ভারতে সাধারণ মানুষের উত্থান by এম সাখাওয়াত হোসেন
ভারতের ১৬তম লোকসভার নির্বাচনী
ফলাফল আমরা জেনে গেছি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দক্ষিণপন্থী
হিন্দুত্ববাদী বলে বিবেচিত ভারতীয় জনতাঁ পার্টি বা বিজেপির যে বিজয় হবে,
তাঁ একপ্রকার দেয়ালেই অঙ্কিত ছিল। তবে প্রশ্ন ছিল, বিজেপি কি একক
সংখ্যাগরিষ্ঠতাঁ পাবে, না বিগত তিন দশকের ভারতীয় রাজনীতিতে চলে আসা
কোয়ালিশন সরকার হবে৷ সম্ভবত বিজেপিও বিশ্বাস করেনি যে দলটি নিজের শক্তিতেই
সরকার গঠনের মতো ক্ষমতাঁ অর্জন করবে। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল
কংগ্রেসের নেত্রী বিজেপি তথা এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র
মোদির অতীত নিয়ে িতর্যক মন্তব্য করলেও মোদি ইট খেয়ে পাটকেলটি মারেননি।
তবে
কংগ্রেসের যে অবিশ্বাস্য ভরাডুবি হয়েছে, তাঁ হয়তো খোদ সোনিয়া গান্ধী
অথবা রাহুল গান্ধীও কল্পনা করতে পারেননি। যে কংগ্রেস ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে
রাহুল গান্ধীর বাবা প্রয়াত রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে ৪১৪টি আসন পেয়ে রেকর্ড
গড়েছিল, সেই কংগ্রেসকে প্রায় তিন দশক পর দলের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা খারাপ
ফলের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস একক দল হিসেবে পঞ্চাশের
(৪৪টি) এবং ইউপিএ জোটগতভাবে এক শর নিচে (৬১) আসন পেয়েছে। কংগ্রেসের এ
পরাজয় সমগ্র ভারতে সেক্যুলারপন্থীদের শুধু হতাঁশই নয়, একপ্রকার বাকরুদ্ধ
করেছে।
যে নরেন্দ্র মোদি তিনবার গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সর্বভারত তথা বিশ্বে একজন অতি হিন্দুত্ববাদী এবং উগ্র ডানপন্থী হিসেবে বিবেচিত, সেই ব্যক্তি কীভাবে এ ধরনের উত্থান ঘটাতে পারলেন, তাঁ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর ওপর ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যা অন্যতম বেস্টসেলার হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার মদদদাতাঁ হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ভিসা স্থগিত করেছিল, তাঁকেই এখন বিশ্ববাসী বরণ করতে তৈরি হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সাফল্য একসময়ের কংগ্রেসশাসিত গুজরাটকে শিল্পায়িত ও ব্যবসাবান্ধব রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা। ভারতের ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক সাফল্যকে গুজরাট মডেল হিসেবে দেখা হয় এবং মোদির প্রচারণার অন্যতম স্লোগানই ছিল ‘বিকাশ’ বা উন্নয়ন।
দু–এক দিনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে ভারতের সরকার। কেমন হবে তাঁদের চরিত্র, কেমন হবে পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কেমনই বা হবে আগামী ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি—এ বিষয় নিয়েই আমাদের দেশসহ প্রতিবেশী দেশগুেলা চিন্তাতাঁর মধ্যে রয়েছে। এর আগেও ভারতে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার গঠন করে প্রশাসন চালিয়েছিল, তবে ওই সময়কার বিজেপি এবং বর্তমানের মধ্যে যে পার্থক্যটি, সেটি হলো নেতৃত্বে। অটল বিহারি বাজপেিয়র নেতৃত্বের পেছনে ছিল কয়েক দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাঁ এবং সর্বভারত তথা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি, যা মোদির নেই। তিনি রাজ্যের বাইরে ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন না বিধায় অভিজ্ঞতাঁর ঘাটতি নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে হবে। অবশ্য ভারতের রাজনীতি এবং সরকারব্যবস্থা এতই প্রতিষ্ঠিত যে পূর্ব-অভিজ্ঞতাঁ কম হলেও সরকার পরিচালনায় তেমন সমস্যা হয় না। রাজীব গান্ধী এর উদাহরণ।
অপরদিকে ক্রমেই রাজ্য সরকারগুলো যেভাবে শক্তিশালী ভূমিকা অর্জন করেছে, তাঁতে কেন্দ্রের শাসনের পরিধি সংকুচিত হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর প্রমাণ। এ বিষয়টিও মোদির জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে৷ তাঁর রাজনৈতিক উত্থান অনেকটা কল্পকাহিিনর মতো শোনা যেতে পারে, তবে অতি সাধারণ, অতি দরিদ্র ঘরের এই ব্যক্তির গড়ে ওঠার মধ্যে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ও জীবনদর্শন। রেলওয়ে স্টেশনের এক চা বিক্রেতাঁর ছেলের চিত্তের দৃঢ়তাঁর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল শৈশেবই৷ অখ্যাত এক মফস্বল শহর ভাদনগর রেলওয়ে স্টেশনের পাশের ছোট কুটিরে বেড়ে উঠছিলেন ‘ঘানচি’ বা বাংলায় কলু বা তেলি সম্প্রদায়ের মোদি। গুজরাটের ঘানচিদের পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী হিসেবেই মনে করা হয়৷ মোদির ঘানচি পরিবারে জন্মই তাঁকে গোত্রবৈষম্যের বিরুদ্ধ মনোভাবের ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবিই এবারের নির্বাচনের প্রচারে অনেকটা প্রভাব ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপট তাঁকে সাধারণ মানুষের অতি নিকটে টানতে সাহায্য করেছে। তিনি তাঁর এই জন্মসূত্রকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মোদি কোনো রাজনৈতিক পরিবারের ব্যক্তি নন বিধায় ভারতের রাজনীতিতে শক্ত পরিবারতন্ত্রের বিপক্ষের একজন হিসেবে ভারতের ৮১ কোটি ভোটারের সিংহভাগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদির অতি ভারতীয় ও দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে ছিল চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়। ১২ বছরের বালক মোদি ভাদনগর রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধফেরত আহত সৈনিকদের চা পরিবেশনকালে কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষানীতির দুর্বলতাঁ এবং ভারতের লজ্জাকর পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারেননি। ওই যুদ্ধের ফলাফল এবং সৈনিকদের পরাজয়ের গ্লানিমাখা মুখ কিশোর মোদির মনে যে গভীর রেখাপাত করে, তাঁরই প্রেক্ষাপটে তাঁর আরএসএসে যোগদানের কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। প্রথমে আরএসএসের সামান্য কর্মী থেকে প্রচার সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিষ্ঠিত হন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে সংঘ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাঁ এবং বিজেপি গঠিত হলে সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন।
বিজেপি বা ভারতীয় জনতাঁ পার্টি প্রথমে শ্যামা প্রসাদের জনসংঘ এবং পরে জনতাঁ পার্টির উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৮০ সালে, প্রধানত ভারত বিভক্তির পর পশ্চিমাঞ্চলের শরণার্থীদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক অঙ্গ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাঁয় আসীন হতে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই নরেন্দ্র মোদিই এবারের বিজেপির এই অবিশ্বাস্য উত্থানের নায়ক। মোদির অতি সাধারণ মানুষ হওয়াই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে ভারতীয়রা গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রায় ৬২ বছরের ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরু পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদির উত্থানই ছিল বিজেপির শক্তি, যা ভারতের রাজনীতিতে উচ্চ বর্ণের এবং পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। মোদির উত্থান ভারতীয় তথা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের রেওয়াজকে ভাঙতে হয়তোবা প্রেরণা জোগাতে পারে।
