বিনা, বাউকুল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় by সোহরাব হাসান

বাউ ড্রাগন ফলেরও উদ্ভাবক অধ্যাপক এম এ রহিম
গত বৃহস্পতিবার আমরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম সেখানকার গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (জিটিআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। উপলক্ষ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা। এবারের কর্মশালায় ২০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন।
ব্রহ্মপুত্রের পারে ১ হাজার ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি মনে পড়ল। ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।’ ঠিক ক্যাম্পাস বলতে যা বোঝায়, এটি তার চেয়েও বেশি নান্দনিক। বলা যায়, সবুজ শস্যখেত, বাগান, পুকুর ও খামারই এখানকার শ্রেণিকক্ষ।
রবীন্দ্রনাথ যে ধানের শিষের ওপরে শিশির বিন্দু দেখেছিলেন, সেই ধানের এবং আরও অনেক জাতের ফসল নিয়েই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন ও অনুশীলন। সাধারণভাবে অভিযোগ আছে, বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর চত্বরে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাজ দেখলে সেই অভিযোগ অসার মনে হবে।
১৮ অক্টোবর প্রথম আলোয় ইফতেখার মাহমুদের লেখা প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: জমি কমলেও চাল উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ (১৯৭১-২০১৫)। একইভাবে বেড়েছে ভুট্টা, গম, বিভিন্ন জাতের ফল, সবজি, মাছ, গবাদিপশু ইত্যাদির উৎপাদনও। এর আগে মৎস্য চাষ, সবজি চাষে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়েও বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। এই উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশের কৃষকদের অবদানই যে সবচেয়ে বেশি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা যদি নতুন নতুন জাতের শস্য, ফল, সবজি, সার, বীজ ইত্যাদি উদ্ভাবন না করতেন, তাহলে কোনোভাবেই কৃষিতে এই সাফল্য পাওয়া যেত না। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গবেষণা প্রকল্পের কাজ
শেষ করেছেন। বর্তমানে দুই শতাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। গবেষণা করেছে অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটও। কিন্তু মানতে হবে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ই এর পথিকৃৎ। আমরা গবেষণা বলতে বইপত্র তথ্য–উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণকে বুঝি। কিন্তু এখানকার গবেষক ও শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাঠের পাশাপাশি মাঠের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগান।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত বাউকুলের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। কয়েকজন সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. শাহিদুজ্জামান যখন আমাদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রকল্প ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তখনই বাউকুলের প্রসঙ্গটি এল। জিজ্ঞেস করলাম, বাউকুল উদ্ভাবক কে? তাঁরা সমস্বরে বললেন, অধ্যাপক এম এ রহিম। জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক। আমরা সেই সেন্টারে বিভিন্ন বাহারি ফল দেখছিলাম। এরই মধ্যে তিনি এলেন। পরিচয় হলো। সেখানে দেশ-বিদেশের নানা জাতের ফলের চাষ ও গবেষণা হচ্ছে। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, দেশে তো আপনার বাউকুল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বিদেশে বাজার পেয়েছে কি? তিনি বললেন, ৫৭টি দেশ বাউকুল নিয়েছে চাষবাসের জন্য। এর বিনিময়ে তারা বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেয় মেধাস্বত্বের মাশুল হিসেবে।
কেবল বাউকুল নয়, আরও বেশ কিছু ফলের জাত উদ্ভাবন করেছেন তিনি। এ জন্য ২০১২ সালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদক দেওয়া হয়। কেবল পেয়ারাগাছ বাঁকা করে অধ্যাপক এম এ রহিম এমন এক চাষপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যাতে পেয়ারার উৎপাদন ১০ গুণ বেড়েছে। তিনি দেখিয়েছেন পেয়ারা চাষের জন্য শুধু বর্ষকালই উপযুক্ত নয়, সব ঋতুতেই পেয়ারার চাষ হতে পারে। শীতকালের পেয়ারা বেশি মিষ্টি হয়।
২০০৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে এম এ রহিম ড্রাগন ফলের চারা নিয়ে এসে এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে চাষ করেন। এখন বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবেও ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে। গাছটি দেখতে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো।
জিজ্ঞেস করলাম এশিয়ার মধ্যে কোন দেশটি কৃষিতে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে? তিনি বললেন, ভিয়েতনাম। কারণ, যুদ্ধের পর দেশটির নেতা হো চি মিন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখন সবাই মিলে দেশটা গড়ে তোলো।’
ভিয়েতনামিরা দেশটা গড়ে তুলেছে। আমরা কি পেরেছি?
