ভর্তি পরীক্ষার তোতাকাহিনি by শিশির ভট্টাচার্য্য
বিশ্ববিদ্যালয়
কেন ভর্তি পরীক্ষা নেয়? ঠোঁট দিয়ে সৌভাগ্য-নির্দেশক খাম খুঁজে বের করতে
পারে বা শেখানো বুলি গড়গড় করে বলতে পারে, এমন এক ঝাঁক তোতাপাখি খুঁজে বের
করতে, নাকি নিজের বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে পেশাগত ও ব্যক্তিগত সমস্যা
সমাধান করতে পারে, এমন আশরাফুল মাখলুকাতদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিতে?
ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য কি ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের যেনতেন প্রকারে
ছাঁটাই করা, নাকি স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করার উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান এবং
সাধারণ জ্ঞান আছে এমন শিক্ষার্থী নির্বাচন করা?
‘ভাষাজ্ঞান’ বলতে আমরা নিশ্চয়ই বুঝব এমন জ্ঞান, যা দিয়ে শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বাংলা এবং ইংরেজি শব্দ গঠন করতে পারবে, শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে তার ধারণা থাকবে এবং সে গ্রহণযোগ্য বাক্য রচনা করতে পারবে। বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার বাংলা অংশে যে ২৫টি প্রশ্ন আছে, তার অধিকাংশই পরীক্ষার্থীর ভাষাজ্ঞান বিচার করার জন্য উপযুক্ত নয়। সন্ধি ও সমাসের নাম জানা বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনে অপরিহার্য নয়। ‘গবাদি’ শব্দের সঠিক সন্ধি বিচ্ছেদ কোনটি, সংস্কৃত শব্দ ‘কাদম্বিনী’ বা আঞ্চলিক শব্দ (চৌচালা টিনের ঘরের) ‘টুয়া’-র অর্থ কী, বা ‘প্রতিকৃতি’ শব্দে উপসর্গ কোন অর্থে ব্যবহৃত ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানলেই যে পরীক্ষার্থী বাংলা ভাষা ‘শুদ্ধ করিয়া লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারিবে’ সেই নিশ্চয়তা দেওয়া মুশকিল।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণে সক্ষম শ্রেষ্ঠ চৌকস শিক্ষার্থীটিকে খুঁজে বের করা বাংলা অংশে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আছে, যেগুলোর সঠিক উত্তর শতভাগ স্মৃতিনির্ভর। Reflections on the Revolution in France গ্রন্থটি কে লিখেছিলেন তা জানার সঙ্গে বাংলা ভাষাজ্ঞানের কী সম্পর্ক? ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ কার রচনা তা জানাটা কি বাংলা লিখতে জানার জন্য অপরিহার্য? কোনো একটি বিশেষ গল্পে কোনো একটি বিশেষ উক্তি কোন বিশেষ চরিত্র করেছিল, কোনো একটি গল্পে কোনো একটি বাক্যের শূন্যস্থানে কী আছে, কোনো একটি গল্পে বিশেষ একটি মন্তব্য কার সম্পর্কে করা হয়েছে—এসব জানা বা না-জানার ওপর শুদ্ধ বাংলা বাক্য লেখার ÿক্ষমতা আদৌ কি নির্ভর করে?