বিজেপি তথা মোদির এই ঝড় শুধু নেহরু-গান্ধী পরিবারকেই ধরাশায়ী করেনি, করেছে বিভিন্ন রাজ্যের অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ঘরানার। উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিং এবং তাঁর ছেলে মুখ্যমন্ত্রী শাসনকে নিচে নেমে এনেছে। সেখানে ৮০ আসনের মধ্যে ৭১টি মোদির বিজেপি অর্জন করেছে। উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিংয়ের নেতৃত্বে এসপি ও পরিবারতন্ত্রের দিন শেষের পথে। তেমনি নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চর্চিত বিএসপির নেতাঁ মায়াবতী ধরাশায়ী হয়েছেন। এসপি পেয়েছে মাত্র পাঁচটি আসন আর কংগ্রেসের নেহরু পরিবার ঐতিহ্যবাহী আমেথি এবং রায়বেরেলি ধরে রেখেছে মাত্র৷ উত্তর প্রদেশে রাহুল তথা নেহরু পরিবারের যে শোচনীয় অবস্থা, তাঁ ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। একইভাবে হিন্দি অঞ্চল বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশের মতোই অবস্থা মধ্য প্রদেশ, বিহার ও ছত্তিশগড়ের। অনেকেই মনে করেন, ভারতের রাজনীতিতে হিন্দি অঞ্চলের যে ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁ আর থাকছে না। মধ্যপ্রদেশে ২৯টি আসনের ২৭টিতে বিজেপি জয়ী হয়েছে। বিহারে ৪০টির মধ্যে বিজেপি ও মিত্ররা ৩১টি, ঝাড়খন্ডে ১৪টির মধ্যে ১৩টি, ছত্তিশগড়ে ১১টি আসনের ১০টি, এমনকি দিল্লির সাতটি আসনের সব কটিতেই বিজেপি ও মিত্রদের জয় অবশ্য হিন্দি অঞ্চলের প্রভাব খর্ব করবে।
ইতিমধ্যে ১৬তম লোকসভার নির্বাচনে বহু বড় নেতাঁ তাঁদের পার্টির পদ তথা ক্ষমতাঁ থেকে ইস্তফা দেওয়া শুরু করেছেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীিতশ কুমারের মতো সফল মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের পার্টির ব্যর্থতাঁর দায় গ্রহণ করে পদত্যাগ করেছেন। কংগ্রেসের ব্যর্থতাঁর দায়দায়িত্ব নিয়ে দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের চিন্তাতাঁভাবনা করছেন রাহুল ও তাঁর মা সোনিয়া গান্ধী৷ কয়েক দিনের মধ্যে পদত্যাগের আরও খবর পাওয়া যাবে। এখানেই ভারতের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরা নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত অবশ্যই।
অতি সাধারণ ঘরের অবহেলায় শৈশব কাটানো নরেন্দ্র মোদির উত্থার অতি দক্ষিণপন্থীদের উৎসাহিত করলেও ব্যক্তি মোদির উত্থানকে সাধারণ মানুষের উত্থান হিসেবে দেখা হবে এবং হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি যদি ভারতকে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, ‘সুশাসন’ দিতে পারেন, তবে উপমহাদেশে পরিবারতন্ত্রের জাল ছিঁড়ে সাধারণ মানুষের উত্থান ঠেকানো দুরূহ হতে পারে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার৷
hhintlbd@yahoo.com

যে নরেন্দ্র মোদি তিনবার গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সর্বভারত তথা বিশ্বে একজন অতি হিন্দুত্ববাদী এবং উগ্র ডানপন্থী হিসেবে বিবেচিত, সেই ব্যক্তি কীভাবে এ ধরনের উত্থান ঘটাতে পারলেন, তাঁ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর ওপর ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যা অন্যতম বেস্টসেলার হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার মদদদাতাঁ হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ভিসা স্থগিত করেছিল, তাঁকেই এখন বিশ্ববাসী বরণ করতে তৈরি হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সাফল্য একসময়ের কংগ্রেসশাসিত গুজরাটকে শিল্পায়িত ও ব্যবসাবান্ধব রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা। ভারতের ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক সাফল্যকে গুজরাট মডেল হিসেবে দেখা হয় এবং মোদির প্রচারণার অন্যতম স্লোগানই ছিল ‘বিকাশ’ বা উন্নয়ন।
