সাধারণ এক মানুষের অসাধারণ বিজয় by সুভাষ সাহা ও নুরুল ইসলাম
একজন
অতি সাধারণ মানুষের অসাধারণ এক ঐতিহাসিক বিজয়। স্তম্ভিত দিলি্লবাসী। সকালে
ঘুম থেকে উঠেই কেজরিওয়াল-সুনামি। ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এ
রাজনৈতিক সুনামিতে ভেসে গেল বিজেপি ও কংগ্রেস। টেলিভিশন পর্দায় ভারতবর্ষের
জনগণসহ গোটা বিশ্ববাসী দেখল, 'কামব্যাক ম্যান' অরবিন্দ কেজরিওয়াল-ম্যাজিক।
মাত্র নয় মাস আগে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে উঠেছিল মোদি-ওয়েভ। কে জানত, এত
অল্প সময়ের মধ্যেই তা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। জনমত জরিপগুলো পর্যন্ত আঁচ
করতে পারল না, কী ম্যাজিক না দেখাতে যাচ্ছেন কেজরিওয়াল! বুথফেরত জরিপেও
মিলল না তার কোনো আভাস-ইঙ্গিত। ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দিলি্ল বিধানসভা
নির্বাচনে কংগ্রেস-বিজেপিকে সাফ করে দিয়ে সাধারণ মানুষ অরবিন্দ কেজরিওয়াল
পেলেন এক অসাধারণ বিজয়। দিলি্ল বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে তিনটি ছাড়া সব
কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির দখলে। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি পেয়েছে মাত্র দুটি আসন। বিজেপির মিত্র আকালি দল
পেয়েছে বাকি একটি। টানা দ্বিতীয়বার দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন অরবিন্দ
কেজরিওয়াল। এর আগে ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি
পর্যন্ত ৪৯ দিন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন এই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও
সাবেক সরকারি চাকুরে। সে সময় কংগ্রেসের সমর্থনে কেজরিওয়াল ছিলেন সংখ্যালঘু
সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে দুর্র্নীতিবিরোধী
লোকায়ুক্ত বিল পাসে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। তার পর থেকে
দিলি্লতে ছিল রাষ্ট্রপতির শাসন।
এই ঐতিহাসিক জয় দিলি্লবাসীকে উৎসর্গ করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, যে অভাবনীয় সমর্থন তার দল পেয়েছে, তা 'ভয় পাওয়ার মতো'। দিলি্লর প্যাটেল নগরে দলের সদর দপ্তরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কেজরিওয়াল বলেন, 'আমি দলের সব বিধায়ক ও সমর্থককে অনুরোধ জানাই, আপনারা মোটেই অতি উল্লসিত ও উদ্ধত হবেন না। কারণ, এর আগে উদ্ধত হয়ে কংগ্রেস হারিয়ে গেছে। এবার বিজেপির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটল।'কেজরিওয়াল বলেন, 'দিলি্লবাসী তাক লাগানো একটা ফল অর্জন করেছে। আমি তাদের স্যালুট জানাই। এটা সত্যের জয়। আমি নিশ্চিত, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দিলি্লকে গর্ব করার মতো স্থানে পরিণত করতে সক্ষম হবো। তবে আমি একা সবকিছু করতে পারব না। আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ।'
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকেই বেছে নিয়েছেন কেজরিওয়াল; গত বছর যে দিনটাতে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। নিজ আসন নয়াদিলি্লতে বিজেপির নূপুর শর্মাকে ৩০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন কেজরিওয়াল (কেজরিওয়াল ৫৭ হাজার, নূপুর ২৫ হাজার)।আমি নই, হেরেছে বিজেপি :নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি ২৮-৩৯, বিজেপি ২২-২৭ এবং কংগ্রেস তিন থেকে পাঁচটি আসন পাবে বলে মোটামুটি আভাস দেওয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের পর বুথফেরত জরিপে আম আদমি ৪৯ আসন পর্যন্ত পেতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল গতকাল ফল প্রকাশের পর। তবে দলের শোচনীয় পরাজয়ের দায় নিজ কাঁধে তুলে নিতে অস্বীকার করেছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী কিরণ বেদি। বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী কিরণ বেদি বলেন, 'এ নির্বাচনে আমি হারিনি, হেরেছে বিজেপি। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিজেপি একটি জাতীয় দল। তাদের উচিত, এ পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করা।' যদিও এর আগে কিরণ বেদি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'দল (বিজেপি) জিতলে তা হবে দলের সবার বিজয়। আর হারলে তার দায় নেব আমি নিজে।'বিজেপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নিজ আসন কৃষ্ণনগরে আম আদমির অখ্যাত এস কে বাগগার কাছে হেরেছেন কিরণ বেদি। তবে কিরণসহ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা মানতে নারাজ, এ পরাজয়ে 'মোদি-ওয়েভ' একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। দলের অন্যতম মুখপাত্র শাহনেওয়াজ বলেন, 'নানা কারণে আমাদের পরাজয় হয়েছে। তবে আমরা হতাশ নই। সামনের নির্বাচনগুলোতে আমরাই জিতব, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে।' আর মোদিকে এ পরাজয়ের দায় থেকে আড়াল করে কিরণ বেদি বলেন, তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন না। তাহলে তার কথা আসছে কেন?
