বিপর্যস্ত পর্যটন খাত
দেশের
চলমান সঙ্কটে হুমকির মুখে দেশের পর্যটন খাত। ভরা মওসুমেও দেখা মিলছে না
পর্যটকদের। বিদেশী তো দূরের কথা, আনাগোনা নেই দেশী পর্যটকদেরও। আর এ কারণে
পথে বসতে চলেছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো। ফুটপাথের ব্যবসায়ী থেকে শুরু
করে পাঁচতারকা হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদেরও একই পরিণতি। পর্যটনের ওপর
নির্ভরশীল নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। অন্যদিকে এর
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছেন কোটি কোটি টাকা। দেশের প্রধান
তিনটি পর্যটন এলাকা- সিলেট, কক্সবাজার এবং কুয়াকাটা ঘুরে এ চিত্র তুলে
এনেছেন আমাদের রিপোর্টাররা।
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সিলেট থেকে জানান, শীতের মওসুম চলছে। কি করে বুঝবেন? গায়ে ঠান্ডা লাগবে, ভারি পোশাক পরে লোকজনকে চলাফেরা করতে দেখা যাবে, বাজারে মিলবে মওসুমি সবজি ও ফল। এসব তো আছেই, শীত যে এসেছে তা বোঝার আরও একটা উপায় আছে সিলেটের বাসিন্দাদের। বিশেষ করে বিভিন্ন মূল সড়কের পাশে যাদের বাস তারা কিন্তু শীতের আগমনী গান শুনতে পান। হ্যাঁ গানই শুনতে পান তারা। মাইকে ভেসে আসা গান জানান দেয় শীত এসেছে-শীত চলছে। মাইক বাজিয়ে গান গেয়ে দল বেঁধে এ মওসুমে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে আনন্দভ্রমণে যান সিলেট ও বাইরে থেকে আসা লোকজন। স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে ছুটেন জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, লাউয়াছড়া, মাধবকু-, সাতছড়ি, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে। তাদের আনন্দের ছোঁয়া মাইক হয়ে পথচলতি মানুষ ও আশেপাশের লোকজনের কানে সুখ দেয়। তবে এবার চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। গান শুনে শীতবার্তা খোঁজার উপায় নেই। দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধের কারণে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে এখন কেবলই শূন্যতা। বাইরে থেকে তো দূরের কথা স্থানীয়রাও সাহস করতে পারছে না আনন্দ ভ্রমণের। পর্যটকরা না আসায় একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্যবসায় লোকসান গুনছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন মণিপুরী পোশাক, শীতলপাটি, চা, সাতকড়া কোন কিছুরই ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। নগরীর লামাবাজারে মণিপুরী পোশাকের দোকানগুলোতে এখন মোটেই ভিড় জমে না। পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন সিলেটের হোটেল ব্যবসায়ীরাও। কারোরই ব্যবসা হচ্ছে না। খুলে রেখে শুধু লোকসানই বাড়ছে। সিলেট নগরীর দরগাহ গেইটের হোটেলগুলোতে এ সময় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা থাকলেও এখন একেবারে দৈন্যচিত্র। কেউ কেউ বাইরে এসে চেষ্টা করেন খুঁজে পেতে কোন অতিথি পাওয়া যায় কিনা। একই অবস্থা নগরীর ছোট-বড় আর সব হোটেলেও। সিলেটের পর্যটন খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের অবস্থাও সুখকর নয়। হোটেলটির জনসংযোগ কর্মকর্তা পলাশ চৌধুরী বললেন, এ সময়ই মূলত পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকে। হোটেলে লোক সমাগমও তাই এ সময়টাতেই হয়ে থাকে। তিনি জানান, দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসীরা তাদের মূল সেবাগ্রহীতা। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকেই এ বছর দেশে আসেননি। দেশের মধ্য থেকে যারা আসেন তারাও হরতাল-অবরোধে ঝুঁকি নিয়ে আসতে চান না বলে জানান পাঁচতারা হোটেলের এ কর্মকর্তা। তিনি হতাশার সুরে বলেন ব্যবসা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
