সংকটের সমাধান বল প্রয়োগে নয় by মামুন আহমেদ
বাংলাদেশের
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটজনক ও গভীর উদ্বেগজনক। যেন এক অনিশ্চিত
গন্তব্যে চলেছি আমরা। রাজনৈতিক আন্দোলন অবরোধ-হরতাল ৬ জানুয়ারি থেকে চলমান।
এতে দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বলা চলে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। অর্থনীতি স্থবির
হয়ে পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়সহ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণী কার্যক্রম চলছে না। এসএসসি ও সমমানের
পরীক্ষার রুটিনে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে অবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে
আছে বলে মনে হচ্ছে না। এরই মধ্যে চলছে সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন,
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা। যার শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ
মানুষ ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী। নিঃসন্দেহে এরই মাঝে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে
উঠেছে। পেট্রোল বোমায় মানুষ মারা হচ্ছে। বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত
হত্যাকাণ্ডেও বাড়ছে লাশের সংখ্যা।
দেশব্যাপী সহিংসতার রূপ যখন ভয়াবহ, তখন সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হলেও তা কমছে না। এমনকি আমরা দেখছি পুলিশের নিরাপত্তায় যখন যানবাহন চলছে, তখনও সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। তাতে ঘোরতর প্রশ্ন, তাহলে এসব করছে কারা?
সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, এসব সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্যে জড়িত অনেকেই সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। অথচ সরকার কেবল বিরোধী দলকে দায়ী করছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এমনকি অনেক এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে অনেক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। তল্পিতল্পা নিয়ে সাধারণ মানুষের অন্যত্র যাওয়ার দৃশ্যও আমরা দেখেছি।
অথচ এই সংকট প্রধানত রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধান না করে যখন সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, তখনই অপরাধী ও অপশক্তি জেগে উঠেছে। এতে চরমভাবে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে।
আমাদের বুঝতে হবে, রাজনৈতিক এই সংকটের মূল কোথায়। এ সংকট তৈরি হয়েছে মূলত সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার ফলে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন সে সংকটের উপলক্ষ হলেও এই প্রহসনমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এটা ছিল সরকারের এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। এ রকম আরও কিছু কর্মকাণ্ড বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছে। আসলে সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করেছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকেই বিরোধী দলের ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি যে অস্বাভাবিক ছিল তা তৎকালীন সরকারও স্বীকার করে নিয়েছিল এবং অনতিবিলম্বে সবার সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও সরকার দিয়েছিল। কিন্তু দেশবাসী অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, সেই সরকারই ক্ষমতাসীন হয়ে তাদেরই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত অনৈতিক সংসদ ও সরকারের কার্যক্রম ৫ বছর অব্যাহত রাখার চেষ্টা ও ঘোষণা করে। সরকারের মন্ত্রীরা নানা সময়েই ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন হবে না_ এ রকম ঘোষণা প্রকাশ্যে দিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী নির্বাচনও একই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বারবার নিজেরাই ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে জোরেশোরে।
সরকারের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে এমন বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে, আন্দোলন করে ভোটাধিকার অর্জন ও সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি অর্জন করা না গেলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের সব পদ্ধতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই বিরোধী জোটের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন এক অর্থে সরকারই অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য করে তুলেছে।
এমনকি ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার তাদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণে বিরোধী দলের যে কোনো কার্যক্রম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। যার ফলে বিএনপিসহ ২০ দলকে তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। তারই সাম্প্রতিক উদাহরণ এ বছরের ৫ জানুয়ারি। যেদিন থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট অবরোধের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই ৫ জানুয়ারিকে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা দিবস বলে তাদের পক্ষ থেকে সভা-সমাবেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু সরকার সে সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ জারি করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস তালাবদ্ধ করে রাখে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সমাবেশে যোগদানে বাধা প্রদান করে। তার কার্যালয় বালুর ট্রাক দিয়ে ঘেরাও করে, এমনকি সেখান থেকে সমাবেশের উদ্দেশে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার ওপর বিষাক্ত পিপার স্প্রে করা হয়।
সরকার কেবল তা করেই ক্ষান্ত হয়নি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিরোধী নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকার সমাবেশে আসতে না পারে সে জন্য সব ধরনের যানবাহন চলাচলে বাধানিষেধ আরোপ করে। যার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ৪ জানুয়ারি থেকেই সরকার প্রথম অবরোধ পালন করে। ৪ ও ৫ তারিখে সরকার যদি এ রকম বাধা সৃষ্টি না করে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিত, তাহলে হয়তো আজকের এ অবস্থা সৃষ্টি হতো না।
সরকার একদিকে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি, অন্যদিকে তারাই বিভিন্ন সময়ে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। যার মাধ্যমে মূলত পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। তারা বিএনপির চলমান কর্মসূচিকে দমন করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে সেখানে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টিভিসহ সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অমানবিক আচরণ করেছে। মনে রাখতে হবে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের চলমান আন্দোলনের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী সব সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। যদিও চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের পদ্ধতি ও চলমান সহিংসতা নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগও আছে।
বিএনপি দাবি করে আসছে, তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং তারা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে সরকার এ আন্দোলনকে সহিংসতা বলে কালিমালিপ্ত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমিয়ে রাখার সব প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার এ আন্দোলনকে সহিংসতা বলে প্রচার করতে চাইলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয় অস্বীকার করার নৈতিক অবস্থান তাদের নেই। সরকার ও বিরোধী শিবিরের পরস্পরমুখী অনড় অবস্থান দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক জীবনসহ আমাদের সব অর্জন ও সফলতা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশপ্রেমিক যে কোনো মানুষ অতিদ্রুত এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
দেশের চলমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সুতরাং এর সমাধান একমাত্র সম্ভব রাজনৈতিকভাবেই। যেহেতু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক এই সংকটের সূত্রপাত করেছে সরকার, তাই এর সমাধানের চাবিকাঠি একমাত্র সরকারের হাতেই রয়েছে। বিরোধী দলকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো শুভ উদ্যোগকে সহায়তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বলে বিরোধী দল দমন করে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে কালিমা লেপন করে কোনো লাভ হবে না।
তাই এই মুহূর্তে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনমূলক মামলা প্রত্যাহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা যত দ্রুত করা যায়, তত দ্রুত আমরা এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
দেশব্যাপী সহিংসতার রূপ যখন ভয়াবহ, তখন সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হলেও তা কমছে না। এমনকি আমরা দেখছি পুলিশের নিরাপত্তায় যখন যানবাহন চলছে, তখনও সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। তাতে ঘোরতর প্রশ্ন, তাহলে এসব করছে কারা?
সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, এসব সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্যে জড়িত অনেকেই সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। অথচ সরকার কেবল বিরোধী দলকে দায়ী করছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এমনকি অনেক এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে অনেক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। তল্পিতল্পা নিয়ে সাধারণ মানুষের অন্যত্র যাওয়ার দৃশ্যও আমরা দেখেছি।
অথচ এই সংকট প্রধানত রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধান না করে যখন সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, তখনই অপরাধী ও অপশক্তি জেগে উঠেছে। এতে চরমভাবে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে।
আমাদের বুঝতে হবে, রাজনৈতিক এই সংকটের মূল কোথায়। এ সংকট তৈরি হয়েছে মূলত সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার ফলে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন সে সংকটের উপলক্ষ হলেও এই প্রহসনমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এটা ছিল সরকারের এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। এ রকম আরও কিছু কর্মকাণ্ড বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছে। আসলে সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করেছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকেই বিরোধী দলের ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি যে অস্বাভাবিক ছিল তা তৎকালীন সরকারও স্বীকার করে নিয়েছিল এবং অনতিবিলম্বে সবার সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও সরকার দিয়েছিল। কিন্তু দেশবাসী অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, সেই সরকারই ক্ষমতাসীন হয়ে তাদেরই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত অনৈতিক সংসদ ও সরকারের কার্যক্রম ৫ বছর অব্যাহত রাখার চেষ্টা ও ঘোষণা করে। সরকারের মন্ত্রীরা নানা সময়েই ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন হবে না_ এ রকম ঘোষণা প্রকাশ্যে দিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী নির্বাচনও একই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বারবার নিজেরাই ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে জোরেশোরে।
সরকারের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে এমন বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে, আন্দোলন করে ভোটাধিকার অর্জন ও সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি অর্জন করা না গেলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের সব পদ্ধতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই বিরোধী জোটের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন এক অর্থে সরকারই অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য করে তুলেছে।
এমনকি ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার তাদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণে বিরোধী দলের যে কোনো কার্যক্রম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। যার ফলে বিএনপিসহ ২০ দলকে তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। তারই সাম্প্রতিক উদাহরণ এ বছরের ৫ জানুয়ারি। যেদিন থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট অবরোধের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই ৫ জানুয়ারিকে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা দিবস বলে তাদের পক্ষ থেকে সভা-সমাবেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু সরকার সে সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ জারি করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস তালাবদ্ধ করে রাখে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সমাবেশে যোগদানে বাধা প্রদান করে। তার কার্যালয় বালুর ট্রাক দিয়ে ঘেরাও করে, এমনকি সেখান থেকে সমাবেশের উদ্দেশে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার ওপর বিষাক্ত পিপার স্প্রে করা হয়।
সরকার কেবল তা করেই ক্ষান্ত হয়নি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিরোধী নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকার সমাবেশে আসতে না পারে সে জন্য সব ধরনের যানবাহন চলাচলে বাধানিষেধ আরোপ করে। যার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ৪ জানুয়ারি থেকেই সরকার প্রথম অবরোধ পালন করে। ৪ ও ৫ তারিখে সরকার যদি এ রকম বাধা সৃষ্টি না করে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিত, তাহলে হয়তো আজকের এ অবস্থা সৃষ্টি হতো না।
সরকার একদিকে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি, অন্যদিকে তারাই বিভিন্ন সময়ে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। যার মাধ্যমে মূলত পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। তারা বিএনপির চলমান কর্মসূচিকে দমন করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে সেখানে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টিভিসহ সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অমানবিক আচরণ করেছে। মনে রাখতে হবে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের চলমান আন্দোলনের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী সব সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। যদিও চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের পদ্ধতি ও চলমান সহিংসতা নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগও আছে।
বিএনপি দাবি করে আসছে, তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং তারা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে সরকার এ আন্দোলনকে সহিংসতা বলে কালিমালিপ্ত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমিয়ে রাখার সব প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার এ আন্দোলনকে সহিংসতা বলে প্রচার করতে চাইলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয় অস্বীকার করার নৈতিক অবস্থান তাদের নেই। সরকার ও বিরোধী শিবিরের পরস্পরমুখী অনড় অবস্থান দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক জীবনসহ আমাদের সব অর্জন ও সফলতা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশপ্রেমিক যে কোনো মানুষ অতিদ্রুত এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
দেশের চলমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সুতরাং এর সমাধান একমাত্র সম্ভব রাজনৈতিকভাবেই। যেহেতু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক এই সংকটের সূত্রপাত করেছে সরকার, তাই এর সমাধানের চাবিকাঠি একমাত্র সরকারের হাতেই রয়েছে। বিরোধী দলকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো শুভ উদ্যোগকে সহায়তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বলে বিরোধী দল দমন করে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে কালিমা লেপন করে কোনো লাভ হবে না।
তাই এই মুহূর্তে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনমূলক মামলা প্রত্যাহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা যত দ্রুত করা যায়, তত দ্রুত আমরা এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
No comments