ঢাকায় ভিনদেশীদের অপরাধ জাল by নুরুজ্জামান লাবু
তারা ভিনদেশী নাগরিক। ঢাকায় অস্থায়ী আবাস। ব্যবসা বা ভ্রমণের কথা বলে
আসা অনেক বিদেশী নাগরিক রাজধানী জুড়ে গড়ে তুলেছে অপরাধের জাল। প্রতারণা আর
আইন ভঙ্গ করে অর্থ উপার্জনই তাদের টার্গেট।
কেউ তৈরি করছেন
জাল মুদ্রা। স্বর্ণ চোরাচালান, আদম পাচার, মাদক ব্যবসা, অবৈধ ভিওআইপি
ব্যবসা, জঙ্গি কার্যক্রমসহ নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
দেশের অভ্যন্তরে ভিনদেশীরা কি করছে এসব বিষয়ে কার্যকর কোন নজরদারি না থাকায়
সহজেই অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে তারা। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতায় এই
অপরাধী চক্রের কেউ কেউ ধরা পড়লেও চক্রের বড় অংশটিই থেকে যাচ্ছে অধরা।
গ্রেপ্তার হলেও মামলার দুর্বলতার কারণে ও আইনি ফাঁকফোকর গলে জেল থেকে সহজেই
জামিনে বেরিয়ে আসে কেউ কেউ। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও
ডিবি’র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মাঝে মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা
থেকে ভিনদেশী অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের পরপরই
তারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ভাষাগত সমস্যার কারণে অপরাধ
সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ধার করা যায় না। তিনি বলেন, ভিনদেশী নাগরিকদের
গ্রেপ্তারের পর তাদের নিজ নিজ দেশের দূতাবাসকে জানাতে হয়। এছাড়া, বিষয়টি
স্পর্শকাতর হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তবে
ঢাকায় ভিনদেশী অপরাধীদের ওপর নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি চলে। গত কয়েক বছরে
শতাধিক ভিনদেশী অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,
রাজধানীর উত্তরা ও কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী ও বারিধারা
এলাকায় ভিনদেশী অপরাধীরা আস্তানা গেড়ে থাকে। বেশির ভাগই ঢাকায় প্রবেশ করে
পর্যটক ভিসায়। কোন দেশ থেকে সরাসরি ভিসা সংগ্রহ করে আবার কোন কোন দেশের
নাগরিকরা অন অ্যারাইভাল ভিসায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিদেশী ট্যুরিস্টদের
সবসময় স্বাগত জানাতে বিদেশী নাগরিকদের সহজেই ভিসা দিয়ে দেয়া হয়। এই সুযোগে
অপরাধী চক্র দেশে ঢুকে আস্তানা গেড়ে বসে। সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা
এমনিতেই অপরাধপ্রবণ ও ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় ভিনদেশী অপরাধীরা সহজেই অপরাধ
কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ অপরাধীরই এ দেশীয় এজেন্ট রয়েছে।
দেশীয় এজেন্টরাই তাদের মূলত অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করে থাকে।
ভিনদেশীদের অপরাধ কার্যক্রম নিয়ে অনুসন্ধান করা ডিবি’র একজন কর্মকর্তা
জানান, নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে ভিনদেশী
অপরাধীরা। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রাপাচার ও জাল মুদ্রা তৈরি, আদম পাচার, জঙ্গি
কার্যক্রম ও মাদক ব্যবসা। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এসব
কাজের সঙ্গে বেশি জড়িত। এসব দেশের মধ্যে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, ঘানা,
কঙ্গো, লিবিয়া, উগান্ডা, সুদান, আলজিরিয়া, তাঞ্জানিয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া,
প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার ছাড়াও আফগানিস্তান, ইরাক, শ্রীলঙ্কার
নাগরিকরাও এ দেশে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ডিবি’র ওই কর্মকর্তা বলেন,
পাকিস্তানের নাগরিকরা সাধারণত জঙ্গি ও মুদ্রা পাচার এবং জাল মুদ্রা তৈরির
সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে যোগাযোগ থাকায় ব্যবসার
আড়ালে তারা ঢাকায় আসে। পরে দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ডে
জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া, ভারতের নাগরিকরা বেশির ভাগই স্বর্ণ চোরাচালানসহ বিভিন্ন
চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আন্তর্জাতিক জাল
ডলার তৈরি চক্র ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া, অন্যান্য দেশের নাগরিকরা