রাসেল চৌধুরী, কক্সবাজার থেকে জানান, লাগাতার অবরোধে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে কক্সবাজার। দৈনিক ১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের। এনিয়ে অবরোধের ৩৬ দিনে ৪২০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু কর্মচারীকে ‘বাধ্যগত’ ছুটি দেয়া হয়েছে। ছাঁটাইয়ের তালিকায় রয়েছেন ২০ হাজার শ্রমিক। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হোটেল-মোটেল মালিকরা। বুধবার সৈকতের সী ইন পয়েন্টে সরজমিন দেখা যায়, সৈকত এলাকার রাস্তা ও সৈকত প্রায় জনশূন্য। সৈকতের কিটকট ছাতাগুলো ‘শূন্য’ পড়ে আছে। সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট, ডায়াবেটিক পয়েন্টেও একই চিত্র। যেখানে পর্যটকের ভিড়ে হাঁটা যেত না। সেখানে ফাঁকা সৈকতে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। সৈকতের কিটকট ছাতা ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, পর্যটক নেই। পুরো দিনে এক শ’ টাকাও আয় হয় না। সৈকতে পর্যটকের ছবি তুলে সংসার চালান মোস্তফা হোসেন। তিনি জানান, দিনে ৫০ টাকা আয় হয়। মাঝে মাঝে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয়। জীবন চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সৈকতে পর্যটক না থাকা মানে হোটেল-মোটেলের অবস্থা করুণ হওয়া। মাঝারি মানের হোটেল থেকে শুরু করে তারকামানের হোটেলও পর্যটকশূন্য। আর হোটেলে পর্যটক নেই মানে রেস্তরাঁ ব্যবসা বন্ধ। হোটেল- মোটেল জোনের রোদেলা রেস্তরাঁর ব্যবস্থাপক মিনহাজ উদ্দিন জানান, রেস্তরাঁর ৩২ জন কর্মচারীসহ দৈনিক ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। দিনের আমদানিও তোলা যাচ্ছে না। পর্যটক থাকলে দৈনিক ৬৫-৭০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এখন ২-৩ হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিতে হবে বলেও জানান তিনি। পর্যটন এলাকায় ৮৪টি রেস্তরাঁ রয়েছে। ডাইনিং রেস্তরাঁ, শালবন রেস্তরাঁ ও জিয়া রেস্তরাঁসহ ৫০টি রেস্তরাঁ ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারকামানের হোটেল দ্য কক্স টুডে’র রুম ডিভিশন ম্যানেজার আবু তালেব শাহ জানান, জানুয়ারি মাসে যা বুকিং ছিলো। অবরোধে তা বাতিল হয়ে গেছে। অবরোধের কারণে গত মাসে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। আবু তালেব শাহ আরও জানান, জেলার অন্তত ৫০ ভাগ মানুষ পর্যটন ব্যবসানির্ভর। পর্যটক আসলে চালের দোকানি, রিকশাচালক, শুঁটকি বিক্রেতা থেকে শুরু করে সবাই লাভবান হন। কিন্তু এখন পর্যটক নেই। আর এ প্রভাব প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। পর্যটক না আসায় হোটেল মালিকরা চরমভাবে হতাশ বলেও মন্তব্য করেন আবু তালেব শাহ। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, পর্যটনের এ ভর মওসুমে অন্তত ৪-৫ লাখ পর্যটক থাকতো। কিন্তু এখন ৩শ’ পর্যটকও কক্সবাজারে নেই। কক্সবাজারে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেলগুলোর দৈনিক দশ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এতে করে অবরোধে ৩৬ দিনে ৩শ’ ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের। তিনি আরও জানান, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে অনেকে হোটেল করেছেন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হোটেলে তালা দিয়ে পালিয়ে যেতে হবে। ডায়মন্ড গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক বাদল বড়ুয়া জানান, পুরো হোটেলে মাত্র এগার জন পর্যটক রয়েছেন। তারাও স্থানীয়। বাইরের কোন পর্যটক নেই। পর্যটক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল টিউনের নির্বাহী পরিচালক বেলাল আবেদিন ভুট্টো জানান, পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পর্যটক আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি। কারণ নিরাপত্তাবেষ্টিত যানবাহনেও যেভাবে হামলা হচ্ছে এতে করে পর্যটকরা ঘরের বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। শহরের বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকি বিক্রেতা, সৈকতে চটপটি বিক্রেতা, ভ্রাম্যমাণ হকার, ফটোগ্রাফার, কিটকট ছাতা ব্যবসায়ী, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটক সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দর্শনীয় স্থানগুলো এখন পর্যটক শূন্য। এ অবস্থা সুরাহা না হলে পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
হোসাইন আমির, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) থেকে জানান, টানা ৩৭ দিন রাজনৈতিক সহিংসতা আর হরতাল-অবরোধে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতিটি দর্শনীয় স্থানগুলো এখন পর্যটকশূন্য। এ ভরা মওসুমেও এখানকার হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিজম, ট্রান্সপোর্ট, সী-বিচ ফটোগ্রাফারসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। কখন, কবে দেশের চলমান এ সঙ্কটের অবসান হবে সে আশায় বসে আছেন পর্যটকমুখী ব্যবসায়ীরা। হোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বিরাজমান এ পরিস্থিতির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ১শ’ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ১১ই ফেব্রুয়ারি বুধবার কুয়াকাটা সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, মাত্র ৭-৮ জন লোক সৈকতে আনাগোনা করছে। তবে এরাও স্থানীয়। দীর্ঘ ১৮ কি.মি দৈর্ঘ্য সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় অন্যান্য বছরগুলোতে এই সময় অর্ধেকই থাকতো দেশী-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের হুড়োহুড়ি। কিন্তু বর্তমানে পাল্টে গেছে চিরচেনা সে দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ততদূর জনশূন্য। যে নারিকেল পিকনিক স্পটে থাকতো শ’ শ’ গাড়ি সেখানকার চিত্রও উল্টো। খালি পড়ে আছে ট্যুরিস্ট বোট। এসবের দায়িত্বে থাকা ব্যবসায়ীরা বসে বসে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। সী-বিচ চা বিক্রেতা রেজাউল করিম বলেন, গত দু’দিনে ১২টি বনরুটি আনছি, ক্রেতা না পেয়ে নষ্ট হওয়ার আগেই ভিক্ষুক ও নিজেরাই খেয়ে ফেলেছি। দুটি ছেলের লেখাপড়ার খরচ চলে এই ইনকাম দিয়ে। সী ট্যুরিজম পরিচালক জনি আলমগীর জানান, এ মওসুমের শুরুর দিকে বোটগুলো তৈরি করে এনেছি। কিন্তু এখনও সেগুলো কাজে লাগানো যায়নি। খরচ ওঠাতো দূরের কথা, আমাদের অবস্থাই বেহাল। কুয়াকাটা সদর রোড রেস্টুরেন্ট রাজধানীর মালিক জয়নাল জানান, ডিসেম্বর মাসে স্কুলগুলোর পরীক্ষা থাকায় কিছু বেচাকেনা হইছে কিন্তু বর্তমানে যা শুরু হয়েছে তাতে কপালে কি আছে কে জানে? অভিজাত হোটেল বিচ হ্যাভেনের ম্যানেজার রঞ্জু বলেন, গত মাসে ৪২টি রুম থেকে ৪ হাজার টাকা আয় হয়েছে। কিন্তু এই ১০ দিনে কোন রুমে গেস্ট ছিলো না। খালি পড়ে আছে রুমগুলো। অন্য জায়গা থেকে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। গত বছরেও এ মওসুমে হরতাল- অবরোধের কারণে পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছিল। এ বছরেও একই অবস্থা। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক এম মোতালেব শরিফ মানবজমিনকে জানান, রাজনৈতিক অবরোধ হরতালের জন্য আমাদের হোটেল ব্যবসায় বিপর্যয় নেমেছে। পানি, বিদ্যুৎ, স্টাফ খরচ মেটাতে দেনা করতে হচ্ছে প্রতিদিন। এমনিতেই ৩-৪ মাস ধরে এখানে পর্যটন ব্যবসা হয়। কিন্তু এবার আর ব্যবসাই হলো না। তিনি জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে শুধু হোটেল ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে ১শ’ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে, এছাড়া অন্যান্য ব্যবসাতো আছেই।
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সিলেট থেকে জানান, শীতের মওসুম চলছে। কি করে বুঝবেন? গায়ে ঠান্ডা লাগবে, ভারি পোশাক পরে লোকজনকে চলাফেরা করতে দেখা যাবে, বাজারে মিলবে মওসুমি সবজি ও ফল। এসব তো আছেই, শীত যে এসেছে তা বোঝার আরও একটা উপায় আছে সিলেটের বাসিন্দাদের। বিশেষ করে বিভিন্ন মূল সড়কের পাশে যাদের বাস তারা কিন্তু শীতের আগমনী গান শুনতে পান। হ্যাঁ গানই শুনতে পান তারা। মাইকে ভেসে আসা গান জানান দেয় শীত এসেছে-শীত চলছে। মাইক বাজিয়ে গান গেয়ে দল বেঁধে এ মওসুমে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে আনন্দভ্রমণে যান সিলেট ও বাইরে থেকে আসা লোকজন। স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে ছুটেন জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, লাউয়াছড়া, মাধবকু-, সাতছড়ি, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে। তাদের আনন্দের ছোঁয়া মাইক হয়ে পথচলতি মানুষ ও আশেপাশের লোকজনের কানে সুখ দেয়। তবে এবার চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। গান শুনে শীতবার্তা খোঁজার উপায় নেই। দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধের কারণে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে এখন কেবলই শূন্যতা। বাইরে থেকে তো দূরের কথা স্থানীয়রাও সাহস করতে পারছে না আনন্দ ভ্রমণের। পর্যটকরা না আসায় একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্যবসায় লোকসান গুনছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন মণিপুরী পোশাক, শীতলপাটি, চা, সাতকড়া কোন কিছুরই ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। নগরীর লামাবাজারে মণিপুরী পোশাকের দোকানগুলোতে এখন মোটেই ভিড় জমে না। পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন সিলেটের হোটেল ব্যবসায়ীরাও। কারোরই ব্যবসা হচ্ছে না। খুলে রেখে শুধু লোকসানই বাড়ছে। সিলেট নগরীর দরগাহ গেইটের হোটেলগুলোতে এ সময় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা থাকলেও এখন একেবারে দৈন্যচিত্র। কেউ কেউ বাইরে এসে চেষ্টা করেন খুঁজে পেতে কোন অতিথি পাওয়া যায় কিনা। একই অবস্থা নগরীর ছোট-বড় আর সব হোটেলেও। সিলেটের পর্যটন খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের অবস্থাও সুখকর নয়। হোটেলটির জনসংযোগ কর্মকর্তা পলাশ চৌধুরী বললেন, এ সময়ই মূলত পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকে। হোটেলে লোক সমাগমও তাই এ সময়টাতেই হয়ে থাকে। তিনি জানান, দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসীরা তাদের মূল সেবাগ্রহীতা। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকেই এ বছর দেশে আসেননি। দেশের মধ্য থেকে যারা আসেন তারাও হরতাল-অবরোধে ঝুঁকি নিয়ে আসতে চান না বলে জানান পাঁচতারা হোটেলের এ কর্মকর্তা। তিনি হতাশার সুরে বলেন ব্যবসা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