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আরও যেসব সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর জাত উদ্ভাবন। এটি করেছেন পশু প্রজনন বিজ্ঞানী অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম। বাড়ির ছাদে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারবিহীন একই সঙ্গে মাছ ও সবজি উলম্ব একোয়া পনিক্স পদ্ধতিতে চাষ করার কৌশল আবিষ্কার করেছেন মৎস্যবিজ্ঞানী ড. এম এ সালাম।
উন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই–অক্সাইড ও মিথেনের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ করে যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ নিঃসরিত এসব কার্বন গ্রহণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করছে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটি উদ্ঘাটন করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল বাতেন।
জার্মপ্লাজম সেন্টারে ফল ও ফসলের ৯০টিরও বেশি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, রাইজোবিয়াম জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং কিট, হাওর এলাকায় হাঁস পালনের কলাকৌশল, গবাদিপশুর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহার, মাছের বংশপরিক্রমা নির্ণয়, তারাবাইম, গুচিবাইম, বড় বাইম, কুচিয়া ও বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন, কচি গমের পাউডার উৎপাদন, নিরাপদ শুঁটকি তৈরির টানেল উদ্ভাবন, বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার স্থাপন, গাভির ওলান প্রদাহ রোগ নির্ণয়পদ্ধতি আবিষ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য সাফল্য। এ ছাড়া সার ছিটানো যন্ত্র, উন্নত জাতের মুরগির জাত, অধিক মাংস উৎপাদনকারী সংকর গরুর জাত, পশুপাখির টিকা, ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ যন্ত্রও উদ্ভাবন করা হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবটাই গৌরবের নয়। এখানেও হানাহানি আছে, আছে হল দখলের ঘটনা। গত বছর ছাত্রলীগের কর্মী সাদকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীরা। এরপর ওই সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও এখনো তাঁরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর আগে ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষে রাব্বি নামে একটি শিশু মারা যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাঞ্ছিত হয়েছেন সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের হাতে। উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে।
ওই অনুষ্ঠানে আলাপ হয় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. শমসের অালীর সঙ্গে। তিনি আমাদের তাঁর প্রতিষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তাঁরা কীভাবে কাজ করছেন, কী কাজ করছেন, সেিট দেশবাসীর জানা দরকার। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য বেশ কয়েকটি জাতের লবণাক্ত–সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব পরমাণু গবেষণাগার নেই। ফলে তারা জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কাজ করে। এই ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা বর্তমানে বিনা ২৯ নামে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে; যা প্রচলিত ধানের উৎপাদন সময়ের চেয়ে ১৫ দিন কম সময় লাগবে। এ ছাড়া বিনার কৃষিবিজ্ঞানীরা উচ্চ ফলনশীল ৮টি জাতের ধান, ৮টি জাতের সরিষা, ৬টি জাতের চিনাবাদাম, ২টি জাতের সয়াবিন, ৮টি জাতের মুগ, ৬টি জাতের ছোলা, ৬টি জাতের মসুর, ৩টি জাতের পাট, ৭টি জাতের টমেটো ও ২টি জাতের বিনা তিল উদ্ভাবন করেছে।
শমসের আলী জানালেন, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানটি নিরন্তর গবেষণা করছে, যাতে দেশ খাদ্যে স্বাবলম্বী হয়। তবে তাঁরা এখন বেশি জোর দিয়েছেন তেলবীজের ওপর। প্রিতবছর বিদেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এই আমদানিনির্ভরতা কমাতে চাষ করা হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল সয়াবিন ও সূর্যমুখী।
কৃষি উন্নয়নে আরও যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তার মধ্যে রয়েছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের অগ্রগতিকে অনেক বিদেশি পণ্ডিত ধাঁধা বলে উল্লেখ করেেছন। আসলে সেই ধাঁধার রহস্যটা কৃষিতেই নিিহত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.