গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগে অরাজকতা সৃষ্টি নয় by জিল্লুর রহমান খান
যুক্তরাষ্ট্রের
পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত
সহিংসতাকে 'অযৌক্তিক' হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা করেছে। এতে বলা
হয়_ বাসে আগুন দেওয়া, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ, ট্রেন লাইনচ্যুত করাসহ
নাশকতার ঘটনার শিকার হচ্ছে নিরীহ লোকজন। বারাক ওবামার ভারত সফরের পরপরই
এসেছে এবং স্পষ্টতই এতে রাজনীতির নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার কঠোর নিন্দা
জানানো হয়েছে। এভাবে রাজনীতির জন্য নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা কখনও
বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেনি। পেট্রোল বোমায় ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক
নারী-পুরুষ-শিশুর করুণ মৃত্যু হয়েছে। আরও শতাধিক দগ্ধ হয়েছেন। তাদের
রোগযন্ত্রণা অবর্ণনীয়। হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিট পোড়া মানুষের গন্ধ ও
রোগী-স্বজনের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে। সবারই প্রশ্ন, এর শেষ কোথায়?
আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারার নিষ্ঠুরতার অবসান কবে ঘটবে? রাজনীতির
পর্যবেক্ষণ যারা করেন তারা জানেন স্থিতিশীলতা ব্যতিরেকে উন্নয়ন সম্ভব নয়। ৮
ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মাত্র ১৫
মিনিটের জন্য পথে নেমেছিলেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত এসব ব্যক্তি কেন
পথে নামবেন? প্রকৃতপক্ষে তারা বাধ্য হয়েছেন। তারা জানেন যে, বর্তমান সময়ে
সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। যারা সহিংসতার পথে
সমাধান চাইছে, তাদের অবশ্যই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব তাদের দেশেও এ ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করছে।
বাংলাদেশ যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম, সেটা তারা উপলব্ধি করতে
পারছে। নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য উন্নয়নের মডেল হতে
পারে। গত কয়েক বছরে তারা প্রতিকূলতা জয় করে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব
লক্ষ্য অর্জন করেছে এবং আরও উন্নত পর্যায়ে যেতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, তা মোটেই
স্বপ্নকল্প নয়। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায়
রাখা। বিরোধী মতপ্রকাশের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত
একটিই_ গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করা চলবে না।
যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা এটাই দেখি। তাদেরকেও 'মব' নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
নিউইয়র্ক, ডেনভার, মিসৌরি প্রভৃতি স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা ঘটেছে।
বারাক ওবামার দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মারণাস্ত্রের যেমন অভাব নেই,
তেমনি রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও শক্তিশালী। তারপরও
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত
দেশে অশান্তি সৃষ্টিতে সক্রিয়দের মোকাবেলার কাজটি কত কঠিন, সেটা তারা
উপলব্ধি করতে পারে।
যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে বাক্-স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। মতপ্রকাশের সুযোগ দিতেই হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর যেতে না যেতেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু ঘটে। তার অবর্তমানে গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত রচনার কাজ বিঘি্নত হয়। দেশটিতে বারবার সামরিক শাসন জারি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের অধিকার তারা মেনে নিতে চায়নি। ১৯৭১ সালে সে দেশের সেনাবাহিনী নির্বাচনের রায় বানচালের জন্য গণহত্যার পথ বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। দেশটিতে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে এবং এখন প্রতিদিন অশান্তি আমরা দেখছি। বাংলাদেশে এখন যে অশান্তি চলছে তার পেছনে আইসিএসের মতো উগ্রবাদী শক্তির ইন্ধন থাকা অসম্ভব নয়। দেশের নানা প্রান্তে হামলা চলছে সাধারণ মানুষের ওপর। কে এদের বোমা বানানোর কৌশল শেখাচ্ছে? কারা অর্থ দিচ্ছে? এ ধরনের শক্তিকে মোকাবেলার কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও আমরা বিব্রত হতে দেখেছি। প্রশ্ন উঠছে, বাক্-স্বাধীনতা কতটা দেওয়া হবে? সহিংসতার পক্ষে কাউকে কি প্রচারণার সুযোগ দেওয়া হবে? সেখানেও কিন্তু এখন বলা হচ্ছে_ স্বাধীনতা দাও, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখ। স্থিতিশীলতা চাইলে এর বিকল্প নেই।
ভোটের অধিকার গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেসব দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ভারতকে ব্যতিক্রম বলতে পারি। সেখানে যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারছে তার পেছনে টিএন সেশনের অবদান রয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে এমন সব বিধিবিধান বলবৎ করতে সক্ষম হন, যা কেবল ভারতের জনগণের কাছে নয় বিশ্বের সর্বত্রই নন্দিত হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে বিচার বিভাগের প্রতিও জনগণের আস্থা রয়েছে। অনুন্নত দেশগুলোর কাছে ভারত অবশ্যই তার বেছে নেওয়া পথের জন্য মডেল হতে পারে। সেখানের নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনের কাজেও এ ধরনের স্বচ্ছতা দেখি। তারপরও কিন্তু ওই দুটি দেশেও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর বাংলাদেশে তো এখন পর্যন্ত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের যাত্রাই শুরু হয়নি। পাকিস্তানের সময়টি কেটেছে সামরিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনে। ১৯৭০ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তার রায় ভণ্ডুল করা হয়েছে। কেন শেখ মুজিবুর রহমানের দল ওই নির্বাচনে এত বেশি সংখ্যক আসন পেল, সেজন্য ইয়াহিয়া খানকে ভর্ৎসনা করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। বাঙালিদের এভাবে জয় যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। তার বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হচ্ছে সেটা তিনি জানতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে একটি গবেষণা কাজের জন্য কথা বলতে গেলে আমি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন রাখি। তার ধানমণ্ডির বাড়ি ছিল একেবারেই অরক্ষিত। এ প্রশ্ন তুলতেই তিনি তার একজন স্টাফকে উদ্দেশ করে বলেন, 'দেখ, আমেরিকান প্রফেসর কী বলছে। রাশিয়ার দূতও তো একই কথা বলে গেছে।' তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনো বাঙালি তার ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু আমি মনে করি, তার জীবনের এটি ছিল বড় ভুল। সে সময়ে দেশে অশান্তি সৃষ্টির জন্য নকশাল ও ইসলামপন্থি কিছু শক্তি একজোট হয়। আওয়ামী লীগের শত শত লোককে তারা টার্গেট করে হত্যা করে। তিনি জরুরি আইন জারি ও একক দল বাকশাল গঠন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ পদক্ষেপে অনেক ইতিবাচক দিক ছিল। যেমন, জেলায় জেলায় নির্বাচিত গভর্নরের হাতে মূল ক্ষমতা অর্পণ। স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করার জন্যও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, সব শক্তি এক হলে দেশের উন্নতি হবেই। কিন্তু তিনি তো নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই দুর্বল করে রেখেছিলেন। কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশের সব দল একত্র হয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনল। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার জন্য তখন থেকেই দাবি ওঠে। তবে এখন পর্যন্ত তা পূর্ণতা পায়নি। এজন্য কিছু ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। যেমন, কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে এবং তা কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না। কেউ কোনো অভিযোগ তুললে তার যথোপযুক্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ভার থাকবে এই কমিশনের হাতেই। এজন্য একটি সোশাল কন্ট্রাক্ট আবশ্যক।
আমি মনে করি যে, জাতীয় সংসদের একটি আপার হাউসও এখন সময়ের দাবি। নিম্নপরিষদ বর্তমান জাতীয় সংসদের মতোই গঠিত হবে। কিন্তু আপার হাউস হবে সিনেট ধরনের, যাতে পেশাজীবী, বিচার বিভাগ প্রভৃতি নানা স্থান থেকে সদস্যরা আসবেন। আমাদের বেশ কিছু কমিশন কাজ করছে। যেমন_ দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন। এগুলোকে এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তাদের মানুষের আস্থায় কোনো ঘাটতি না থাকে, বরং দিন দিন বেড়ে যায়।
সামরিক শাসন আমরা দেখেছি। এ পথে বাংলাদেশের উন্নতি নেই। স্থিতিশীলতা জরুরি। এখন ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামের নামে সক্রিয় আরও কিছু সক্রিয় গোষ্ঠী সহিংসতার পথে চলছে। স্বাধীন মত তাদের পছন্দ নয়। এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধে চাই গণজাগরণ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, এ নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; প্রফেসর ইমেরিটাস ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, যুক্তরাষ্ট্র
যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে বাক্-স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। মতপ্রকাশের সুযোগ দিতেই হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর যেতে না যেতেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু ঘটে। তার অবর্তমানে গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত রচনার কাজ বিঘি্নত হয়। দেশটিতে বারবার সামরিক শাসন জারি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের অধিকার তারা মেনে নিতে চায়নি। ১৯৭১ সালে সে দেশের সেনাবাহিনী নির্বাচনের রায় বানচালের জন্য গণহত্যার পথ বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। দেশটিতে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে এবং এখন প্রতিদিন অশান্তি আমরা দেখছি। বাংলাদেশে এখন যে অশান্তি চলছে তার পেছনে আইসিএসের মতো উগ্রবাদী শক্তির ইন্ধন থাকা অসম্ভব নয়। দেশের নানা প্রান্তে হামলা চলছে সাধারণ মানুষের ওপর। কে এদের বোমা বানানোর কৌশল শেখাচ্ছে? কারা অর্থ দিচ্ছে? এ ধরনের শক্তিকে মোকাবেলার কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও আমরা বিব্রত হতে দেখেছি। প্রশ্ন উঠছে, বাক্-স্বাধীনতা কতটা দেওয়া হবে? সহিংসতার পক্ষে কাউকে কি প্রচারণার সুযোগ দেওয়া হবে? সেখানেও কিন্তু এখন বলা হচ্ছে_ স্বাধীনতা দাও, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখ। স্থিতিশীলতা চাইলে এর বিকল্প নেই।