সাধারণ জ্ঞান অংশের প্রশ্নগুলো কী কারণে ‘সাধারণ’ হবে তা বোঝা মুশকিল। আমরা বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই যেখানে এই প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগের উত্তর জানি না, সেখানে পরীক্ষকেরা কীভাবে ধরে নেন যে বাংলাদেশে বসবাসরত অষ্টাদশবর্ষীয় শিক্ষার্থীরা তাদের ‘সাধারণ জ্ঞানের’ ওপর ভিত্তি করে বলতে পারবে: মান্ধাতা কোন যুগের শাসক, ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি কেন বিখ্যাত, কোন অর্থনীতিবিদ ‘অদৃশ্য হাত’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় বা ব্যাডমিন্টন কোন দেশের জাতীয় খেলা। প্রশ্নকর্তা কি ধরেই নিচ্ছেন যে পরীক্ষার্থীরা এক বা একাধিক গাইড বই পড়ে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর মুখস্থ করবে? নাকি বাজারে চালু আছে এমন কোনো গাইড বই থেকেই প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়? অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এই যে গাইড বই পড়ে যারা শত শত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ রাখতে পারে, শুধু তারাই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় (এবং অনতিবিলম্বে সেই তথ্যগুলো ভুলে যায়!)। সুতরাং এ ধরনের ভর্তি পরীক্ষায় মানবসন্তানের বিশ্লেষণী শক্তি নয়, মুখস্থ করতে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি যাচাই করা হচ্ছে।
প্রশ্ন কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কার্যকর এমসিকিউ প্রশ্ন করার জন্য প্রশিক্ষণ ও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ সময় বরাদ্দ হয়েছে, সেই পরিমাণ সময় যথেষ্ট কি না, তাও যাচাই করে দেখতে হবে। এমসিকিউ (MCQ) প্রশ্ন করার কিছু অপরিহার্য নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রশ্ন হতে হবে প্রধানত বিশ্লেষণমূলক, একান্তভাবে স্মৃতিনির্ভর নয়। জ্ঞানের যদি দুটি অংশ থাকে: স্মৃতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তবে তার মধ্যে স্মৃতিশক্তির অনেকটাই সম্ভবত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। বিশ্লেষণের ক্ষমতাটা মানুষ শিক্ষা ও অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। শিক্ষার্থী সেটা আদৌ অর্জন করতে পেরেছে কি না বা কতটুকু পেরেছে, সেটাই বিচার করতে হবে যেকোনো পরীক্ষায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের খ ইউনিটের General English এবং Elective English প্রশ্নের ধরন লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হওয়া উচিত। প্রশ্নপত্রের এই দুই অংশে স্মৃতিনির্ভর প্রশ্ন নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ প্রশ্ন ইংরেজি ভাষাজ্ঞান যাচাই করার লক্ষ্যে রচিত হয়েছে। টোয়েফল, আইএলটিএস ইত্যাদি পরীক্ষার আলোকে বাংলা ভাষাজ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান যাচাইয়ের প্রশ্নের ধরনে কার্যকর পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।
সর্বোত্তম তোতাপাখিটি বাছাই করা নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণে সক্ষম শ্রেষ্ঠ চৌকস শিক্ষার্থীটিকে খুঁজে বের করা। ভাবতে শেখেনি, শুধু মুখস্থ করে উগরে দিতে শিখেছে—চোখকান বন্ধ করে এমন প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হলে শিক্ষা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও দেশরক্ষা—রাষ্ট্রের এই চতুরঙ্গের কোথাও গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না আরও বহু প্রজন্মে। হয়তো এই ভুলটাই আমরা করে আসছি। সুদক্ষ ও মননশীল আশরাফুল মাখলুকাতের বদলে অকার্যকর পরীক্ষার জাল পেতে ধরে আনছি ঝাঁকে ঝাঁকে ময়না-তোতা। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের যাবতীয় দুরারোগ্য ব্যাধির মূলেও হয়তো আছে এই করুণ তোতাকাহিনি।
শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
‘ভাষাজ্ঞান’ বলতে আমরা নিশ্চয়ই বুঝব এমন জ্ঞান, যা দিয়ে শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বাংলা এবং ইংরেজি শব্দ গঠন করতে পারবে, শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে তার ধারণা থাকবে এবং সে গ্রহণযোগ্য বাক্য রচনা করতে পারবে। বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার বাংলা অংশে যে ২৫টি প্রশ্ন আছে, তার অধিকাংশই পরীক্ষার্থীর ভাষাজ্ঞান বিচার করার জন্য উপযুক্ত নয়। সন্ধি ও সমাসের নাম জানা বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনে অপরিহার্য নয়। ‘গবাদি’ শব্দের সঠিক সন্ধি বিচ্ছেদ কোনটি, সংস্কৃত শব্দ ‘কাদম্বিনী’ বা আঞ্চলিক শব্দ (চৌচালা টিনের ঘরের) ‘টুয়া’-র অর্থ কী, বা ‘প্রতিকৃতি’ শব্দে উপসর্গ কোন অর্থে ব্যবহৃত ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানলেই যে পরীক্ষার্থী বাংলা ভাষা ‘শুদ্ধ করিয়া লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারিবে’ সেই নিশ্চয়তা দেওয়া মুশকিল।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণে সক্ষম শ্রেষ্ঠ চৌকস শিক্ষার্থীটিকে খুঁজে বের করা বাংলা অংশে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আছে, যেগুলোর সঠিক উত্তর শতভাগ স্মৃতিনির্ভর। Reflections on the Revolution in France গ্রন্থটি কে লিখেছিলেন তা জানার সঙ্গে বাংলা ভাষাজ্ঞানের কী সম্পর্ক? ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ কার রচনা তা জানাটা কি বাংলা লিখতে জানার জন্য অপরিহার্য? কোনো একটি বিশেষ গল্পে কোনো একটি বিশেষ উক্তি কোন বিশেষ চরিত্র করেছিল, কোনো একটি গল্পে কোনো একটি বাক্যের শূন্যস্থানে কী আছে, কোনো একটি গল্পে বিশেষ একটি মন্তব্য কার সম্পর্কে করা হয়েছে—এসব জানা বা না-জানার ওপর শুদ্ধ বাংলা বাক্য লেখার ÿক্ষমতা আদৌ কি নির্ভর করে?
সাধারণ জ্ঞান অংশের প্রশ্নগুলো কী কারণে ‘সাধারণ’ হবে তা বোঝা মুশকিল। আমরা বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই যেখানে এই প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগের উত্তর জানি না, সেখানে পরীক্ষকেরা কীভাবে ধরে নেন যে বাংলাদেশে বসবাসরত অষ্টাদশবর্ষীয় শিক্ষার্থীরা তাদের ‘সাধারণ জ্ঞানের’ ওপর ভিত্তি করে বলতে পারবে: মান্ধাতা কোন যুগের শাসক, ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি কেন বিখ্যাত, কোন অর্থনীতিবিদ ‘অদৃশ্য হাত’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় বা ব্যাডমিন্টন কোন দেশের জাতীয় খেলা। প্রশ্নকর্তা কি ধরেই নিচ্ছেন যে পরীক্ষার্থীরা এক বা একাধিক গাইড বই পড়ে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর মুখস্থ করবে? নাকি বাজারে চালু আছে এমন কোনো গাইড বই থেকেই প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়? অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এই যে গাইড বই পড়ে যারা শত শত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ রাখতে পারে, শুধু তারাই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় (এবং অনতিবিলম্বে সেই তথ্যগুলো ভুলে যায়!)। সুতরাং এ ধরনের ভর্তি পরীক্ষায় মানবসন্তানের বিশ্লেষণী শক্তি নয়, মুখস্থ করতে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি যাচাই করা হচ্ছে।
প্রশ্ন কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কার্যকর এমসিকিউ প্রশ্ন করার জন্য প্রশিক্ষণ ও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ সময় বরাদ্দ হয়েছে, সেই পরিমাণ সময় যথেষ্ট কি না, তাও যাচাই করে দেখতে হবে। এমসিকিউ (MCQ) প্রশ্ন করার কিছু অপরিহার্য নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রশ্ন হতে হবে প্রধানত বিশ্লেষণমূলক, একান্তভাবে স্মৃতিনির্ভর নয়। জ্ঞানের যদি দুটি অংশ থাকে: স্মৃতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তবে তার মধ্যে স্মৃতিশক্তির অনেকটাই সম্ভবত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। বিশ্লেষণের ক্ষমতাটা মানুষ শিক্ষা ও অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। শিক্ষার্থী সেটা আদৌ অর্জন করতে পেরেছে কি না বা কতটুকু পেরেছে, সেটাই বিচার করতে হবে যেকোনো পরীক্ষায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের খ ইউনিটের General English এবং Elective English প্রশ্নের ধরন লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হওয়া উচিত। প্রশ্নপত্রের এই দুই অংশে স্মৃতিনির্ভর প্রশ্ন নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ প্রশ্ন ইংরেজি ভাষাজ্ঞান যাচাই করার লক্ষ্যে রচিত হয়েছে। টোয়েফল, আইএলটিএস ইত্যাদি পরীক্ষার আলোকে বাংলা ভাষাজ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান যাচাইয়ের প্রশ্নের ধরনে কার্যকর পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।
সর্বোত্তম তোতাপাখিটি বাছাই করা নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণে সক্ষম শ্রেষ্ঠ চৌকস শিক্ষার্থীটিকে খুঁজে বের করা। ভাবতে শেখেনি, শুধু মুখস্থ করে উগরে দিতে শিখেছে—চোখকান বন্ধ করে এমন প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হলে শিক্ষা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও দেশরক্ষা—রাষ্ট্রের এই চতুরঙ্গের কোথাও গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না আরও বহু প্রজন্মে। হয়তো এই ভুলটাই আমরা করে আসছি। সুদক্ষ ও মননশীল আশরাফুল মাখলুকাতের বদলে অকার্যকর পরীক্ষার জাল পেতে ধরে আনছি ঝাঁকে ঝাঁকে ময়না-তোতা। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের যাবতীয় দুরারোগ্য ব্যাধির মূলেও হয়তো আছে এই করুণ তোতাকাহিনি।
শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments