সব দায় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের?
ব্যাংকিং খাতের যেকোনো ক্ষতি, অনিয়ম বা বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ব্যাংক তত্ত্বাবধায়ক বা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তোলা অনেকটা নিয়মিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক কালের কিছু ব্যাংকের অনিয়মের ঘটনা এবং অতি সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের ঋণ শ্রেণীকরণের বা খেলািপ ঋণের বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া দেখে তাই প্রতীয়মান হয়। শেয়ারবাজার চাঙা না হওয়ার পেছনেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতিবাচক দৃষ্টিভিঙ্গ খোঁজা হয়েছিল। এমনকি ২০১৩ সালের শেষার্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়তা তথা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহীত বিশেষ ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোকেও নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক হিসেবে এ খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নজরদাির এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বের কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। তবে সব ধরনের ক্ষতি বা অনিয়মের দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের—এমনটি ভাবা কি যুক্তিযুক্ত? বাংলাদেশ ব্যাংক কি এককভাবে ব্যাংকের সব ক্ষতি বা অনিয়ম প্রতিরোধ করতে পারে? আমাদের ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনব্যবস্থা কি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে পর্যাপ্ত সহায়তা করছে? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে বিভিন্ন ব্যাংকের সাম্প্রতিক অনিয়মের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় কতটুকু। এই লেখা এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটি প্রচেষ্টা। গত বছরের শেষের দিকের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে যে গুরুতর অস্থিতিশীলতা এসেছিল, তা সবাই জানি। সে সময় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হুমকির মুখে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের দায় মেটাতে অসমর্থ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতির বিদ্যমান নিয়মাবিলর কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার অবস্থায় ছিল না। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেয় এবং সঞ্চিতি বিধিমালা কিছুটা শিথিল করে। বিশেষ অবস্থায় অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এহেন উদারতা কি অনভিপ্রেত? বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শ্রেণীকৃত বা খেলািপ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিধিমালা শৈথিল্যকরণকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের ব্যাংকের সহায়তায় অপব্যবহার করেছে। কিন্তু অনেক ভালো ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকিং খাত এ পদক্ষেপ থেকে লাভবানও হয়েছে। আমি মনে করি, ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহীত পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় ছিল। অনিয়মের কিছু ঘটনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ইতিবাচক প্রচেষ্টার পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং শ্রেণীকরণকৃত/খেলাপি ঋণের সাম্প্রতিক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সৃষ্ট পরিস্থিতিকেই দায়ী করা যায়। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওই নাজুক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রচলিত বিধিমালায় অবিচল থাকত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত এবং অর্থনীতির ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরণ আরও বিলম্বিত হতো। অবশ্যই খেলািপ ঋণের বৃদ্ধি অনাকাঙ্ক্ষিত, তবে বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক বিচারে তা অস্বাভাবিক নয়। আমি মনে করিয়ে দিই, সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার সময়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমৃদ্ধ ও সুগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে নিয়মের বাইরে এসে ব্যাংকগুলোকে অর্থ সাহায্য দিতে হয়েছে, যা বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের আওতায় অগ্রহণযোগ্য হলেও অর্থনৈতিক বিবেচনায় কাম্য ছিল। আমরা অবগত আছি যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কিছু অনিয়মের ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ সময়ের অনিয়মের দায়ভারও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে কিছু অসাধু ব্যাংকারের সহায়তা ছাড়া এসব কর্মকাণ্ড সম্ভব ছিল না, যা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনব্যবস্থার নজরদারিতে না আসার কোনো কারণ নেই। অথচ এ বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সাধারণত ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত করে, তখন সেটিকে প্রতিরোধ করার মতো পর্যাপ্ত সময় থাকে না। হয়তো শাস্তি বা পরবর্তী অনিয়ম মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এসব অনিয়ম প্রতিরোধ করতে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করার কোনো বিকল্প নেই। এ কথা প্রতিষ্ঠিত যে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনব্যবস্থার সহায়তার সাপেেক্ষই কেবল ব্যাংক তত্ত্বাবধানের সর্বোত্তম সুফল পাওয়া সম্ভব। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ব্যাংকিং খাতকে টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক তত্ত্বাবধান এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নজরদািরর ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতির নিয়মাবলি কঠিনতর করার পরেও ব্যাংকগুলোতে খেলাপি বা ঋণ শ্রেণীকরণের পরিমাণ কমে এসেছে এবং কিছু অনিয়ম ও জালিয়াতির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ব্যাংকিং খাতে সার্বিক শৃঙ্খলা বজায় রয়েছে। আমার বিশ্বাস, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান ও নজরদারির ক্ষেত্রে যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে, তার ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় উত্তরোত্তর ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব: অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)৷
ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব: অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)৷
No comments