আওয়ামী লীগ-জামায়াত-হেফাজত একাকার!
আল্লামা শফীর দোয়া নিচ্ছেন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ |
সম্প্রতি ২০০ নেতা-কর্মীসহ পাবনা জেলার আতাইকুলা ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির রাজ্জাক হোসেন রাজার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদানের খবরটি অনেককে বিস্মিত করেছে। এ কী করে সম্ভব? যেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় জামায়াতে ইসলামীকে রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও পাকিস্তানের দালাল বলে গালমন্দ করেন, সেখানে তাঁরা সেই দলের নেতা-কর্মীদের এভাবে সাদরে বরণ করেন কীভাবে? তবে বাংলাদেশে সবকিছুই সম্ভব। পত্রিকায় দেখলাম, এখন সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী; তিনি সোনার বাংলা করার জন্য সরকারকে তাঁদের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ কিছুদিন আগেও এই ধর্মীয় নেতা বর্তমান সরকারকে মুরতাদ ও নাস্তিক ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন। ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হেফাজদের সম্মেলনে আহমদ শফী বলেছেন, ‘হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ বলেন আর ছাত্রলীগ বলেন, সবাই আমাদের বন্ধু। এদের সঙ্গে কোনো আদাওয়াত (শত্রুতা) নাই। কেউ যদি বলে, হাসিনা সরকার আমাদের দুশমন, এটা আপনাদের বোঝাটা ভুল হবে। এদের কাউকে কোনো দিন আমি গাল দিই নাই।’ (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল, ২০১৪)
এর পাশাপাশি পত্রিকায় হেফাজতে ইসলামের আরও একটি খবর ছাপা হয়েছে, ১৯ এপ্রিল মানবজমিনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘অবশেষে রেলওয়ের ৩২ কোটি টাকার জমি গিফট দেওয়া হচ্ছে হেফাজত ইসলাম নেতা আল্লামা শফীকে। হাটহাজারী মাদ্রাসার নামে দুই বছর আগেই জায়গাটিতে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে।...রেলওয়ের জায়গাটি নিজেদের জন্য বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন আল্লামা শফী।’ (মানবজমিন, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪) আল্লামা শফী জমি পেয়েছেন কি না কিংবা সরকারের সঙ্গে তাঁর কোনো আঁতাত হয়েছে কি না, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। ধর্মীয় নেতারা আইয়ুব খান থেকে শুরু করে এরশাদ পর্যন্ত সব সামরিক শাসকের খেদমত করেছেন। যদিও বর্তমানে দেশে একটা ‘গণতান্ত্রিক সরকারই’ ক্ষমতায় আছে। আমাদের জিজ্ঞাসা, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থানটা কী? এত দিন যে দলটি বিএনপিকে হেফাজতি-জামায়াতিদের দোসর হিসেবে গালমন্দ করে আসছে, সেই দলটি কীভাবে কট্টর সাম্প্রদায়িক দলটির নেতা-কর্মীদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়। গতকাল জামায়াতের যে নেতা-কর্মীরা মওদুদীর আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন, আজ তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হয়ে গেলেন কীভাবে? কয়েক মাস আগেও আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা আহমদ শফীকে ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে ঠাট্টা-মশকরা করতেন। এরই মধ্যে এমন কী ঘটল যে হেফাজতের নেতা ‘শত্রু’ আওয়ামী লীগকে ‘বন্ধু’ ঘোষণা করলেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদান কিংবা হেফাজতের আমিরের বন্ধুত্বের আহ্বান দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটাবে কি না, সেটি জানার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এর ফলে দেশের মুক্তচিন্তার ও মুক্তমনের মানুষের যেটুকু আশা-ভরসা ছিল, সেটুকুও তিরোহিত হবে—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। উদ্বেগের জায়গাটা হলো, জাতীয় পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কারণে সেক্যুলার আওয়ামী লীগ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখেছে। জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা হলে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ হয়ে যাবে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে। সাম্প্রতিক গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে যে কাণ্ড ঘটেছে, তা অশনিসংকেত বলেই মনে করি।
শাহবাগের দ্বিখণ্ডিত হওয়া এবং হেফাজতের নেতার বন্ধুত্ব কামনার বিষয়টি কাকতালীয় ভাবার কারণ নেই। আতাইকুলার বাসিন্দাদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর উল্লিখিত নেতা-কর্মীরা মামলা থেকে বাঁচার জন্য আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এই বক্তব্য সঠিক হলে প্রথম যে সত্যটি বেরিয়ে আসে, তাহলো যাঁর বিরুদ্ধে যত মামলাই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগে যোগ দিলে সাত খুন মাফ। তাঁর কোনো শাস্তি হবে না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নেতারা জেনে-শুনে হত্যা-লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের আসামিদের নিজ দলে এনে যে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে চান, সেই শক্তি ভবিষ্যতে কার বা কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন? জামায়াত নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগদান এটাই প্রথম নয়। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কুষ্টিয়ায় জামায়াতের নেতাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। সম্প্রতি ১৯ দলের এক সভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের আঁতাত হয়েছে বলেও তিনি সন্দেহ করে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী ১৯-দলীয় জোটে থাকবে কি না, সে ব্যাপারে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে লাভ হবে না। কাজ ফুরালে তারা ছুড়ে ফেলে দেবে। বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনপূর্ব হত্যা, লুট, জ্বালাও-পোড়াওসহ গুরুতর অপরাধের দায়ে বিরোধী দলের, বিশেষ করে জামায়াতের যেসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তা নিয়ে প্রত্যয়ন-বাণিজ্য করছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। মামলার ধরনভেদে তাঁরা মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের নেতাদের আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে প্রত্যয়নপত্র থানায় জমা দেন। মামলা নিয়ে পুলিশ করে আটক-বাণিজ্য আর আওয়ামী লীগের নেতারা করেন প্রত্যয়ন-বাণিজ্য। মামলা করার সময় পুলিশের হিসাব থাকে, কত কম মামলায় কত বেশি আসামি দেখানো যায়। তাতে লাভ বেশি। বগুড়ায় পুলিশের এক কর্মকর্তা তো জামায়াতের নেতাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিনিময়ে জমি দলিল করিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও প্রথম আলোয় সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ফেঁসে যান। এ রকম পুলিশ কর্মকর্তা যে প্রশাসনে দ্বিতীয়টি নেই, সে কথা কি সরকার জোর দিয়ে বলতে পারবে? ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।
No comments