অধ্যাপক জাফর ইকবালের বক্তব্যের সঙ্গে কিছু কথা by নুরুল ইসলাম নাহিদ
আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক,
বিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্প্রতি ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’
বিষয়ে কয়েক দিনের ব্যবধানে পত্রপত্রিকায় তিনটি কলাম লিখেছেন। তাঁর
উদ্বেগ, ক্ষোভ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাগিদকে আমি আন্তরিকভাবে
স্বাগত জানাই। তাঁর জোরালো বক্তব্য আমাদের শক্তি জোগাবে এই জঘন্য অপরাধীদের
খুঁজে বের করতে এবং ভবিষ্যতে বিভ্রান্ত করতে না পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণে
স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল আমাদের শিক্ষা পরিবারের একজন তারকা সদস্য, অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মৌলিক কাজের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও খুবই সৌভাগ্যবান যে তিনি আমার একজন আন্তরিক শুভানুধ্যায়ী। তাঁর পরামর্শ ও সক্রিয় ভূমিকা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে নানাভাবে তিনি সক্রিয় আছেন। বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাঁরই নেতৃত্বে আমরা ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি তৈরি করে স্কুলে স্কুলে প্রচারণা চালিয়েছি। আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক রচনা, সম্পাদনা প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে তাঁর অবদান আমাদের সাফল্যের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাঁর লেখা বইপুস্তক আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এসব বই পড়ে তারা উদ্বুদ্ধ হয় এবং বিজ্ঞান বিষয়ে সহজে অনেক কঠিন বিষয় বুঝতে পারে। আমরা বিভিন্ন সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তাঁর ওপর চাপিয়ে দিই। তিনি সানন্দে তা সম্পাদন করেন। তাই তাঁকে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং শিক্ষায় সার্বিক সাফল্যের সঙ্গে আলাদা করে দেখা যায় না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে তিনি যে মতামত ব্যক্ত করেছেন, আমি তার চেয়ে কম উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ নই। তিনি লিখে তাঁর ক্ষোভ-উদ্বেগ যেভাবে প্রকাশ করতে পারেন, আমাকে শুধু সেটুকু করলেই চলে না। আমাকে আরও বেশি কিছু করতে হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে মূল যে কথা বলেছেন, আমরা কিছুই করছি না, এমনকি তিনি যে লিখছেন, তাও পড়ে দেখি না। আমরা নির্বিকার। হয় তো ক্ষোভে-দুঃখে তিনি এ কথা বলেছেন।
আমরা ২০০৯ সাল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ করছি। সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষা (ফল ১৭ মে প্রকাশিত হয়েছে) পর্যন্ত এ সময়ে একটি পরীক্ষারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, এমন অভিযোগ ওঠেনি। যদিও এর আগে অহরহ তা হয়েছে। কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। ২০১০ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল, যা আমরা আগেই ধরে অপরাধীদের খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
আমাদের কঠোর সতর্ক থাকা সত্ত্বেও এবারই প্রথম এইচএসসি পরীক্ষায় এমন অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটেছে।
পরীক্ষার শুরুর দিনের আগের দিনই প্রচার হয় প্রথম দিনের প্রশ্নপত্র (বাংলা প্রথমপত্র) ফাঁস হয়েছে। আমি সাংবাদিকদের নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে ফাঁস হয়েছে, এমন প্রশ্ন তাঁদের মেলাতে বলেছি। তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। বাংলা দ্বিতীয়পত্র, ইংরেজি প্রথমপত্র সম্পর্কেও গুজব থাকলেও কোনোটাই প্রমাণ করা যায়নি।
ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা ছিল ১০ এপ্রিল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কঠোর সতর্কতার কারণে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সন্ধান পেয়ে রাতেই আমরা পরীক্ষা স্থগিত করে ৮ জুন পরীক্ষার তারিখ পুনর্নির্ধারণ করি। এটি আমরাই করেছি। সংবাদমাধ্যম বা কোনো ব্যক্তি আমাদের জানাননি বা ফাঁস হয়েছে এমন প্রশ্নও তোলেননি। আমরাই সাংবাদিকদের অনুরোধ করি ১০ এপ্রিলের স্থগিত হওয়া পরীক্ষা ৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে, তা দয়া করে প্রচার করতে। তাঁরা সবাই সাহায্য করেছেন এবং এ জন্য সারা দেশে আমরা খবর পৌঁছাতে সক্ষম হই। রসায়ন প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে ব্যাপক (ফেসবুকসহ) প্রচার হলেও কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রশ্নপত্রের প্রচার হয়েছে, তা থেকে প্রথমপত্রে সাজেশন আকারে প্রচারিত ৯-১০টির মধ্যে তিনটি প্রশ্ন এবং দ্বিতীয়পত্রে প্রায় একই সংখ্যার সাজেশনের মধ্যে দুটি প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে। কথিত সাজেশনের সঙ্গে কিছু মিলতেই পারে। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজে বিভিন্ন শিরোনামে এভাবে সাজেশন প্রকাশ করা হয়েছে। যাঁরা করেছেন, তাঁরা এতে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কেন তাঁরা এই ঘৃণ্য কাজ করেছেন? এসব বিষয়ে আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছি। তাঁরা এই পেজগুলো বন্ধও করেছেন, কিন্তু এই দুষ্ট চক্র নতুন নতুন নামে এই অনৈতিক কাজ তার পরও করছে। সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র তৈরি করে সব বিষয়েই ব্যবসা বা সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিপদে ফেলার এবং পরীক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিনই প্রচার হয়েছে। তার দু-একটি প্রশ্ন যে মিলবে, তা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমন প্রমাণ নিশ্চিত না হওয়া গেলে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ জন ছাত্রছাত্রীর বিষয়ে যেনতেনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেটা আরও ক্ষতিকর হতে পারে। তাই বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। আমরা নিজেরাই সর্বাগ্রে নিশ্চিত হয়ে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছি। সুতরাং আমরা তা অস্বীকার করিনি, বরং নিজেরাই সর্বাগ্রে ব্যবস্থা নিয়েছি।
সুতরাং, আমরা জানি না বা স্বীকার করি না, এ কথাটি সঠিক নয়। মামলা করেছি। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। অনেকের সাহায্য নিচ্ছি। আমরা ড. জাফর ইকবালের লেখা পড়েছি না, এ কথাও ঠিক নয়। তাঁর যেকোনো লেখাই পড়ছি, যা আমাদের সম্পর্কে তা পড়ব না, এটা ভাবা আমাদের প্রতি অবিচার। এ দেশে এ রকম অবস্থায় আরও দশজন যা করে, আমরা তা করিনি। বড় বড় গরম-গরম কথা বলিনি। তবে কাজ করছি না, এ অপবাদ সঠিক নয়। এখন মনে হচ্ছে, অন্যদের মতো গরম কথা বলে প্রতিদিন মিডিয়ায় থাকলে হয়তো বাহবা পেতাম, তা আমি করি না।
আমরা তাত্ক্ষণিক দুটি তদন্ত কমিটি করেছি। একটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে। যেহেতু আমাদের জন্য গুরুতর ও মারাত্মক ঘটনা, তাই আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও করেছি, যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন। এই কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্ ও দক্ষ কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসাইন।
এই কমিটির সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের মধ্যে প্রধান হচ্ছে—ক. এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করা এবং কোথায় কীভাবে তা সংঘটিত হয়েছে, তা বের করা। খ. ভবিষ্যতে প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এখনো প্রায়ই কোনো প্রসঙ্গে খবর লেখা হয়।
এই কমিটি রাত-দিন পরিশ্রম করে কাজ করছে। সারা দেশে যাচ্ছে। যাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবে ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে, তাঁদের তালিকায় ড. জাফর ইকবালও রয়েছেন। কমিটির চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা সিলেট যাচ্ছেন জাফর ইকবালের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাঁর অভিমত ও ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ গ্রহণের জন্য। পরে বলেছেন, তাঁরা যাওয়ার আগের রাতে খবর নিয়েছেন, তিনি সিলেটে নেই, ঢাকায়। পরে আমিই বললাম, আরও তথ্য ও প্রমাণ বের করার পর এ রকম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরের দিকে সাক্ষাত্ করে তাঁদের অভিমত নিলে আমাদের ভবিষ্যত্ করণীয় নির্ধারণে সহায়ক হবে। তাই কমিটি এখনো তাঁর কাছে যায়নি। স্বাভাবিক নিয়মেই যাবে।
আমি কখনো আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বা সমালোচনা করলে তার পাল্টা কোনো বক্তব্য বা প্রতিবাদ করি না। আমি তা বোঝার ও উপলব্ধির চেষ্টা করি। ভুল থাকলে শুদ্ধ করার চেষ্টা করি। না থাকলে বা আমার কাছে সঠিক মনে না হলেও চুপ থাকি। কোথাও এমন প্রমাণ পাবেন না যে আমার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনার প্রতিবাদ করেছি। আমার ত্রুটি বা সমালোচনা (সঠিক না হলেও) আমার কাজকর্মের জন্য এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার জন্য সহায়ক বলে মনে করি এবং এটাই আমার রাজনৈতিক শিক্ষা।
বিশেষ করে আমার শ্রদ্ধেয় ও শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক জাফর ইকবালের কোনো বক্তব্যের প্রতিবাদ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি শুধু তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে কয়টি পয়েন্ট যোগ করেছি মাত্র।
আমাদের তদন্ত কমিটি, সরকারের বিভিন্ন জেলার ও স্তরের কর্মকর্তা, বিভিন্ন এজেন্সি প্রশ্ন ফাঁসকারীদের খুঁজে বের করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সাড়ে পাঁচ বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার এটাই একমাত্র ঘটনা। আমরা এ জন্য অনেক ধরনের কাজ করছি। এগুলো প্রচার করার উপযুক্ত সময় হয়নি। তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত অনেক কথাই বলা আমার জন্য সমীচীন নয়। এতে তদন্ত ব্যাহত হতে পারে বা অপরাধীরা সুযোগ নিতে পারে।
আমি শিক্ষাপরিবারের একজন সদস্য হিসেবে এ ব্যাপারে অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং সঙ্গেসঙ্গে দেশবাসীর সাহায্য চাই। শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়ে অপরাধীদের অনৈতিক প্রচারের পিছে ছুটবে না। আপনারা যাঁরা দেশ ও জাতির বিবেক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাঁরা দয়া করে নকল করা, ফাঁসকৃত প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা দেওয়াকে ঘৃণা করার জন্য আহ্বান জানালে আমাদের কোমলমতি পরীক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হবে। যারা প্রশ্ন দিচ্ছে বা প্রচার করছে (সত্য/মিথ্যা যা-ই েহাক), দয়া করে তাদের ধরিয়ে দিন। এত প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু একজন দায়িত্বশীল মানুষও কেন তাদের ধরে বা তাদের পরিচয় আমাদের তদন্ত কমিটিকে দিচ্ছেন না? এটা কি আমাদের সবার দায়িত্ব নয়? যার কাছ থেকেই পান, তাকে ধরিয়ে দিন; তার মাধ্যমে আমরা গোড়ায় পৌঁছাতে পারি। এ কাজ কেন কেউ করেন না? অপরাধীদের ধরতে দয়া করে সবাই সাহায্য করুন।
No comments