কংগ্রেস 'নো প্লেয়ার' :২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদ দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছিল কংগ্রেসের দখলে। এবার একটি আসনও পেল না সর্বভারতীয় এ দলটি। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বড় বিধানসভায় কংগ্রেস হয়ে গেল 'নো প্লেয়ার'। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো বিরোধী দল এক-দশমাংশ আসন না পাওয়ায় কেন্দ্রের মতো দিলি্ল বিধানসভায়ও এবার থাকছেন না কোনো বিরোধীদলীয় নেতা।কেন এই বিপুল বিজয়দিলি্ল বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির পক্ষে এমন বিপুল বিজয় অর্জন সম্ভব হলো কীভাবে? প্রধান কারণ, দিলি্লতে কংগ্রেসের পায়ের নিচের মাটি পুরোপুরি সরে যাওয়া। হিন্দুস্তান টাইমস ও এনডিটিভির বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০১৩ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস যে ২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তার উল্লেখযোগ্য অংশ এবার আম আদমির পক্ষে চলে যাওয়ায় কেজরিওয়ালের ভূমিধস বিজয় সহজ হয়েছে। তা ছাড়া কেজরিওয়ালের সাধারণ জীবন, দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থান, বিজেপির আক্রমণাত্মক নির্বাচনী প্রচারও আম আদমির বিস্ময়কর বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষণে বলা হয়, বিজেপি যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় রয়েছে, সেখানে নানা উপলক্ষে কট্টর ধর্মীয় সংগঠন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে'র (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্য এবং সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টাকে আমজনতা ভালো চোখে দেখেননি। তারা মোদিকে উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। ভারতের জনগণ ধর্মভীরু হলেও তারা চান না, কোনোমতেই রাষ্ট্রশাসনে ধর্মগুরুরা নাক গলান। বিজেপি এই কঠিন সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছে কি! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিন্তু এসব ধর্মীয় সংগঠনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য বলিষ্ঠভাবে চ্যালেঞ্জ জানাননি। মাঝেমধ্যেই কোনো না কোনো ধর্মীয়, এমনকি কিছু কিছু বিজেপি নেতার সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট বক্তব্য মোদি সরকারের ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছে, যে কারণে দিলি্লর সাধারণ মানুষ মোদির ব্যাপারেও সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া মোদির এখন সার্বক্ষণিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্য সময় ও এনার্জি ব্যয় করার কথা। তিনি কেন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির প্রধান মুখ হতে যাবেন? দিলি্লর মানুষ এটাও পছন্দ করেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা ভূমি অধিগ্রহণ আইনও দিলি্লর গ্রামীণ বিপুলসংখ্যক ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা শঙ্কিত, এর মাধ্যমে তাদের জমি বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অন্যের হাতে চলে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে 'শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ'কে কেন্দ্র করে বামফ্রন্টের ৩২ বছরের শাসনকে মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন ভোটাররা। কেজরিওয়াল এ ইস্যুকে ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণে আম আদমি পার্টি শহরের চেয়েও গ্রামাঞ্চলে বেশি ভোট পেয়েছে। এমনকি শহরের গরিবদের পাশাপাশি ধনীরাও এবার ভোট দিয়েছে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে, যে ধনীরা গত নির্বাচনে ছিল বিজেপির পক্ষে। নয়াদিলি্ল, আরকে পুরম, গ্রেটার কৈলাস, মালবিয়া নগরের মতো বিলাসবহুল এলাকাগুলোতেও এবার জিতেছে আম আদমি।
৪৯ দিনের দিলি্ল শাসনে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করে দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। দিলি্ল পুলিশের ঘুষ গ্রহণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিলেন। এতে অটোচালক থেকে রাস্তায় ঘুমানো দিনমজুর পর্যন্ত উপকৃত হন। বস্তি এলাকার লোকজনের ঘর নির্মাণেও আম আদমি পার্টির অগুনতি সমর্থক হাত লাগান। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভাবতে শেখে, তাদের অধিকার আদায় ও জীবন-জীবিকাকে নিরাপদ করতে হলে কেজরিওয়াল শাসন মডেলই উত্তম।এটা ঠিক, গত বছর কেজরিওয়ালের হঠাৎ দিলি্লর ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াটা সাধারণ ভোটার জনগণ সহজভাবে নেননি। তখন কেজরিওয়ালের সমালোচনায় মুখর হন সবাই। কিন্তু জনগণকে বোঝানোর ক্ষেত্রে নিরন্তন প্রচেষ্টা চালান অদম্য কেজরিওয়াল। আর কংগ্রেসের দোলাচল অবস্থা, মোদির সুশাসনের প্রতিশ্রুতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পাওয়া ও জনগণের উপকারে আসা সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণে ধীরগতি আম আদমির নীরব জনপ্রিয়তাকে করে আকাশচুম্বী। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে ব্যাপারে নানা অজুহাতে মোদির বিলম্ব, সর্বোপরি ভূমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স এবং হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির রাশ টেনে ধরতে ব্যর্থতার কারণে কেজরিওয়ালের দিকে জনগণ দৃষ্টি ফেরায়। গত বছর আকস্মিক ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিনি দিলি্লর জনগণের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করেন। এটাও মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। শাসন পরিচালনা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতার কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেন। মানুষের মনে তার এসব স্বীকারোক্তি দাগ কাটতে সমর্থ হয়। তারা ভাবে, কেজরিওয়াল তো আমাদেরই লোক।
মোদি-অমিত শাহ টিমের আরও একটি গুরুতর ভুল হলো, তারা কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে কিরণ বেদিসহ নাগরিক আন্দোলনের দু'জন নারী নেত্রীকে দলে নেন। কিন্তু কিরণ বেদি যে কোনোভাবেই কেজরিওয়ালের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নন, তা তিনি প্রায় প্রতিটি টিভি অনুষ্ঠানেই প্রমাণ করেছেন; বরং শেষ মুহূর্তে দলে নেওয়া ও কিরণ বেদিকে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করাটা বিজেপির বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে। অন্যদিকে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সফলতার জন্য জনগণ মোদির প্রশংসা করলেও ওবামার সঙ্গে ১০ লাখ টাকার সুট পরাটা তার ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
গত বছর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর থেকেই পুনর্নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন কেজরিওয়াল। নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে ঘোরেন ভোটারের দ্বারে দ্বারে। সে তুলনায় বিজেপির প্রস্তুতি ছিল স্বল্প সময়ের। শুধু কংগ্রেস নয়, মুসলিমদের ভোটও একচেটিয়া পড়েছে আম আদমির বাক্সে। দলটির জয়ের পেছনে এসব ফ্যাক্টরও রেখেছে বড় ভূমিকা। তা ছাড়া গত লোকসভা নির্বাচনে দিলি্লতে সাতটি আসনের সবক'টি পেয়ে খুশিতে গদগদ ছিল বিজেপি। ভেবেছিল, বিধানসভায়ও তার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ভোটাররা ভেবেছেন উল্টোটা।
এই ঐতিহাসিক জয় দিলি্লবাসীকে উৎসর্গ করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, যে অভাবনীয় সমর্থন তার দল পেয়েছে, তা 'ভয় পাওয়ার মতো'। দিলি্লর প্যাটেল নগরে দলের সদর দপ্তরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কেজরিওয়াল বলেন, 'আমি দলের সব বিধায়ক ও সমর্থককে অনুরোধ জানাই, আপনারা মোটেই অতি উল্লসিত ও উদ্ধত হবেন না। কারণ, এর আগে উদ্ধত হয়ে কংগ্রেস হারিয়ে গেছে। এবার বিজেপির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটল।'কেজরিওয়াল বলেন, 'দিলি্লবাসী তাক লাগানো একটা ফল অর্জন করেছে। আমি তাদের স্যালুট জানাই। এটা সত্যের জয়। আমি নিশ্চিত, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দিলি্লকে গর্ব করার মতো স্থানে পরিণত করতে সক্ষম হবো। তবে আমি একা সবকিছু করতে পারব না। আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ।'
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকেই বেছে নিয়েছেন কেজরিওয়াল; গত বছর যে দিনটাতে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। নিজ আসন নয়াদিলি্লতে বিজেপির নূপুর শর্মাকে ৩০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন কেজরিওয়াল (কেজরিওয়াল ৫৭ হাজার, নূপুর ২৫ হাজার)।আমি নই, হেরেছে বিজেপি :নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি ২৮-৩৯, বিজেপি ২২-২৭ এবং কংগ্রেস তিন থেকে পাঁচটি আসন পাবে বলে মোটামুটি আভাস দেওয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের পর বুথফেরত জরিপে আম আদমি ৪৯ আসন পর্যন্ত পেতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল গতকাল ফল প্রকাশের পর। তবে দলের শোচনীয় পরাজয়ের দায় নিজ কাঁধে তুলে নিতে অস্বীকার করেছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী কিরণ বেদি। বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী কিরণ বেদি বলেন, 'এ নির্বাচনে আমি হারিনি, হেরেছে বিজেপি। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিজেপি একটি জাতীয় দল। তাদের উচিত, এ পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করা।' যদিও এর আগে কিরণ বেদি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'দল (বিজেপি) জিতলে তা হবে দলের সবার বিজয়। আর হারলে তার দায় নেব আমি নিজে।'বিজেপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নিজ আসন কৃষ্ণনগরে আম আদমির অখ্যাত এস কে বাগগার কাছে হেরেছেন কিরণ বেদি। তবে কিরণসহ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা মানতে নারাজ, এ পরাজয়ে 'মোদি-ওয়েভ' একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। দলের অন্যতম মুখপাত্র শাহনেওয়াজ বলেন, 'নানা কারণে আমাদের পরাজয় হয়েছে। তবে আমরা হতাশ নই। সামনের নির্বাচনগুলোতে আমরাই জিতব, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে।' আর মোদিকে এ পরাজয়ের দায় থেকে আড়াল করে কিরণ বেদি বলেন, তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন না। তাহলে তার কথা আসছে কেন?
কংগ্রেস 'নো প্লেয়ার' :২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদ দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছিল কংগ্রেসের দখলে। এবার একটি আসনও পেল না সর্বভারতীয় এ দলটি। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বড় বিধানসভায় কংগ্রেস হয়ে গেল 'নো প্লেয়ার'। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো বিরোধী দল এক-দশমাংশ আসন না পাওয়ায় কেন্দ্রের মতো দিলি্ল বিধানসভায়ও এবার থাকছেন না কোনো বিরোধীদলীয় নেতা।কেন এই বিপুল বিজয়দিলি্ল বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির পক্ষে এমন বিপুল বিজয় অর্জন সম্ভব হলো কীভাবে? প্রধান কারণ, দিলি্লতে কংগ্রেসের পায়ের নিচের মাটি পুরোপুরি সরে যাওয়া। হিন্দুস্তান টাইমস ও এনডিটিভির বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০১৩ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস যে ২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তার উল্লেখযোগ্য অংশ এবার আম আদমির পক্ষে চলে যাওয়ায় কেজরিওয়ালের ভূমিধস বিজয় সহজ হয়েছে। তা ছাড়া কেজরিওয়ালের সাধারণ জীবন, দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থান, বিজেপির আক্রমণাত্মক নির্বাচনী প্রচারও আম আদমির বিস্ময়কর বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষণে বলা হয়, বিজেপি যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় রয়েছে, সেখানে নানা উপলক্ষে কট্টর ধর্মীয় সংগঠন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে'র (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্য এবং সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টাকে আমজনতা ভালো চোখে দেখেননি। তারা মোদিকে উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। ভারতের জনগণ ধর্মভীরু হলেও তারা চান না, কোনোমতেই রাষ্ট্রশাসনে ধর্মগুরুরা নাক গলান। বিজেপি এই কঠিন সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছে কি! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিন্তু এসব ধর্মীয় সংগঠনের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য বলিষ্ঠভাবে চ্যালেঞ্জ জানাননি। মাঝেমধ্যেই কোনো না কোনো ধর্মীয়, এমনকি কিছু কিছু বিজেপি নেতার সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট বক্তব্য মোদি সরকারের ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছে, যে কারণে দিলি্লর সাধারণ মানুষ মোদির ব্যাপারেও সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া মোদির এখন সার্বক্ষণিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্য সময় ও এনার্জি ব্যয় করার কথা। তিনি কেন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির প্রধান মুখ হতে যাবেন? দিলি্লর মানুষ এটাও পছন্দ করেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা ভূমি অধিগ্রহণ আইনও দিলি্লর গ্রামীণ বিপুলসংখ্যক ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা শঙ্কিত, এর মাধ্যমে তাদের জমি বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অন্যের হাতে চলে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে 'শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ'কে কেন্দ্র করে বামফ্রন্টের ৩২ বছরের শাসনকে মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন ভোটাররা। কেজরিওয়াল এ ইস্যুকে ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণে আম আদমি পার্টি শহরের চেয়েও গ্রামাঞ্চলে বেশি ভোট পেয়েছে। এমনকি শহরের গরিবদের পাশাপাশি ধনীরাও এবার ভোট দিয়েছে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে, যে ধনীরা গত নির্বাচনে ছিল বিজেপির পক্ষে। নয়াদিলি্ল, আরকে পুরম, গ্রেটার কৈলাস, মালবিয়া নগরের মতো বিলাসবহুল এলাকাগুলোতেও এবার জিতেছে আম আদমি।
৪৯ দিনের দিলি্ল শাসনে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করে দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। দিলি্ল পুলিশের ঘুষ গ্রহণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিলেন। এতে অটোচালক থেকে রাস্তায় ঘুমানো দিনমজুর পর্যন্ত উপকৃত হন। বস্তি এলাকার লোকজনের ঘর নির্মাণেও আম আদমি পার্টির অগুনতি সমর্থক হাত লাগান। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভাবতে শেখে, তাদের অধিকার আদায় ও জীবন-জীবিকাকে নিরাপদ করতে হলে কেজরিওয়াল শাসন মডেলই উত্তম।এটা ঠিক, গত বছর কেজরিওয়ালের হঠাৎ দিলি্লর ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াটা সাধারণ ভোটার জনগণ সহজভাবে নেননি। তখন কেজরিওয়ালের সমালোচনায় মুখর হন সবাই। কিন্তু জনগণকে বোঝানোর ক্ষেত্রে নিরন্তন প্রচেষ্টা চালান অদম্য কেজরিওয়াল। আর কংগ্রেসের দোলাচল অবস্থা, মোদির সুশাসনের প্রতিশ্রুতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পাওয়া ও জনগণের উপকারে আসা সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণে ধীরগতি আম আদমির নীরব জনপ্রিয়তাকে করে আকাশচুম্বী। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে ব্যাপারে নানা অজুহাতে মোদির বিলম্ব, সর্বোপরি ভূমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স এবং হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির রাশ টেনে ধরতে ব্যর্থতার কারণে কেজরিওয়ালের দিকে জনগণ দৃষ্টি ফেরায়। গত বছর আকস্মিক ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিনি দিলি্লর জনগণের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করেন। এটাও মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। শাসন পরিচালনা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতার কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেন। মানুষের মনে তার এসব স্বীকারোক্তি দাগ কাটতে সমর্থ হয়। তারা ভাবে, কেজরিওয়াল তো আমাদেরই লোক।
মোদি-অমিত শাহ টিমের আরও একটি গুরুতর ভুল হলো, তারা কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে কিরণ বেদিসহ নাগরিক আন্দোলনের দু'জন নারী নেত্রীকে দলে নেন। কিন্তু কিরণ বেদি যে কোনোভাবেই কেজরিওয়ালের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নন, তা তিনি প্রায় প্রতিটি টিভি অনুষ্ঠানেই প্রমাণ করেছেন; বরং শেষ মুহূর্তে দলে নেওয়া ও কিরণ বেদিকে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করাটা বিজেপির বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে। অন্যদিকে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সফলতার জন্য জনগণ মোদির প্রশংসা করলেও ওবামার সঙ্গে ১০ লাখ টাকার সুট পরাটা তার ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
গত বছর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর থেকেই পুনর্নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন কেজরিওয়াল। নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে ঘোরেন ভোটারের দ্বারে দ্বারে। সে তুলনায় বিজেপির প্রস্তুতি ছিল স্বল্প সময়ের। শুধু কংগ্রেস নয়, মুসলিমদের ভোটও একচেটিয়া পড়েছে আম আদমির বাক্সে। দলটির জয়ের পেছনে এসব ফ্যাক্টরও রেখেছে বড় ভূমিকা। তা ছাড়া গত লোকসভা নির্বাচনে দিলি্লতে সাতটি আসনের সবক'টি পেয়ে খুশিতে গদগদ ছিল বিজেপি। ভেবেছিল, বিধানসভায়ও তার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ভোটাররা ভেবেছেন উল্টোটা।
No comments