় করব! খারাপ পাট্টি!’
‘আপনার কি মনে হয় না, নির্বাচন হলে দেশে শান্তি ফিরে আসত?’
‘দুই হাজার উনিশ সালের আগে ইলেকশান নাই।’
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উল্টো দিকের ফুটপাতে এক দোকানি আমাকে বললেন, আওয়ামী লীগ এমন একগুঁয়ে একটা দল যে বিএনপি যদি নির্বাচনের দাবিতে হাজার হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারে, তবু এখন নির্বাচন দেবে না। কারণ, আওয়ামী লীগ জানে, নির্বাচন হলেই তারা বিএনপির কাছে গো-হারা হেরে যাবে। সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না, তাতে আওয়ামী লীগের কী? তাদের তো খাওয়াদাওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। পেট্রলবোমায় পুড়ে মরছে তো সাধারণ মানুষ। দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের কিচ্ছু যাবে–আসবে না। তারা বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থেকে যাবে।
লোকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রধানত যে মতটা পাওয়া গেল, তা হলো, চলমান সহিংসতা বন্ধ করার উপায় একটাই। নির্বাচন হবে, দুই বড় দল ও তাদের নিজ নিজ জোটের শরিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে—এ রকম একটা ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে চলমান সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে, দেশে স্বাভাবিক শান্তি–শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু সেটা হবে সাময়িক একটা সমাধান, যা টেকসই হবে না। ধরা যাক মধ্যবর্তী একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেল। তখন আওয়ামী লীগ কী করবে? বিএনপি-জামায়াত এখন যা করছে, তখন আওয়ামী লীগও কি তা-ই করবে না?
মূল সমস্যাটা হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা গ্রহণযোগ্য স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সে রকম একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সব পক্ষই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। উভয় পক্ষই ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করার মতলবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে তারা যে ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছিল, সেটাই ওই ব্যবস্থাটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তারা যখন নিজেদের রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানায়, তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ব্যবস্থা আর চলবে না। তারপর জরুরি অবস্থার অধীনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় একটা নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু সেই নির্বাচনকে বিএনপি নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে মেনে নেয়নি। তারা মনে করে, ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছে।
এখন দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের দাবি উঠেছে। তারা সংলাপে বসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হোক এবং দেশে এটা নির্বাচন হোক—এটাই প্রধান মত। কিন্তু এ রকম আপাত ফয়সালার কথা ভেবে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, কয়েক বছর পর আবার যখন নির্বাচনের সময় আসবে, তখন ক্ষমতাসীন দল আবারও ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করবে এবং তার ফলে একই সংকট নতুন করে দেখা দেবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর শান্তিপূর্ণভাবে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্থায়ী একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বময় ক্ষমতার সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধানের কথা ভাবতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যার দ্বারা সরকারের ক্ষমতার রাশ টেনে রাখা যাবে। পাকিস্তানের মতো ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক দেশেও অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা কেন তা করতে পারছি না?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
সে লু নারীটির কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনার কান্না দেখে মনে হচ্ছে আপনি উপর্যুপরি দুঃখের শিকার।’
নারী উত্তরে বললেন, ‘আসলেই তা-ই। একদিন এইখানে আমার শ্বশুর বাঘের কবলে পড়ে মারা যান। আমার স্বামীরও মৃত্যু হয়েছে একইভাবে। আর এখন আমার ছেলেকে বাঘে মেরে ফেলল।’
শুনে কনফুসিয়াস তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান না কেন?’
নারী বললেন, ‘যাই না, কারণ এখানে কোনো অত্যাচারী সরকার নাই।’
তখন কনফুসিয়াস বললেন, ‘আমার বৎসরা শোনো, অত্যাচারী সরকার বাঘের চেয়েও ভয়ংকর।’
বার্ট্রান্ড রাসেল ‘দ্য টেমিং অব পাওয়ার’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে এই গল্পটি উল্লেখ করে বলেছেন, সরকার যাতে বাঘের চেয়ে কম ভয়ংকর হয়, সেটা নিশ্চিত করার সমস্যাটি অতি প্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে: সামরিক একনায়কতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক শাসন, গোষ্ঠীতন্ত্র, সাধু-সন্তদের শাসন, গণতন্ত্র ইত্যাদি। মূল লক্ষ্য ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা, শুধু ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সরকারকে বাঘের চেয়ে কম ভয়ংকর রাখা সম্ভব।
প্রায় একই রকমের কথা শুনলাম ঢাকার নিউ ইস্কাটনে এক সবজি বিক্রেতার মুখে। তাঁর বক্তব্য, দেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে, তার গোড়ার কারণ ক্ষমতাসীন সরকারের সীমাহীন ক্ষমতার দাপট। তারা বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের জন্য কোনো জায়গাই রাখেনি। তাদের দমন-পীড়নে বিএনপি জনগণের চোখের সামনে থেকে প্রায় নাই হয়ে গেছে। তাদের এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি বলা যায়, যার অধিকাংশ নেতাই হয় কারাগারে আছেন, নয়তো গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা এখন এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য যা যা করতে পারেন, তার সবই করবেন।
আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি বিএনপির সমর্থক?’ তিনি বললেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ধানের শিষে, আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন নৌকায়। আমি জানতে চাইলাম, সামনের নির্বাচনে কোন মার্কায় ভোট দেবেন, ধানের শিষে? তিনি হেসে বললেন, ‘ভোটের শিক্ষা আমার হয়া গেছে। আমি আর ভোট-টোটের মধ্যে নাই।’
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নতুন নির্বাচন চায়। রাজধানীর পথেঘাটে, বিপণিবিতানে, ফুটপাতের দোকানে কিংবা রিকশায় যেতে যেতে রিকশাচলকের সঙ্গে আলাপ করে এ রকমই আমার মনে হয়েছে। যেমন রোববার সন্ধ্যায় রিকশায় গ্রিন রোড ধরে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে যেতে যেতে রিকশাচালক কথাচ্ছলে বলছিলেন, ‘খালি কন, ভোট হইব, লগে লগে দেখবেন পেট্টলবোমা মারা বন্ধ হইয়া গেছে। দেখবেন, আর গাড়িতে আগুন দিতাছে না। মানুষ মরতাছে না। মানুষ মারা বন্ধ করতে হইলে ভোট দিতে হইব। যদ্দিন ভোট না হইতাছে, তদ্দিন মানুষ মারা চলতেই থাকব।’
কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ক্রমাগত বলে চলেছে, ২০১৯ সালের এক দিন আগেও তারা নির্বাচন দেবে না। অন্যদিকে, বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর চলমান অবরোধ-হরতালের এক নম্বর লক্ষ্য সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা, নতুন নির্বাচন আদায় করা। দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থানের কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান কীভাবে ঘটবে, তা সম্ভবত এই মুহূর্তে কেউই জানে না। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৮০ পেরিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে মসজিদের প্রাচীর ঘেঁষে রিকশা–ভ্যান শ্রমিক লীগের ব্যানার টানানো। সম্ভবত কোনো সমাবেশের আয়োজন চলছে। কিন্তু লোকসমাগম তখনো শুরু হয়নি। ব্যানার থেকে বেশ দূরে দাঁড়ানো এক যুবকের সঙ্গে কথা শুরু করি, ‘আপনাদের সমাবেশ?’
‘আপনে কে?’ যুবকের জিজ্ঞাসা। আমি নিজের পরিচয় ও আমার পত্রিকার নাম বললাম। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সমাবেশ।’
‘কিসের দাবিতে?’
‘আগুন দিয়ে মানুষ মারার প্রতিবাদে। আপনারা সাংবাদিক, সবই তো জানেন।’
আমি বলি, ‘আপনার কী মনে হয়, বিরোধী দল কেন আগুন দিয়ে মানুষ মারছে?’
‘ভোট চায়, ইলেকশান।’
আমি জানতে চাই, ‘তাদের এই চাওয়াটা কি অন্যায়?’
‘এক বছর আগেই তো ভোট হইল, হেরা সেই ভোটে গেল না ক্যান?’
‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে বিএনপি কি তাঁর অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে?’
‘তাইলে এখন ফাল পারতাছে ক্যান? ভোটে না গিয়া এখন আবার ভোটের জন্য মানুষ মারতাছে ক্যান? শালারা মানুষ মাইরা ভোট আদায় করব! খারাপ পাট্টি!’
‘আপনার কি মনে হয় না, নির্বাচন হলে দেশে শান্তি ফিরে আসত?’
‘দুই হাজার উনিশ সালের আগে ইলেকশান নাই।’
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উল্টো দিকের ফুটপাতে এক দোকানি আমাকে বললেন, আওয়ামী লীগ এমন একগুঁয়ে একটা দল যে বিএনপি যদি নির্বাচনের দাবিতে হাজার হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারে, তবু এখন নির্বাচন দেবে না। কারণ, আওয়ামী লীগ জানে, নির্বাচন হলেই তারা বিএনপির কাছে গো-হারা হেরে যাবে। সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না, তাতে আওয়ামী লীগের কী? তাদের তো খাওয়াদাওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। পেট্রলবোমায় পুড়ে মরছে তো সাধারণ মানুষ। দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের কিচ্ছু যাবে–আসবে না। তারা বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থেকে যাবে।
লোকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রধানত যে মতটা পাওয়া গেল, তা হলো, চলমান সহিংসতা বন্ধ করার উপায় একটাই। নির্বাচন হবে, দুই বড় দল ও তাদের নিজ নিজ জোটের শরিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে—এ রকম একটা ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে চলমান সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে, দেশে স্বাভাবিক শান্তি–শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু সেটা হবে সাময়িক একটা সমাধান, যা টেকসই হবে না। ধরা যাক মধ্যবর্তী একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেল। তখন আওয়ামী লীগ কী করবে? বিএনপি-জামায়াত এখন যা করছে, তখন আওয়ামী লীগও কি তা-ই করবে না?
মূল সমস্যাটা হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা গ্রহণযোগ্য স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সে রকম একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সব পক্ষই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। উভয় পক্ষই ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করার মতলবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে তারা যে ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছিল, সেটাই ওই ব্যবস্থাটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তারা যখন নিজেদের রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানায়, তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ব্যবস্থা আর চলবে না। তারপর জরুরি অবস্থার অধীনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় একটা নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু সেই নির্বাচনকে বিএনপি নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে মেনে নেয়নি। তারা মনে করে, ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছে।
এখন দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের দাবি উঠেছে। তারা সংলাপে বসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হোক এবং দেশে এটা নির্বাচন হোক—এটাই প্রধান মত। কিন্তু এ রকম আপাত ফয়সালার কথা ভেবে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, কয়েক বছর পর আবার যখন নির্বাচনের সময় আসবে, তখন ক্ষমতাসীন দল আবারও ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করবে এবং তার ফলে একই সংকট নতুন করে দেখা দেবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর শান্তিপূর্ণভাবে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্থায়ী একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বময় ক্ষমতার সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধানের কথা ভাবতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যার দ্বারা সরকারের ক্ষমতার রাশ টেনে রাখা যাবে। পাকিস্তানের মতো ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক দেশেও অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা কেন তা করতে পারছি না?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments