ব্যাংকারদের কর্মসময় এবং মানবসম্পদ by ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও ব্যাংকারদের অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি |
ব্যাংকারদের
সম্পর্কে একটা কৌতুক প্রায় সবারই জানা, সেটা হচ্ছে একজন ব্যাংকারকে তাঁর
সন্তানেরা কত বড় হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি দুই হাত পাশাপাশি ফাঁক করে
বোঝাতে চেষ্টা করেন সন্তানের দৈর্ঘ্য। কারণ ছেলে কিংবা মেয়েকে তিনি প্রায়
কখনোই দাঁড়ানো অবস্থায় দেখার সুযোগ পান না, তাঁর অফিসে যাওয়ার সময় এবং
ফেরার পরও দেখতে পান ঘুমন্ত অবস্থায়। আসলেই বিষয়টা কি আদৌ কৌতুকপ্রদ?
তথ্যপ্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের দিনে সত্যসম প্রসঙ্গটা নিয়ে ভাবার সময়
এসেছে।
বর্তমান প্রজন্মের ব্যাংকাররা বিশাল লেজার বই, টোকেন বা স্ক্রল, ব্যালান্সিং, ক্যালকুলেটরবিহীন হিসাব—এসব কোনো কিছুর সঙ্গে পরিচিত নন। আমাদের দেশে ব্যাংকিংয়ের হিসাবরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। এই নতুন প্রযুক্তি চালু হওয়ার আগে ব্যাংকারদের জীবন ওপরের কৌতুকের মতো না হলেও তার কাছাকাছি ছিল। লেজারে ভুল পোস্টিংয়ের জন্য ব্যালান্সিং না হলে (অর্থাৎ লেজার বইগুলোর মোট স্থিতি অক্সিলিয়ারি লেজারের সঙ্গে না মিললে) ব্যাংকারদের বহু সন্ধ্যা রাত অবধি গড়িয়ে গেছে ভুল খুঁজে বের করার জন্য। প্রতিবছর জুন এবং ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ ছিল ব্যাংকারদের জন্য কেয়ামতের দিন, অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক হিসাব মেলানোর এই দুই তারিখে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাঁদের, তখন এমনকি ক্যালকুলেটরের ব্যবহারও ছিল সীমিত। বর্তমান সময়ে হিসাব মেলানোর জন্য কম্পিউটারের বদৌলতে জুন বা ডিসেম্বরের শেষ দিনের সঙ্গে অন্যান্য মাসের শেষ তারিখের কোনো পার্থক্য টেরই পান না ব্যাংকাররা। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার পরও ব্যাংকারদের জীবনযাত্রায় তেমন পরিবর্তন এসেছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বাত্মক হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাংকারদের দায়িত্ব। একসময় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ছিল আমানত গ্রহণ এবং ঋণ দেওয়া। তারপর বাণিজ্যিক কারণে দিনে দিনে বেড়েছে সেবার পরিধি, তার সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি। ব্যাংকিং নিয়মাচারকে কঠোর শৃঙ্খলায় বেঁধে মূলধন ভিত্তি শক্ত করার জন্য বাসেল ১ এবং ২-এর ধারাবাহিকতায় বাসেল ৩ প্রণীত হলে ব্যাংকারদের দায়িত্ব এবং সতর্কতা আরও বেড়ে যাবে। এর মধ্যে ২০০৩ সালে চালু হওয়া মানি লন্ডারিং আইন এবং কেওয়াইসি (নো ইয়োর কাস্টমার) বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের ফলে ব্যাংকারদের এই দায়িত্ব কেবল ব্যাংকের ওপর থাকে না, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার ওপরও বর্তায়। তাই কোরবানির গরুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র বসানো থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয়
মূলধন সংরক্ষণ নিশ্চিত করা, ঈদের ছুটির মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা থেকে কর ও শুল্ক ফাঁকি, কালোটাকা ও জঙ্গি অর্থায়নের উৎস খোঁজা কিংবা আমেরিকান নাগরিকদের কেউ দ্বৈত কর থেকে রেহাই পাচ্ছেন কি না—সবই ব্যাংকারদের দেখতে হয়।
যদিও শেষোক্ত এসব কর্মকাণ্ড রোধের জন্য রয়েছে একাধিক এবং অধিক ক্ষমতাধর সংস্থা। এর সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া তো রয়েছেই। ফলে ব্যাংকের হিসাবরক্ষণের জন্য কম্পিউটার প্রবর্তন করে কর্মসময়ের সাশ্রয় ঘটালেও তার কোনো সুবিধা ব্যাংকাররা পাননি। একসময় প্রযুক্তিবিহীন ব্যবস্থায় ব্যাংকাররা যেমন কখনোই বিকেলের আলোর মুখ দেখতে পারতেন না, এখন প্রায় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়ও এমন অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। একসময় সনাতনী ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে দৈনন্দিন কর্মদিবসের সময়ের অতিরিক্ত কাজ করাকে দক্ষতা এবং পরিশ্রমের মাপকাঠি বলে ধরা হতো। এমনকি এমনও শেখানো হতো যে একজন ভালো ব্যাংকার সব সময়ই খারাপ স্বামী বা পিতা। অর্থাৎ একজন ভালো ব্যাংকারকে সব সময়ই রাত করে ঘরে ফিরতে হবে। অথচ নির্ধারিত কর্মসময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরা যে সত্যিকার দক্ষতার পরিচায়ক, এই সরল সত্যটা সে সময় এবং বর্তমান সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের নতুন ধারণাতেও প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
ব্যাংকারদের বহুমুখী কর্মপরিধি, ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা এবং কঠোর নিয়মাচার পরিপালনের চাপ কেবল তাঁদের সাময়িক ক্ষতিই করে না, দীর্ঘ মেয়াদে জন্ম দেয় বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত, মানসিক এবং সামাজিক জটিলতার। যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে জানা যায়, ব্যাংকারদের মানসিক চাপসৃষ্ট জটিলতা নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন উদ্বিগ্ন। মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য ব্যাংক অব আমেরিকা, কেপিএমজি, মর্গান স্ট্যানলি, প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার, লয়েডস ব্যাংকিং গ্রুপ এবং গোল্ডম্যান স্যাকসসহ ডজন খানেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিটি মেন্টাল হেলথ অ্যালায়েন্স’ নামের একটা সংগঠন এক জরিপে দেখিয়েছে, ব্রিটিশ চাকরিজীবীদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন উদ্বেগ এবং ডিপ্রেশনের শিকার। কর্মস্থলে ব্যয় করা সময়ের স্থায়িত্ব এবং পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানসিক সুস্থতা এবং কর্মদক্ষতা—এই উপসর্গটির বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহীরা ওয়াকিবহাল যে এর ফলে দক্ষ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন এবং কামাই করার প্রবণতা ব্যবসায়ের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে ‘ব্যাংক ওয়ার্কার্স চ্যারিটি’ নামের আরেকটা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণা জরিপে তুলে এনেছে যে যুক্তরাজ্যে আর্থিক সমস্যা বা উদ্বেগ, গুরুদায়িত্বের চাপ এবং ভবিষ্যতের ভাবনা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের দক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গবেষণায় কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য তিনটি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে: অনুপভোগ্য চাকরি, কর্মক্ষেত্র ও পরিবার বা ব্যক্তিগত জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাবের দুশ্চিন্তা এবং চাকরির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহীত উপাত্ত থেকে জানা যায়, ৬০ শতাংশ ব্যাংকার অনিয়মিত নিদ্রারোগে ভোগেন, ৪৭ শতাংশ থাকেন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় আর ৪০ শতাংশ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
কয়েক বছর আগে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক আবিষ্কার করেছেন যে আমেরিকার নবীন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারদের কারও কারও মধ্যে অনিদ্রা, মাদকাসক্তি, খাবারে অরুচি, বদমেজাজ ইত্যাদির প্রকোপ দেখা গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম বছর দুয়েক এসব ব্যাংকার সপ্তাহে ৮০ থেকে ১২০ ঘণ্টাও কাজ করেন। চতুর্থ বছরে গিয়ে এঁরা ভুগতে শুরু করেন নিদ্রাহীনতায়। কারও মধ্যে দেখা গেছে নানান রকম অ্যালার্জি, মাদকাসক্তি, চর্মরোগ, (সোরিয়াসিস) আর্থ্রাইটিস এবং থাইরয়েডের সমস্যা। আমাদের দেশে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের তেমন বড় কোনো প্রভাব না থাকলেও এই উপসর্গের কিছুটা বাণিজ্যিক ব্যাংকারদের মধ্যেও মিলতে পারে, যদি তেমন কোনো গবেষণা চালানো যায়। জেপি মর্গান চেজ অ্যান্ড কোম্পানির এক সাবেক প্রধান নির্বাহীর বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেরই চাকরির কয়েক বছরের মাথায় ৩০ থেকে ৪০ পাউন্ড ওজন বেড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এই সমস্ত তথ্য এবং গবেষণালব্ধ আবিষ্কার থেকে পাশ্চাত্য বিশ্বের নানান পেশা, বিশেষত ব্যাংকিংয়ে নিয়োজিত মানুষের সমস্যার কথা উঠে এসেছে।
এ রকম উপলব্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক নির্দেশনায় কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ করে মহিলাদের নির্ধারিত ব্যাংকিং সময়সূচির পর কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে আদেশ জারি করেছে। এই নির্দেশনা যে কেবল অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে উপস্থিতিকে নিরুৎসাহিত করছে তা নয়, বরং এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের ফলে নিশ্চিত হতে পারে দেশের ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত মানবসম্পদের পরিচর্যা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের যথাযথ নিরাপত্তা। অদূরদর্শিতার কারণে আমরা খুব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারি না, তাই উপলব্ধি করতে পারি না কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানবসম্পদ উন্নয়নে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মসময়ের বাইরের এই সময়টুকু কেবল চাকরিজীবীদের সন্তানদের দেখাশোনা করা, কিংবা পরিবারের সদস্যদের আরও বেশি সময় দেওয়ার প্রয়োজনেই নয়, তাঁরা নিজেরাও যাতে বাড়তি জ্ঞানার্জনের কিছুটা সময় দিতে পারেন, কিংবা যুক্ত হতে পারেন সামাজিক বা বিনোদনমূলক কাজে। ব্যাংকারদের বছরে একবার বাধ্যতামূলক দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার বিধানটাও এ জন্যই জারি করা হয়েছে, যাতে তাঁরা কিছুদিন সব মানসিক চাপমুক্ত থেকে অবসর যাপন করতে পারেন।
বর্তমান সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সুযোগ কম বলে কর্মসময়ের বাইরের সময়টুকু পড়াশোনায় ব্যয় করা জরুরি এবং আগ্রহীরা সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে চান। বিশ্বব্যাংকের ২০১২ সালের জ্ঞান অর্থনীতি সূচকে (নলেজ ইকোনমি ইনডেক্স) ১৪৬টা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭তম, অর্থাৎ তালিকার সর্বশেষ দশটি দেশের একটি। অন্য নয়টি দেশ হচ্ছে সুদান, জিবুতি, ইথিওপিয়া, গিনি, ইরিত্রিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, মিয়ানমার ও হাইতি। এই সূচক থেকে আমাদের মানবসম্পদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের দৈন্যদশার পরিমাপ করা যায়।
এ ছাড়া দেশের গণপরিবহনের অব্যবস্থার কারণে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ব্যাংকে কাটিয়ে নিত্য ঘরে ফেরার কঠোর সংগ্রামের পর সাধারণ কর্মজীবী কিংবা ব্যাংকারদের পক্ষে পরিবারের অন্য সদস্যদের সময় দেওয়া কিংবা জ্ঞানচর্চা কোনোটাই সম্ভব হয় না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
বর্তমান প্রজন্মের ব্যাংকাররা বিশাল লেজার বই, টোকেন বা স্ক্রল, ব্যালান্সিং, ক্যালকুলেটরবিহীন হিসাব—এসব কোনো কিছুর সঙ্গে পরিচিত নন। আমাদের দেশে ব্যাংকিংয়ের হিসাবরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। এই নতুন প্রযুক্তি চালু হওয়ার আগে ব্যাংকারদের জীবন ওপরের কৌতুকের মতো না হলেও তার কাছাকাছি ছিল। লেজারে ভুল পোস্টিংয়ের জন্য ব্যালান্সিং না হলে (অর্থাৎ লেজার বইগুলোর মোট স্থিতি অক্সিলিয়ারি লেজারের সঙ্গে না মিললে) ব্যাংকারদের বহু সন্ধ্যা রাত অবধি গড়িয়ে গেছে ভুল খুঁজে বের করার জন্য। প্রতিবছর জুন এবং ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ ছিল ব্যাংকারদের জন্য কেয়ামতের দিন, অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক হিসাব মেলানোর এই দুই তারিখে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাঁদের, তখন এমনকি ক্যালকুলেটরের ব্যবহারও ছিল সীমিত। বর্তমান সময়ে হিসাব মেলানোর জন্য কম্পিউটারের বদৌলতে জুন বা ডিসেম্বরের শেষ দিনের সঙ্গে অন্যান্য মাসের শেষ তারিখের কোনো পার্থক্য টেরই পান না ব্যাংকাররা। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার পরও ব্যাংকারদের জীবনযাত্রায় তেমন পরিবর্তন এসেছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বাত্মক হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাংকারদের দায়িত্ব। একসময় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ছিল আমানত গ্রহণ এবং ঋণ দেওয়া। তারপর বাণিজ্যিক কারণে দিনে দিনে বেড়েছে সেবার পরিধি, তার সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি। ব্যাংকিং নিয়মাচারকে কঠোর শৃঙ্খলায় বেঁধে মূলধন ভিত্তি শক্ত করার জন্য বাসেল ১ এবং ২-এর ধারাবাহিকতায় বাসেল ৩ প্রণীত হলে ব্যাংকারদের দায়িত্ব এবং সতর্কতা আরও বেড়ে যাবে। এর মধ্যে ২০০৩ সালে চালু হওয়া মানি লন্ডারিং আইন এবং কেওয়াইসি (নো ইয়োর কাস্টমার) বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের ফলে ব্যাংকারদের এই দায়িত্ব কেবল ব্যাংকের ওপর থাকে না, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার ওপরও বর্তায়। তাই কোরবানির গরুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র বসানো থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয়
মূলধন সংরক্ষণ নিশ্চিত করা, ঈদের ছুটির মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা থেকে কর ও শুল্ক ফাঁকি, কালোটাকা ও জঙ্গি অর্থায়নের উৎস খোঁজা কিংবা আমেরিকান নাগরিকদের কেউ দ্বৈত কর থেকে রেহাই পাচ্ছেন কি না—সবই ব্যাংকারদের দেখতে হয়।
যদিও শেষোক্ত এসব কর্মকাণ্ড রোধের জন্য রয়েছে একাধিক এবং অধিক ক্ষমতাধর সংস্থা। এর সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া তো রয়েছেই। ফলে ব্যাংকের হিসাবরক্ষণের জন্য কম্পিউটার প্রবর্তন করে কর্মসময়ের সাশ্রয় ঘটালেও তার কোনো সুবিধা ব্যাংকাররা পাননি। একসময় প্রযুক্তিবিহীন ব্যবস্থায় ব্যাংকাররা যেমন কখনোই বিকেলের আলোর মুখ দেখতে পারতেন না, এখন প্রায় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়ও এমন অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। একসময় সনাতনী ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে দৈনন্দিন কর্মদিবসের সময়ের অতিরিক্ত কাজ করাকে দক্ষতা এবং পরিশ্রমের মাপকাঠি বলে ধরা হতো। এমনকি এমনও শেখানো হতো যে একজন ভালো ব্যাংকার সব সময়ই খারাপ স্বামী বা পিতা। অর্থাৎ একজন ভালো ব্যাংকারকে সব সময়ই রাত করে ঘরে ফিরতে হবে। অথচ নির্ধারিত কর্মসময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরা যে সত্যিকার দক্ষতার পরিচায়ক, এই সরল সত্যটা সে সময় এবং বর্তমান সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের নতুন ধারণাতেও প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
ব্যাংকারদের বহুমুখী কর্মপরিধি, ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা এবং কঠোর নিয়মাচার পরিপালনের চাপ কেবল তাঁদের সাময়িক ক্ষতিই করে না, দীর্ঘ মেয়াদে জন্ম দেয় বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত, মানসিক এবং সামাজিক জটিলতার। যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে জানা যায়, ব্যাংকারদের মানসিক চাপসৃষ্ট জটিলতা নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন উদ্বিগ্ন। মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য ব্যাংক অব আমেরিকা, কেপিএমজি, মর্গান স্ট্যানলি, প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার, লয়েডস ব্যাংকিং গ্রুপ এবং গোল্ডম্যান স্যাকসসহ ডজন খানেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিটি মেন্টাল হেলথ অ্যালায়েন্স’ নামের একটা সংগঠন এক জরিপে দেখিয়েছে, ব্রিটিশ চাকরিজীবীদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন উদ্বেগ এবং ডিপ্রেশনের শিকার। কর্মস্থলে ব্যয় করা সময়ের স্থায়িত্ব এবং পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানসিক সুস্থতা এবং কর্মদক্ষতা—এই উপসর্গটির বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহীরা ওয়াকিবহাল যে এর ফলে দক্ষ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন এবং কামাই করার প্রবণতা ব্যবসায়ের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে ‘ব্যাংক ওয়ার্কার্স চ্যারিটি’ নামের আরেকটা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণা জরিপে তুলে এনেছে যে যুক্তরাজ্যে আর্থিক সমস্যা বা উদ্বেগ, গুরুদায়িত্বের চাপ এবং ভবিষ্যতের ভাবনা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের দক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গবেষণায় কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য তিনটি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে: অনুপভোগ্য চাকরি, কর্মক্ষেত্র ও পরিবার বা ব্যক্তিগত জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাবের দুশ্চিন্তা এবং চাকরির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহীত উপাত্ত থেকে জানা যায়, ৬০ শতাংশ ব্যাংকার অনিয়মিত নিদ্রারোগে ভোগেন, ৪৭ শতাংশ থাকেন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় আর ৪০ শতাংশ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
কয়েক বছর আগে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক আবিষ্কার করেছেন যে আমেরিকার নবীন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারদের কারও কারও মধ্যে অনিদ্রা, মাদকাসক্তি, খাবারে অরুচি, বদমেজাজ ইত্যাদির প্রকোপ দেখা গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম বছর দুয়েক এসব ব্যাংকার সপ্তাহে ৮০ থেকে ১২০ ঘণ্টাও কাজ করেন। চতুর্থ বছরে গিয়ে এঁরা ভুগতে শুরু করেন নিদ্রাহীনতায়। কারও মধ্যে দেখা গেছে নানান রকম অ্যালার্জি, মাদকাসক্তি, চর্মরোগ, (সোরিয়াসিস) আর্থ্রাইটিস এবং থাইরয়েডের সমস্যা। আমাদের দেশে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের তেমন বড় কোনো প্রভাব না থাকলেও এই উপসর্গের কিছুটা বাণিজ্যিক ব্যাংকারদের মধ্যেও মিলতে পারে, যদি তেমন কোনো গবেষণা চালানো যায়। জেপি মর্গান চেজ অ্যান্ড কোম্পানির এক সাবেক প্রধান নির্বাহীর বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেরই চাকরির কয়েক বছরের মাথায় ৩০ থেকে ৪০ পাউন্ড ওজন বেড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এই সমস্ত তথ্য এবং গবেষণালব্ধ আবিষ্কার থেকে পাশ্চাত্য বিশ্বের নানান পেশা, বিশেষত ব্যাংকিংয়ে নিয়োজিত মানুষের সমস্যার কথা উঠে এসেছে।
এ রকম উপলব্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক নির্দেশনায় কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ করে মহিলাদের নির্ধারিত ব্যাংকিং সময়সূচির পর কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে আদেশ জারি করেছে। এই নির্দেশনা যে কেবল অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে উপস্থিতিকে নিরুৎসাহিত করছে তা নয়, বরং এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের ফলে নিশ্চিত হতে পারে দেশের ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত মানবসম্পদের পরিচর্যা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের যথাযথ নিরাপত্তা। অদূরদর্শিতার কারণে আমরা খুব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারি না, তাই উপলব্ধি করতে পারি না কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানবসম্পদ উন্নয়নে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মসময়ের বাইরের এই সময়টুকু কেবল চাকরিজীবীদের সন্তানদের দেখাশোনা করা, কিংবা পরিবারের সদস্যদের আরও বেশি সময় দেওয়ার প্রয়োজনেই নয়, তাঁরা নিজেরাও যাতে বাড়তি জ্ঞানার্জনের কিছুটা সময় দিতে পারেন, কিংবা যুক্ত হতে পারেন সামাজিক বা বিনোদনমূলক কাজে। ব্যাংকারদের বছরে একবার বাধ্যতামূলক দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার বিধানটাও এ জন্যই জারি করা হয়েছে, যাতে তাঁরা কিছুদিন সব মানসিক চাপমুক্ত থেকে অবসর যাপন করতে পারেন।
বর্তমান সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সুযোগ কম বলে কর্মসময়ের বাইরের সময়টুকু পড়াশোনায় ব্যয় করা জরুরি এবং আগ্রহীরা সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে চান। বিশ্বব্যাংকের ২০১২ সালের জ্ঞান অর্থনীতি সূচকে (নলেজ ইকোনমি ইনডেক্স) ১৪৬টা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭তম, অর্থাৎ তালিকার সর্বশেষ দশটি দেশের একটি। অন্য নয়টি দেশ হচ্ছে সুদান, জিবুতি, ইথিওপিয়া, গিনি, ইরিত্রিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, মিয়ানমার ও হাইতি। এই সূচক থেকে আমাদের মানবসম্পদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের দৈন্যদশার পরিমাপ করা যায়।
এ ছাড়া দেশের গণপরিবহনের অব্যবস্থার কারণে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ব্যাংকে কাটিয়ে নিত্য ঘরে ফেরার কঠোর সংগ্রামের পর সাধারণ কর্মজীবী কিংবা ব্যাংকারদের পক্ষে পরিবারের অন্য সদস্যদের সময় দেওয়া কিংবা জ্ঞানচর্চা কোনোটাই সম্ভব হয় না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
No comments