রাসেল চৌধুরী, কক্সবাজার থেকে জানান, লাগাতার অবরোধে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে কক্সবাজার। দৈনিক ১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের। এনিয়ে অবরোধের ৩৬ দিনে ৪২০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু কর্মচারীকে ‘বাধ্যগত’ ছুটি দেয়া হয়েছে। ছাঁটাইয়ের তালিকায় রয়েছেন ২০ হাজার শ্রমিক। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হোটেল-মোটেল মালিকরা। বুধবার সৈকতের সী ইন পয়েন্টে সরজমিন দেখা যায়, সৈকত এলাকার রাস্তা ও সৈকত প্রায় জনশূন্য। সৈকতের কিটকট ছাতাগুলো ‘শূন্য’ পড়ে আছে। সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট, ডায়াবেটিক পয়েন্টেও একই চিত্র। যেখানে পর্যটকের ভিড়ে হাঁটা যেত না। সেখানে ফাঁকা সৈকতে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। সৈকতের কিটকট ছাতা ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, পর্যটক নেই। পুরো দিনে এক শ’ টাকাও আয় হয় না। সৈকতে পর্যটকের ছবি তুলে সংসার চালান মোস্তফা হোসেন। তিনি জানান, দিনে ৫০ টাকা আয় হয়। মাঝে মাঝে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয়। জীবন চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সৈকতে পর্যটক না থাকা মানে হোটেল-মোটেলের অবস্থা করুণ হওয়া। মাঝারি মানের হোটেল থেকে শুরু করে তারকামানের হোটেলও পর্যটকশূন্য। আর হোটেলে পর্যটক নেই মানে রেস্তরাঁ ব্যবসা বন্ধ। হোটেল- মোটেল জোনের রোদেলা রেস্তরাঁর ব্যবস্থাপক মিনহাজ উদ্দিন জানান, রেস্তরাঁর ৩২ জন কর্মচারীসহ দৈনিক ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। দিনের আমদানিও তোলা যাচ্ছে না। পর্যটক থাকলে দৈনিক ৬৫-৭০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এখন ২-৩ হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিতে হবে বলেও জানান তিনি। পর্যটন এলাকায় ৮৪টি রেস্তরাঁ রয়েছে। ডাইনিং রেস্তরাঁ, শালবন রেস্তরাঁ ও জিয়া রেস্তরাঁসহ ৫০টি রেস্তরাঁ ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারকামানের হোটেল দ্য কক্স টুডে’র রুম ডিভিশন ম্যানেজার আবু তালেব শাহ জানান, জানুয়ারি মাসে যা বুকিং ছিলো। অবরোধে তা বাতিল হয়ে গেছে। অবরোধের কারণে গত মাসে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। আবু তালেব শাহ আরও জানান, জেলার অন্তত ৫০ ভাগ মানুষ পর্যটন ব্যবসানির্ভর। পর্যটক আসলে চালের দোকানি, রিকশাচালক, শুঁটকি বিক্রেতা থেকে শুরু করে সবাই লাভবান হন। কিন্তু এখন পর্যটক নেই। আর এ প্রভাব প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। পর্যটক না আসায় হোটেল মালিকরা চরমভাবে হতাশ বলেও মন্তব্য করেন আবু তালেব শাহ। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, পর্যটনের এ ভর মওসুমে অন্তত ৪-৫ লাখ পর্যটক থাকতো। কিন্তু এখন ৩শ’ পর্যটকও কক্সবাজারে নেই। কক্সবাজারে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেলগুলোর দৈনিক দশ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এতে করে অবরোধে ৩৬ দিনে ৩শ’ ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের। তিনি আরও জানান, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে অনেকে হোটেল করেছেন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হোটেলে তালা দিয়ে পালিয়ে যেতে হবে। ডায়মন্ড গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক বাদল বড়ুয়া জানান, পুরো হোটেলে মাত্র এগার জন পর্যটক রয়েছেন। তারাও স্থানীয়। বাইরের কোন পর্যটক নেই। পর্যটক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল টিউনের নির্বাহী পরিচালক বেলাল আবেদিন ভুট্টো জানান, পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পর্যটক আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি। কারণ নিরাপত্তাবেষ্টিত যানবাহনেও যেভাবে হামলা হচ্ছে এতে করে পর্যটকরা ঘরের বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। শহরের বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকি বিক্রেতা, সৈকতে চটপটি বিক্রেতা, ভ্রাম্যমাণ হকার, ফটোগ্রাফার, কিটকট ছাতা ব্যবসায়ী, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটক সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দর্শনীয় স্থানগুলো এখন পর্যটক শূন্য। এ অবস্থা সুরাহা না হলে পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
হোসাইন আমির, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) থেকে জানান, টানা ৩৭ দিন রাজনৈতিক সহিংসতা আর হরতাল-অবরোধে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতিটি দর্শনীয় স্থানগুলো এখন পর্যটকশূন্য। এ ভরা মওসুমেও এখানকার হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিজম, ট্রান্সপোর্ট, সী-বিচ ফটোগ্রাফারসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। কখন, কবে দেশের চলমান এ সঙ্কটের অবসান হবে সে আশায় বসে আছেন পর্যটকমুখী ব্যবসায়ীরা। হোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বিরাজমান এ পরিস্থিতির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ১শ’ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ১১ই ফেব্রুয়ারি বুধবার কুয়াকাটা সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, মাত্র ৭-৮ জন লোক সৈকতে আনাগোনা করছে। তবে এরাও স্থানীয়। দীর্ঘ ১৮ কি.মি দৈর্ঘ্য সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় অন্যান্য বছরগুলোতে এই সময় অর্ধেকই থাকতো দেশী-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের হুড়োহুড়ি। কিন্তু বর্তমানে পাল্টে গেছে চিরচেনা সে দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ততদূর জনশূন্য। যে নারিকেল পিকনিক স্পটে থাকতো শ’ শ’ গাড়ি সেখানকার চিত্রও উল্টো। খালি পড়ে আছে ট্যুরিস্ট বোট। এসবের দায়িত্বে থাকা ব্যবসায়ীরা বসে বসে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। সী-বিচ চা বিক্রেতা রেজাউল করিম বলেন, গত দু’দিনে ১২টি বনরুটি আনছি, ক্রেতা না পেয়ে নষ্ট হওয়ার আগেই ভিক্ষুক ও নিজেরাই খেয়ে ফেলেছি। দুটি ছেলের লেখাপড়ার খরচ চলে এই ইনকাম দিয়ে। সী ট্যুরিজম পরিচালক জনি আলমগীর জানান, এ মওসুমের শুরুর দিকে বোটগুলো তৈরি করে এনেছি। কিন্তু এখনও সেগুলো কাজে লাগানো যায়নি। খরচ ওঠাতো দূরের কথা, আমাদের অবস্থাই বেহাল। কুয়াকাটা সদর রোড রেস্টুরেন্ট রাজধানীর মালিক জয়নাল জানান, ডিসেম্বর মাসে স্কুলগুলোর পরীক্ষা থাকায় কিছু বেচাকেনা হইছে কিন্তু বর্তমানে যা শুরু হয়েছে তাতে কপালে কি আছে কে জানে? অভিজাত হোটেল বিচ হ্যাভেনের ম্যানেজার রঞ্জু বলেন, গত মাসে ৪২টি রুম থেকে ৪ হাজার টাকা আয় হয়েছে। কিন্তু এই ১০ দিনে কোন রুমে গেস্ট ছিলো না। খালি পড়ে আছে রুমগুলো। অন্য জায়গা থেকে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। গত বছরেও এ মওসুমে হরতাল- অবরোধের কারণে পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছিল। এ বছরেও একই অবস্থা। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক এম মোতালেব শরিফ মানবজমিনকে জানান, রাজনৈতিক অবরোধ হরতালের জন্য আমাদের হোটেল ব্যবসায় বিপর্যয় নেমেছে। পানি, বিদ্যুৎ, স্টাফ খরচ মেটাতে দেনা করতে হচ্ছে প্রতিদিন। এমনিতেই ৩-৪ মাস ধরে এখানে পর্যটন ব্যবসা হয়। কিন্তু এবার আর ব্যবসাই হলো না। তিনি জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে শুধু হোটেল ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে ১শ’ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে, এছাড়া অন্যান্য ব্যবসাতো আছেই।
No comments