ভোটের অধিকার গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেসব দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ভারতকে ব্যতিক্রম বলতে পারি। সেখানে যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারছে তার পেছনে টিএন সেশনের অবদান রয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে এমন সব বিধিবিধান বলবৎ করতে সক্ষম হন, যা কেবল ভারতের জনগণের কাছে নয় বিশ্বের সর্বত্রই নন্দিত হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে বিচার বিভাগের প্রতিও জনগণের আস্থা রয়েছে। অনুন্নত দেশগুলোর কাছে ভারত অবশ্যই তার বেছে নেওয়া পথের জন্য মডেল হতে পারে। সেখানের নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনের কাজেও এ ধরনের স্বচ্ছতা দেখি। তারপরও কিন্তু ওই দুটি দেশেও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর বাংলাদেশে তো এখন পর্যন্ত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের যাত্রাই শুরু হয়নি। পাকিস্তানের সময়টি কেটেছে সামরিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনে। ১৯৭০ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তার রায় ভণ্ডুল করা হয়েছে। কেন শেখ মুজিবুর রহমানের দল ওই নির্বাচনে এত বেশি সংখ্যক আসন পেল, সেজন্য ইয়াহিয়া খানকে ভর্ৎসনা করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। বাঙালিদের এভাবে জয় যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। তার বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হচ্ছে সেটা তিনি জানতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে একটি গবেষণা কাজের জন্য কথা বলতে গেলে আমি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন রাখি। তার ধানমণ্ডির বাড়ি ছিল একেবারেই অরক্ষিত। এ প্রশ্ন তুলতেই তিনি তার একজন স্টাফকে উদ্দেশ করে বলেন, 'দেখ, আমেরিকান প্রফেসর কী বলছে। রাশিয়ার দূতও তো একই কথা বলে গেছে।' তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনো বাঙালি তার ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু আমি মনে করি, তার জীবনের এটি ছিল বড় ভুল। সে সময়ে দেশে অশান্তি সৃষ্টির জন্য নকশাল ও ইসলামপন্থি কিছু শক্তি একজোট হয়। আওয়ামী লীগের শত শত লোককে তারা টার্গেট করে হত্যা করে। তিনি জরুরি আইন জারি ও একক দল বাকশাল গঠন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ পদক্ষেপে অনেক ইতিবাচক দিক ছিল। যেমন, জেলায় জেলায় নির্বাচিত গভর্নরের হাতে মূল ক্ষমতা অর্পণ। স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করার জন্যও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, সব শক্তি এক হলে দেশের উন্নতি হবেই। কিন্তু তিনি তো নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই দুর্বল করে রেখেছিলেন। কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশের সব দল একত্র হয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনল। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার জন্য তখন থেকেই দাবি ওঠে। তবে এখন পর্যন্ত তা পূর্ণতা পায়নি। এজন্য কিছু ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। যেমন, কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে এবং তা কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না। কেউ কোনো অভিযোগ তুললে তার যথোপযুক্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ভার থাকবে এই কমিশনের হাতেই। এজন্য একটি সোশাল কন্ট্রাক্ট আবশ্যক।
আমি মনে করি যে, জাতীয় সংসদের একটি আপার হাউসও এখন সময়ের দাবি। নিম্নপরিষদ বর্তমান জাতীয় সংসদের মতোই গঠিত হবে। কিন্তু আপার হাউস হবে সিনেট ধরনের, যাতে পেশাজীবী, বিচার বিভাগ প্রভৃতি নানা স্থান থেকে সদস্যরা আসবেন। আমাদের বেশ কিছু কমিশন কাজ করছে। যেমন_ দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন। এগুলোকে এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তাদের মানুষের আস্থায় কোনো ঘাটতি না থাকে, বরং দিন দিন বেড়ে যায়।
সামরিক শাসন আমরা দেখেছি। এ পথে বাংলাদেশের উন্নতি নেই। স্থিতিশীলতা জরুরি। এখন ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামের নামে সক্রিয় আরও কিছু সক্রিয় গোষ্ঠী সহিংসতার পথে চলছে। স্বাধীন মত তাদের পছন্দ নয়। এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধে চাই গণজাগরণ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, এ নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; প্রফেসর ইমেরিটাস ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, যুক্তরাষ্ট্র
No comments