আদম পাচার করে বলে তিনি জানান। ওই কর্মকর্তা বলেন, কোন ভিনদেশী অপরাধীকে
সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এছাড়া, অনেকেই দেশে
ঢুকেই তাদের পাসপোর্ট ফেলে দেয়। ফলে তাদের নিজ নিজ দেশে পুশব্যাকও করা যায়
না। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পোশাক শিল্প, বায়িং হাউস, আইটি ও টেলিকম
সেক্টর, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, রেস্টুরেন্ট এবং এনজিওসহ নানা ধরনের
প্রতিষ্ঠানের ঢাল ব্যবহার করে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে থাকে। অনেকেই
গার্মেন্ট শিল্পের ক্রেতা সেজেও বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা
করেছে।
সূত্র জানায়, ভিনদেশী অপরাধীরা এদেশে প্রবেশের আগেই প্রথমে তারা
দেশীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। দেশে প্রবেশ করে প্রথমে তারা
নামীদামি আবাসিক হোটেলগুলোতে অবস্থান নেয়। পরে দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে
গুলশান, বনানী, বারিধারা কিংবা উত্তরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু
করে। এসব এলাকায় এমনিতেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশী
নাগরিকরা থাকেন বলে কেউ তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে না। এছাড়া,
ভিনদেশীদের সবাই সমীহ করে চলে বলে এই সুযোগ কাজে লাগায় তারা। দেশীয়
এজেন্টদের মাধ্যমে তারা প্রতারণা ও আদম পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া,
দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তাদের হাত করে মুদ্রা ও মাদক পাচার করে থাকে। শাহজালাল বিমানবন্দরকে
তারা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে।
র্যাবের গোয়েন্দা
সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন
সময়ে দেশে এসে দেশীয় জঙ্গিদের সংগঠিত করে থাকে। তবে বর্তমানে জঙ্গিদের
কার্যক্রম কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ
চক্রের সদস্যরা ঢাকাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। গত মাসে তারা
উত্তরা এলাকা থেকে এমন একটি চক্রকে শনাক্ত করেছেন যারা দীর্ঘ দেড় বছর ধরে
উত্তরায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করে আসছিল। ওই
চক্রটির ভিওআইপি ব্যবসার পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির আন্তর্জাতিক
চক্রের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার
পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান জানান, ভিনদেশীদের অপরাধ
কর্মকাণ্ড ঠেকাতে র্যাব সবসময় কড়া গোয়েন্দা নজরদারি করে থাকে। ঢাকায় বেশ
কয়েকটি আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সন্ধান পেয়েছে র্যাব। তাদের শনাক্ত করে
গ্রেপ্তারের জন্য অনুসন্ধান চলছে। তিনি জানান, গত কয়েক বছরে র্যাব বিভিন্ন
অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে ৯১ জন বিদেশী নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে।
এর মধ্যে গত বছরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৩ জনকে। গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগই
জঙ্গি, মাদক ও জাল মুদ্রা তৈরি ও পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে তিনি জানান।
বিশ্বের
বিভিন্ন দেশে ট্যুরিস্ট ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত বিদেশী নাগরিককে
সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হলেও বাংলাদেশে ভিনদেশীদের ওপর কার্যকর কোন
নজরদারি নেই। ফলে ট্যুরিস্ট ভিসায় ভিনদেশী নাগরিকরা দেশে ঢুকে সহজেই নানা
অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও মাসের পর মাস দেশেই
অবস্থান করছে। এমনকি ভিনদেশী অপরাধীরা জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আবারও
অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিদেশী পর্যটক কিংবা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দেশে
আসা নাগরিকদের নজরদারি করে থাকে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। তাদের এক
কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় বিদেশী নাগরিকদের যথাযথ নজরদারি
করা যায় না।
No comments