দু–এক দিনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে ভারতের সরকার। কেমন হবে তাঁদের চরিত্র, কেমন হবে পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কেমনই বা হবে আগামী ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি—এ বিষয় নিয়েই আমাদের দেশসহ প্রতিবেশী দেশগুেলা চিন্তাতাঁর মধ্যে রয়েছে। এর আগেও ভারতে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার গঠন করে প্রশাসন চালিয়েছিল, তবে ওই সময়কার বিজেপি এবং বর্তমানের মধ্যে যে পার্থক্যটি, সেটি হলো নেতৃত্বে। অটল বিহারি বাজপেিয়র নেতৃত্বের পেছনে ছিল কয়েক দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাঁ এবং সর্বভারত তথা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি, যা মোদির নেই। তিনি রাজ্যের বাইরে ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন না বিধায় অভিজ্ঞতাঁর ঘাটতি নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে হবে। অবশ্য ভারতের রাজনীতি এবং সরকারব্যবস্থা এতই প্রতিষ্ঠিত যে পূর্ব-অভিজ্ঞতাঁ কম হলেও সরকার পরিচালনায় তেমন সমস্যা হয় না। রাজীব গান্ধী এর উদাহরণ।
অপরদিকে ক্রমেই রাজ্য সরকারগুলো যেভাবে শক্তিশালী ভূমিকা অর্জন করেছে, তাঁতে কেন্দ্রের শাসনের পরিধি সংকুচিত হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর প্রমাণ। এ বিষয়টিও মোদির জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে৷ তাঁর রাজনৈতিক উত্থান অনেকটা কল্পকাহিিনর মতো শোনা যেতে পারে, তবে অতি সাধারণ, অতি দরিদ্র ঘরের এই ব্যক্তির গড়ে ওঠার মধ্যে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ও জীবনদর্শন। রেলওয়ে স্টেশনের এক চা বিক্রেতাঁর ছেলের চিত্তের দৃঢ়তাঁর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল শৈশেবই৷ অখ্যাত এক মফস্বল শহর ভাদনগর রেলওয়ে স্টেশনের পাশের ছোট কুটিরে বেড়ে উঠছিলেন ‘ঘানচি’ বা বাংলায় কলু বা তেলি সম্প্রদায়ের মোদি। গুজরাটের ঘানচিদের পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী হিসেবেই মনে করা হয়৷ মোদির ঘানচি পরিবারে জন্মই তাঁকে গোত্রবৈষম্যের বিরুদ্ধ মনোভাবের ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবিই এবারের নির্বাচনের প্রচারে অনেকটা প্রভাব ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপট তাঁকে সাধারণ মানুষের অতি নিকটে টানতে সাহায্য করেছে। তিনি তাঁর এই জন্মসূত্রকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মোদি কোনো রাজনৈতিক পরিবারের ব্যক্তি নন বিধায় ভারতের রাজনীতিতে শক্ত পরিবারতন্ত্রের বিপক্ষের একজন হিসেবে ভারতের ৮১ কোটি ভোটারের সিংহভাগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদির অতি ভারতীয় ও দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে ছিল চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়। ১২ বছরের বালক মোদি ভাদনগর রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধফেরত আহত সৈনিকদের চা পরিবেশনকালে কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষানীতির দুর্বলতাঁ এবং ভারতের লজ্জাকর পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারেননি। ওই যুদ্ধের ফলাফল এবং সৈনিকদের পরাজয়ের গ্লানিমাখা মুখ কিশোর মোদির মনে যে গভীর রেখাপাত করে, তাঁরই প্রেক্ষাপটে তাঁর আরএসএসে যোগদানের কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। প্রথমে আরএসএসের সামান্য কর্মী থেকে প্রচার সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিষ্ঠিত হন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে সংঘ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাঁ এবং বিজেপি গঠিত হলে সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন।
