মোদির বিজয়ে ভারত কী হারাল? by উইলিয়াম ডালরিম্পল
মোদি একজন শক্তিমান বক্তা৷ গত কয়েক মাসে
তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছেন, এমনকি তিনি পূজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত
হয়েছেন৷ হিন্দু জাতীয়তাবাদে যাঁরা বিশ্বাস করেন না, তাঁরাও মোদির প্রশংসা
করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ কারণ হচ্ছে, তাঁর কর্মসূচিতে ভারতের ৩০০ মিলিয়ন
মধ্যবিত্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে৷ তা হলো দেশটির অর্থনৈতিক
পুনরুজ্জীবন৷ তাঁর নেতৃত্বে গুজরাটের অর্থনীতি ২০০১ সালের পর আকারে তিন গুণ
বেড়েছে৷ সে কারণেই ২০০১ সালের পর থেকে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অপরিসীম৷ কাজ করিয়ে নিতে ও বিনিয়োগ আনতে তিনি
পারঙ্গম৷ দুর্নীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা তাঁর আছে, আমলাতান্ত্রিক লাল
ফিতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন তিনি৷ অচল ও ঝামেলাপূর্ণ নিয়মকে ঝেড়ে
ফেলার ক্ষমতা রাখেন তিনি৷ ভারতের মানুষ আরও পাঁচ বছর কংগ্রেস শাসনে থাকতে
চায় না কেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়৷ কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে
মোদির অবস্থান ও পুরোনো রেকর্ড জানার পরও মানুষ তাঁকে নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত
কেন, তা বোঝা অতটা সহজ নয়৷
২০০২ সালে মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, সে সময় প্রায় দুই হাজার মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করে৷ আরও প্রায় দুই লাখ মুসলিম ঘরছাড়া হয়৷ অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, পুরুষদের কেটে টুকরো টুকরো করা হয় এবং কেরোসিন দিয়ে বা জ্বলন্ত টায়ারে পুড়িয়ে মারা হয়৷ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পেট চিরে তাঁদের চোখের সামনে ভ্রূণ হত্যা করা হয়৷ মোদি নিজের ব্যবহারিক প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে গর্ব করলেও তাঁর বিরুদ্ধে ২০০২ সালের দাঙ্গা সংঘটিত হতে দেওয়ার অভিযোগ আছে৷ এমনকি দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার না করার জন্যও নাকি তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদিও এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মোদির প্রশাসন এই হত্যাযজ্ঞে সহযোিগতা করেছে৷ ‘এটা ছিল পরিকল্পিত আক্রমণ’৷ ওই প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেছেন, ‘এটা সংঘটিত হয়েছে পুলিশ ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়৷’
মোদি বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক তদন্তের মুখোমুখি হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো রায় হয়নি৷ এমনকি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে তাঁর সরকার ব্যর্থ হলেও তিনি কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করেননি বা তাঁর মধ্যে কোনো অনুশোচনাও দেখা যায়নি৷ দাঙ্গাবিষয়ক প্রশ্ন করা হলেও তিনি এর উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন৷ এ বিষয়ে গত বছর তিনি মন্তব্য করেন, ‘একটি কুকুরছানা গািড়চাপা পড়লে’ আমি যেমন দুঃখিত হতাম, দাঙ্গায় মুসলমানদের দুর্দশায় ঠিক তেমন কষ্ট পেয়েছি৷ একবার তিনি দাঙ্গাবাজদের কর্মকাণ্ডকে আংশিকভাবে যৌক্তিকও বলেছিলেন৷ যেমন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নয়–এগারো–পরবর্তীকালে নিরপরাধ শিখ নিহত হয়েছিল, কেন? কারণ সে দেখতে সন্ত্রাসীদের মতো ছিল৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের িশক্ষিত মানুষদের যদি উসকানি দিয়ে এ কাজ করানো সম্ভব হয়, তাহলে গুজরাটের মানুষদের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করা হবে?’ আরও একবার এর চেয়েও শীতল কণ্ঠে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন: ‘কেন ২০০২ সাল নিয়ে এত কথা হচ্ছে?... এটা অতীত, এর কী তাৎপর্য আছে?’ নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, তাঁর একমাত্র আক্ষেপ হচ্ছে, তিনি মিডিয়াকে সামলাতে পারেননি৷
এসব বক্তব্যে ভারতীয় মুসলমানরা আশ্বস্ত হননি, উদার হিন্দুদেরও তা আশ্বস্ত করতে পারেনি৷ এই ঘরানার মানুষ ভারতের বহুত্ববাদী সমাজকাঠামোর ওপর ভরসা রাখে৷ মোদির দলের মুসলমানবিরোধিতাও কমেনি: সেই দাঙ্গার শিকার ৫০ হাজার মানুষ এখনো অতিদারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, উদ্বাস্তু হয়ে তারা ৮৩টি ‘শরণার্থী শিবিরে’ পচে মরছে৷ মোদি একবার এসব শিবির পরিদর্শন করলেও তিনি তাচ্ছিল্যভরে এসব শিবিরকে মুসলিম ‘শিশু উৎপাদন শিবির’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন৷ নির্বাচনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় তিনি বারবার মুসলিম টুপি পরতে অস্বীকার করেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘এর মানে হবে সংখ্যালঘুদের তোয়াজ করা৷’
১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গেও মোদির সম্পর্ক আছে৷ তার আগে ১৯৯০ সালে সোমনাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা আয়োজনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল৷ এই রথযাত্রায় যে প্রচারণা চালানো হয়, সেটাই পরবর্তীকালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে প্ররোচনা দেয় বলে অভিযোগ আছে৷ মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০১ সালের সাত অক্টোবর৷ চার মাস পরেই গোধরা স্টেশনে ৫৯ জন তীর্থযাত্রী ট্রেনে আগুন লেগে পুড়ে মারা যান৷ কোনো সুনিির্দষ্ট তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই মোদি বলে বসেন, এটা পাকিস্তানের মুসলমানদের ষড়যন্ত্র৷ তিনি রাজ্যব্যাপী হরতাল ডেকে বসেন৷ আর আগুনে পোড়া তীর্থযাত্রীদের মরদেহ নিয়ে মিছিল করেন৷ উত্তেজক বক্তৃতাও দেন তিনি৷
তার পরের দিন জিঙ্গ হিন্দুদের একটি বিশাল দল নানা রকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুজরাটের অভিজাত মুসলিম আবাসিক এলাকা গুলবার্গের সামনে জড়ো হয়৷ সেখানে থাকতেন কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ এহসান জাফরি৷ পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূিমকা দেখে জাফরি আতঙ্কিত হয়ে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে ফোন করতে শুরু করেন৷ এঁদের মধ্যে মোদিও ছিলেন৷ তাঁর সঙ্গে কথা বলে জাফরি নিরাশ হয়ে পড়েন৷ সে সময় জাফরির বািড়তে ইমতিয়াজ পাঠান নামের একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রি আশ্রয় নেন৷ ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় তিনি বলেন, ‘আমি যখন জাফরি সাহেবকে বলি, কী হয়েছে; ‘তিনি বলেন, কোনো পুলিশ মোতায়েন করা হবে না৷’ জাফরির বিধবা স্ত্রী জাকিয়ার ভাষ্য অনুসারে, মোদি তাঁর স্বামীকে বিদ্রূপ করে বলেন, জাফরি এখনো বেঁচে আছেন শুনে তিনি বিিস্মত৷
এর কিছুক্ষণ পরেই জাফরির স্ত্রী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আতঙ্ক নিয়ে দেখেন, দাঙ্গাবাজরা তাঁর স্বামীকে দিগম্বর করে টেনে রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে৷ তাঁর চোখের সামনেই তারা জাফরিকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে একে একে তাঁর আঙুল, হাত, পা, মাথা কেটে টুকরো টুকরো করছে৷ তারপর জাফরির মৃতদেহকে তারা একটি উন্মুক্ত চিতায় স্থাপন করে৷ পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেও কিছু করেনি৷ এমনকি জাফরিকে পুলিশ বলে, ‘আপনাকে বাঁচানোর ব্যাপারে আমাদের ওপর কোনো নির্দেশ নেই৷’ পরবর্তীকালে একটি ম্যাগাজিনের তদন্তে কয়েকজন দাঙ্গাবাজকে ক্যামেরার সমানে বলতে শোনা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী এই আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন৷ মোদি আমাদের তিন দিন সময় দিয়ে বলেছেন, এর মধ্যে যা পার করো’, দাঙ্গাবাজদের একজন গর্বভরে বলেন৷
মোদির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুতর৷ কিন্তু তিনি যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন, এমনকি এ–ও বলেন, সেদিন রাত সাড়ে আটটার আগে তিনি এ ঘটনা জানতেনই না৷ সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমও (এসআইটি) তাঁর এই ভাষ্য সত্য বলে ধরে নিয়েছে৷ তবে এই এসআইটির প্রতিবেদনে অনেক অসংগতি আছে৷ ফলে এটা গ্রহণ করা কঠিন৷ যেমন, ঘটনার দিন দাঙ্গা শুরু হলে গুলবার্গে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বহুবার যোগাযোগ হয়েছে, সে রেকর্ড আছে৷
এই প্রতিবদনে মোদির প্রশংসা করে বলা হয়েছে, সেদিন তিনি বারবার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ সেটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কী করে জাফরিকে খুনের ঘটনাটি রাতে জানলেন? ফলে প্রতিবেদনটি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে৷ বিশেষত মোদির একজন সাবেক সহকারী যখন একটি অ্যাফিডেভিটের বরাত দিয়ে বলেন, গুজরাটের আইনজীবীদের কাছে ওই প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছিল৷ তাঁরা এটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেন, এমনকি এর সম্পদনাও করেন৷
ভারতের জনগণ একটি মারাত্মক জুয়া খেলায় মেতে উঠেছে৷ তারা মোদির মানবািধকার ও নাগরিক স্বাধীনতাবিষয়ক অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে তাঁর মধ্যে একজন শক্তিশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন৷ যিনি হয়তো কিছু কঠিন সংস্কার করতে পারবেন, সুশাসনও কিছুটা নিশ্চিত করতে পারবেন৷ এতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও হয়তো আসবে৷ কিন্তু তার বদলে ভারতীয়রা কী হারাল, সেটা তাদের ভেবে দেখা দরকার৷
নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ প্রতীক বর্ধন
উইলিয়াম ডালরিম্পল: নিউ স্টেটসম্যানের ভারতের প্রতিনিধি৷
No comments