বিজেপি বা ভারতীয় জনতাঁ পার্টি প্রথমে শ্যামা প্রসাদের জনসংঘ এবং পরে জনতাঁ পার্টির উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৮০ সালে, প্রধানত ভারত বিভক্তির পর পশ্চিমাঞ্চলের শরণার্থীদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক অঙ্গ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাঁয় আসীন হতে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই নরেন্দ্র মোদিই এবারের বিজেপির এই অবিশ্বাস্য উত্থানের নায়ক। মোদির অতি সাধারণ মানুষ হওয়াই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে ভারতীয়রা গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রায় ৬২ বছরের ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরু পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদির উত্থানই ছিল বিজেপির শক্তি, যা ভারতের রাজনীতিতে উচ্চ বর্ণের এবং পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। মোদির উত্থান ভারতীয় তথা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের রেওয়াজকে ভাঙতে হয়তোবা প্রেরণা জোগাতে পারে।
বিজেপি তথা মোদির এই ঝড় শুধু নেহরু-গান্ধী পরিবারকেই ধরাশায়ী করেনি, করেছে বিভিন্ন রাজ্যের অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ঘরানার। উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিং এবং তাঁর ছেলে মুখ্যমন্ত্রী শাসনকে নিচে নেমে এনেছে। সেখানে ৮০ আসনের মধ্যে ৭১টি মোদির বিজেপি অর্জন করেছে। উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিংয়ের নেতৃত্বে এসপি ও পরিবারতন্ত্রের দিন শেষের পথে। তেমনি নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চর্চিত বিএসপির নেতাঁ মায়াবতী ধরাশায়ী হয়েছেন। এসপি পেয়েছে মাত্র পাঁচটি আসন আর কংগ্রেসের নেহরু পরিবার ঐতিহ্যবাহী আমেথি এবং রায়বেরেলি ধরে রেখেছে মাত্র৷ উত্তর প্রদেশে রাহুল তথা নেহরু পরিবারের যে শোচনীয় অবস্থা, তাঁ ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। একইভাবে হিন্দি অঞ্চল বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশের মতোই অবস্থা মধ্য প্রদেশ, বিহার ও ছত্তিশগড়ের। অনেকেই মনে করেন, ভারতের রাজনীতিতে হিন্দি অঞ্চলের যে ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁ আর থাকছে না। মধ্যপ্রদেশে ২৯টি আসনের ২৭টিতে বিজেপি জয়ী হয়েছে। বিহারে ৪০টির মধ্যে বিজেপি ও মিত্ররা ৩১টি, ঝাড়খন্ডে ১৪টির মধ্যে ১৩টি, ছত্তিশগড়ে ১১টি আসনের ১০টি, এমনকি দিল্লির সাতটি আসনের সব কটিতেই বিজেপি ও মিত্রদের জয় অবশ্য হিন্দি অঞ্চলের প্রভাব খর্ব করবে।
ইতিমধ্যে ১৬তম লোকসভার নির্বাচনে বহু বড় নেতাঁ তাঁদের পার্টির পদ তথা ক্ষমতাঁ থেকে ইস্তফা দেওয়া শুরু করেছেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীিতশ কুমারের মতো সফল মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের পার্টির ব্যর্থতাঁর দায় গ্রহণ করে পদত্যাগ করেছেন। কংগ্রেসের ব্যর্থতাঁর দায়দায়িত্ব নিয়ে দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের চিন্তাতাঁভাবনা করছেন রাহুল ও তাঁর মা সোনিয়া গান্ধী৷ কয়েক দিনের মধ্যে পদত্যাগের আরও খবর পাওয়া যাবে। এখানেই ভারতের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরা নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত অবশ্যই।
অতি সাধারণ ঘরের অবহেলায় শৈশব কাটানো নরেন্দ্র মোদির উত্থার অতি দক্ষিণপন্থীদের উৎসাহিত করলেও ব্যক্তি মোদির উত্থানকে সাধারণ মানুষের উত্থান হিসেবে দেখা হবে এবং হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি যদি ভারতকে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, ‘সুশাসন’ দিতে পারেন, তবে উপমহাদেশে পরিবারতন্ত্রের জাল ছিঁড়ে সাধারণ মানুষের উত্থান ঠেকানো দুরূহ হতে পারে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments